বইপ্রেমীর জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

পলান সরকার

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:০৪

১.
মনে রাখবার মতোন নিরব সাধকদের খোঁজ নিতে গিয়ে বিস্মিত যেমন হই, তেমনি খুশিতেও মনটা ভরে ওঠে। এই যেমন যখন জানতে পারি, জয়নুল আবেদিন রিকশা চালিয়ে ময়মনসিংহে হাসপাতাল করেছেন, কার্তিক প্রামাণিক নরসুন্দর হিসেবে পেশাগত কাজের সাথে সাথে বৃক্ষরোপন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবুজায়ন ঘটিয়েছেন, আর হাঁটতে হাঁটতে মনের আনন্দে গ্রামের মানুষকে বই পড়িয়ে ছেড়েছেন নাটোরের আলোকিত মানুষ, সাদা মনের অসাধারণ একজন মানুষ পলান সরকার। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের অশিক্ষার অন্ধকারে পলান সরকাররা হয়ে উঠেছেন উজ্জ্বল এক একটি প্রদীপের মতো। উল্লেখ্য, রাজশাহীতে বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সকলের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য তাঁকে ইউনিলিভার বাংলাদেশ 'সাদা মনের মানুষ' খেতাবে ভূষিত করে। ২০১১ সালে তিনি লাভ করেন একুশে পদক। পলান সরকারকে নিয়ে আরও একটি আনন্দের সংবাদ হচ্ছে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর 'ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে' উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ। বলা যায় টিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র প্রচারণার ফলে পলান সরকার পেলেন বিশ্ব স্বীকৃতি। একজন আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৫ ভাদ্র মোতাবেক ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে মহান এই আলোকিত মানুষটিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা, ফুলেল শুভেচ্ছা।

২.
গ্রামের লোকেরা সকালে ঘুম ভেঙে দেখতে পায়, তাদের আঙিনায় হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছেন পলান সরকার। তাঁর কাঁধে ঝোলা, ঝোলার ভেতরে বই। বয়সে প্রায় শতবর্ষী, কিন্তু ত্রিশ বছরের যুবকের মতো আজো যেন সমান সচল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে গ্রাম-গ্রামান্তরে যান। নিজের টাকায় কেনা বই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে পড়তে দেন। পড়া শেষ হলে দিয়ে আসেন নতুন কোনো বই। এভাবে একটানা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে করছেন এই কাজ। রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় ২০টি গ্রামজুড়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বই পড়ার এক অভিনব আন্দোলন। পলান সরকার, মানসিকতায় বৃদ্ধ নন মোটেই; শরীরও মনের কথা মেনে চলে, তবে সব সময় নয় হয়তবা, তবুও কাঁধে একটি ঝোলা আর ঝোলাভর্তি বই, চোখে মোটা কাঁচের ঘোলাটে চশমা, গায়ে সাদামাটা পাঞ্জাবী। হাঁটছেন গাঁয়ের কোনো মেঠো রাস্তা ধরে। পাশের ধানক্ষেত থেকে কেউ বলে উঠলো “বইওয়ালা দুলাভাই, কই যান?”। মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন দুলাভাই। গ্রামের সকলের কাছে তিনি বইওয়ালা দুলাভাই নামে পরিচিত।

৩.
২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রচারিত ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয় বইপ্রেমী পলান সরকারকে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামের পলান সরকার তার গ্রামে শুরু করেন এই বই পড়ার আন্দোলন। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য তিনি নিজের টাকায় কেনা বই বিলি করেন সবাইকে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে নতুন পাঠকের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন তিনি। এই বৃদ্ধ বয়সেও মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে বাড়িতে বাড়িতে তার পাঠকদের কাছে গিয়ে পুরনো বই ফেরত নিয়ে নতুন বই দিয়ে আসেন। নিজের ডায়াবেটিস রোগের কারণে প্রতিদিন রুটিন করে হাঁটা তার অভ্যাস। তাই এক কাজে দুই কাজ করেন তিনি। অনেকেই হাটের দিন তাদের পড়া পুরনো বই নিয়ে আসেন এবং সেই বই ফেরত দিয়ে পলান সরকারের কাছ থেকে নতুন বই নিয়ে যান। গ্রামের সব বয়সী মানুষই রয়েছে তার পাঠক তালিকায়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের বই তিনি বিভিন্ন শ্রেণি ও বয়সের মানুষকে বিলিয়ে বেড়ান।
 
৪.
জন্মের মাত্র কয়েক মাস পরই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। অর্থনৈতিক কারণে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। নিজে লেখাপড়া বেশিদূর করতে না পারলেও পরিবারের সবাইকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন, কারণ জ্ঞানদান করাটাকে তিনি মহৎ কাজ বলে মনে করেন। তার এই বইপড়া আন্দোলনে সহযোগিতা করার জন্য ইত্যাদির মাধ্যমে তাকে দুই সেলফ ভর্তি বই দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে তার পাঠক সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি তার বই পড়ার আন্দোলন আরও বিস্তৃত হয়। ইত্যাদিতে প্রচারের পর তাকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, নির্মিত হয়েছে বিজ্ঞাপন। পলান সরকার ইত্যাদির পরবর্তী অনুষ্ঠানে বলেন, 'ইত্যাদি'র অনুষ্ঠান হওয়ার পরে এবং 'ইত্যাদি' থেকে বই দেওয়ার পরে পাঠক সংখ্যা অনেক বাইরা গেছে'। শুধু তাই নয় এরপর তাকে নিয়ে নির্মিত হয় বিজ্ঞাপন, রচিত হয় নাটক, অনুষ্ঠিত হয় পলান মেলা।
 
৫.
একটি চলমান শ্রদ্ধার অপর নাম পলান সরকার। তিনি নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হায়াত উল্লাহ সরকার এবং মইফুন্নেসার ৩ পুত্র এবং ২ কন্যার মৃত্যুর পর তার জন্ম হয় বলে মা তাকে পলান বলে ডাকতেন। প্রকৃত নাম হারেজ উদ্দিন সরকার। মাত্র ৫ মাস বয়সে পিতার মৃত্যু হলে নানা ময়েন উদ্দিন নিজ কন্যা ও নাতিকে নিজ গ্রাম বাউসাতে নিয়ে আসেন। নানা ময়েন উদ্দিনের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় পলান বেশ আদরেই বেড়ে উঠছিলেন নানার সংসারে। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। এইটুকু বয়সেই তার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। সেই অভ্যাসের বশেই তিনি যেখানে যে বই পেতেন, সংগ্রহ করতেন, নিজে পড়তেন এবং অন্যকেও বই পড়তে উৎসাহিত করেন।

৬.
নানা ময়েন উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। যৌবনে পলান সরকার নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন এবং দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে ১৯৬২ সালে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান। বেতনের টাকা দিয়ে নিজে বই কিনতেন এবং মানুষকেও ধার দিতেন। নানার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন। সে সম্পত্তিও তিনি মানবকল্যাণে উৎসর্গ করেন। ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন। তিনিই আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। অন্যদিকে মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা- অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জাগ্রত হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর প্রচারবিমুখ পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। বাউসা বাজারে তাঁর একটি চালকল ও রয়েছে। 

৭.
১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জন করত তাদের বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তাঁর কাছে বইয়ের আবদার করলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাদেরও বই দিবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষ ও তাঁর কাছে বই চাইতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় বই পড়া আন্দোলনের ভিত। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখনই তাঁর মাথায় এক অভিনব চিন্তা আসে। তিনি স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন। এছাড়া যারা তাঁর চালকলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও তিনি বই উপহার দেন। তাঁর কর্মকাণ্ড সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এলাকার চায়ের দোকানী পর্যন্ত হয়ে ওঠে বই পাগল, প্রতি বিকালে তার দোকানে বসে বই পড়ার আসর। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। ২০১১ সালে তিনি একুশে পদকে ভুষিত হন।বাংলা একাডেমী একুশে বইমেলায় সবচেয়ে বেশি বই ক্রয়কারীকে তার সম্মানে প্রদান করেন পলান সরকার স্মৃতি পুরষ্কার।

৮.
যৌবনে তিনি যাত্রাদলে ভাঁড়ের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। মানুষকে হাসি আনন্দ আর বিনোদন দিতে পছন্দ করতেন বলেই ভাঁড়ের ভুমিকায় অভিনয় করতেন। সেকালে যাত্রাপালার দলে লেখাপড়া জানা মানুষের বেশ অভাব ছিল। যাত্রাদলে একমাত্র লেখাপড়া জানা মানুষ ছিলেন পলান সরকার। সেই সময় যাত্রার স্ক্রিপ্ট কপি করার মতো ফটোকপি মেশিন ছিল না। ফলে পলানকেই যাত্রার স্ক্রিপ্ট লিখে লিখে কপি করতে হত। মাঝে মাঝে তিনি প্রম্পটের কাজও করতেন। প্রম্পট হলো যিনি মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দেন। এভাবে লেখাপড়ার সাথে তার সম্পৃক্ততা থেকেই যায়, যা পলানকে বই পাঠের অভ্যাস বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৯.
‘আমার বাবা পলান সরকার’ স্মৃতিচারণায় তাঁর কন্যা রোকেয়া খাতুন অকপটে বলছেন পিতাকে নিয়ে এভাবে, ‘আমার বাবা খুব সাধারণ মানুষ। তাঁর নামের আগে কোনো ডিগ্রি নেই। পদবি নেই। এই বাবাকে নিয়েই আমি গর্বিত। আমি মনে করি, আমার বাবার নামটাই একটা বিশেষণ হয়ে গেছে। রাজশাহীতে এক যুবক তাঁর একটি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের নাম রেখেছে ‘পলান সরকার পাঠাগার’। পাঠাগারের নামকরণই হয়েছে আমার বাবার নামে। ভাবলেই ভালো লাগে। বাবা কেমন মানুষ বোঝার জন্য বাবাকে নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।
 
খুব ছোটবেলায় নিজের বাবাকে হারিয়েছেন আমার বাবা পলান সরকার। তাই পঞ্চম শ্রেণির পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি পড়াশোনা বন্ধ করেননি। শুধু নিজে পড়াশোনা করেছেন এমন নয়, এলাকার মানুষকে বইপ্রেমী করে তোলার জন্য নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসেন। শুরুতে দেখা গেছে, দশটা বই দিলে আটটাই ফেরত পাওয়া যায় না। গ্রামের অন্য মানুষের বাড়িতে গিয়ে দেখতাম বাবার আলমারির বই। বাবাকে বলতাম। শুনে বাবা বলতেন, যার বাড়িতেই থাকুক, সে তো পড়ার জন্যই রেখেছে। পড়লেই হলো।

বইয়ের ব্যাপারে বাবার দুর্বলতা এতই বেশি যে বই কেনার টাকা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, কত লাগবে। কোনো দিন হিসাব চাননি। বিয়ের দাওয়াত খেতে উপহার হিসেবে বই নিয়ে যান। আমাদের চালকলে যাঁরা হালখাতার সময় সব টাকা পরিশোধ করতেন, বাবা তাঁদের বই উপহার দিতেন। গ্রামের স্কুলে যাদের রোল নম্বর এক থেকে দশের মধ্যে থাকত, তাদের বই উপহার দিতেন। আমাদের ভাইবোনদের লেখার জন্য রিম ধরে কাগজ কিনে দিতেন। কয়েক দিন পর পর খোঁজ নিতেন, লেখার কাগজ শেষ হয়েছে কি না। শেষ না হলে রাগ করে বলতেন, কী লেখাপড়া করো! এক রিম কাগজ শেষ হতে কয় দিন লাগে?

আমাদের পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে বাবার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। এসএসসি পাস করার পর আমি চাইলাম শহরের কলেজে পড়ব। তখন আমার বড় ভাই অভিভাবক। তিনি চাইলেন, আমি গ্রামেই এইচএসসি পড়ি। আমার ইচ্ছে বুঝতে পেরে বাবা আমার পক্ষ নিলেন। ভাইয়াকে বললেন, ‘বোনকে শহরের কলেজে পড়ানোর খরচ যদি তুমি না দাও, তাহলে আমার জমি আছে, জমি বিক্রি করেই পড়াব।’

কলেজে পড়ার সময় বাইরে থাকতাম। এ সময় মেয়েদের একটা বাড়তি হাতখরচ লাগে। বাবা সেটা দিয়ে দিতেন। একসময় বড় ভাই জেনে যান, বাবা আমাকে আলাদা করে টাকা দেন। তারপর থেকে বড় ভাই ওই পরিমাণ টাকা কম দিতেন। এতে আমার অসুবিধা হয়। কিন্তু বাবা তা হতে দেননি। আমি যেদিন বাড়ি থেকে শহরে কলেজের উদ্দেশে বের হতাম, বাবা আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। যে পথে আমি স্টেশনে যাই, সেই রাস্তায় গিয়ে টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেখানেই টাকা দিতেন যাতে বড় ভাই বুঝতে না পারেন, আবার কষ্টও না পান।
বইয়ের দোকান ছাড়া বাবা কারও কাছে বাকিতে কোনো জিনিস কেনেন না। একবার অতিবর্ষণে জমিতে ধান হলো না। চাল কিনে খেতে হবে। একদিন বাবা বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভরে চাল নিয়েছেন। তারপর পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, টাকা নেই। চুরি হয়ে গেছে। বাবা ব্যাগ উপুড় করে চাল ঢেলে দিয়ে ফিরে আসছিলেন। দোকানি ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সরকার সাহেব, আপনি চাল ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন কেন?’ বাবা বললেন, পকেটমার টাকা নিয়ে নিয়েছে। দোকানি বললেন, ‘আপনি পরের হাটে এসে টাকা দিয়েন।’ বাবা বললেন, পরের হাটে যদি আর আসতে না পারি? বাবা চাল না নিয়েই ফিরে আসেন।

বাবার বয়স প্রায় ১০০ বছর হতে যাচ্ছে। তাই বলে বাবাকে আমার কখনোই সেকেলে বলে মনে হয় না। আমি বাংলায় এমএ করেছি। মাস্টার্স শেষ করার আগেই মা আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু বাবা তাতে রাজি হননি। বাবা বলেছেন, ‘আমার মেয়ে এমএ পাস করবে। তারপর মেয়েকে জিজ্ঞেস করব, তার পছন্দের কোনো ছেলে আছে কি না। মেয়ের পছন্দের ছেলে থাকলে তার সঙ্গেই আমি তাকে বিয়ে দেব। না থাকলে আমার পছন্দের ছেলের সঙ্গে দেব।’

সত্যিই আমার পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর বাবা আমার মতামত জানতে চাইলেন। আমি জানিয়ে দিলাম, আমার পছন্দের কোনো ছেলে নেই। বাবা শুনে বললেন, ‘তাহলে আমার পছন্দের একটি ছেলে আছে।’ তার সঙ্গেই আমাকে বিয়ে দিলেন। বিয়ে হলো, কিন্তু আমার চাকরি হলো না। বাবা বললেন, ‘সবাইকে চাকরি করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুখী হতে বেশি কিছু লাগে না।’

বাবা খুবই উদার মানসিকতার একজন মানুষ। আমাদের একজন আত্মীয় দূর থেকে আমাদের পুকুরে গোসল করতে আসতেন। বাবা বলতেন, বাড়ির পাশে পুকুর কাটলেই হয়, এত দূরে আসার কী দরকার? আমাদের সেই আত্মীয় বাবাকে বললেন, ‘আমার বাড়ির কাছে আপনার দুই বিঘা জমি আছে, রেজিস্ট্রি করে দিলেই পুকুর কাটতে পারি।’ এ কথা শুনে সত্যি সত্যিই বাবা তাঁকে দুই বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। যদিও জমির বিনিময়ে কিছু টাকা তিনি দিয়েছেন, কিন্তু জমিটা তো আমাদের বিক্রি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাবা হাসতে হাসতে এ রকম অনেক বড় বড় কাজ করে ফেলেন।

ছোটবেলায় দেখতাম, বাবা যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। তখন মনে হতো, বাবা যদি টেলিভিশনে অভিনয় করতেন! আমাদের এই আক্ষেপ আর নেই। বাবা টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন। প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বাবাকে নিয়ে লেখা প্রতিবেদন বিভিন্ন ভাষার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

আমার বাবার বড় কোনো ডিগ্রি না থাকলেও দেশের বইপ্রেমীরা বাবাকে অনেক সম্মানিত করেছেন। বাবা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। এই বাবাকে নিয়ে আমি গর্বিত। আমার বাবা আমার অহংকার। 
(দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ জুন ২০১৭, অনুলিখন: আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ)

১০.
আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে? আমাদের সমস্যা, সম্ভাবনা ও স্বপ্নের বিভিন্ন দিক নিয়ে বইপাঠে উদ্বুদ্ধকারী একুশে পদকপ্রাপ্ত পলান সরকার ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মুখোমুখি হয়েছিলো নতুন প্রজন্ম।২০১৪ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক প্রথম আলোর উদ্যোগে সেই আয়োজনে পলান সরকার যেসব কথা বলেছিলেন, সেগুলো শোনা যাক।
প্রশ্ন: শুরুতেই পলান সরকারের কাছে জানতে চাই, আপনি কী ভাবনা থেকে বই বিতরণ শুরু করেছিলেন?
পলান সরকার: এক কথায় কই, ‘পড়িলে বই আলোকিত হই, আর না পড়িলে বই অন্ধকারেই রই।’ বই পড়া যত বেশি হবে, সবাই তত আলোকিত হবে, আনন্দিত হবে। জীবন সুখী হবে। আমি সবাইকে বই পড়তে দিয়েছি কারণ আমার মতে, পৃথিবীতে যত কাজ আছে তার মধ্যে সব থেকে মূল্যবান কাজ হলো জ্ঞানদান। আর জ্ঞানের আধার হলো এই বই। বই যে যত বেশি পড়বে, সে তত বেশি জ্ঞানবান হবে। কিন্তু আমার টাকাপয়সা ছিল না, বিদ্যা-বুদ্ধি ছিল না। শুরুতে এক লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করে নগদে, বাকিতে বই নিতাম। রাজশাহী অঞ্চলের ২০-২২টা গ্রামে হেঁটে হেঁটে গিয়ে আমি বই পড়তে দিই। আরেক দিন ফেরত আনি। এভাবেই চলছে ৩০ বছর। হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে আমি বই পড়তে দিয়েছি। আমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত। বই পড়ার প্রতি, পড়ালেখার প্রতি কারও আগ্রহ নেই। তারপরেও কিছু লোক আসে, বইপত্র পড়ে। আর আমার আসল কাজ, পথে পথে বই বিতরণ চলছেই।
প্রশ্ন: পলান সরকার, আপনি কীভাবে লেখাপড়ায় আগ্রহী হলেন?
পলান সরকার: জন্মালেই মানুষ হয় না। শিক্ষাই মানুষকে মানুষ করে। আমি নিজে কিন্তু কিছু না। পাঁচ মাস বয়সে বাবা মারা গিয়েছেন। কলেজ-ভার্সিটি পড়তে পারিনি। নিজে নিজে লেখাপড়া করেছি। এক মাস্টার বিনা পয়সায় প্রাইমারি পড়িয়েছিলেন, তাও সেই স্কুলে ক্লাস ফাইভ ছিল না। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম। তাও ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নাটোর যাওয়ার কথা ছিল, সেই নাটোরে যাওয়ার পয়সা দেওয়ার কেউ ছিল না। তাই যাওয়া হয়নি, পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি। আমার পড়াশোনা ওইটুকুই। দুনিয়া আমার এভাবেই চলছে। আজ যতটুকু আসতে পেরেছি, নিজের চেষ্টাতেই পেরেছি।
প্রশ্ন: আপনি যেসব গ্রামে বই বিতরণ করেন, সেখানে শুধু কি ছেলেরাই পড়ে, নাকি মেয়েরাও আছে?
পলান সরকার: ছেলে ও মেয়ে সবার কাছে আমি বই দিই। শুরুর দিকে শুধু ছেলেরা ছিল, ছিল দু-একজন মেয়ে। এখন মেয়েরা অনেক পড়ছে। মেয়েদের না হলে জাতির উন্নতি হয় না। মেয়েদের কাজে লাগাতে হবে। ক্ষমতা দিতে হবে। যত রকমের ক্ষমতা আছে, সব কাজেই তাদের লাগাতে হবে।
প্রশ্ন: জীবন নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
পলান সরকার: ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন-নদে?’ এই জীবন নদীতে জোয়ার-ভাটা সবই আছে। এসব থেকে বাঁচতে হলে দরকার জ্ঞান। লেখাপড়া। অনেকেই এগুলো বিশ্বাস করে না। নিজে কীভাবে ধনী হওয়া যাবে, আরেকজনকে কীভাবে জব্দ করা যাবে, তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই দেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মারামারি কাটাকাটিতে দেশ অস্থির হয়ে গেছে। কে কার থেকে বড় হবে, ওপরে উঠবে তা নিয়েই ব্যস্ত। ঠেলাঠেলি-মারামারি করে এরা অস্থির। আমি রাজনীতি বুঝি না। কিন্তু এরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। মারামারি করে কোনো সমাধান আসবে না। মিলিতভাবে কাজ করলে, আলোচনা করলে সমাধান আসবে। সে জন্য দরকার ভালো মানুষ।
প্রশ্ন: তাহলে ভালো মানুষ তৈরিতে আপনার পরামর্শ কী?
পলান সরকার: ভালো মানুষ চিনতে হলে নিজেকেও ভালো মানুষ হতে হবে। সব দিক বিচার-বিবেচনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। নিজে ভালো মানুষ হও। আরেকজন ভালো মানুষকে চিনতে পারবে। সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। বসে থাকলে কিছু হবে না। নিজের চেষ্টার কারণেই সবকিছু হবে। যে চেষ্টা করবে, সেই বড় হতে পারবে। আর কাজ করতে হবে। ভালো ভালো কথা অনেকেই বলে কিন্তু কাজ কেউ করে না। কথায় আছে, ‘মনে বলে হেন কর্ম না করিব আর’ মনে সবাই বলে যে কেউ খারাপ কাজ করবে না। কিন্তু স্বভাবে পরিবর্তন না হলে সে কাজ সবাই করতেই থাকবে। মনে মনে বলে কিছু হবে না। স্বভাবের পরিবর্তন করতে হবে।
(দৈনিক প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০১৫)

১১.
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ও নাট্যকার অধ্যাপক মলয় ভৌমিক ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর মুখোমুখি হয়েছিলেন পলান সরকারের। ‘পলান সরকারের সঙ্গে কিছু সময়’ শিরোনামে প্রকাশিত তাঁর রচনাটিও পাঠ করা যাক। অধ্যাপক মলয় ভৌমিক লিখেছেন, ‘হেমন্তের শুরু হলেও আকাশ ছিল মেঘলা। আগের রাতে ভারী বৃষ্টিও হয়েছে। ৩০ মিনিট রাজশাহী-নাটোর সড়ক ধরে এগোতেই সকালের গুমসোভাব অনেকটা কেটে গেল। ঈদের পরদিন। রাস্তা যতটা ফাঁকা থাকবে ভেবেছিলাম ততটা নয়। মূল সড়কে এত খুদে যানবাহন অন্য সময় চোখে পড়ে না। পুঠিয়া পৌঁছে গাড়ি নেমে গেল দক্ষিণের সড়কপথে। দিনে দিনে আরও বেশি বিবর্ণ হয়েছে পুঠিয়া রাজবাড়ি। এ বাড়ির সীমানা স্পর্শ করে পিচঢালা পথ গেছে বাঘা উপজেলার আড়ানি বাজারে। সেখানে পৌঁছে আবার ডান-বাঁয়ে দুটো পথ। আমরা যেতে চাই পলান সরকারের গ্রামে—তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তিনি কেমন আছেন জানতে। কোন পথে এগোব? প্রথম আলোর আলোকচিত্র সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করেন, পলান সরকারের বাড়ি—। প্রশ্ন শেষ না হতেই পথিক ডান দিকে ইঙ্গিত করেন। পলান সরকারের গ্রাম বাউসা থেকে আমরা তখনো ১২-১৩ কিলোমিটার দূরে। বোঝা গেল, অনেক দূরের মানুষের কাছেও তিনি পরিচিত। না, তিনি একুশে পদক পেয়েছেন বা পত্রিকায় তাঁর নাম-ছবি ছাপা হয়েছে বলে সবাই তাঁকে চেনেন, তা নয়। অনেক আগে থেকে নিজের কাজের জন্যই তিনি মানুষের পরিচয়ের সীমানায় পৌঁছে গেছেন।

রাস্তার দুই ধারে মাঝেমধ্যে আমন ধানের খেত। বেশির ভাগ জমিজুড়ে আমবাগান। প্রায় প্রতিটি বাগানে আমগাছের নিচে কোথাও হলুদগাছ, কোথাও আবার মাষকলাই। এখন মাষকলাই চাষের মৌসুম বটে। তবে আমবাগানে হলুদের চাষ বাঘার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

দেখতে দেখতে ১২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গেলাম। গাড়ি গিয়ে দাঁড়ায় রাস্তার কোল ঘেঁষে নির্মিত পলান সরকার পাঠাগারের ছোট্ট উঠোনে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ। তিনি স্থানীয় মানুষ, ছাত্র-যুবকদের কাছে বেশ শ্রদ্ধেয়ও।

২০০৮ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদের উদ্যোগে পলান সরকারের নিজস্ব জমির ওপরই নির্মিত হয়েছে পলান সরকার পাঠাগার। খুব বড় নয়। গ্রন্থতালিকা এবং বিষয়বৈচিত্র্যের হিসাবে তেমন সমৃদ্ধও বলা যায় না। ১০-১২টি কাঠের শেলফে কয়েক হাজার বই বুকে করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে পাঠাগারটি। সেখানে দু-একজন পাঠক আসেন কি আসেন না ভাবতে ভাবতেই চলন্ত পাঠাগার পলান সরকার আমাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ান। পরনে লুঙ্গি-ফতুয়া। সহজ-সরল-সাবলীল। তাঁকে দেখে কে বলবে ১৯২১ সালে পৃথিবীর আলো দেখা এই মানুষটি ৯৩ পেরিয়ে ৯৪ বছরে পা রাখলেন। হাঁটাচলা, কথা বলা সবই প্রায় স্বাভাবিক। মাথায় এখনো কিছু কাঁচা চুল সাদা চুলের অন্তরালে থেকে উঁকি দিচ্ছে। হাতে হাত মেলাতে মেলাতেই তিনি জানিয়ে দেন, ঝোলায় বই নিয়ে সাইকেলে চেপে গ্রাম থেকে গ্রামে আজও তিনি ঘুরে বেড়ান—এখনো তাঁর জন্য অপেক্ষায় থাকেন পাঠকেরা। তাহলে ইট-সিমেন্টের দেয়ালঘেরা স্থির দাঁড়িয়ে থাকা এই পাঠাগার? মুখোমুখি চেয়ারে বসা পলান সরকার প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেন না। হয়তো ভাবেন, কালের দীর্ঘ পথচলায় ব্যক্তি পলান সরকারকে একসময় স্থির হতেই হবে, তখন এই পাঠাগারই তাঁর হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যাবে জ্ঞানের বার্তা।

ভাসানযাত্রা থেকে গ্রন্থযাত্রা। প্রায় ৬৫ বছর ধরে বিরতিহীন সেই যাত্রা আজও চলছে। যৌবনের শুরুতে যাত্রাদল তাঁকে টেনেছিল। আজও সেই টানে কোনো ভাটা পড়েনি। গ্রামের তফির শাহের দলের সঙ্গে ভাসানযাত্রা, ইমানযাত্রা, কেষ্টযাত্রা (কৃষ্ণযাত্রা) নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। রামকৃষ্ণ দেব বলেছেন, ‘থ্যাটার করলে লোকশিক্ষা হয়’। হারেস উদ্দিন আহম্মদ নামান্তরে পলান সরকার কথাটা বিশ্বাস করেন। যাত্রাদলে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চেহারা খারাপ ছিল বলে নায়ক-সহনায়কের পাট আমাকে দেওয়া হতো না। ফকরামো (ফক্কড়) বা লোক হাসানোর পাট করতে হতো আমাকে। কেউ অসুস্থ হলে বা অনুপস্থিত থাকলে সে পাটটা করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হতো। এভাবে করতে করতে একসময় প্রম্ট মাস্টারের দায়িত্ব পেয়ে যাই।’

পলান সরকার টানা ৩০-৩২ বছর গান-বাজনা, যাত্রা-থিয়েটারের মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত-সচেতন করে তোলার কাজ করে গেছেন। এরই ধারাবাহিকতা থেকে একসময় তাঁর মনে হয় বই পড়ে মানুষ আরও তাড়াতাড়ি শিক্ষিত হতে পারে। তাঁর কথায় ‘জ্ঞানদান সব থেকে বড় দান’। সুতরাং তিনি আর বসে থাকেননি। যাত্রা-থিয়েটার করার পাশাপাশি আড়ানির ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি থেকে বই কিনতে শুরু করেন। নিজের পড়া শেষ হলে ব্যাগ ভর্তি করে সে বই পৌঁছে দিতে থাকেন বাড়ি বাড়ি। গত শতকের আশির দশকে চলন্ত পাঠাগার পলান সরকারের গ্রন্থযাত্রা শুরু হয় এভাবেই।

পাঠাগারের সম্মুখ চত্বরে বসে শিশুসুলভ সরলতায় পলান সরকার যখন তাঁর জীবনের নানা কথা বলে যাচ্ছিলেন, তখন ধীরে ধীরে সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে। তাঁর সন্তানেরা যেমন এসে দাঁড়ান, তেমনি আসেন প্রতিবেশীরাও। আমাদের কথোপকথনের মধ্যে তাঁরাও যুক্ত হন। একটা বৈঠকি আবহ তৈরি হয়। পলান সরকারও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বই কেনার টাকা কোথায় পান? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘সংসারে সচ্ছলতা থাকলেও বই কেনার অভ্যাস বা সামর্থ্য ছিল না। একসময় রাস্তার কাগজ কুড়িয়েও পড়েছি। এ সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের কর সংগ্রহের কাজটা পেয়ে গেলাম। সেখান থেকে যা আয় হতো, তা দিয়েই বই কিনেছি।’

পলান সরকারের জন্ম পার্শ্ববর্তী নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ায়। মাত্র পাঁচ দিন বয়সে বাবার মৃত্যু হলে মায়ের সঙ্গে তিনি রাজশাহীর বাঘা থানার বাউসা গ্রামে নানাবাড়িতে চলে আসেন। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অথচ বাংলা ভাষার ওপর তাঁর চমৎকার দখল। জমির দলিল তৈরি, ব্যবসায়ের চুক্তিনামা, সভার কার্যবিবরণী—এসব কাজের জন্য এলাকার মানুষ তাঁর ওপর নির্ভরশীল। ‘গান-বাজনা করতে করতে, প্রম্ট করতে করতে আমার লেখাপড়া ঠিক হয়েছে।’ স্বশিক্ষিত হওয়ার পেছনের গল্পটা এভাবেই জানিয়ে দেন পলান সরকার। আর নিজ জীবনের এই অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে তিনি উচ্চারণ করেন আরও এক গুরুত্বপূর্ণ কথা। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, মানুষকে আলোকিত করতে হলে গ্রামে গ্রামে পাঠাগার গড়ে তোলার পাশাপাশি যাত্রা-থিয়েটারও গড়ে তুলতে হবে।

আরজ আলী মাতুব্বরের মতোই পলান সরকারের নিজস্ব উপলব্ধিতে যুক্ত হয়েছে কাণ্ডজ্ঞানের দর্শন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, তথ্যের ওপর সবল শক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং বর্তমান সময়ে তথ্যবিভ্রান্তির গোলকধাঁধা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন। যেকোনো বই পড়লেই মানুষ আলোকিত হয় কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তাই তিনি বলেন, ‘বই হলো এমন অস্ত্র, যা সৃষ্টির কাজে ব্যবহার হয়, আবার ধ্বংসের কাজেও ব্যবহার করা যায়। কাজেই এর ব্যবহারবিধিটাই আসল।’ ভালো বই পড়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, বই শুধু পড়লেই হবে না—অসত্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। বই পড়ার পাশাপাশি মিছিলেও যেতে হবে। যত শিক্ষিত হোক, যত ভালো মানুষই হোক, কারও পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব নয়। কাজেই সংঘবদ্ধভাবে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিমে হেলতে শুরু করে। আগে থেকেই ঠিক ছিল আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। তাই আগে থেকেই তিনি দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণও জানিয়ে রেখেছিলেন। বাড়ির ভেতরে ঢোকার মুহূর্তে দক্ষিণের পুকুরঘাটে গিয়ে দাঁড়াই আমরা। পলান সরকার জানান, গ্রামে একমাত্র তাঁর পুকুরেই গ্রীষ্মকালে পানি থাকে। পুকুরটি তিনি সবার জন্যই উন্মুক্ত রেখেছেন। বেশ কয়েক বিঘা জমির ওপর আধা পাকা বাড়ি। চারদিকে আমবাগান। অদূরে ৪০-৪৫ বিঘা আবাদি জমি। সেসব এখন বর্গা দেওয়া আছে। একসময় মায়ের তরফ থেকে পাওয়া নিজের সেই জমিতে কাজ করতেন পলান সরকার। লাঙল চষা, মই দেওয়া, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা, মহিষের গাড়িতে করে সে ধান বাড়ির উঠোনে আনা, ধান মাড়াই করা—সব কাজেই তিনি সিদ্ধহস্ত। কোনো কাজই তাঁর কাছে ছোট নয়। পদক-পুরস্কারের আশায়ও কোনো কাজ করেন না। কেবল নিজের জন্য নয়, মানুষের জন্য কাজ করা যেকোনো মানুষের স্বাভাবিক দায়িত্ব—এই বোধ থেকেই কাজ করে যান পলান সরকার। আসলে এ দেশে শত বিপত্তির মধ্যেও মানুষের এগিয়ে চলা বোধ করি সম্ভব হচ্ছে পলান সরকারের মতো ব্যক্তিদের জন্যই।

আমাদের সঙ্গে খাবার টেবিলে একপাশে তিনিও বসেন। ৯৪ বছর বয়সী পলান সরকারের জন্য আলাদা কোনো আয়োজন নেই। স্বাচ্ছন্দ্যে সব খাবারই খেতে থাকেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে সুস্থ ও দীর্ঘায়ুর জন্য নিজেকে জটিল-কুটিল চিন্তা থেকে দূরে রাখা জরুরি বলে আমাদের মনে হতে থাকে।

পলান সরকার মানুষকে ভালোবাসেন। তাঁর এই ভালোবাসা, ব্যক্তিজীবনে সৎ থাকা বা প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার পেছনে যাত্রাদলের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দর্শনও কাজ করেছে।

পলান সরকারের মুখ থেকে আমরা এ কথাও জানতে পারি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি মিছিল করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। একাত্তর সালে পারিবারিক সমস্যার কারণে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা ও সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। খাবার টেবিলে বসে আমরা যখন এসব তথ্য জানছিলাম, তখন বাইরে পলান সরকার পাঠাগারে চলছিল অন্য এক আয়োজন।

বেলা তিনটা নাগাদ আমরা যখন পাঠাগারে এসে উপস্থিত হলাম, তখন অপরিসর সেই পাঠাগারে তিল ধারণের স্থানও ছিল না। মানব উন্নয়ন সংস্থা, কিশোর কলি, অনুশীলন ফাউন্ডেশন, কিশলয়, সেবার জন্য আমরা, ওরা এগারো জন, আড়ালের আর্তনাদ—এমন সব বাহারি নামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছে-দূরের কর্মীরা উপস্থিত হয়ে পাঠাগারকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। না, এসব সংগঠন কোনো দাতা সংস্থার অর্থানুকূল্যে গড়ে ওঠেনি। পলান সরকারের এলাকা, সুতরাং যুবকেরা গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসাবেন কেন? প্রথম আলো প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ওই সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সংক্ষেপে তুলে ধরলেন তাঁদের কর্মকাণ্ড। বোঝা গেল এসব সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর প্রেরণাও কাজ করেছে। ইতিমধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এসেছেন বাউসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফ আলী, স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল করিম, কবি ড. হাসান রাজা। সবাই কথা বললেন। আড্ডা আরও বেশি জমে উঠল, যখন এলাকার কণ্ঠশিল্পী রেজাউল করিম তাঁর দরাজ গলায় একে একে পুরোনো দিনের গান গাইতে থাকলেন।
সৃজনশীল সেই আড্ডার শেষ বক্তা ছিলেন পলান সরকার, যিনি দুপুরের খাওয়া শেষে কোনো বিশ্রাম না নিয়েই সাহসী যুবকের মতো উপস্থিত যুবকদের মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন। তাঁর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমরা যখন পাঠাগারের সামনে রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িতে উঠে বসলাম তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে আরও ঢলে পড়েছে। চারদিকে শেষ বিকেলের ঝকঝকে রোদ—আমবাগানের মাথার ওপর চোখ গেলে দেখা যায় স্বচ্ছ উদার নীল আকাশ।

১২.
‘বইয়ের নেশায় ছয়টি দশক’ শিরোনামে ২০১৪ সালের ৭ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত পলান সরকারের নিজস্ব বক্তব্যটি এবার জানা যাক। ‘আমি সব জায়গায় বলি, ‘পড়লে বই আলোকিত হই, না পড়লে বই অন্ধকারে রই।’ অথচ এই আমি কিন্তু ঠিকমতো তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাইনি। পড়েছি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পরীক্ষার ফির সামান্য কয়টা টাকাও তখন দিতে পারিনি। এ জন্য আমাকে বিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছিল। আমি বিদ্যালয় ছেড়েছি, কিন্তু কখনো বই ছাড়িনি। অশিক্ষার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রবল আগ্রহ তখন থেকেই আমাকে তাড়া করত। 

আমার বাবার পৈতৃক নিবাস নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার নূরপুর মালঞ্চী গ্রামে। আমার পাঁচ মাস বয়সে বাবা মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে মা খুব অসহায় অবস্থায় পড়ে যান। আমাকে নিয়ে মা চলে আসেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে নানার বাড়িতে। নানার বাড়িতেই আমি বড় হয়েছি। তাই বাউসা গ্রামই আমার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যায়। প্রথম জীবনে সেখানকার জমিদারের খাজনা আদায় করা ছিল আমার কাজ। পরে জমিদারি প্রথা উঠে গেলে আমি বেকার হয়ে পড়ি।

১৯৬৩ সালে আমি পাই বাউসা ইউনিয়নের চৌকিদারি ট্যাক্স আদায়ের দায়িত্ব। তত দিনে আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। গ্রামে আমার চালকল হয়েছে। ট্যাক্স আদায় করে যে কমিশন পেতাম, তা দিয়ে শুধু বই কিনতাম। নিজে পড়তাম, অন্যদের পড়তেও উৎসাহিত করতাম।
চালকলে হালখাতার সময় যারা সব বাকি পরিশোধ করে দিত, তাদের আমি একটি করে বই উপহার দিতাম। কোথাও নেমন্তন্ন খেতে গেলে বই ছাড়া কোনো উপহার দিই না। গ্রামে নিজের জমিতে একটি হাইস্কুল করেছি। সেই বিদ্যালয়ের আমি সভাপতি। এই স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় মেধাতালিকায় যারা এক থেকে দশের মধ্যে থাকে তাদেরও একটি করে বই দিতে শুরু করি। যারা দশের পরে থাকে, তাদেরও বই দিই। তবে ওদের পড়তে দিই ফেরত দেওয়ার শর্তে।

আস্তে আস্তে কীভাবে যেন এ খবর গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ছাত্রছাত্রী ছাড়াও যাঁরা অবসর সময় কাটান, বিশেষ করে যাঁরা গৃহবধূ, তাঁদের কাছ থেকেও বইয়ের বায়না আসতে থাকে। অনেকেই বাড়ি থেকে বই নিয়ে যান।

বই বিলানোর এই কাজটা শুরু করেছিলাম শুধুই মনের টানে। এ টান তৈরি হয়েছিল আমার যৌবনে। তখন যাত্রায় অভিনয় করতাম। সে সময় অন্য অভিনেতাদের বই পড়ে শোনাতাম, যাত্রার পাণ্ডুলিপি কপি করে দিতাম, যাত্রায় প্রম্পট করতাম। এভাবে বই পড়ার একটা নেশা আমাকে পেয়ে বসে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রসারের কারণে গ্রামাঞ্চলে যাত্রাপালা অনেকটাই কমে যেতে থাকে। যাত্রা-নাটকের বইও তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার মনে বইয়ের আসন তত দিনে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে।

এরই মধ্যে আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। চিকিৎসক বললেন, প্রতিদিন তিন কিলোমিটার করে হাঁটতে হবে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু তিন কিলোমিটার পথ আর ফুরোতে চায় না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি এসে যায়। ভালো লাগে না। হাঁটতে হাঁটতেই ভাবতে থাকি, কী করলে হাঁটার কষ্টটা ভুলে থাকা যাবে। ভাবতে ভাবতেই মনে আসে বইয়ের কথা।

হাঁটতে হাঁটতে আমি একেক দিন একেক গ্রামে যাই। ভাবলাম, যাঁরা বাড়ি থেকে বই নিয়ে যান, তাঁদের বাড়িতে যদি আমিই বই নিয়ে যাই, তাহলে তো তাঁরা আরও বেশি উৎসাহিত হবেন। এমনকি এর ফলে যাঁরা আমার বাড়িতে বই নিতে আসতে পারেন না, যেমন ধরা যাক গৃহবধূরা, তাঁরাও বই পড়ার সুযোগ পাবেন। অনেক ছেলেও দিনে কাজের ব্যস্ততার কারণে আলাদা সময় বের করে বই নিতে আসতে পারে না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সত্যি সত্যি কিছু দিনের মধ্যেই হু-হু করে পাঠক বাড়তে শুরু করল।

বাঘা উপজেলার আড়ানী বাজারের লাইব্রেরিতে আমার নামে বাকি বাড়তে লাগল। কিছুদিন পর ভুলে গেলাম যে আমি হাঁটছি ডায়াবেটিসের কারণে। ভোরে ঘুম ভাঙলেই একটা নেশা আমাকে রাস্তায় টেনে বের করে আনে। আমি চাইলেও আর বসে থাকতে পারি না। বই হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। রাস্তা হাঁটার ক্লান্তি কোথায় যেন চলে যায়।

দিনে দিনে আমার ভাবনায় আরও নানা কিছু যুক্ত হতে থাকে। আমি বুঝতে চাই, পাঠকেরা নতুন কী বই চায় অথবা নতুন কী বই তাদের হাতে তুলে দেওয়া দরকার। দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে এভাবে মানুষকে আমি বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করে চলেছি। এটা যে একটা সামাজিক আন্দোলন, তা কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। আমি শুধু দেখেছি দিনে দিনে বই পড়ার এই আগ্রহ গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামে গ্রামে আমার জন্য মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। আশপাশের ১৫-২০ গ্রামের সব বাড়িতেই আমার অবাধ প্রবেশাধিকার। প্রতিটি বাড়ির মানুষ আমাকে ভালোবাসে।

কী করে যেন প্রথম আলো আমার কাজের খবর পেয়ে গেল। প্রথম আলোর প্রতিবেদক আমার বাড়িতে এসে এ নিয়ে প্রতিবেদন করতে চাইলে আমি জোর আপত্তি করেছিলাম। আমি তো প্রচারের জন্য এ কাজ শুরু করিনি। ২০০৭ সালের বইমেলাকে সামনে রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’তে আমাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হলো, ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’। প্রথম আলোর সেই ছবিটি নিয়ে গ্রামীণফোন ২৬ মার্চ দেশের প্রধান দৈনিকগুলোতে আধা পৃষ্ঠাজুড়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করল। টেলিভিশনেও আমার কাজ নিয়ে প্রচারিত হলো একটি বিজ্ঞাপন।
এর পর থেকে কী যেন ঘটে গেল। মিডিয়ায় ঝড় উঠল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলের লোকেরা উপচে পড়ল আমার বাড়িতে। সেই বছর সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৫০টিরও বেশি সংবর্ধনা পেলাম আমি। আমাকে প্রধান চরিত্র করে একটি নাটকও প্রচারিত হলো।
এক দিন ঢাকা থেকে এক লেখক তাঁর লেখা প্রায় ৮০০ বইয়ের কপি নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির। ২০০৭ সালের ১৯ মে রাজশাহীর বাঘায় এক সংবর্ধনায় প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বললেন, প্রকৃত মানুষ গড়ার জন্য আমাদের ঘরে ঘরে পলান সরকারের মতো বইয়ের আলো জ্বালাতে হবে। তাঁর সে আহ্বানে এখানে বহু মানুষ সাঁড়া দিতে শুরু করল। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামে তরুণদের একটি সংগঠন ঠিক আমারই মতো বাড়ি বাড়ি বই বিতরণের কাজ করছে। পত্রিকায় দেখেছি, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলায় এক যুবক ব্যক্তিগত উদ্যোগে একই কাজ শুরু করেছেন। লালপুরেও এক যুবক এ কাজ শুরু করেছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের কাজ হচ্ছে বলে খবর পাচ্ছি। ভাবতে ভালো লাগে, আমি আগে একা মানুষের হাতে বই তুলে দিয়েছি, এখন এ অঞ্চলে আমার কত কত হাত।

আমি শুরু করেছিলাম নিছক মনের আনন্দে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসায়, মানুষের প্রতি ভালোবাসায়। ২০১১ সালে আমাকে একুশে পদক দেওয়া হলো। পদকটি গ্রহণ করার পর আমার মনে প্রথমেই ভেসে উঠল প্রথম আলোর কথা। পদক নিয়েই আমি ছুটে গিয়েছিলাম তাদের কার্যালয়ে। কোনো প্রতিদানের আশায় আমি কাজ করিনি। কিন্তু তারা আমার খবর ছাপায় মানুষের অগাধ ভালোবাসা আমি পেয়েছি।

একুশে পদক পেয়ে অবাক হয়েছিলাম। আবারও অবাক হলাম, গত ২০ সেপ্টেম্বর ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে আমার এই আন্দোলন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে শুনে। আমার এই সামান্য কাজে বাংলাদেশের সুনাম যদি অন্য দেশের মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছায়, সেও তো এক বড় আনন্দ।

না চাইতেই আমি অনেক পেয়েছি। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আমার বাড়ির পাশে ‘পলান সরকার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি পাঠাগার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। বই পড়ুয়ারা পাঠাগারে এসে ইচ্ছেমতো বই পড়তে পারে।

এ বছর আমার বয়স হলো ৯৪ বছর। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। সংসারের দায়িত্ব এখন আর নেই। এখন আমার অখণ্ড অবসর। জানি না আর কত দিন হাঁটতে পারব। কিন্তু যত দিন পারি, তত দিন আমি হাঁটতে হাঁটতে মানুষের বাড়িতে বই পৌঁছে দিতে থাকব। একদিন হয়তো আমার পথচলা থেমে যাবে, তখন মানুষ যেন এই পাঠাগারে এসে হাতে বই তুলে নেয়।’

(তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত