জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

অভিজিৎ রায়

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:২২

১.
মানবতাবাদী লেখক অভিজিৎ রায় কেবল আজ আর একটি নাম নয়, তিনি নন কেবল একজন মুক্তচিন্তার শহীদ মাত্র। তিনি শুধুমাত্র একজন বহুলপরিচিত লেখকই ছিলেন না, ছিলেন একজন অত্যন্ত প্রাণবন্ত মানুষ এবং একটি হৃদয়বান বাবা, স্বামী, ছেলে এবং বন্ধু। আমেরিকাপ্রবাসী অভিজিৎ ছিলেন একজন সক্রিয় ব্লগার এবং যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তক এবং নিরীশ্বরবাদীদের জন্য প্রথম বাংলা আন্তর্জালিক প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তমনা’র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শুধু বিজ্ঞান বা নাস্তিকতা নিয়েই লিখতেন না, তার লেখনী যে কোন ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যে কোন ধরনের অবিচার, কুসংস্কার অথবা বৈষম্যের প্রতিবাদে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলো। তার লেখা বই ও ব্লগগুলোর বিষয়ের ব্যপ্তির দিকে তাকালেই ওপরের কথাটার প্রমাণ মেলে। নারীবাদ থেকে শুরু করে (হাইপেশিয়াকে নিয়ে মর্মস্পর্শী লেখাটা এক্ষেত্রে বিষেশভাবে উল্লেখ্য) সমকামিতা, কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা, অথবা ইরাক যুদ্ধে কি আবু ঘারীবে ঘটতে থাকা অমানবিকতা, গুজরাতের, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর উদাসীনতা – এসবই ছিলো তার লেখার বিষয়বস্তু। অভিজিৎ রায় ১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। অভিজিৎ রায়ের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, মানবিক চিন্তক, বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। তারপর হাসপাতালে নেয়ার পর অভিজিৎের মৃত্যু ঘটে এবং স্ত্রী বন্যা দুই দিন বাংলাদেশে চিকিৎসা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। 

২.
শুরুতেই একটু পিছন ফিরে স্মৃতির আয়নার আপন মুখচ্ছবি দেখার চেষ্টা করা যাক। আমার আনন্দভুবন নবসৃষ্ট ভাসানটেক সরকারি কলেজের ছেলেময়েরা অধিকাংশই দরিদ্র বসিস্তবাসী হলেও ওদের মনটা দারুণ উদার, ভীষণই মানবিক আর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। সৃজনশীল শিক্ষামূলক যে কোন কাজে ওদের সবার উৎসাহ অসীম। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্যার হলেও বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শিক্ষা শাখার সকলেই কেন জানি না আমাকে বেশ পছন্দ করে। আমার মনটা সেদিন আনন্দে ভরে গিয়েছিলো যেদিন অধ্যক্ষ মহোদয় জানালেন, ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে দাবি জানিয়েছে, আমাকে ওদের নিয়মিত ক্লাস শিক্ষক হিসেবে পেতে চায়, আমাকে ওদের ক্লাস নিতে হবে। আমি সদানন্দে রাজি না হয়ে পারি? একেই বুঝি বলে, ‘একেতো নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি’। ক্লাস যেমন আমার কাছে পবিত্রতম স্থান তেমনি আনন্দেরও অসীম উৎসস্থল। তাই সুযোগ পেলেই ছুটে যাই যে কোন শাখার ক্লাসে, যে কোন সময়। আমার এইসব ছেলে-মেয়েরা নিয়মিতভাবে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি সম্প্রতি বিজ্ঞান ক্লাব গঠন করেছে। তারা বিজ্ঞানমনস্ক হতে চায়, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদের চর্চা ও চেতনায় ধারণ করবে বলেও গোপনে মনে শপথ নিয়েছে। আমারও দৃঢ় আস্থা জন্মেছে ওদের সাথে ইদানিং বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে। ওরা মানবিক ও বিজ্ঞানমনস্ক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, সে জন্যে জীবনব্যাপী কাজও করতে চায়। আশাকরি ওরা আলোকিত মানুষ হবে, স্বপ্ন সার্থকতায় বিজয়ী হবেই হবে।ওদের কয়েকজনের উৎসাহ-আগ্রহেই আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলির আয়োজন ঘটে একদিন। একুশে বইমেলার ঠিক বাইরে ভাষা শহিদ মিনারের অদূরে টিএসসি চত্বরের যে স্থানে সস্ত্রীক অভিজিৎের ওপর হামলা চালায় মৌলবাদি সন্ত্রাসীরা, সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালাম আমরা সেদিন। অভিজিৎের লেখা ও কর্ম নিয়েও সামান্য আলোচনা করলাম, শিক্ষার্থীদের ধারণা দিলাম। আমি ঠিক জানি না, দেশের আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আমাদের মত এভাবে শ্রদ্ধা জানাতে দলবেধে এখানে এসেছিলো কি না। আমাদের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে সবিনয় দাবি রইল- অভিজিৎ এর আক্রান্ত স্থানে খুব দ্রুত একটি স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।

৩.
আগেই বলেছি, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে। তারপর হাসপাতালে নেয়ার পর অভিজিৎ এর মৃত্যু ঘটে এবং স্ত্রী বন্যা দুই দিন বাংলাদেশে চিকিৎসা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে মার্কিন প্রবাসী অভিজিৎ রায় পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। ‘মুক্তমনা’ নামের ব্লগের এই প্রতিষ্ঠাতা ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কলম ধরে বেশ কয়েক বার জঙ্গিদের হুমকি পেয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নয়। এ বারের বইমেলাতেও তাঁর দু’টি বই প্রকাশ পেয়েছে। মূলত বইমেলা ও একুশের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্যই ১৫ তারিখে ঢাকায় ফিরেছিলেন অভিজিৎ। লেখালেখি নিয়ে অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল জঙ্গিবাদীরা। হুমায়ুন আজাদের পরে লেখক অভিজিৎ রায়, আক্রান্ত হলেন সামান্য দূরত্বে, প্রায় একই স্থানে, একই রকম চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত হলেন, মারাও গেলেন দু’জনেই। ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গিদের হামলায় এভাবেই বারবার রক্তাক্ত হয় ঢাকার রাজপথ। 

৪.
আক্রান্তের এক মাস পর রাফিদা আহমেদ বন্যা লিখেছেন, ‘মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ঠিক এক মাস আগে, ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি আমার স্বামী অভিজিৎ রায় এবং আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মমভাবে আক্রান্ত হয়েছিলাম। অভিজিৎ বিজ্ঞান এবং মানবাধিকার বিষয়ে লেখালেখি করত, কঠোর সমালোচনা করত ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে এবং প্রতিষ্ঠা করেছিল মুক্তচিন্তকদের জন্য বাংলায় সর্বপ্রথম একটা অনলাইন প্লাটফর্ম-– ‘মুক্তমনা’। এই সবের জন্য, ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।’ অভিজিৎ এর আগে ২০০৪-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি এ ভাবেই বইমেলা থেকে বার হওয়া মাত্র আক্রান্ত হয়েছিলেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। এ ভাবেই তাঁকে কোপানো হয়েছিল। পরে তদন্তে জানা যায়, ইসলামি জঙ্গিরাই এই হামলা চালিয়েছিল। ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ব্লগার রাজীব আহমেদকেও কুপিয়ে খুন করেছিল দুষ্কৃতীরা। সে কাজেও জঙ্গিদের হাত খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।

৫.
অভিজিৎ রায়ের (জন্ম : ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ – প্রয়াণ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) লেখা বইগুলো হলো : আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫), মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭), স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮), সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০), অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১), বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২), ভালবাসা কারে কয় (২০১২), শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪), ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫)।

৬.
অভিজিৎ রায়, আধুনিক বাঙলাদেশের মুক্তমনা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। অসংখ্য মানবদরদী মানবতাবাদী মুক্তচিন্তকের মতই তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন সমাজের নানা প্রথার, ধর্মীয় মতাদর্শের।সেই অভিজিৎকে শূন্যলোকে বিলীন করে দেওয়া হলেও আমাদের জন্য তিনি রেখে গেলেন ‘অশূন্য’ অনেক অনুপ্রেরণা। তাঁর প্রকাশিত বিভিন্ন বই ও মুক্তভাবনার মাধ্যমে তিনি আমাদের আলো দিয়ে যাবেন ‘ঐ যে সুদূর নিহারীকার’ মতোই– অহর্নিশ। আর আমরা কেবলই শোনার আশায় থাকি, আমাদের কণ্ঠে নূরলদীনের সেই আহ্বান ধ্বনিত হওয়ার, ‘‘জাগো বাহে, কুনঠে সবাই!’’

৭.
ইতিহাস থেকে আমরা জানি, চিন্তার স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে সব দেশেই মানুষ নির্যাতিত ও নিহত হয়েছে যুগে যুগে। প্রথাগত চিন্তার বেশি বাইরে চলে যাওয়ায় অনেককে দেশত্যাগীও হতে হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের অভিজ্ঞতায়ও মানুষ এসব প্রত্যক্ষ করেছে। তাই শুধু একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দায়ী করলে চলবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশেও চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একশ্রেণির মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন একের পর এক। আইনত আক্রান্ত হওয়ার বদলে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন দৈহিকভাবে। অথচ চিন্তার স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাসী নন বা যারা একে সীমাবদ্ধ করে দিতে চান, তারা কিন্তু নিজেদের বাকস্বাধীনতা অবারিত ভাবেন। ভিন্নমত বা ধারার মানুষকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখতে তাদের অনেকেই কুণ্ঠিত নন। তারা ভেবে দেখেন না, রাষ্ট্র ও সমাজে এর প্রতিক্রিয়াও তৈরি হবে। কথায় বলে, ‘শত ফুল বিকশিত হোক, শত মত পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক’। বাস্তবে সেটা আদর্শ রূপে ঘটে না। বিরোধী বা নতুন মতের মানুষজন চিন্তাভাবনা প্রকাশে সঙ্কটে থাকেন এবং তাদের অনেকে আক্রান্তও হন। আর তাই চিন্তা চর্চা কিংবা মতাদর্শের ইতিহাস পাঠে খুব সহজেই ভাসে গুরু সক্রেটিসের মুখ।
 
৮.
আজকে আমরা যা কিছু জানি, সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান একসময়ে কেন্দ্রীভূত ছিল দর্শন শাস্ত্রে। বলা হয় দর্শন সকল জ্ঞানের জননী। সক্রেটিস মূলত দর্শন চর্চা করে গেছেন, তার ছিল তীক্ষ্ণ যুক্তিজ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর তার প্রশ্ন করার গুণ ছিল অনন্যমানের। তিনি অত্যন্ত উঁচুমানের তার্কিক ছিলেন, প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি তুলে আনতেন দর্শনের বিভিন্ন দিক। দেখিয়ে দিতেন প্রতিষ্ঠিত ধারণার ত্রুটিসমূহ। অধিকাংশ সময় তিনি সে সময়ের তরুণদের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শ্রোতার কাছ থেকে শুনতেন এবং ক্রমাগত পালটা প্রশ্ন করে করে বক্তার বক্তব্যকে অসাড়তা প্রমাণ করতেন। মহান সক্রেটিস হাটে বাজারে, লোক সমাগমে বক্তৃতা করে বেড়াতেন। তার বক্তৃতার অন্যতম বিষয় সমাজে প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে, প্রচলিত সব ধর্মের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড যুক্তিতর্ক এবং প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি নগ্ন করে দিতেন প্রচলিত সমাজকে, সামাজিক প্রথা আর ধর্মকে, ধর্মজীবীদেরকে, আইন কানুন আর ব্যবস্থাকে আর সেসময়ের প্রভাবশালীদেরকে। তিনি দেখতে কদাকার ছিলেন, কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি আর সাহস নিয়ে নিজের ধারণার কথা উচ্চারণ করতেন, সত্য জানাতেন। যুক্তি আর প্রশ্ন ছিল তার প্রধান অস্ত্র, যে অস্ত্রের সামনে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম, প্রথা আর রাজনীতি অসহায় বোধ করতো। তার এই ক্যারিশমাটিক অস্ত্রের জোরে তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন, বিশেষ করে সেসময়ের তরুণদের মাঝে। তরুণরা তার বক্তৃতায় প্রচণ্ডরকম আকৃষ্ট হতে শুরু করলো। তার কথা শোনার জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তরুণরা দলে দলে আসতে লাগলো, একটি গণজাগরণের সূচনা হলো। যেই জাগরণ ছিল চিন্তার মুক্তির, বাক-স্বাধীনতা, যুক্তি, দর্শন আর ধর্মবিরোধিতার, যেই জাগরণ ছিল সমস্ত প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সত্যকে সামনে তুলে নিয়ে আসার। তার শত্রুদের সংখ্যা মোটেও কম ছিল না। তার শত্রুরা ছিল সে সময়ের রাজনীতিবিদগণ, সে সময়ের ধর্মযাজকগণ, যাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান পন্থা ছিল জনগণের মগজ ধোলাই করে মানুষকে মুর্খতার কুয়ায় শেকল দিয়ে আটকে রাখা। তাদের এতদিনকার প্রথা এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং আইনকানুন নিয়ে, দেবদেবী আর অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন সক্রেটিস। এরপরে যা হবার, যা এখনও হয়ে চলেছে সেটা হল। তৎকালীন শাসক সমাজ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপ করলো যে সে তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের নৈতিকতা নষ্ট করছে। প্রচলিত ধর্মকে অস্বীকার করছে, প্রচলিত দেবতাদের নিয়ে ঠাট্টা করছে, তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে তরুণদের নৈতিকতা ধ্বংস করা, ধর্মবিরোধিতা সহ মানুষকে ধর্মের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার অভিযোগ দায়ের করা হয়। বিচারের সভায় সক্রেটিসের কাছে যুক্তিতে ভয়াবহভাবে পরাজিত হবার পরেও সক্রেটিসের শাস্তি হলো হেমলকের বিষে মৃত্যুদণ্ড।

৯.
আজো অভিজিৎ রায়ের নির্মৃম হত্যাকাণ্ডের সঠিক কূল-কিনার হলো না, ন্যায় বিচার তো নয়ই। একুশের বইমেলার প্রিয় মাস ফেব্রুয়ারি তাই আমাদের মাঝে আসে বেদনা আর ক্ষোভ নিয়ে। বইমেলাতেও অভিজিৎ রায়- দীপনদের স্মৃতির প্রতি যথাযোগ্য সম্মান জানাতে দেখি না বলেও কষ্টে বুক ভরে যায়। আর অভিজিৎ সঙ্গী বন্যা আহমেদের ব্যথার অনুভূতি তো অব্যক্তই থেকে যায় প্রায়। তবুও তিনি মাঝে মাঝে উচ্চারণ করেন আপন শব্দাবলি। যেমনটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বন্যা আহমেদ (Bonya Ahmed ) লিখছেন, ‘ এই মাসটা খুব ওলোটপালটের মাস। ২৬ তারিখ ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকলে 'ভাল খারাপের' প্রশ্নটাও করতে ভয় লাগে। ফেসবুকে আমার অনুপস্থিতি দেখে অনেকেই কুশল জানতে চেয়েছেন, সহানুভূতি জানিয়েছেন। ২০১৫ সালে ভ্যালেন্টাইনস ডে তে তৃষার সাথে ওর কলেজে দেখা করে আমি আর অভি বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। তাই প্রতি বছর এই সময়টা যত এগিয়ে আসতে থাকে তৃষার ভঙ্গুরতাও ততো বাড়তে থাকে। আমি ব্যক্তিগত সুখদুঃখ বড়ো একটা ভাগ করে নিতে পারিনা, এটা আমার অক্ষমতাই বলতে পারেন। এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকাও আমি এখনো মেনে নিতে পারিনি।

৯.২
গত তিন বছরে অনেকে এটা নিয়ে আমার সমালোচনা করেছেন, আমার 'বাইরের হাসি' দেখে কেউ কেউ বিরক্ত হয়েছেন, প্রকাশ্যে তা জানিয়েছেনও। একজন ব্লগার বন্ধু একদিন এও বললেন যে, আমি নাকি ‘কাওয়ার্ড' তাই নিজের একান্ত অনুভূতিগুলো সবার সাথে ভাগ করে নিতে ভয় পাই। হবে হয়তো! তবে এখনো আমার বিশ্বাস যে, কিছু একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি আছে যেগুলো সবার সাথে ভাগাভাগি করে নিতে গেলে তারা তাদের গভীরতা হারায়। গভীরতার তাৎপর্য যে আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কতটা বেশী হয়ে দাঁড়িয়েছে তা আর নতুন করে বলে কী লাভ- আমিই হয়তো ভুল, এসব সূক্ষ্ম মানবিক অনুভূতির হিসেব মেলানো বা এদের 'সঠিকতা / বেঠিকতা' নির্ণয় করা তো আর কোন সহজ কাজ নয়।

৯.৩
এই তিন বছরে অনেকের সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কতো মানুষের জীবন অহরহ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ছে - কখনো বিনা কারণে, আবার অনেক সময়েই মানুষের, সমাজের, দেশের বা বহু দেশের স্বার্থের কারণে। সেই ছিন্নভিন্ন অংশগুলোকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতে করতেই জীবনের একটা বিশাল অংশ পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিগত সুখদুঃখের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সমাজ ও পৃথিবীকে একটু সাহস করে দেখতে শুরু করলে, একে অতীত, বর্তমান, ও ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে ফেলে জানার এবং বোঝার চেষ্টা করলে নিজের কষ্টগুলো একটু হলেও কমে আসে - এটাই আমার শিক্ষা গত তিন বছরে। 

৯.৪
এবং এই সময়টাতে দেশ বিদেশের কত মানুষ এগিয়ে এসেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, কেমন আছি জানতে চেয়েছেন - তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বিজ্ঞানের চোখে সময়ের অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক - সময় যেহেতু সবসময় এগিয়েই চলে তাই আমাদেরও সামনে এগুনো ছাড়া আর উপায় কী?’

১০.
আমরা জেনেছি ঘোর অন্ধকারেও অভিজিৎ রায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে আলোর সন্ধান দিতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন- এ ইতিহাস শত সহস্র বছর ধরে ধারণ করার দায়িত্ব বিশ্বের সকল মুক্তমনা, স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাসী আর ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের। অভিজিৎ এর মতো মেধাবীদের পাশে সরকারকে দাড়াঁনোর আহ্বান জানিয়ে নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেছিলেন, অভিজিৎ এর বই পড়ে মনে হয়েছে তাদের মত মেধাবীদের দেশের জন্য বাঁচার দরকার আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেছেন, দুই ধরণের মুক্তচিন্তা রয়েছে। একটি ইসলামকে কেন্দ্র করে জামায়াত শিবিরে মুক্তচিন্তা। আর একটা ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে মুক্তচিন্তার চর্চা। ফারাবীর মত লোক ইসলামের মুক্তচিন্তার চর্চা করে মানুষ হত্যা করে। অপরদিকে অভিজিৎের মত মানুষ ধর্ম নিরপেক্ষভাবে মুক্তচিন্তা করে। আর তাই ভিন্নমত বা মুক্তচিন্তা প্রকাশের সমাজের গড়ে তুলতে হবে, সমালোচনার সুস্থ পরিবেশেকেও বাঁচিয়ে রাখতে হয়।

(তথ্যসূত্র : অভিজিৎ রায়ের বই সমূহ, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত