শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী

প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০১৮, ১১:৫৭

১.
মাটি ও মানুষের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। তাঁর চিত্রসাধনায় ফুটে উঠেছিল বাংলাদেশের রূপকল্প। সুন্দরের নিরন্তর সাধক শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতানুষ্ঠানে বক্তৃতাদানকালে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই এই গুণী শিল্পীর জীবনাবসান হয়। শেষ কথা শুনতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই এ মহান চিত্র জাদুকরকে বিদায় জানাতে হয়েছিলো বাংলাদেশের মানুষকে। প্রিয় শিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ ফেনী জেলায়। শুধু শিল্পকলা নয়, সাহিত্য-গান-চলচ্চিত্রও ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর আনন্দময় উপভোগের ক্ষেত্র। আঁকাআঁকির পাশাপাশি লিখেছেনও অবিরল ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ। সেসব লেখা গুছিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে তাঁর প্রবন্ধের বই জীবনে আমার যত আনন্দ ও কাব্যগ্রন্থ হাতের ছোঁয়ায় রোদের শিহরণ। বেরিয়েছে একটি জীবনীও। 

২.
কাইয়ুম চৌধুরী- আমৃত্যু তাঁকে গণ্য করা হতো বাংলাদেশের শিল্পকলার অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ হিসেবে। চিত্রকলাকে দেশের গণ্ডি থেকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করে তুলতেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। শিল্প-সমালোচকরা তাঁকে অভিহিত করেন ‘রঙের রাজা’ হিসেবে। রং নিয়ে তিনি দীর্ঘকাল তাঁর স্বপ্নকে রাঙিয়েছেন। আমাদের প্রকাশনা শিল্পকেও তিনি সমানভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে জন্ম নেওয়া কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর সমগ্র জীবন সাধনার মাধ্যমে শুধু আমাদের চিত্রশিল্পের জগৎকেই উৎকর্ষমণ্ডিত করেননি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সমগ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকেই তাঁর অগ্রসর চিন্তার আলোকে উদ্দীপিত রেখেছেন। আমৃত্যু তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক ভুবনে যৌবনকালের মতোই সক্রিয় এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ছয় দশক ধরে এই শিল্পী আমাদের প্রকাশনার জগৎকে তাঁর বিপুল সৃষ্টির মাধ্যমে যেভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রাখেন, তার কোনো তুলনা মেলে না। আমাদের শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগৎকে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সুরুচির আলোয় আলোকিত করে তোলার চেষ্টায় ছিলেন। আর এভাবেই তিনি পরিণত হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের এক সার্থক শিল্পী-ব্যক্তিত্বে। এই সার্থকতার পেছনে তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার পাশাপাশি সক্রিয় গভীরতর নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। 

৩.
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ক্ষয়িঞ্চু এক জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন, যেখানে অর্থের জৌলুস না থাকলেও শিক্ষা ও উদার মানসের জোরদার অবস্থান ছিল। তাঁর পিতা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় বিভাগের পরিদর্শক। পরবর্তীতে তিনি সমবায় ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে কাইয়ুম চৌধুরী দেশের অনেক এলাকা ঘুরে ফিরেছেন। গ্রামের মক্তবে তার শিক্ষার হাতেখড়ি। পরে ভর্তি হন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। এরপর কিছুকাল কুমিল্লায় কাটিয়ে চলে যান নড়াইলে। চিত্রা পাড়ের এই শহরে কাটে তাঁর তিনটি বছর। সেখান থেকে সন্দ্বীপ এসে ভর্তি হন প্রথমে সন্দ্বীপ হাই স্কুলে ও পরে কারগিল হাই স্কুলে। এরপর নোয়াখালী জেলা সদরে কিছুকাল কাটিয়ে পিতার সঙ্গে চলে যান ফেনীতে। ভর্তি হন ফেনী হাই স্কুলে, সেখানে থেকে যান ফরিদপুরে। ফরিদপুর থেকে ময়মনসিংহ এসে ১৯৪৯ সালে সিটি কলোজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। স্কুল জীবন থেকে আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর। ১৯৪৯ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ সালে। শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন ছিলেন তার শিক্ষক। সদ্য-প্রতিষ্ঠিত আর্টস ইনস্টিটিউটের নবীন শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কাইয়ুম চৌধুরীও ছিলেন তাদের একজন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কাইয়ুম চৌধুরী নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ করেছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, আর বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণের কাজ করেছেন। কাইয়ুম চৌধুরী, ছায়াছবি নামে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকী যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছিলেন কিছুকাল। ১৯৫৭ সালে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৬১ সালে রেলওয়ের টাইমটেবিলের প্রচ্ছদ এঁকে সেরা পুরস্কারটি লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। চারুকলা ইনস্টিটিউট হওয়ার পর তিনি এতে যোগ দেন অধ্যাপক হিসেবে। এখান থেকে ১৯৯৭ সালে অবসর নেন। দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত হন। আমৃত্যু তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছিলেন। কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচলিত কয়েকটি নোটেরও অলঙ্করণ করেছেন। তিনি ১৯৬০ সালে তাহেরা খানমের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাহেরা খানমও ছিলেন আর্ট কলেজের প্রথম সময়কার শিক্ষার্থী। ১৯৬১ সালে ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে অবজারভার হাউজে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। নিজের শিল্পকর্মের জন্য ১৯৮৬ সালে তিনি একুশে পদকে ভুষিত হন। ২০১০ সালে সুফিয়া কামাল পদক লাভ করেন । গুনী এই শিল্পী শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদকেও ভূষিত হয়েছেন।

৪.
আমরা তাঁর জীবনেতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, শিল্প ও সংস্কৃতির সব ধারা থেকে রস আহরণ করে কাইয়ুম চৌধুরী নিরন্তর পরিপুষ্ট করে চলেন নিজ সৃজনশক্তিকে। আর এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন রাষ্ট্র, জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশের সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী শিল্পী হিসেবে সর্বশেষ ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদকে’। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর স্বীকৃতি লাভ যেন পূর্ণতা অর্জন করে। কেননা, এর আগে তিনি পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমী প্রদত্ত শিল্পকলার জাতীয় পুরস্কার (১৯৭৭), মনোনীত হয়েছেন বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো এবং লাভ করেছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৮৬)। তারও আগে বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে তিনি দু-দুবার রেলওয়ের টাইমটেবলের প্রচ্ছদের জন্য সেরা পুরস্কার পেয়েছেন (১৯৫৯, ১৯৬১), পেয়েছেন শিল্পকলায় পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার (১৯৬১-৬২), পঞ্চম তেহরান বিয়েনাল থেকে রাজকীয় দরবার পুরস্কার (১৯৬৬) এবং বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের জন্য সাতবার গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার (১৯৬৪-৭৬) ও স্বর্ণপদক (১৯৭৫)।

৫.
১৯৪৯ সালে ঢাকার শিল্প শিক্ষালয়ের ছাত্র হওয়ার পর জয়নুল আবেদিনসহ শিক্ষকদের সাহচর্যে যেমন তাঁর জীবনানুভবে অঙ্কুরিত হয়েছিল দেশাত্মবোধের বীজ, তেমনি বন্ধু শিল্পী আমিনুল ইসলাম ও মুর্তজা বশীরের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে তিনি বামপন্থী রাজনীতির চিন্তাস্রোতের নিবিড় সংস্পর্শ লাভ করে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন উচ্চতর মানবতার বোধে। সেই তারুণ্য থেকে শুরু; তারপর ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এই দেশ ও এর শুভবোধসম্পন্ন মানুষের কল্যাণার্থে উৎসর্গীকৃত হয়েছে শিল্পীর সব চিন্তা, কর্ম ও সৃষ্টি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধিকার ও স্বাধীনতাকেন্দ্রিক এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সব সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে তিনি সক্রিয় থেকেছেন। ষাটের দশকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে সর্বজনাব মতিউর রহমান, মফিদুল হক, আবুল হাসনাত, আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ যখনই শিল্পসংশ্লিষ্ট কোনো কাজের দাবি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছেন, তখনই তা আনন্দচিত্তে পূরণ করেছেন। এমনকি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় তাঁদেরই কেউ কেউ রাতে কারফিউর মধ্যে সরকারবিরোধী প্রচার ও প্রকাশনার শিল্পবিষয়ক কাজের জন্য তাঁর বাসায় উপস্থিত হলে তিনিও নির্ভীকচিত্তে সেসব কাজ সম্পাদন করেছেন। ষাটের দশকের নানা প্রতিবাদী প্রকাশনা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর শিল্পের ছোঁয়ায়। 

৬.
২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর বেঙ্গল আয়োজিত ধ্রুপদী সংগীত আসরে কথা বলার শেষ দিকে হঠাৎ শিল্পী মঞ্চেই পড়ে যান। আর এভাবেই চির বিদায় নেন, অজানালোকে চলে যান তিনি। সেই মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমি। 

(সূত্র : কালি ও কলম, শিল্প ও শিল্পী, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত