আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু

প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০১৮, ১২:০৯

১.
সফল বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। জগদীশচন্দ্র বসু কেবল একজন সফল বিজ্ঞানী হিসেবেই নন, নানাভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন বাঙালির ইতিহাসে। কর্মজীবনের প্রথম ধাপেই অন্যায়ের কাছে আপোসহীন একজন দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়। জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মহান এই বাঙালি বিজ্ঞানীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু গিরিডিতে মারা যান। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ একটি বই হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অদম্য অধ্যবসায় আর নিরলস কর্মপদ্ধতি ছিল যার পথ চলার পাথেয়, সেই জ্ঞানসাধক বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান মহলে একদিন মাথা উঁচু করে বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছিলেন। নিজের সব কর্মফলকে পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে বিনা শর্তে দান করে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা ইতিহাসে বিরল। বেতারযন্ত্র এবং জড়জগতের রহস্য উদ্ঘাটনকে ঘিরে তাঁর রয়েছে শতাধিক চমকপ্রদ আবিষ্কার। খ্যাতিমান এবং সফল বিজ্ঞানী হিসেবেই স্যার জগদীশচন্দ্র বসুকে স্মরণ করছি। তিনি কেবল আমাদের কাছেই গৌরবের বিষয় নন, গোটা উপমহাদেশও তাকে নিয়ে গর্বিত। যিনি আমেরিকান প্যাটেন্টের অধিকারী উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি। আর বাঙালি হিসেবেও তার শ্রেষ্ঠত্ব আমরা দেখেছি। ২০০৪ সালে যিনি বিবিসি রেডিওর জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে সপ্তম স্থান লাভ করেন। বিজ্ঞানে তাঁর জগৎজোড়া গবেষণা তাকে দিয়েছে এক অনন্য সম্মান। নানা গুণে গুণান্বিত এই মানব আচার্য, স্যার, মহাবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক নানাভাবে ভূষিত হয়েছিলেন। 

২.
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একজন সফল বিজ্ঞানী, স্মরণীয় কৃতি বাঙালি। বাঙালির গৌরব তিনি। তিনি নানা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। এক জীবনেই অনেক কিছু ছিলেন তিনি। জ্বালিয়েছিলেন আলোকবর্তিকা। সেই আলোর পথ ধরে বিশ্ব আজো এগিয়ে চলছে, কিন্তু আলোকিত সেই মুখ আর কেউ মনে আনে না। অথচ নিজের সময়ের চেয়ে অর্ধশত বছরের বেশি এগিয়ে ছিলেন মেধা-মনন-কর্ম-অধ্যবসায়-সাধনা ও সৃষ্টিতে। তাঁর গবেষণার প্রধান দিক ছিল উদ্ভিদ ও তড়িৎ চৌম্বক। জগদীশচন্দ্র বসু বেশ কিছু নবতর গবেষণা পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। তাঁর আবিষ্কারের মধ্যে উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ আবিষ্কার ও উদ্ভিদের দেহের উত্তেজনার বেগ নিরুপক সমতল তরুলিপি যন্ত্র, অতি সীমিত মাত্রায় নড়াচড়াকে এক কোটি গুণ বিবর্ধন করে দেখানোর যন্ত্র ‘রিজোনাস্ট রেকর্ডার’ অন্যতম। এছাড়া তিনি ঘুম, বাতাস, খাদ্য ও ওষুধ প্রভৃতির প্রভাব প্রদর্শনের জন্য যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করেন। গাছের প্রাণ সম্পর্কে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ ধারণা দিতে পারেননি। জগদীশ চন্দ্র বসুই পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, উদ্ভিদের প্রাণ আছে। উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। জগদীশ চন্দ্র কাজ করেছিলেন অতিক্ষুদ্র তথা মাইক্রো বেতার তরঙ্গ নিয়ে। যার প্রয়োগ ঘটেছে আধুনিক টেলিভিশন এবং রাডার যোগাযোগের ক্ষেত্রে। আর মার্কনি আধুনিক ছোট বা শর্ট তরঙ্গ মাপের বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে দূরে বেতার সংকেত পাঠাতে সফল হয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতি হল রেডিও। জগদীশ চন্দ্র বসুর আশ্চর্য আবিষ্কার দেখে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেন, জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রত্যেকটি আবিষ্কার বিজ্ঞান জগতে একটি বিজয়স্তম্ভ।

৩.
প্রথম সফলকাম বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (জন্ম : ৩০ নভেম্বর, ১৮৫৮- প্রয়াণ : ২৩ নভেম্বর, ১৯৩৭) শুধু বিজ্ঞানী নন, ছিলেন সাহিত্যিকও। ঋষির মতো জীবনযাপন করেছেন তিনি। তাঁর গবেষণার প্রধান দিক ছিল উদ্ভিদ ও তড়িৎ চৌম্বক। প্রথম জীবনে তড়িৎ চৌম্বকের ওপর ব্যাপক গবেষণা এবং জীবনের শেষভাগ তাঁর কাটে উদ্ভিদের প্রাণ ও অনুভূতির ওপর। তিনি বেতার বিজ্ঞানের পথ দেখিয়েছিলেন। উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে, সে আবিষ্কর্তাও তিনি। আবার প্রথম বাংলা সায়েন্স ফিকশনেরও লেখক তিনি। তাঁর প্রথম ফিকশন গল্পের নাম ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী।’ আর গল্পগ্রন্থের নাম ‘অব্যক্ত।’ বিজ্ঞান ও সাহিত্য জ্ঞানের সঙ্গে রসের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তিনি। পুরো জীবন কাটিয়েছেন গবেষণায়। তাঁর দেখানো গবেষণার পথ ধরে বিশ্বের বিজ্ঞান আজ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে আর সেভাবে স্মরিত হতে দেখি না আমরা। ছিলেন না মোটেও বিষয়ী। বৈষয়িক লোভ-লালসা-মোহ তাঁকে কাবু করেনি এবং বিষয়ী প্রয়োজনও গুরুত্ব পায়নি তেমন। কারণ বিষয়ের ফাঁদে পা দিতে চাননি। অর্থ, বিত্ত, লোভ, মোহের কাছে নত হননি বলেই তাঁর আবিষ্কার অবলম্বন করে অন্যরা বেসাত গড়েছে। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর আক্ষেপ ছিল না। আধুনিক বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি প্রমাণ রেখেছেন, বাঙালিরাও বিজ্ঞানচর্চা এবং গবেষণায় বৈশ্বিক অবদান রাখতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিহিত করেছিলেন ভারতবর্ষের লজ্জা দূর করার জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত অস্ত্র হিসেবে। কবিগুরু লিখছেন, ‘তিনি সম্প্রতি নিঃস্বার্থ জ্ঞানপ্রচারের জন্য তাঁহার দ্বারে আগত প্রচুর ঐশ্বর্য-প্রলোভনকে অবজ্ঞাসহকারে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন, সে সংবাদ আমরা অবগত হইয়াছি, কিন্তু সে সংবাদ প্রকাশ করিবার অধিকার, আমাদের আছে না আছে, দ্বিধা করিয়া আমরা মৌন রহিলাম। অতএব এই প্রলোভনহীন পণ্ডিত জ্ঞানস্পৃহাকেই সর্বোচ্চ রাখিয়া জ্ঞানে, সাধনায়, কর্মে, এই হতচারিত্র হতভাগ্য দেশের গুরু ও আদর্শস্থানীয় হইবেন, ইহাই আমরা একান্তমনে কামনা করি।’ আর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তো বলেছেনই, “জগদীশ বসু বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য যতগুলো তথ্য দান করেছেন, তার যে কোনটির জন্য স্মৃতিস্তম্ভ স্খাপন করা উচিত।”

৪.
জগদীশচন্দ্র বসুর পরিচিতিটা আমাদের কাছে উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবেই বেশি। উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে তা সর্বপ্রথম তিনিই আবিষ্কার করেন। উদ্ভিদের প্রাণ ও সংবেদনশীলতা নিয়ে বেশ কাজ করেছিলেন বিক্রমপুরের এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী। উদ্ভিদও যে উদ্দীপনায় সাড়া দেয়-এ তথ্য তার আগে কেউ উপলব্ধি করেননি, প্রমাণ করতে পারেননি। তাই পদার্থবিজ্ঞানে তার অনস্বীকার্য মৌলিক অবদান থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু আমাদের কাছে উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবেই বেশি পরিচিত। বলা বাহুল্য, উদ্ভিদ গবেষণায়ও তিনি পদার্থবিদ্যা প্রয়োগ করেছিলেন! জগদীশচন্দ্র বসু হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম বায়োফিজিসিস্ট। তিনি উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কে গবেষণা করেছেন পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ ঘটিয়ে। তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং দেশীয় উপাদানে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে একটা বৈদ্যুতিক সংবেদনশীল যন্ত্রের মডেল তৈরি করেন যা অনেকটা কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের মতো। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও সংবেদনশীলতা মাপতে ব্যবহৃত হয় এ যন্ত্র।

৫.
জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণাকাল তিন পর্যায়ে বিভক্ত: প্রথম পর্যায় ১৮৯৫-৯৯ সাল, দ্বিতীয় পর্যায় : ১৯০০-১৯০২ সাল এবং তৃতীয় পর্যায় : ১৯০৩-৩২ সাল। তার পর্যায়ভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্র ছিল : বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, জৈব ও অজৈব পদার্থের উত্তেজনার প্রতি সাড়া প্রদানের ক্ষমতা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর পেশির তুলনামূলক শারীরবৃত্ত। ১৯১৬ সালে তিনি অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর দু’বছরের মধ্যে (১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর) তিনি ‘জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞানমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেই বিজ্ঞানমন্দিরে গবেষণা পরিচালনা করেন। বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্রের সফলতার কথা সর্বজন স্বীকৃত। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে।

৬.
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর গভীর বন্ধুত্বের, প্রগাঢ় আন্তরিকতার নানা পরিচয় আমরা পাই। তাঁরা পরস্পরের কাজের ক্ষেত্রে ছিলেন আস্থাশীল, সহায়কও। ‘জগদীশচন্দ্র বসু’ স্মৃতিরচনায় রবীন্দ্রনাথ অকপটে লিখছেন, ‘ছেলেবেলা থেকে আমি নিঃসঙ্গ, সমাজের বাইরে পারিবারিক অবরোধের কোণে কোণে আমার দিন কেটেছে। আমার জীবনে প্রথম বন্ধুত্ব জগদীশের সঙ্গে। আমার চিরাভ্যস্ত কোণ থেকে তিনি আমাকে টেনে বের করেছিলেন যেমন করে শরতের শিশিরস্নিগ্ধ সূর্যোদয়ের মহিমা চিরদিন আমাকে শোবার ঘর থেকে ছুটিয়ে বাইরে এনেছে। তাঁর মধ্যে সহজেই একটি ঐশ্বর্য দেখেছিলুম। অধিকাংশ মানুষেরই যতটুকু গোচর তার বেশি আর ব্যঞ্জনা নেই, অর্থাৎ মাটির প্রদীপ দেখা যায়, আলো দেখা যায় না। আমার বন্ধুর মধ্যে আলো দেখেছিলুম। আমি গর্ব করি এই যে, প্রমাণের পূর্বেই আমার অনুমান সত্য হয়েছিল। প্রত্যক্ষ হিসাব গণনা করে যে শ্রদ্ধা, তাঁর সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধা সে জাতের ছিল না। আমার অনুভূতি ছিল তার চেয়ে প্রত্যক্ষতর; বর্তমানের সাক্ষ্যটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ করে ভবিষ্যৎকে সে খর্ব করে দেখে নি। এই চিঠিগুলির মধ্যে তারই ইতিহাস পাওয়া যাবে, আর যদি কোনো দিন এরই উত্তরে প্রত্যুত্তরে আমার চিঠিগুলিও পাওয়া যায়, তা হলে এই ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারবে।’ (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩)

৭.
আবার, ‘আচার্য জগদীশের জয়বার্তা ’ রচনায় রবীন্দ্রাথ বলছেন, ‘নিজের প্রতি শ্রদ্ধা মনের মাংসপেশী। তাহা মনকে ঊর্ধ্বে খাড়া করিয়া রাখে এবং কর্মের প্রতি চালনা করে। যে জাতি নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হারাইতে বসে, সে চলৎশক্তিরহিত হইয়া পড়ে।… আচার্য জগদীশ আমাদিগকে দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন। তিনি বিজ্ঞান-রাজ্যে যে পথের সন্ধান পাইয়াছেন, সে পথ প্রাচীন ঋষিদিগের পথ-- তাহা একের পথ। কি জ্ঞানে বিজ্ঞানে, কি ধর্মে কর্মে, সেই পথ ব্যতীত "নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।' … কিন্তু আচার্য জগদীশ যে কর্মে হাত দিয়াছেন, তাহা শেষ করিতে তাঁহার বিলম্ব আছে। বাধাও বিস্তর। প্রথমত, আচার্যের নূতন সিদ্ধান্ত ও পরীক্ষার দ্বারা অনেকগুলি পেটেন্ট অকর্মণ্য হইয়া যাইবে এবং একদল বণিকসম্প্রদায় তাঁহার প্রতিকূল হইবে। দ্বিতীয়ত, জীবতত্ত্ববিদগণ জীবনকে একটা স্বতন্ত্র শ্রেষ্ঠ ব্যাপার বলিয়া জানেন, তাঁহাদের বিজ্ঞান যে কেবলমাত্র পদার্থতত্ত্ব, এ কথা তাঁহারা কোনোমতেই স্বীকার করিতে চাহেন না। তৃতীয়ত, কোনো কোনো মূঢ় লোকে মনে করেন যে, বিজ্ঞানদ্বারা জীবনতত্ত্ব বাহির হইলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করিবার প্রয়োজন থাকে না, তাঁহারা পুলকিত হইয়াছেন। তাঁহাদের ভাবগতিক দেখিয়া খৃস্টান বৈজ্ঞানিকেরা তটস্থ, এজন্য অধ্যাপক কোনো কোনো বৈজ্ঞানিকের সহানুভূতি হইতে বঞ্চিত হইবেন। সুতরাং একাকী তাঁহাকে অনেক বিপক্ষের সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে। … কেবল অবসরের অভাবকে তেমন ভয় করি না। এখানে সর্বপ্রকার আনুকূল্যের অভাব। আচার্য জগদীশ কী করিতেছেন, আমরা তাহা ঠিক বুঝিতেও পারি না। এবং দুর্গতিপ্রাপ্ত জাতির স্বাভাবিক ক্ষুদ্রতাবশত আমরা বড়োকে বড়ো বলিয়া শ্রদ্ধা করিতে পারি না, শ্রদ্ধা করিতে চাহি-ও না। আমাদের শিক্ষা, সামর্থ্য, অধিকার যেমনই থাক্, আমাদের স্পর্ধার অন্ত নাই। ঈশ্বর যে-সকল মহাত্মাকে এ দেশে কাজ করিতে পাঠান, তাহারা যেন বাংলা গবর্মেন্টের নোয়াখালি-জেলায় কার্যভার প্রাপ্ত হয়। সাহায্য নাই, শ্রদ্ধা নাই, প্রীতি নাই-- চিত্তের সঙ্গ নাই, স্বাস্থ্য নাই, জনশূন্য মরুভূমিও ইহা অপেক্ষা কাজের পক্ষে অনুকূল স্থান; এই তো স্বদেশের লোক-- এদেশীয় ইংরাজের কথা কিছু বলিতে চাহি না। এ ছাড়া যন্ত্র-গ্রন্থ, সর্বদা বিজ্ঞানের আলোচনা ও পরীক্ষা ভারতবর্ষে সুলভ নহে।’ (বঙ্গদর্শন, আষাঢ়, ১৩০৮)।

৮.
পদার্থবিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ইংরেজ সরকারের একজন ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। বসু পরিবারের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল নামক গ্রামে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ট্যাক্স কালেক্টর এবং পরবর্তীতে ম্যাজিস্ট্রেট পিতা ভগবানচন্দ্র বসুর সঙ্গে চাকরি সূত্রে বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন বাল্যকালে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশেছেন, মিলিয়েছেন নিজেকে।

৯.
জগদীশচন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষার সূত্রপাত হয় ফরিদপুর জেলার একটি গ্রাম্য বিদ্যালয়ে। এ সময় বাংলার লোক অভিনয়, যাত্রা-পালাগান এবং রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী এবং চরিত্রগুলি সম্পর্কে তাঁর গভীর আগ্রহ জাগে। তাঁর এগার বৎসর বয়সে বসু পরিবার কলকাতায় চলে যায়। সেখানে তিনি প্রথমে হেয়ার স্কুলে, পরে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে অধ্যয়ন করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে ১৮৭৫ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। ১৮৭৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময়েই তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত রচিত হয়। রেভারেন্ড ফাদার লাফোন্ট (Rev Father Lafont)-এর উৎসাহে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। লাফোন্টের উদ্যোগে তাঁকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় এবং পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তবে প্রথমে তিনি এক বৎসর চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে ট্রাইপজ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। প্রায় একই সময়ে ১৮৮৪ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন। 

১০.
১৮৮৫ সালে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর জগদীশচন্দ্র বসু কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অস্থায়ী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। কিন্তু একে তো এটি ছিল অস্থায়ী তার উপর ভারতীয় হওয়ায় সেখানে তার বেতন নির্ধারণ করা হল ইউরোপীয় অধ্যাপকদের বেতনের অর্ধেক। এই অন্যায় বৈষম্যের প্রতিবাদ করে, দীর্ঘকাল তিনি কোন বেতন না নিয়েই শিক্ষকতা করে যান এবং অনেক ইংরেজ অধ্যাপকদের থেকে অধিক দক্ষতা প্রদর্শনে সমর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার তার কাছে নতি স্বীকার করেন। তার তিন বছরের বকেয়া মাইনে পরিশোধ করে দেয়া হয় এবং এর সাথে তার চাকুরিটিও স্থায়ী হয়ে যায়। তখন থেকেই ইউরোপীয় ও ভারতীয় অধ্যাপকদের বেতনের বৈষম্য দূরীভূত হয়। ইউরোপীয় শিক্ষকদের অনেকেই মনে করতেন ভারতীয়রা বিজ্ঞান শিক্ষাদান এবং গবেষণা কাজের উপযুক্ত নয়। এখানেই তাঁর শিক্ষক এবং যথার্থ অনুসন্ধানী গবেষকের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জীবনের সূত্রপাত ঘটে, তাঁর গবেষণার সূত্রপাতও এখান থেকেই। তাঁর মহান বৈজ্ঞানিক গবেষণাসমূহের সূতিকাগার এই কলেজেই। এখান থেকেই জগদীশ চন্দ্র ‘বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুতে’ রূপান্তরিত হন।
 
১১.
১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা অবলার বিবাহ হয়। তিনি ছিলেন একজন ডাক্তার। তিনি একজন সমাজকর্মী ছিলেন।

১২.
জগদীশচন্দ্র ১৮৯৪ সালের দিকে ব্যাপকভাবে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। বিদ্যুৎতরঙ্গের আলোকধর্মী প্রবণতার মধ্যে প্রতিফলন, প্রতিসরণ, সর্বমোট প্রতিফলন, সমবর্তী বিচ্ছুরণ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি গবেষণা পরিচালনা করেন। আকাশ-তরঙ্গ ও বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে জগদীশচন্দ্র বেতার বার্তার সূত্র আবিষ্কার করেন। বিনাতারে শব্দ প্রেরণের ‘ক্রিস্ট্যাল রিসিভার’ নামক যে বেতার যন্ত্রটি তিনি আবিষ্কার করেন তার সাহায্যে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত তাঁর বাসভবনে সাংকেতিক শব্দ প্রেরণ করতে সক্ষম হন।এ ছাড়া তিনি নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে অদৃশ্য-আলোকেও দৃশ্য-আলোকের সকল ধর্ম বর্তমান। 

১৩.
তাঁর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল বিশ্বের প্রধান বিজ্ঞান সাময়িকীগুলিতে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে দি ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি, জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এবং দ্য ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন এর মতো বিখ্যাত সাময়িকী ও জার্নালগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সকল গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করেই ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.এসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ক্ষুদ্র শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি সম্পর্কিত তাঁর গবেষণা থেকে আধুনিক তরঙ্গপথের ধারণার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁর পরিচালিত গবেষণা ও আবিষ্কৃত যন্ত্রসমূহের সঙ্গে রাডার প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ের যন্ত্রসমূহের ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে। 

১৪.
১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত সময়ব্যাপী জগদীশ বসু জীব ও জড়ের উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণায় ব্যাপৃত থাকেন। বৈদ্যুতিক তরঙ্গ গ্রহণকারী বা ‘কোহেরারস’ (coherers)-এর কার্যকারিতা কমে যাওয়া আবার কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর কার্যকর হওয়া সম্পর্কিত পূর্ববর্তী গবেষণাগুলির গভীর পর্যবেক্ষণ তাঁকে নতুন করে এ ক্ষেত্রটি সম্পর্কে খুবই উৎসাহী করে তুলেছিল। ওয়ালার-এর তত্ত্বের প্রতিবিধান অনুসারে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার সামর্থ্যকে প্রাণশক্তি উন্মেষের বিশ্বজনীন চিহ্ন হিসেবে পরিগণিত করা যেতে পারে। বসু পরীক্ষার মাধ্যমে প্রদর্শন করেন যে, জীব ও জড় বস্ত্তর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ তাদের আণবিক গঠনে একই রূপ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এ ধরনের কিছু ধারাবাহিক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে প্রাণীদেহ এবং শাকসবজির কোষকলাসমূহ বৈদ্যুতিক ক্রিয়া দ্বারা উদ্দীপ্ত হয় ও সাড়া দেয়। এ ছাড়া তাপ, ঔষধ, রাসায়নিক দ্রব্য এবং যান্ত্রিক চাপেও একইভাবে এরা উদ্দীপ্ত হয়। তিনি আরও দেখিয়েছেন, একইভাবে নির্দিষ্ট কিছু অজৈব পদার্থেও সমরূপ উদ্দীপনা ঘটানো যেতে পারে। তাঁর এ গবেষণাকর্ম বিখ্যাত বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি সাময়িকীটিতে ‘জীব ও জড়ের সাড়া দেয়ার শক্তি’ (Response in the Living and Non-Living) শিরোনামে তাঁর এ সংক্রান্ত সকল লেখা সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয়।

১৫.
উদ্ভিদ জগতের সংবেদনশীলতা বিষয়ক গবেষণার পর জগদীশচন্দ্র আত্মনিয়োগ করেন প্রাণ-পদার্থবিদ্যা এবং উদ্ভিদ-শরীরতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায়। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর পদার্থবিদসুলভ গভীর দৃষ্টি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দক্ষতার কার্যকরী প্রয়োগ ঘটান। তিনি কিছুসংখ্যক অজৈব পদার্থের মডেল তৈরি করেন যা প্রাণী ও উদ্ভিদের কোষকলাসমূহের মতো নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি সমরূপ সাড়া প্রদান করে। এধরনের একটি মডেল তৈরি করা হয় নরম লৌহদন্ডের উপর তার পেঁচিয়ে, একটি বিদ্যুৎপ্রবাহ উৎস এবং একটি গ্যালভানোমিটার সংযুক্ত করে। প্রাণীর স্নায়ুতে পরিচালনের ফলে সৃষ্ট আন্দোলন গ্যালভানোমিটার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। জগদীশ বসু উদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্রের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যন্ত্রটির নাম ক্রেসকোগ্রাফ। এটি সামান্য নড়াচড়াকে ১ কোটি গুণ বিবর্ধিত করতে পারে। পরিবাহিতা পরিমাপক, ট্রান্সপিরোগ্রাফ, ফটোসিনথেটিক গ্রাহক এবং চৌম্বক রেডিওমিটার তাঁর উদ্ভাবিত অন্যান্য যন্ত্র। জগদীশচন্দ্রের বিস্ময়কর কর্মউন্মাদনা এবং একাগ্রচিত্ত বিজ্ঞান সাধনার ফলেই এসব গবেষণা কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯০৮ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অসংখ্য গবেষণা প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ রচনা করেন।
 
১৬.
জগদীশচন্দ্র বসু ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি এমিরিটাস প্রফেসর পদ লাভ করেন। ১৯১৭ সালে উদ্ভিদ-শরীরতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি কলকাতায় ‘‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এখানে উদ্ভিদ ও কৃষি রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণার জন্য উল্লিখিত বিষয়সমূহের বিভাগ খোলা হয়। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র আমৃত্যু এখানে গবেষণাকার্য পরিচালনা করেন। 

১৭.
জগদীশচন্দ্র ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানকার বিদগ্ধ বিজ্ঞানীদের নিকট তিনি তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল তুলে ধরেন। এসময়ে কিছুকাল (১৯০০-১৯০২) তিনি লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। ১৯১৬ সালে জগদীশচন্দ্র বসু ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯২০ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের ফেলো নির্বাচিত হন এবং ১৯২৮ সালে ভিয়েনা একাডেমী অব সায়েন্সের করেসপন্ডিং সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বিজ্ঞান সমিতির সম্মানিত সদস্য ছিলেন। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১৯২৭ কার্যবর্ষে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ঐ সময়ে লীগ অব নেশন্স-এর বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যার বর্তমান নাম ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমী। তিনি কিছুকাল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। 

১৮.
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধাবলী অব্যক্ত নামক গ্রন্থে সংকলিত। তাঁর ইংরেজি রচনাবলি হচ্ছে: Responses in the Living and Non-living (1902), Plant Responses as a Means of Physiological Investigations (1906), Comparative Electrophysiology (1907), Physiology of the Asent of Sap (1923), Physiology of Photosynthesis (1924), Nervous Mechanism of Plants (1925), Collected Physical Papers (1927), Motor Mechanism of Plants (1928), Growth and Tropic Movement in Plants (1929)। 
১৯.
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ বিজ্ঞানী তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন শেষে ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর গিরিডিতে মৃত্যুবরণ করেন।

২০. 
‘জগদীশচন্দ্র’ স্মৃতিচারণায় কবিগুরু লিখছেন, ‘তরুণ বয়সে জগদীশচন্দ্র যখন কীর্তির দুর্গম পথে সংসারে অপরিচিতরূপে প্রথম যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন, যখন পদে পদে নানা বাধা তাঁর গতিকে ব্যাহত করছিল, সেইসময়ে আমি তাঁর ভাবী সাফল্যের প্রতি নিঃসংশয়ে শ্রদ্ধাদৃষ্টি রেখে বারে বারে গদ্যে পদ্যে তাঁকে যেমন করে অভিনন্দন জানিয়েছি, জয়লাভের পূর্বেই তাঁর জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছি, আজ চিরবিচ্ছেদের দিনে তেমন প্রবল কণ্ঠে তাঁকে সম্মান নিবেদন করতে পারি সে শক্তি আমার নেই। আর কিছু দিন আগেই অজানা লোকে আমার ডাক পড়েছিল। ফিরে এসেছি। কিন্তু সেখানকার কুহেলিকা এখনো আমার শরীর-মনকে ঘিরে রয়েছে। মনে হচ্ছে, আমাকে তিনি তাঁর অন্তিমপথের আসন্ন অনুবর্তন নির্দেশ করে গেছেন। সেই পথযাত্রী আমার পক্ষে আমার বয়সে শোকের অবকাশ দীর্ঘ হতে পারে না। শোক দেশের হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের সাধনায় যিনি তাঁর কৃতিত্ব অসমাপ্ত রেখে যান নি, বিদায় নেওয়ার দ্বারা তিনি দেশকে বঞ্চিত করতে পারেন না। যা অজর যা অমর তা রইল। শারীরিক বিচ্ছেদের আঘাতে সেই সম্পদের উপলব্ধি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, যেখানে তিনি সত্য সেখানে তাঁকে বেশি করে পাওয়ার সুযোগ ঘটবে। বন্ধুরূপে আমার যা কাজ সে আমার যখন শক্তি ছিল তখন করতে ত্রুটি করি নি। কবিরূপে আমার যা কর্তব্য সেও আমার পূর্ণ সামর্থ্যের সময় প্রায় নিঃশেষ ক'রে দিয়েছি-- তাঁর স্মৃতি আমার রচনায় কীর্তিত হয়েই রয়েছে।

২০.২
বিজ্ঞান ও রসসাহিত্যের প্রকোষ্ঠ সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন মহলে, কিন্তু তাদের মধ্যে যাওয়া-আসার দেনা-পাওনার পথ আছে। জগদীশ ছিলেন সেই পথের পথিক। সেইজন্যে বিজ্ঞানী ও কবির মিলনের উপকরণ দুই মহল থেকেই জুটত। আমার অনুশীলনের মধ্যে বিজ্ঞানের অংশ বেশি ছিল না, কিন্তু ছিল তা আমার প্রবৃত্তির মধ্যে। সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর ছিল অনুরূপ অবস্থা। সেইজন্যে আমাদের বন্ধুত্বের কক্ষে হাওয়া চলত দুই দিকের দুই খোলা জানলা দিয়ে। তাঁর কাছে আর-একটা ছিল আমার মিলনের অবকাশ যেখানে ছিল তাঁর অতি নিবিড় দেশপ্রীতি।

২০.৩
প্রাণ পদার্থ থাকে জড়ের গুপ্ত কুঠুরিতে গা ঢাকা দিয়ে। এই বার্তাকে জগদীশ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পাকা করে গেঁথে দেবেন, এই প্রত্যাশা তখন আমার মনের মধ্যে উন্মাদনা জাগিয়ে দিয়েছিল-- কেননা ছেলেবেলা থেকেই আমি এই ঋষিবাক্যের সঙ্গে পরিচিত-- "যদিদং কিঞ্চ জগৎ, প্রাণ এজতি নিঃসৃতং', "এই যা-কিছু জগৎ,যা-কিছু চলছে, তা প্রাণ থেকে নিঃসৃত হয়ে প্রাণেই কম্পমান।' সেই কম্পনের কথা আজও বিজ্ঞানে বলছে। কিন্তু সেই স্পন্দন যে প্রাণস্পন্দনের সঙ্গে এক, এ কথা বিজ্ঞানের প্রমাণভাণ্ডারের মধ্যে জমা হয় নি। সেদিন মনে হয়েছিল আর বুঝি দেরি নেই।

২০.৪ 
তার পরে জগদীশ সরিয়ে আনলেন তাঁর পরীক্ষাগার জড়রাজ্য থেকে উদ্ভিদরাজ্যে, যেখানে প্রাণের লীলায় সংশয় নেই। অধ্যাপকের যন্ত্র-উদ্ভাবনী শক্তি ছিল অসাধারণ। উদ্ভিদের অন্দরমহলে ঢুকে গুপ্তচরের কাজে সেই-সব যন্ত্র আশ্চর্য নৈপুণ্য দেখাতে লাগল। তাদের কাছ থেকে নতুন নতুন খবরের প্রত্যাশায় অধ্যাপক সর্বদা উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকতেন। এ পথে তাঁর সহযোগিতার উপযুক্ত বিদ্যা আমার না থাকলেও তবুও আমার অশিক্ষিত কল্পনার অত্যুৎসাহে তিনি বোধ হয় সকৌতুক আনন্দ বোধ করতেন। কাছাকাছি সমজদারের আনাগোনা ছিল না; তাই আনাড়ি দরদীর অত্যুক্তিমুখর ঔৎসুক্যেও সেদিন তাঁর প্রয়োজন ছিল। সুহৃদের প্রত্যাশাপূর্ণ শ্রদ্ধার মূল্য যাই থাক্, গম্যস্থানের উজান পথে এগিয়ে দেবার কিছু-না-কিছু পালের হাওয়া সে জুগিয়ে থাকে। সকল বাধার উপরে তিনি যে জয়লাভ করবেনই, এই বিশ্বাস আমার মধ্যে ছিল অক্ষুণ্ন। নিজের শক্তির 'পরে তাঁর নিজের যে শ্রদ্ধা ছিল, আমার শ্রদ্ধার আবেগ তাতে অনুরণন জাগাত সন্দেহ নেই।

২০.৫
এই গেল আদিকাণ্ড। তার পরে আচার্য তাঁর পরীক্ষালব্ধ তত্ত্ব ও সহধর্মিণীকে নিয়ে সমুদ্রপারের উদ্যোগে প্রবৃত্ত হলেন। স্বদেশের প্রতিভা বিদেশের প্রতিভাশালীদের কাছ থেকে গৌরব লাভ করবে, এই আগ্রহে দিন রাত্রি আমার হৃদয় ছিল উৎফুল্ল। এই সময় যখন জানতে পারলুম যাত্রার পাথেয় সম্পূর্ণ হয় নি, তখন আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুললে। সাধনার আয়োজনে অর্থাভাবের শোচনীয়তা যে কত কঠোর, সে কথা দুঃসহভাবেই তখন আমার জানা ছিল। জগদীশের জয়যাত্রায় এই অভাব লেশমাত্রও পাছে বিঘ্ন ঘটায়, এই উদ্বেগ আমাকে আক্রমণ করলে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার নিজের সামর্থ্যে তখন লেগেছে পুরো ভাঁটা। লম্বা লম্বা ঋণের গুণ টেনে আভূমি নত হয়ে চালাতে হচ্ছিল আমার আপন কর্মতরী। অগত্যা সেই দুঃসময়ে আমার একজন বন্ধুর স্মরণ নিতে হল। সেই মহদাশয় ব্যক্তির ঔদার্য স্মরণীয় বলে জানি। সেইজন্যেই এই প্রসঙ্গে তাঁর নাম সম্মানের সঙ্গে উল্লেখ করা আমি কর্তব্য মনে করি। তিনি ত্রিপুরার পরলোকগত মহারাজা রাধাকিশোর দেবমাণিক্য। আমার প্রতি তাঁর প্রভূত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা চিরদিন আমার কাছে বিস্ময়ের বিষয় হয়ে আছে। ঠিক সেই সময়টাতে তাঁর পুত্রের বিবাহের উদ্যোগ চলছিল। আমি তাঁকে জানালুম শুভ অনুষ্ঠানের উপলক্ষে আমি দানের প্রার্থী, সে দানের প্রয়োগ হবে পুণ্যকর্মে। বিষয়টা কী শুনে তিনি ঈষৎ হেসে বললেন, "জগদীশচন্দ্র এবং তাঁর কৃতিত্ব সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছুই জানি নে, আমি যা দেব, সে আপনাকেই দেব, আপনি তা নিয়ে কী করবেন আমার জানবার দরকার নেই।' আমার হাতে দিলেন পনেরো হাজার টাকার চেক। সেই টাকা আমি আচার্যের পাথেয়ের অন্তর্গত করে দিয়েছি। সেদিন আমার অসামর্থ্যের সময় যে বন্ধুকৃত্য করতে পেরেছিলুম, সে আর-এক বন্ধুর প্রসাদে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগ পাশ্চাত্য মহাদেশকে আশ্রয় করেই দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে, সেখানকার দীপালিতে ভারতবাসী এই প্রথম ভারতের দীপশিখা উৎসর্গ করতে পেরেছেন, এবং সেখানে তা স্বীকৃত হয়েছে। এই গৌরবের পথ সুগম করবার সামান্য একটু দাবিও মহারাজ নিজে না রেখে আমাকেই দিয়েছিলেন, সেই কথা স্মরণ করে সেই উদারচেতা বন্ধুর উদ্দেশে আমার সুগভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

২০.৬
তার পর থেকে জগদীশচন্দ্রের যশ ও সিদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়ে দূরে প্রসারিত হতে লাগল, এ কথা সকলেরই জানা আছে। ইতিমধ্যে কোনো উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী তাঁর কীর্তিতে আকৃষ্ট হলেন, সহজেই ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তাঁর পরীক্ষা-কাননের প্রতিষ্ঠা হল, এবং অবশেষে ঐশ্বর্যশালী বসুবিজ্ঞানমন্দির স্থাপনা সম্ভবপর হতে পারল। তাঁর চরিত্রে সংকল্পের যে একটি সুদৃঢ় শক্তি ছিল, তার দ্বারা তিনি অসাধ্য সাধন করেছিলেন। কোনো একক ব্যক্তি আপন কাজে রাজকোষ বা দেশীয় ধনীদের কাছ থেকে এত অজস্র অর্থসাহায্য বোধ করি ভারতবর্ষে আর কখনো পায় নি, তাঁর কর্মারম্ভের ক্ষণস্থায়ী টানাটানি পার হবামাত্রই লক্ষ্মী এগিয়ে এসে তাঁকে বরদান করেছেন এবং শেষপর্যন্তই আপন লোকবিখ্যাত চাপল্য প্রকাশ করেন নি। লক্ষ্মীর পদ্মকে লোকে সোনার পদ্ম বলে থাকে। কিন্তু কাঠিন্য বিচার করলে তাকে লোহার পদ্ম বলাই সংগত। সেই লোহার আসনকে জগদীশ আপনার দিকে যে এত অনায়সে টেনে আনতে পেরেছিলেন, সে তাঁর বৈয়ক্তিক চৌম্বকশক্তি, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে পার্সোনাল ম্যাগনেটিজ্ম্, তারই গুণে।

২০.৭ 
এই সময়ে তাঁর কাজে ও রচনায় উৎসাহদাত্রীরূপে মূল্যবান সহায় তিনি পেয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে। জগদীশচন্দ্রের জীবনের ইতিহাসে এই মহনীয়া নারীর নাম সম্মানের সঙ্গে রক্ষার যোগ্য। তখন থেকে তাঁর কর্মজীবন সমস্ত বাহ্য বাধা অতিক্রম করে পরিব্যপ্ত হল বিশ্বভূমিকায়। এখানকার সার্থকতার ইতিহাস আমার আয়ত্তের অতীত। এদিকে আমার পক্ষে সময় এল যখন থেকে আমার নির্মম কর্মক্ষেত্রের ক্ষুদ্র সীমায় রোদে বাদলে মাটিভাঙা আলবাঁধার কাজে আমি একলা ঠেকে গেলুম। তার সাধনকৃচ্ছ্রতায় আত্মীয়বন্ধুদের থেকে আমার চেষ্টাকে ও সময়কে নিল দূরে টেনে। (প্রবাসী, পৌষ, ১৩৪৪)।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, অনুশীলন, রবীন্দ্র রচনাবলী, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত