জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাবল

প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০১৮, ১৮:০৩

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর তারিখে এডুইন পাওয়েল হাবল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত মার্শফিল্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছায়াপথ, মহাবিশ্বের সম্প্রসার এবং মহাবিশ্বের আকারের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ আবিষ্কার করেছেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন যে নেবুলা মূলত পৃথিবীর ছায়াপথ আকাশ গঙ্গা বা মিলকি ওয়ের মতো একই গোত্রের ছায়াপথ। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন যে মহাকাশ ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। তার এই আবিষ্কারের ফলে বিশ্বের আকারের মত মৌলিক বিষয় অনুধাবন করার ব্যাপারটি সহজ হয়েছে। তিনি মাউন্ট প্যালামার মানমন্দিরে ২০০ ইঞ্চি বা ৫০৮ সেন্টিমিটার দূরবীণ বসানোর কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। সেই সময়ে এটিই ছিলো সর্ববৃহৎ দূরবীন।

তাঁর পিতা জন পাওয়েল হাবল ছিলেন একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানির এক্সিকিউটিভ। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে জন পাওয়েল হাবল পরিবার পরিজন নিয়ে ইলিয়ন রাজ্যের হুইটোনে চলে আসেন। এ কারণে হাবলের শৈশব কেটেছে হুইটোনে। শৈশবে তিনি লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধুলাতে বেশি আসক্ত ছিলেন এবং খেলাধুলাতে তাঁর কৃতিত্ব ছিল বেশি। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি সাতটি বিভাগে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে তিনি তৃতীয় পুরস্কার লাভ করেন। সে সময়ে উচ্চলম্ফে ইলিয়ন রাজ্যে উচ্চ বিদ্যালয় স্তরে তিনি রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। মাঠের খেলার পাশাপাশি তিনি মুষ্টিযুদ্ধও অনুশীলন করতেন।

তিনি শিকাগো এবং ইলিয়নিসে উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর পঠিত বিষয় ছিল গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দর্শন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য তিনি রোডস বৃত্তি লাভ করেন। এ সময় তিনি কাপ্পা সিগমা (আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ভ্রাতৃ সংঘ) সদস্য হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোডস স্কলার হিসাবে তিনি তিন বৎসর অক্সফোর্ডের কুইন কলেজে লেখাপড়া করেন। এখানে তিনি তাঁর পিতার আগ্রহের কারণে আইন নিয়ে পড়েন। এর সাথে তিনি সাহিত্য এবং স্প্যানিশ ভাষা অধ্যয়ন করেন। ‌১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। একই বৎসরে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন।

এর আগে হাবলের পিতা, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো থেকে কেন্টাকি'র শ্যালবিভিলে-তে সপরিবারে চলে এসেছিলেন। ফলে হাবল তাঁর পরিবারের দেখভালের জন্য ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন এবং সপরিবারে কেন্টাকিতে বসবাস শুরু করেন। এই সময় তিনি তাঁর মা, দুই বোন এবং ছোট একটি ভাইয়ের দায়িত্ব নেন।

বরাবরই জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। তাই তিনি আইন ব্যবসায় অনুশীলনে আগ্রহ বোধ করেন নি। কিন্তু জীবিকার তাগিদে তিনি ইন্ডিয়ানা রাজ্যের নিউ এ্যালবেনি উচ্চ বিদ্যালয়ের স্প্যানিশ ভাষা, পদার্থবিজ্ঞান এবং আইনের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এখানে তিনি বাস্কেটবল দলের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষকতা ত্যাগ করে, তিনি তাঁর প্রাক্তন শিক্ষকের সহায়তায় ইয়ার্কস মানমন্দিরে একটি গবেষণার সুযোগ লাভ করেন। এখান থেকে তিনি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল 'নিষ্প্রভ নীহারিকা'।

এরপর মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জর্জ ইল্লেরি হ্যালে (George Ellery Hale) তাঁকে ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়লে, তিনি সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীর সাথে তিনি ফ্রান্সে আসেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জার্মানিতে অবস্থান করেন। এ সময় সেনাবাহিনীতে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি দ্রুততম সময়ে মেজর পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হন।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ থেকে ফিরে বাসার পর জর্জ ইল্লেরি হ্যালের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে যোগদান করেন। এই মানমন্দিরে একটি ১০০-ইঞ্চি (২.৫-মিটার) হুকার দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছিল। উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এটিই ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম দূরবীক্ষণ যন্ত্র। কর্মজীবনের বাকি সময়টা হাবল এই মানমন্দিরে কাজ করেই কাটান।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'এ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা' এবং ত্রিকোণমণ্ডলের ভিতরে 'বিষম তারকা' আবিষ্কার করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার ভিতরে তিনি ১২টি বিষম তারকা আবিষ্কার করেন। তিনি ঘোষণা করেন, এ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা পৃথিবীর ছায়াপথের বাইরে এবং পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তাঁর এই সকল আবিষ্কার প্রথম প্রকাশিত হয় সেই বৎসরের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ২৩ নভেম্বর সংখ্যায়। অবশ্য সে সময় অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী তাঁর মতামতের সাথে একমত হতে পারেন নি। তাঁর প্রস্তাবিত এই তত্ত্বটি 'দ্বীপ মহাবিশ্ব তত্ত্ব' (Island Universe Theory) নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ছায়াপথগুলো নিয়ে তাঁর গবেষণা অব্যাহত থাকে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি গঠনের বিচারে ছায়াপথগুলোকে নিয়মিত এবং অনিয়মিত নামে দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেন।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে জর্জ লেমিটর তাঁর বিগব্যাং সূত্রে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কথা বলেছিলেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে হাবল ছায়াপথসমূহের দূরত্বের সাথে এদের পশ্চাদপসরণের বেগের তুলনা করার মাধ্যমে লেমিটরের সে ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত মাউন্ট পালোমার মানমন্দিরের জন্য ২০০-ইঞ্চি (৫০৮-সে.মি.) দূরবীক্ষণযন্ত্রের (হেল দূরবীণ) নির্মাণকাজে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৫০ সালে পরলোকগমন করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অপরিসীম অবদান রেখে গিয়েছেন হাবল। তাঁর অমর স্মৃতিকে চির উজ্জল করে রাখার মানসে ১৯৯০ সালে পৃথিবীর কক্ষপথে যে দূরবীন স্থাপন করা হয় সেটির নাম রাখা হয় 'হাবল টেলিস্কোপ'।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত