মওলানা আবুল কালাম আজাদ

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০১৮, ১১:৪৫

১.
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন সত্যিকারের স্বশিক্ষিত মানুষ। তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত যিনি সম্প্রদায় ভিত্তিক ভারত বিভাগের চরম বিরোধিতা করেছিলেন। ভারতের অন্যতম মুসলিম পণ্ডিত ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মওলানা আবুল কালাম আজাদ জন্মগ্রহণ করেন মক্কায় ১৮৮৮ সালের ১১ নভেম্বর। প্রজ্ঞাবান এই মানুষটির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল কালাম মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামী ও স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ নামেই অধিক পরিচিত। তাঁর ছদ্মনাম ছিল আজাদ। মওলানা আজাদ ইসলামী ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং সকল ধর্ম গোত্র সম্প্রদায়ের ঐক্যের ভিত্তিতে গঠিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও সক্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে সর্বমহলে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। 

২.
মওলানা আবুল কালাম আজাদ তরুণ বয়সে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৭-এ বিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর মওলানা আজাদ শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৯২ সালে তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্নে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। স্বাধীন ভারতে শিক্ষাবিস্তারে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণে রেখে তাঁর জন্মদিনটি সারা দেশে 'জাতীয় শিক্ষা দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। ১৯২৩ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি। 

৩.
আজাদ একটি সম্ভ্রান্ত, জ্ঞান পিপাসু মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন। যে পরিবার মাওলানা নামে পরিচিত ছিল। তাঁর প্রপিতামহ আফগানিস্তানের হেরাত থেকে মক্কায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবএর সময় খায়রউদ্দীন ভারত ছেড়ে মক্কায় চলে যান এবং সেখানে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা খাইরুদ্দিন। তাঁর মা ছিলেন শেখ মোহাম্মদ জাফর ওয়াত্রির মেয়ে। ১৮৯০ সালে আজাদের বাবা সপরিবারে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। আবুল কালাম আজাদের পড়াশুনার হাতেখড়ি বাবার কাছে। তিনি প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি আরবি, ফার্সি, দর্শন, জ্যামিতি, গণিত এবং অ্যালজেব্রা শিক্ষা গ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই আবুল কালাম আজাদ লেখালেখি করতেন। কবিতার ওপর তার ভাল দখল ছিল। তিনি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন। গদ্য লেখাতেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। তাঁর কবিতা ও গদ্য রচনা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সুধীজনের। আরবি, ফার্সি ও উর্দুতে পণ্ডিত ছিলেন তিনি। 

৪.
আরবি মাতৃভাষা হওয়ায় এবং ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ ও দৃঢ় বিশ্বাসী পারিবারিক পটভূমির কারণে প্রচলিত ধারায় ইসলামী শিক্ষার চর্চা করা ছাড়া আজাদের অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক আধুনিক শিক্ষা লাভ না করলেও ব্যক্তিগতভাবে অধ্যয়ন ও ব্যাপক পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে তিনি উর্দু, ফারসি, হিন্দি ও ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তাঁর সময়ের অনেক যশস্বী ব্যক্তিদের মতো তিনিও নিজ চেষ্টায় শিক্ষিত হওয়ার পথ অনুসরণ করেন এবং বিশ্ব ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হন। পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফিকাহ্ ও কালামের নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করে তিনি অনেক লেখা প্রকাশ করেন। তাঁর পান্ডিত্যই ‘তাকলিক’(সাদৃশ্যের ঐতিহ্য) পরিহার এবং ‘তাজদিদ’(নতুন প্রথা প্রবর্তন) গ্রহণের পথে তাঁকে পরিচালিত করে। তাজদিদ সম্পর্কে তাঁর ধারণা তাঁকে এ বিশ্বাসের দিকে চালিত করে যে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে ভারতের সকল ধর্ম ও গোত্রের জনগণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ও কৃষ্টির সুসমন্বয় ঘটাতে পারে এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন সে রাষ্ট্র গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন রাষ্ট্র ভারতের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ভিত্তিক গণতন্ত্রের ধারণাকে ভারতের যেসব রাজনৈতিক চিন্তাবিদ সর্বাগ্রে সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করেছেন আজাদ সম্ভবত তাঁদের অন্যতম।

৫.
মওলানা আবুল কালাম আজাদ (জন্ম : ১১ নভেম্বর, ১৮৮৮ - মৃত্যু : ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৮) যে পারিবারিক পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন এবং যে ধরনের শিক্ষা লাভ করেছেন, তাতে তাঁর ধর্মীয় নেতা হওয়ারই কথা। তাঁর পূর্বপুরুষদের অধিকাংশই ধর্মবেত্তা ছিলেন বলে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। বস্ত্তত, রাজনীতির প্রতি আজাদের ঝোঁক ছিল। খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। জামালউদ্দীন আফগানির প্যান ইসলামী মতবাদ ও স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড় চিন্তাধারার প্রতি তিনি বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। প্যান ইসলামী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আফগানিস্তান, ইরাক, মিশর, সিরিয়া ও তুরস্ক সফর করেন। কিন্তু জীবন ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন এক উপলব্ধি নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। ইরানে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত নির্বাসিত বিপ্লবীদের সঙ্গে তিনি ইরাকে সাক্ষাৎ করেন। তিনি মিশরে শেখ মুহম্মদ আব্দুহ্ ও সাঈদ পাশা এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লবী কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন। কনস্টান্টিনোপলের তরুণ তুর্কিদের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তাঁর প্রাথমিক জ্ঞান ছিল। এসব সংস্পর্শ তাঁকে একজন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীতে পরিণত করে। ধর্ম ও জীবনের সংকীর্ণ ধারণার শৃঙ্খলমুক্তির স্মারকস্বরূপ তিনি লেখক হিসেবে ‘আজাদ’ নাম গ্রহণ করেন। বিদেশ থেকে ফিরে এসে আজাদ পূর্ব ভারতের দুজন নেতৃস্থানীয় বিপ্লবী শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ ও শ্রীশ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ব্রিটিশ শাসন বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন। প্রকৃতপক্ষে একদিকে তিনি ছিলেন একজন গোপন বিপ্লবী এবং অন্য দিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রকাশ্য কর্মী। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হবে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য, আর সে ঐক্যের ভিত্তিমূল হবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সেক্যুলার ধারণা। কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে তিনি তুরস্কের খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেন, পুরানো শাসকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে নয় বরং নবীন তুর্কিদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য। তাঁর মতে, নবীন তুর্কিরাই ছিলেন খিলাফতের মূল বিধানের সত্যিকার প্রতিনিধি।

৬.
তরুণ বয়স থেকে মওলানা আজাদ উর্দু ভাষায় কবিতা, ধর্ম ও দর্শনসংক্রান্ত নিবন্ধ রচনা করতে শুরু করেন। তিনি সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করেন এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সমর্থন জানান। ১৯১২ সালে তিনি আল-হেলাল নামে উর্দু সাপ্তাহিক বের করেন যাতে ইংরেজদের সমালোচনামূলক জাতীয়তাবাদী রচনা পত্রস্থ হতো। আজাদের উর্দু সাপ্তাহিক সংবাদপত্র আল-হেলাল প্রকাশ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতে এর অপকর্মের আক্রমণাত্মক সমালোচনা করে। এ পত্রিকা কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী মতামত প্রকাশে একটি শক্তিশালী বিপ্লবী মুখপত্রে পরিণত হয়। সম্প্রদায় ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে দুসম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্ট শত্রুতার পর হিন্দু-মুসলমান ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আল-হেলাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকার আল-হেলাল সাপ্তাহিকীকে বিপজ্জনক মতামত প্রচারে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং সে কারণে ১৯১৪ সালে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আজাদ তখন এটির নাম পরিবর্তন করেন এবং আল-বালাগ নামে অপর একটি সাপ্তাহিকী প্রকাশ করেন এবং ইংরেজদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হন। এ পত্রিকারও উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও বিপ্লবী ধ্যান-ধারণা প্রচার করা। এই সময় তিনি মহাত্মা গান্ধীর সংস্পর্শে আসেন। মওলানা আজাদ ১৯১৯ সালের রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজির অহিংস অসহযোগের ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলন সংগঠনে সক্রিয় হন। এ সময় তিনি খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন এবং মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি সারাদেশ চষে বেড়ান এবং ভারতীয় মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে ১৯১৬ সালে সরকার এ পত্রিকাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং আজাদকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে রাঁচিতে অন্তরীণ করে রাখে। এ সময় বোম্বে প্রেসিডেন্সি, সংযুক্ত প্রদেশ (মধ্য প্রদেশ), পাঞ্জাব ও দিল্লীতে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। সেখান থেকে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালের ১ জানুয়ারি কারামুক্ত হন।

৭.
গান্ধীজীর সান্নিধ্যে এসে মওলানা আজাদ তার একনিষ্ঠ সমর্থকে পরিণত হন। তিনি গান্ধীজীর ডাকে অহিংস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কারামুক্ত হয়ে আজাদ রাউলাটি অ্যাক্টের প্রতিবাদে স্বরাজের জন্য, স্বদেশী পণ্য উৎপাদন ও বিদেশী পণ্য বর্জনের পক্ষে সারা দেশে জনমত গড়ে তোলেন। ১৯২৩ সালে তিনি কংগ্রেসের কনিষ্ঠতম সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩১ সালে গান্ধীজীর ডাকা সত্যাগ্রহের তিনি অন্যতম সংগঠক হিসেবে আবির্ভূত হন এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। তিনি সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতিতে উদ্বুদ্ধ হন। এই সময় তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। তিনি ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা প্রচার করেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় পাঁচ বছর তিনি কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিন বছর তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। যেসব ভারতীয় মুসলমান মুসলমানদের জন্য পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবির বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন মওলানা আজাদ। তিনি ভারতের অন্তর্বর্র্তী সরকারেও মন্ত্রিত্ব করেন।

৮.
মওলানা আবুল কালাম আজাদ তখন নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসে মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু এবং সি. আর. দাসের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অন্যতম সদস্য এবং গান্ধীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ঘনিষ্ঠ সহচরদের একজন হিসেবে স্বীকৃত। তিনি দিল্লি (১৯২৩) ও রামগড়ে (১৯৪০) কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ভারতীয় রাজনীতির উত্তাল দিনগুলিতে আজাদ মহাত্মা গান্ধীর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ উপদেষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হন। ক্রিপস মিশন (১৯৪২) থেকে শুরু করে কেবিনেট মিশন (১৯৪৬) পর্যন্ত সকল আলোচনায়, বিশেষত ভারতের সাংবিধানিক বিষয়ে ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, আজাদের সঙ্গে গান্ধী ঘনিষ্ঠভাবে পরামর্শ করেছেন। ক্রিপস মিশন (১৯৪২) এবং কেবিনেট মিশন (১৯৪৬) এ উভয় সময়েই সমঝোতা-পূর্ব আলোচনা বৈঠকে আলোচকদের মধ্যে আজাদ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ায় এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটার ফলে আজাদের প্রভাব হ্রাস পায় বলে মনে হয়। তাঁর লেখা চিঠিপত্র এবং আত্মজীবনীতে তিনি এ প্রসঙ্গে তাঁর হতাশার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, ভারতের বিভক্তি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো যদি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আপসমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে তাঁর (আজাদের) মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন যে, ইতঃপূর্বে মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব কর্তৃক পুরোপুরিভাবে মেনে নেওয়া কেবিনেট মিশন ফর্মূলা আংশিক প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব মহাবিপর্যয় সৃষ্টিকারী ভুল কাজটি করেছেন। আজাদ নেহরুর অভিপ্রায়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, নেহরুর মনোভাব কেবিনেট মিশন পরিকল্পনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে বিভক্তির দিকে চালিত করে। কিন্তু শেষের দিকে সৃষ্ট রাজনৈতিক মতপার্থক্য দুনেতার বন্ধুত্বকে ম্লান করতে পারে নি। তিনি তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী গ্রন্থ ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম নেহরুর নামে উৎসর্গ করে তাঁর সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছেন। উৎসর্গে তিনি লিখেছিলেন ‘বন্ধু ও সাথী জওহরলাল নেহরুর জন্য’। 

৯.
১৯৪০-৪৫ পর্যন্ত কংগ্রেসের দ্বিতীয়বারের মতো সভাপতি থাকাকালে তার ঐকান্তিক চেষ্টায় গান্ধীজীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। এ সময় কংগ্রেসের অন্যান্য নেতার সঙ্গে তিনি ৩ বছর কারান্তরীণ থাকেন। স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী আজাদ অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকারে যোগ দেন। দেশ ভাগের ফলে যে সাম্প্রদায়িক টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়, তখন তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে মওলানা আজাদ অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ও আধুনিক উচ্চ শিক্ষার বিধান রেখে শিক্ষানীতি প্রবর্তন করেন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তারই গড়া দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যা ভারতকে উচ্চতর শিক্ষার পথে ধাবিত করেছে। স্বাধীন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি বিনা মূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার জন্য আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু করেন। তিনিই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন স্থাপন করেন। শুধু তাই নয়, ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী এবং বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের সাংস্কৃতিক বন্ধন জোরদার করা এবং বিদেশে ভারতীয় ঐতিহ্য তুলে ধরার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স (আইসিসিআর), ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে তার প্রচেষ্টা আজ অত্যন্ত ফলপ্রসূ বিবেচিত হচ্ছে।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত