সুচিত্রা সেন

প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:০৭

১.
সুচিত্রা সেনকে আমার না ভালোবেসে উপায় আছে? নাই, নাই, একদমই নাই। তিনি তো কেবল চিরকালের মহানায়িকাই নন, আমার পরম স্বজনও তো বটে! জন্মসূত্রে আমাদের পাবনার সন্তান না তিনি? জন্মসূত্রে তিনি তো আমার স্বজন, আপনজনই। স্বপ্নলোকের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি অচেনালোকে চলে যান স্মৃতিচিহ্ন রেখে। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, সুচিত্রা সেন ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতার কারণে আমাদের মানসপটের মানসী হয়ে বিরাজ করে তবে সেটা শুধু কল্পনায়, সে তো নাটোরে বনলতা সেন। কিন্তু বাংলা কবিতার এই চিরায়ত নায়িকার মতো বাংলা ছবির দর্শকের কাছে যিনি চিরদিনই রোমান্টিকতার প্রতীক তিনি সুচিত্রা সেন। আর অভিনয়ের অসাধারণ পটুত্বের কথা নাই-ই বা বললাম। কারণ সুচিত্রা সেন নামটি উচ্চারিত হলেই একজন আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের প্রবল আত্মবিশ্বাসী রোমান্টিক নায়িকার ছবিই ভেসে ওঠে আমার মতোন আর সকলের মনের ক্যানভাসে, সবার চোখে। নিজেকে আড়াল করে রেখে ভালোই করেছিলেন সুচিত্রা সেন। স্বাপ্নিক মানুষের চোখের সামনে তিনি বুড়িয়ে যাননি আর। সেই যে নিজেকে আড়াল করলেন, আর স্থির হয়ে গেলেন একটি বয়সে এসে-এর পরও বাঁচলেন অনেক দিন, কিন্তু ছবির মতোই জনমানসে থেকে গেলেন রোমান্টিক নায়িকা হয়েই। জয়তু হে মহাদেবি, মহানায়িকা। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, সুচিত্রা সেনের প্রতি স্বজনপ্রীতির কারণে আমাদের ভাসানটেক সরকারি কলেজে সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র সংসদও গড়ে তুলেছি আমরা গত বছর।তাঁর অভিনীত ‘সপ্তপদী’ সিনেমাও আমরা দেখেছি, সুচিত্রা সেনের ছবি ছাপানো টি শার্টও আমরা সংঘবদ্ধভাবে পরিধান করেছি সেদিন।

২.
সুচিত্রা সেন ১০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি অন্তরাল থেকে অদৃশ্য জগতে চিরকালের তরে চলে যান অপার রহস্যময়তার কুয়াশার চাদর মেখে। দীর্ঘ ২৫ দিন লড়াই করে সেদিন সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সুচিত্রা। আর সেই সঙ্গে ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের এক সোনালি যুগের অবসান ঘটে। না, মৃত্যুর পরও তাঁর মুখ দেখা গেল না। অদেখাই রয়ে গেলেন তিনি। কলকাতার বেল ভিউ ক্লিনিক, তাঁর বালিগঞ্জের বাড়ি কিংবা কেওড়াতলা শ্মশানঘাটের সামনে জড়ো হওয়া উৎসুকমানুষ দেখতে পেল না প্রিয় মহানায়িকার মুখ। সুচিত্রা সেন রুপালি জগৎ ছেড়েছেন ১৯৭৮ সালে। শেষবারের মতো লোকসমক্ষে এসেছিলেন ১৯৮৯-তে। তারপর সেই যে স্বেচ্ছানির্বাসনে গেলেন, আর কখনোই কেউ তাঁকে দেখেনি-মুনমুন, রাইমা, রিয়া আর অতি প্রয়োজনীয় কয়েকজন ছাড়া। নিজের চারদিকে গড়ে নেওয়া রহস্যময়তার ঘেরাটোপেই থাকলেন বছরের পর বছর। তারপর, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৪-ডেডস্টপ! মাত্র এক বছর আগে মৃত্যু হয়েছে তার। কিন্তু অন্তরালে তিনি ছিলেন বহুবছর। তাকে কখনও বৃদ্ধা বা প্রবীণার রূপে দেখেনি কেউ। তিনি যেন যৌবনের চিরন্তন প্রতিমা। সুচিত্রা সেনের নাম উচ্চারিত হলেই চোখে ভাসে তার মোহিনি হাসি, সজল দৃষ্টি ও রহস্যময় ভঙ্গিমা। তার চেয়েও প্রতিভাবান অভিনেত্রী বাংলা চলচ্চিত্রে ছিলেন কিন্তু পর্দায় তার চেয়ে রহস্যময়ী ও রোমান্টিক আর কেউ ছিলেন না। তাকে কখনও মনে হয়নি পাশের বাড়ির সহজ সাধারণ মেয়েটি, বরং সর্বদাই তিনি ছিলেন অধরা নারীর প্রতীক।

৩.
সুচিত্রা সেন, সবার মনে হলো রোমান্টিক মহানায়িকার মহাপ্রস্থান ঘটল, সুদূর অতীতে পর্দা মাতানো কোনো অভিনেত্রীর মৃত্যু এটা নয়। কয়েক যুগ ধরে এক-একটি প্রজন্ম একজন সুশ্রী, অভিনয়ে পারদর্শী প্রবল ব্যক্তিত্বশালী একজন নায়িকাকেই চিনেছে। সুচিত্রা সেন তাঁর নাম। সুচিত্রা এখানেই অনন্য। রমা সেন যখন সুচিত্রা সেন হয়ে পর্দা কাঁপাতে শুরু করলেন, সেই থেকে শুরু। সেই থেকে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তর দশক বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ হয়ে রইল সুচিত্রাময়। এবং অবধারিতভাবেই উত্তমময়। সুচিত্রা-উত্তম জুটি বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনধারাই দিল পাল্টে। সেকালের প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা সদ্য বিবাহিত দম্পতি সেলুলয়েডের এই নায়ক-নায়িকাকে রাখলেন বুকের গভীরে লুকিয়ে। প্রবীণেরাও এই জুটির অভিনয়ের স্পর্শে নিজেদের অন্তরের গহিনে ফিরিয়ে আনলেন সোনালি অতীত। বাংলা চলচ্চিত্র এ রকম তুঙ্গস্পর্শী জুটি আর দেখেনি কখনো। 

৪.
১৯৫৩ সালে চলচ্চিত্রে পা রেখেছিলেন সুচিত্রা সেন। সে বছরই সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা জুটির শুরু। আরও কিছু ছবিতে অভিনয় করলেন তাঁরা। তবে ‘৫৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যখন সুচিত্রা-উত্তমের অগ্নিপরীক্ষা ছবিটি মুক্তি পেল, তখনই কেবল চলচ্চিত্র-পরীক্ষায় পুরো নম্বর পেয়ে উতরে গেলেন তাঁরা দুজন। বিভূতি লাহা, অগ্রদূত নামে যিনি পরিচিত, তিনি নিজেও কি ভাবতে পেরেছিলেন, উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম সুপারহিট ছবিটি নির্মাণ করছেন তিনি। এর পরের গল্প তো ইতিহাস। রোমান্টিক জুটি হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া সুচিত্রা-উত্তম এগিয়ে গেলেন শাপমোচন, সবার উপরে, সাগরিকা, শিল্পী, হারানো সুর, পথে হলো দেরী, সপ্তপদীর পথ ধরে। উত্তমকে ছাড়াও বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে দীপ জ্বেলে যাই, অশোক কুমারের সঙ্গে হসপিটাল কিংবা সৌমিত্রের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা করে সুচিত্রা বুঝিয়ে দিলেন, অভিনয়ের ক্যারিশমাটা জানা আছে তাঁর, শুধু উত্তম-সুচিত্রা রসায়নেই যা শেষ হওয়ার নয়। আর হিন্দিজগতে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, অশোক কুমার, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেও তো বুঝিয়ে দিলেন, তিনি চলচ্চিত্র জগতে আগন্তুক নন। টিকে থাকার জন্যই এসেছেন। সুচিত্রা সেন যখন পর্দায় তার ভুবনমোহিনি হাসি দিয়ে দর্শককে মোহিত করতেন তখন দর্শকের মনে হত এই নারী যেন ধুলো-কাদার বিশ্বের নয়। এ যেন ধরাছোঁয়ার বাইরের জগৎ থেকে আসা এক অধরা স্বপ্ন। তিনি যে চরিত্রগুলোতে অভিনয়ের জন্য খ্যাতি পেয়েছেন সেগুলোও যেন গড়পরতা চরিত্র থেকে একটু আলাদা। হয়তো কিছুটা অবাস্তবও। যেমন ‘সাগরিকা’ সিনেমার তরুণী সাগরিকা। পঞ্চাশের দশকে এক ধনী নারী, তদুপরি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী, বিশাল এক বাড়িতে একাই থাকেন। তিনি প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী। সেইসঙ্গে আবার প্রেমের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত।

৫.
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনায় তার জন্ম। তার পারিবারিক নাম রমা। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন পাবনা পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। মায়ের নাম ইন্দিরা দেবী। পাবনাতেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে ঢাকার অভিজাত পরিবারের সদস্য শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আদিনাথ সেনের বাবা দীননাথ সেনের নামে পুরনো ঢাকায় এখনও একটি সড়ক রয়েছে। ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতার চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করেন। ‘শেষ কোথায়’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রূপালি পর্দায় তার যাত্রা শুরু হলেও ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। ছবিটি ব্যবসা সফল হয়। তবে সেটি ছিল কমেডিনির্ভর ছবি এবং এর মূল আকর্ষণ ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিকে তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা হয়। এ ছবিতেই উত্তম- সুচিত্রা বাংলা সিনেমার ক্ল্যাসিক রোমান্টিক জুটিতে পরিণত হন। আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এ ছবিতেও সুচিত্রার চরিত্রটি ছিল গড়পড়তা বাঙালি নারীর চেয়ে ভিন্নতর। অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একের পর এক হিট সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকদের মহানায়িকায় পরিণত হন সুচিত্রা সেন।

৬.
সুচিত্রা সেন হয়ে যান ‘হারানো সুর’ সিনেমার ড. রমা। যিনি স্মৃতি হারানো রোগী উত্তম কুমারকে কলকাতা থেকে নিয়ে যান প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা পলাশপুরে। সেখানে চিকিৎসার জন্য তাকে বিয়ে করেন। আবার তার পূর্ব স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য কলকাতায় উত্তমের বাড়িতে সামান্য গভর্নেস সেজে থাকেন।‘সপ্তপদী’র অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে রিনা ব্রাউন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আসামে মেডিকেল কোরের নার্স। কিংবা ‘বিপাশা’ চলচ্চিত্রের পাঞ্জাবি ও বাঙালি বাবামায়ের সন্তান বিপাশা, যে একা থাকে এবং প্রেমিককে খুঁজে বের করতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা একাই চষে বেড়ায়। অথবা ব্রাহ্মণকন্যা ইদ্রাণী যে সমাজের কোনো অনুশাসনই প্রায় মানে না। এই চরিত্রগুলো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙালি সমাজের সামাজিক বাস্তবতায় যতই অবাস্তব বা অসম্ভব মনে হোক না কেন সুচিত্রা সেন যখন সেই চরিত্রে পর্দায় আবির্ভূত হয়েছেন তখন দর্শকের তাকে মেনে নিতে কোনো দ্বিধা জাগেনি। কারণ সুচিত্রা সেন মানেই তো গতানুগতিক জীবনের বাইরে কোনো রহস্যময়ী অধরা নারী। তিনি মায়াবন বিহারিণী ও স্বপনচারিণী। সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্রেও দারুণ খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘কমললতা’, ‘দেবদাস’, ‘দত্তা’,‘পথের দাবী’সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। রাজলক্ষ্মী চরিত্রে তাকে ছাড়া যেন কাউকে ভাবাই যায় না, তেমনি ভাবা যায় না বিজয়া চরিত্রে অন্য কাউকে। ‘হারানো সুর’, ‘শাপমোচন’, ‘বিপাশা’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘কমললতা’, ‘গৃহদাহ’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘দত্তা’, ‘পথের দাবী’, ‘সবার উপরে’, ‘সপ্তপদী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘সাতপাকে বাঁধা’-সহ অসংখ্য ব্যবসাসফল ও শিল্পসম্মত ছবিতে অভিনয় করে বাংলা ছবির প্রধান নায়িকায় পরিণত হন তিনি। সিনেমায় তার ব্যক্তিত্ব এবং সৌন্দর্য দুটিই দর্শককে মোহাবিষ্ট করে রাখে। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার, বসন্ত চৌধুরী, দীলিপ কুমারসহ অনেক বিখ্যাত নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু উত্তম কুমারের বিপরীতে তার জুটি সবচেয়ে বেশি দর্শকনন্দিত হয় এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি চিরকালের সেরা রোমান্টিক জুটিতে পরিণত হয়। তবে সুচিত্রা সেন নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন উত্তম ছাড়া। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন উত্তম কুমার ছাড়া তিনি সাফল্য পান কি না। পঞ্চাশের দশকে যে সিনেমাগুলোতে অভিনয় করেছিলেন তিনি তার অধিকাংশেরই নায়ক উত্তম কুমার। উত্তম ছাড়া তার অভিনীত অন্য সিনেমা তখনও তেমন সাফল্য পায়নি। অবশ্য হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘দেবদাস’-এ তিনি দীলিপ কুমারের বিপরীতে পার্বতী চরিত্রে অভিনয় করে সাফল্য পেয়েছিলেন। হিন্দিভাষী দর্শক বাঙালি পারুকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সে সিনেমায় চন্দ্রমুখীরূপী বৈজয়ন্তী মালাও তো ছিলেন। বাংলায় উত্তম ছাড়া কি তার সাফল্য নেই তাহলে? কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন দর্শক তাকে উত্তম ছাড়াও গ্রহণ করবে। এ কথা প্রমাণ করতেই যেন ১৯৫৯ সালে তিনি অভিনয় করলেন ‘দীপ জ্বেলে যাই’ সিনেমায়। এখানে তিনি হাসপাতালের নার্স রাধা। মেন্টাল ওয়ার্ডের নার্স তিনি। পুরো কাহিনিই মূলত নায়িকাকেন্দ্রিক। নায়ক দেবাশীষ( বসন্ত চৌধুরী) কে সুস্থ করে তোলার জন্য রাধার অভিনয়, তার ভালোবাসা এবং শেষ পর্যায়ে নিজেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া – এসব কিছু বাস্তব করে তোলার জন্য বাংলায় তখন সুচিত্রা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো অভিনেত্রী ছিলেন না। এরপর ১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’। এর মধ্যে অবশ্য তিনি উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেছেন ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘সপ্তপদী’তে। তিনটিই হিট সিনেমা। তবে ‘সাতপাকে বাঁধা’র অর্চনা চরিত্রে তিনি অনন্য সাধারণ অভিনয় করেন। অর্চনা ধনী পরিবার থেকে আসা এমন এক মেয়ে যে দরিদ্র প্রেমিক-স্বামীকে যেমন ভালোবাসে তেমনি উপেক্ষা করতে পারে না নিজের বাবা-মাকেও। প্রেম ও পরিবারের দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত অর্চনাকে পর্দায় সার্থক করে তুলেছিলেন সুচিত্রা। ‘সাতপাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।ভারতীয় অভিনেত্রীর মধ্যে তিনিই প্রথম এ সম্মান পান। সে বছরটিই যেন ছিল তার সাফল্যের বছর।

৭.
১৯৬৩ সালেই মুক্তি পায় তার অভিনীত ‘উত্তর ফাল্গুনী’। এ সিনেমায় যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে যান তিনি। এখানে তিনি ছিলেন একাধিক চরিত্রে। তার অভিনয় ছিল অনন্য। দেবযানী, পান্না বাই ও সুপর্ণা। তিনটি চরিত্র, তিন নারীর জীবন। সুচিত্রা প্রমাণ করলেন তিনি শুধু সুন্দরী ও সুঅভিনেত্রীই নন, তিনি মহানায়িকা। তিনি ১৯৬৬ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘মমতা’র জন্য সেরা অভিনেত্রীর ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। ‘মমতা’ গল্পটি বাংলা ‘উত্তর ফাল্গুনী’রই হিন্দি রিমেইক। ১৯৭২ সালে সুচিত্রা সেন পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৭৪ সালে তার অভিনীত হিন্দি ছবি ‘আঁধি’ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার আসরে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পান। আর তার বিপরীতে অভিনয়ের জন্য সঞ্জীব কুমার সেরা অভিনেতার পুরস্কার জয় করেন। ‘আঁধি’তে তিনি ছিলেন আরতি দেবী নামে এক রাজনৈতিক নেত্রীর ভূমিকায় যিনি একই সঙ্গে ব্যক্তিত্বময়ী, দৃঢ়, কঠোর আবার প্রেমময়ী ও কোমল। বলা হয়ে থাকে ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া অবলম্বনে আরতি দেবীকে নির্মাণ করা হয়েছিল। সুচিত্রা ছাড়া আরতি দেবীর চরিত্রটি ভারতের অন্য কোনো অভিনেত্রী এত সফলভাবে রূপায়িত করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘দত্তা’, অশোক কুমারের বিপরীতে ‘হসপিটাল’ তার বিখ্যাত সিনেমা। সত্যজিৎ রায় তাকে দেবী চৌধুরাণী হিসেবে কাস্ট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুচিত্রার সঙ্গে শিডিউল মেলেনি। দেবী চৌধুরাণী তাই নির্মাণ করেননি সত্যজিৎ রায়। পরবর্তীতে অবশ্য অন্য পরিচালক দেবী চৌধুরাণী নির্মাণ করেন এবং তাতে সুচিত্রাই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি অনেক নায়কের বিপরীতেই অভিনয় করেছেন, খ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু উত্তম কুমারের বিপরীতেই তিনি ছিলেন সবচেয়ে সার্থক। আজও তাই বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা রোমান্টিক জুটি বলতে উত্তম-সুচিত্রাকেই বোঝায়।

৮.
সুচিত্রা সেনের ব্যক্তি জীবন নিয়ে দর্শকের কৌতূহল ছিল অপার। কিন্তু খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করার সময়ও সুচিত্রা সেন ব্যক্তি জীবনকে সযত্নে লুকিয়ে রাখতেন লোকচক্ষু থেকে। মিডিয়ায় তিনি কখনও সরব ছিলেন না। তাকে ঘিরে কোনো স্ক্যান্ডাল যেন না থাকে সে বিষয়েও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। শুটিং শেষ করেই ‘মিসেস সেন’ যেন চলে যেতেন নিজের রহস্যময় জগতে। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অনেকটাই খেয়ালি। দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিবাহিত জীবনও খুব সুখের হয়নি। তারা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতেন। দিবানাথ সেনের মৃত্যুর পরও তাদের দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে কোনো কথাই মিডিয়ায় প্রকাশ করেননি সুচিত্রা। তাদের একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন এবং নাতনি রিয়া ও রাইমা সেনও চলচ্চিত্রাভিনেত্রী। সংসারে টানাপড়েন শুরুর পরও অভিনয় চালিয়ে যান সুচিত্রা, তবে ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যেতে থাকেন। সব শেষ ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৭৮ সাল থেকে সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্রজগতকে বিদায় জানিয়ে নির্জনে বসবাস শুরু করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা বজায় রাখেন। প্রথম তিনি আড়াল ছেড়ে বাইরে আসেন মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর। মাঝরাত পর্যন্ত বসেছিলেন তার মরদেহের পাশে। সুচিত্রা শেষ জনসমক্ষে আসেন ১৯৮৯ সালে, তার গুরু ভরত মহারাজের মৃত্যুর পর। ২০০৫ সালে সুচিত্রাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলেও ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দিল্লি যেতে রাজি হননি তিনি। অন্তরালে ছিলেন ৩৫ বছর। নিজের পারিবারিক ও অন্তরালের জীবন নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা মেনে চলেছেন সুচিত্রা। শুধু তিনিই নন, তার মেয়ে চিত্রনায়িকা মুনমুন সেন, হালের নায়িকা দুই নাতনি রিয়া ও রাইমা সেনও কখনো মুখ খোলেননি। একান্ত ব্যক্তিগত চিকিৎসক, হাসপাতালের নার্স, পত্রিকার সাংবাদিক কেউ তার অন্তরালে থাকা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি কখনো। স্বেচ্ছা নির্বাসনের বেশিরভাগ সময়ই তার কাটতো রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায়। এরপর সরকারের পরিচয়পত্র তৈরির সময় ছবি তোলার জন্য কেন্দ্রে আসেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু সে কাজটিও খুব গোপনে সেরে চলে যান তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেলভিউ হাসপাতালে তার কক্ষটিও ছিল কঠোর গোপনীয়তার ঘেরাটোপের মধ্যে। তিন যুগের স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিজের চারপাশে রহস্যের যে জগৎ গড়ে তুলেছিলেন, তার ভেতরে থেকেই চিরদিনের জন্য চলে গেলেন তিনি। ২০১২ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ সরকার, রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গ বিভূষণে ভূষিত করে সুচিত্রা সেনকে।

৯.
অসাধারণ অভিনয়শৈলী আর সাবলীল অভিনয় উপহার দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে একচেটিয়া সাফল্য পাওয়ার পাশাপাশি বলিউডেও মজবুত আসন গেড়েছিলেন সুচিত্রা সেন। তিনি নায়িকা ছিলেন এবং নায়িকা চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। পার্শ্ব-চরিত্রে তাকে কখনও দেখা যায়নি। তার তরুণীমূর্তিই দর্শকস্মৃতিতে অম্লান। গত বছর ১৭ই জানুয়ারি মৃত্যুর অন্ধকার জগতে চিরতরে প্রস্থান করলেও মহানায়িকা সুচিত্রা সেন দর্শকদের মনে চিরসবুজ, চিরতরুণ, রোমান্টিক নায়িকারূপে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। সুচিত্রা সেনের অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে : অগ্নি পরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহ প্রবেশ (১৯৫৪), ঢুলি (১৯৫৪), মরণের পরে (১৯৫৪), দেবদাস (১৯৫৫-হিন্দি), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), মেজ বউ (১৯৫৫), ভালবাসা (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), ত্রিযামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৭), পথে হল দেরী (১৯৫৭), জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), মুসাফির (১৯৫৭-হিন্দি), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), দ্বীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), হসপিটাল (১৯৬০), বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০- হিন্দি), সপ্তপদী (১৯৬১), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), মমতা (১৯৬৬), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), মেঘ কালো (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২), দেবী চৌধুরাণী (১৯৭৪), শ্রাবণ সন্ধ্যা (১৯৭৪), প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫), আঁধি (১৯৭৫- হিন্দি), দত্তা (১৯৭৬) এবং সর্বশেষ প্রণয়পাশা (১৯৭৮)।

১০.
কিংবদন্ততুল্য সুচিত্রার জন্মস্থান পাবনার বাড়ি অবশেষে সরকারের দখলে এসেছে। এবার স্মৃতি জাদুঘর হওয়ার পালা। উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পাবনার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি নিয়ে সব ধরনের আইনি জটিলতার অবসান হলো। স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা দ্রুত দখলদার উচ্ছেদ করে সেখানে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা বা ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরি করার দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের সম্রাজ্ঞী সুচিত্রা সেনের শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি। রমা সেন, পুরো নাম রমা দাশ গুপ্ত। সহপাঠীরা তাকে কৃষ্ণা বলেই জানতেন। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন কৃষ্ণা অর্থাৎ সুচিত্রা সেন। পাবনার এই বাড়িতেই কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর কাল। ছোটবেলায় দুরন্তপনা আর গান গাইয়ে মাতিয়ে রাখতেন সঙ্গীদের। তিনি ভালো গান গাইতে পারতেন বলে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে জানা গেছে। সুচিত্রা সেন তার বাবা-মা, এক ভাই ও তিন বোনকে সঙ্গে নিয়ে শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনের এই বাড়িতে। পাবনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সপরিবারে ওপার বাংলায় পাড়ি জমান। তার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন পাবনা পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। ১৯৪৭ সালের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তার বাবা সপরিবারে ভারতে চলে যান। সে সময় জেলা প্রশাসন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য বাড়িটি রিক্যুইজিশন করেন। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাইদুর রহমান তাদের বাড়িটি বাৎসরিক চুক্তি ভিত্তিতে ইজারা দেন। পরে মাওলানা আবদুস সুবহান অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত করে ইমাম গাজ্জালি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাড়িটি দখলের চেষ্টা চালায়। ১৯৯১ সালের ১৮ জুন ইমাম গাজ্জালি ট্রাস্ট বাড়িটি স্থায়ী বন্দোবস্ত নেওয়ার আবেদন করে। ওই বছরের আগস্টে ভূমি মন্ত্রণালয় তাদের স্থায়ী বন্দোবস্ত না দিয়ে আবারও বাৎসরিক ইজারা দেয়। পরে ইজারার টাকা পরিশোধ না করায় ১৯৯৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইজারা বাতিল করা হয়। কিন্তু জামায়াত নেতারা বকেয়া পরিশোধ সাপেক্ষে ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট আবার ইজারা নবায়ন করিয়ে নেন। পরে পাবনাবাসী বাড়িটি উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করলে কর্তৃপক্ষ তাদের লিজ বাতিল করে। মহানায়িকার স্মৃতি স্মরণে জন্মস্থানটি, বাড়িটি অচিরেই জাদুঘরে রূপ পাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
(তথ্যসূত্র : বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত