রোমাঁ রোলাঁ

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১৩:২৯

১.
বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিল্প ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মবিদ রোমাঁ রোলাঁ। বলা হয়ে থাকে রোলাঁর সাহিত্যের শিল্পী জীবন ছাড়াও আরেকটা জীবন ছিল, নৈতিক বা আধ্যাত্মিক জীবনে তিনি ছিলেন মূর্ত্তিমান বিবেক। রোমাঁ রোলাঁ ১৮৬৬ সালের ২৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। মহান এই মানবিক চিন্তক, সাহিত্যিকের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৪৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মনীষী রোমাঁ রোলাঁ ১৯১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। শিল্পকলা ও সংগীত গবেষক রোলাঁ ১৯০৩ সালে সর্বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ Vie de Beethoven (বেটোভেন-চরিত) প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে। এরপর ১৯০৬ সালে মাইকেলাঞ্জেলোর জীবনী ও ১৯১১ সালে তলস্তয়ের জীবনী রচনা করেছিলেন তিনি। জাঁ-ক্রিস্তফ তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য রচনা। ১৯১০ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে দশ খণ্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধের বিরোধিতা করেন। রোলাঁ ছিলেন একজন ভারতপ্রেমিক ও ভারততত্ত্ববিদ। তিনি মহাত্মা গান্ধী, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী রচনা করেছিলেন।

২.
রোম্যাঁ রোলাঁ (জন্ম : ২৯ জানুয়ারি, ১৮৬৬ – মৃত্যু: ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৪৪) ছিলেন এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা। বিবেকী মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায়ের নানা লেখা পড়ে তাঁর প্রতি আমার ধারণা ও প্রবল আগ্রহ জন্মে। জানতে পারি রোমাঁ রোলাঁ ছিলেন এক মহাপুরুষ। উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত চিন্তাবিদ, মানবতা পূজারী এবং প্রগতিবাদী মহান সাহিত্যিকদের মধ্যে রোমাঁ রোলাঁ ছিলেন প্রথম সারির অন্যতম। তিনি একাধারে ছিলেন একজন চিত্র ও ভাস্কর্য শিল্পে পৃষ্ঠপোষক, সঙ্গীত ও সাহিত্যের মরমী র্শিল্পী। যুগ ও জীবনের গভীর স্রষ্টা। মানবতন্ত্রের রূপকার তেমনি অপর দিকে ছিলেন বিশ্বশান্তির প্রবক্তা, শিক্ষাবিদ, জনদরদী এবং শ্রেষ্ট আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও ছিল তাঁর অকৃত্রিম সৌহার্দ্য তার রচনার মাধ্যমেই ইউরোপের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছিলেন ভারতাত্মার সনাতন শান্তির বাণী। ভারতবর্ষের আধ্যাত্মবাদের প্রতি ছিল রোলাঁর অপরিসীম আগ্রহ। ইউরোপের বুদ্ধিজীবী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের তিনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সহযোগিতা করতে। বারবার ধিক্কার ঘোষণা করেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরেুদ্ধে।পৃথিবীর যেখানে কোন অবিচার অত্যাচার ঘটেছে, রোলাঁ অকুণ্ঠিত কণ্ঠে ধিক্কার জ্ঞাপন করেছেন। প্রচারিত হয়েছে তাঁর অহিংস বিদ্রোহের বাণী। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে রোলাঁ ছিলেন পাশ্চাত্যে ভারতের আধ্যাত্মিক রাষ্ট্রদূত। একসময়ে রোলাঁর অশান্ত চিত্তকে প্রশান্তিতে ভরে তোলে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মবাদী বিশ্বমানবতা, স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত দর্শন এবং গান্ধীজীর সত্যমন্ত্র অফুরন্ত জীবনী শক্তি ও তাঁর অহিংসাবাদ ও সংগ্রামী মানসিকতা। রোলাঁ প্রাচ্যের শান্তিবাদী দর্শনসমূহ, বিশেষ করে গৌতমবুদ্ধের প্রচারিত বৌদ্ধ ধর্মে ‘জীবহত্যা মহাপাপ’ এবং ‘অহিংসাই পরমধর্ম’ এই সকল বাণীকে আন্তরিকতার সঙ্গে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। তাই এশিয়াবাসীদের দর্শন থেকে শিক্ষালাভের জন্য তাঁর অনুরাগীদের প্রায় সময় অনুরোধ জানাতেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার যান্ত্রিক অগ্রগতিকে তিনি তেমন সমর্থন দিতেন না।

৩.
মনীষী রম্যাঁ রঁলাকে নিয়ে অধ্যাপক যতীন সরকার সুন্দর করে লিখছেন, ‘দুর্দমনীয় মনোবলের অধিকারী যে-সব বিপ্লবী, যাদের ভেতর কোনো পিছুটান নেই, শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাকেই জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান করে নিয়েছেন যারা, বিগত শতকে দেশি-বিদেশি এমন অনেক বুদ্ধিজীবীর বইপত্র পড়েই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তাদের জীবন ও কর্মের সঙ্গে কমবেশি পরিচয়ের মধ্য দিয়েই ‘মার্কসবাদ’ নামে পরিচিত দর্শনটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। এই দর্শনটি জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যার জন্য ‘দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের যে পদ্ধতি মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে, এযাবৎকাল ধরে সেই ব্যাখ্যাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা কম হয়নি। সে চেষ্টা যারা করেছেন তারা অনেক বিভ্রান্তির ধূম্রজাল ছড়াতে পেরেছেন অবশ্যই, কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য সফল হয়নি; তারা কেউই দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যে ভুল তেমন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। অন্যদিকে মার্কসবাদী বলে পরিচিত নন, কেবল অপক্ষপাত মুক্তদৃষ্টিতে জগৎ ও জীবনের দিকে তাকিয়েছেন, তেমন অনেক বুদ্ধিজীবীর চৈতন্যেও মার্কসবাদের স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। এ-রকমই একজন বুদ্ধিজীবী হলেন রম্যাঁ রলাঁ।… ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই বর্তমানের সমগ্র স্বরূপকে দেখা, ভালোয় মন্দয় আলোয় আঁধারে মেশানো বর্তমানের ভেতর থেকে প্রগতির প্রকৃত ধারাটিকে চিনে নেয়া এবং সেটি করতে গিয়ে অতীতের মহৎ উত্তরাধিকারকে কোনো মতেই অস্বীকার না করা,-প্রকৃত বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদদের এ-রকম সব বৈশিষ্ট্যই ছিল রম্যাঁ রলাঁর মধ্যে।’

৪.
রোমাঁ রোলাঁ ১৮৬৬ সালের ২৯ জানুয়ারি ফ্রান্সের ক্ল্যামেসীতে এক অভিজাত পরিবারে জন্মেছিলেন। পড়াশুনা করেন প্রথমে প্যারিসে পরে রোমে। আজীবন যুদ্ধবিরোধী ও মানবতাবাদী ফ্রান্সের একজন মহামানব পরিচয়ে বিশ্বের অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণকারী রোমাঁ রোলাঁ গণমানুষের মুক্তি সাধনের ব্রত নিয়েই যেন বেড়ে উঠতে থাকেন। নিজ দেশ থেকে তিনি বহির্বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন বেশী। রোলাঁর মা ছিলেন একজন দক্ষ পিয়ানো শিল্পী। মায়ের বাজানো পিয়ানো শুনতে শুনতে সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। আমৃত্যু এই আকর্ষণ কখনো হ্রাস পায়নি। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মোৎসার্ট ও বিঠোভেনের সঙ্গীতের মধ্যে ধাতস্থ হলেন। সঙ্গীতের সঙ্গে সাহিত্য ও নাট্য শাস্ত্রের প্রতি ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। শিক্ষার সর্বস্তরেই ছিল তাঁর সমান গতি। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে রোঁলার পরিচিতি এক মহান আদর্শবাদী লেখক হিসেবে, লেখনী শুধু তাঁর কাছে আনন্দ বিতরণের উৎস নয়, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, একজন লেখক তাঁর সৎ জীবন ও সৃজনশীল সাহিত্যের মাধ্যমে আদর্শস্বরূপ থাকতে পারেন। সমাজের চারপাশের অবক্ষয়ের অন্ধকারে লেখকই পারেন পবিত্র আলোকশিখা প্রজ্জ্বলন করতে। এই মতবাদে আজীবন বিশ্বাসী রোঁমা রোঁলা তাই কখনো সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য চেষ্টা করেননি। তাঁর লেখক জীবন ছিল নিরন্তর সাধনার ইতিহাস।
 
৫.
রোমাঁ রোলাঁ ১৮৯৫ সালে প্যারিসে সারবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ সম্মানের সাথে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি পড়াশুনা করেছিলেন সঙ্গীতের উপর। ডক্টরেটের সময় তাঁর থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল ‘সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় সঙ্গীতের ইতিহাস’। ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করে তিনি শিল্প ইতিহাসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এই সারবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে বিখ্যাত মানবতাবাদী চার্লস পেগুইর সাথে। পরিচয়ের পর পেগুইর সাথে তাঁর সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হয় এবং একে অপরের সহযোগিতায় কাজ করতে শুরু করেন। ১৯০৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতের ইতিহাসের অধ্যাপক পদলাভ করেন। এই সময় তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থও প্রকাশিত হয়। এর একটি ছিল ট্রিলজি নাটক ‘লা থিয়েটার ভিলা রেভোলিউশন’ অপরটি ছিল বিখ্যাত সুরস্রষ্টা বিঠোভেনের উপর রচিত গ্রন্থ, তাছাড়া সেই সময়ে লিখলেন আরো কিছু বই, যে বইগুলো মূলত ছাত্রদের জন্য লিখলেও তিনি এরই মধ্য দিয়ে প্রকাশ করলেন সঙ্গীতের মর্মবাণী তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে মানুষ দেশকাল সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠতে পারে। নিজেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে এক মহামানবের স্তরে। 

৬.
রোলাঁর সাহিত্যের উদ্যমের অনেকটা জুড়ে আছে নাটক রচনা এবং নাটক নিয়ে ভাবনা, অবশ্য তার একটা বিশেষ কারণও আছে। তাঁর দৃষ্টিতে প্রধান বিষয় ছিল মানুষের জীবন এবং এই মানুষের কাছে কথা বলা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য- মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপনের এবং গভীরভাবে কথা বলার প্রকৃষ্ট মাধ্যম হল নাটক। “আর্টের জন্য আর্ট”, এই শিল্পতত্ত্বের বিপরীত মেরুতে রোলাঁর অবস্থান। “আমি আর্টকে এক লক্ষ্য হিসেবে দেখিনা, দেখি এক উপায় হিসেবে, এক প্রকাশ সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে”, এ তাঁর নিজেরই উক্তি। নাটকের দায়িত্বের কথা তিনি সাহিত্য জীবনের প্রারম্ভেই স্মরণ করেছেন। রোলাঁ ছেলেবেলায় সঙ্গীতের সাথে ভালবেসেছিলেন নাটককে এবং শেক্সপীয়ারকে, ধীরে ধীরে অনুভব করতে পেরেছিলেন নাটকের গুরুত্ব। সমাজকে নাটক কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে তারই ভাবনায় ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ এ পাঁচ বছরে তিনি লিখলেন তিনটি নাটক- Saint Louis, Aert, Triomphe de la Raison । এই নাটকগুলোর বিষয়বস্তু ছিল সমাজ, জাতি ও মানুষদের উপর বিশ্বাস। এর উৎস ছিল ফরাসি বিপ্লব, এর পরে আরো কয়েকটি নাটক লিখলেন। এ নাটকগুলোর নাম ট্রাজেডিস অব ফেথ(Tragedies of Faith)। কিন্তু ক্রমশই তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন- তাঁর নাটকে যেন জনগণের প্রাণের স্পর্শ নেই। এ নাটক যেন শুধুমাত্র সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য লেখা হয়েছে। তিনি স্থির করলেন এবার নাটক লিখবেন সাধারণ মানুষের জন্য, জনগণের জন্য, এক নতুন আদর্শের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শুরু করলেন তাঁর নাটক লেখা, তিনি এ পর্যায়ের নাটকের নাম দিলেন গণনাট্য (People’s Theatre)। লিখলেন - Les loups (1898), Leouatarze Juliet, এ পর্যায়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ১৪ই জুলাই, এ নাটকে নায়ক ডাক দিয়েছে বাস্তিল দুর্গ ভেঙ্গে ফেলবার, এ যেন ফরাসি বিপ্লবের ডাক নয়, এ যেন তৎকালীন সমাজের সমস্ত অবক্ষয়কে ভেঙ্গে ফেলবার ডাক।

৭.
রোলাঁ একসময় বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের জীবনী লেখা শুরু করলেন। এ জীবনী রচনায় তিনি এক নতুন আঙ্গিকের জন্ম দিলেন, শুধু সাল, তারিখ আর তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়, লেখকের ভাব, ভাবনা, অনুভূতি এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় বিঠোভেন। বিঠোভেন লিখতে গিয়ে রোলাঁ ব্যক্ত করেন বিঠোভেন শুধু একজন মহান সঙ্গীতকার নন, তাঁর চেয়েও অনেক বড়। যিনি সমস্ত জীবন দুঃখের মধ্যে, যন্ত্রণার মধ্যে অতিবাহিত করেও সব দুঃখ যন্ত্রণার উর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন। এরপর রচনা করলেন ‘মাইকেল এঞ্জেলা (১৯০৮)’ সে সময়ের যুগকে ছবির মত করেই ফুটিয়ে তুলেছেন রোলাঁ। “মাইকেল এঞ্জেলো” সৃষ্টি তাঁর কাছে এক অতি মানবীয় শক্তির প্রকাশ। এর কয়েক বৎসর পর রোলাঁ আরেকটি জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন ‘টলস্টয় (১৯১১)’ এ সময় রোলাঁর মধ্যে অনেক পূর্ণতা এসে গিয়েছে। তাই তাঁর টলস্টয় অনেক পরিণত। এসব জীবনী গ্রন্থ রচনার আগে থেকেই তাঁর মন অন্বেষণ করেছিল এক আদর্শ মানুষের, যে চিরসংগ্রামী দুঃখের ভারে ভেঙ্গে পড়ে কিন্তু নত হয়না। তাঁর মনের ভাবনা আদর্শের প্রকাশ ঘটলো জগৎ বিখ্যাত উপন্যাস ‘জাঁ ক্রিস্তফ (Johan Christopher)’-এ। এই বইখানি লিখতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল রোলাঁর। দশ বৎসর ধরে তিনি রচনা করেছেন তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস। প্রথম খন্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে এবং শেষ খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে। এ সুদীর্ঘকাল ধরে প্রকাশিত হলেও তার প্রতি জনগণের দৃষ্টি পড়েনি। এ বইয়ের মধ্যে ইউরোপের সমস্ত শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীদের আত্মা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। জাঁ ক্রিস্তফের মধ্যে রোলাঁর আত্মাই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিলো। “ জাঁ ক্রিস্তফ” যে শুধু সমকালে সেরা সৃষ্টি তা বললে কমই বলা হবে। নিজস্ব পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও শিল্পগুণে এটি একটি কালোত্তীর্ণ রচনা, যে কারণে আপন স্বাতন্ত্র্যেই এটা বিশ্বসাহিত্যে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। সম্ভবতঃ এক শতাব্দী কালেও এমন রচনা আর দ্বিতীয়টি নেই। এই অমর গ্রন্থের স্রষ্টা রোমাঁ রোলাঁকে পুরস্কৃত করার সময় সুইডিশ একাডেমী ঘোষণা করে : নিগূঢ় সত্যের প্রতি একাত্মতা এবং সহমর্মিতা যার সমন্বয়ে তিনি তাঁর রচনার চরিত্রগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, সেই উচ্চমার্গের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ তাঁকে পুরস্কার প্রদান করা হল।

৮.
ইউরোপের বুকে তখন নেমে এসেছে যুদ্ধের ঘনঘটা। ১৯১৪ সালে শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে এ সময় ব্যক্তি রোলাঁর পরিচয় মুছে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন সমগ্র ইউরোপ তথা মানবজাতির বিবেকের প্রতিরূপ। সেই সময়টাতে রোলাঁ ছিলেন সুইজারল্যাণ্ডে। এই সময় তিনি ফরাসী, জার্মান ও বেলজিয়ামের শিল্পী সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের একত্রিত করার চেষ্টা করেন এবং তাদের সকলের সহযোগিতায় বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে। তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল “যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই মূমুর্ষূদের সেবার জন্য তিনি সুইজারল্যাণ্ডে আন্তর্জাতিক রেডক্রসে যোগদান করেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘জাঁ ক্রিস্তফ’-এর জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। সেই সময়ে রেডক্রসে কাজ করার সময় প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। মানবতাবাদী রোলাঁ নোবেল পুরস্কারের সমুদয় অর্থ রেডক্রসের জন্য তুলে দিলেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যাণ্ডে বাসকালে রোলাঁ বিখ্যাত শান্তিবাদী ইস্তাহার Andssusdela melee প্রকাশ করেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মনীষী, লেখক, শিল্পী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর গ্রহণ করে প্রচার করেন। তাঁর প্রচেষ্টা বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করে তুলতে সাহায্য করেছিল। 

৯.
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রোমাঁ রোলাঁ গভীরভাবে আকৃষ্ট হন ভারতীয় দর্শনের প্রতি। তিনি ভারতীয় দর্শন ধর্ম ও সংস্কৃতি জানার জন্য প্রচুর বই পড়েন। রোলাঁর সাথে রবীন্দ নাথ ঠাকুরের সাক্ষাত হয় ১৯২১ সালে। তিনি তখন ভারতের শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত নিয়ে পড়াশুনা করছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে রবীন্দ নাথের সহযোগিতা গ্রহণ করেন এবং কবির সাথে তাঁর গভীর সম্পর্কও গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে রোলাঁ আকৃষ্ট হন রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রতি। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবনী। রামকৃষ্ণের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন আধ্যাত্ম সাধনা আর মানব প্রেমের এক সম্মিলিত রূপ। রামকৃষ্ণের উপর তিনি লিখেছেন, ‘For Ramkrishna charity meant nothing less then the love of god in all men, for god is incarnate in man.’.“রামকৃষ্ণের কাছে ভালোবাসার অর্থ ছিল সমস্ত মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে ভালোবাসা, কারণ মানুষইতো ঈশ্বরের মূর্ত প্রকাশ”। বিবেকানন্দের মধ্যে পেয়েছিলেন তাঁর কর্মের বাণী, অবশ্য যিনি রোঁমা রোলাঁর কাছে ভারতবর্ষের এক পূর্ণাঙ্গ ছবি তুলে ধরেছিলেন তিনি দিলীপ কুমার রায়। দিলীপ কুমারের কাছে রোলাঁ প্রথম মহাত্মা গান্ধীর নাম শোনেন তারপর লিখলেন গান্ধীর জীবনী যা ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ৩রা সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসে বিশ্বশান্তি সম্মেলন আহ্বান করা হয়। তিনি রবীন্দ্রনাথ সহ ভারতীয় মনীষীদের বাণী সম্বলিত একটি ইশতেহারও প্রকাশ করলেন এই সম্মেলনে। এই ইশতেহারে ভারতীয় যেসব মনীষী সাক্ষরদান করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল রায়, শরৎচন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, নরেশচন্দ সেনগুপ্ত, প্রেমচন্দ এবং পন্ডিত জহরলাল নেহেরু প্রমুখ। 

১০.
মূলত শান্তি ও মানবতার স্বপক্ষে তাঁর জীবন দর্শন গড়ে উঠেছিলো বাল্যকাল থেকেই। তিনি সবাইকে নিয়ে সুখী হতে চাইতেন। একার সুখ মোটেই কাম্য ছিল না। শান্তির বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সাহিত্য এবং রাজনীতি এই দুই মাধ্যমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর শাণিত রচনাগুলো স্থান পায় ‘I will not rest’ গ্রন্থে। রোলাঁ ছিলেন মনেপ্রাণে বিপ্লবী এবং ব্যাক্তিত্ববাদী মানবিকতার পক্ষপাতি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে মহামিলনের সেতু বন্ধনের তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রণী পুরুষ।

১১.
একদিকে রোলাঁ যখন প্রাচ্যের ধ্যানে মগ্ন অন্যদিকে তিনি সৃষ্টি করে চলছেন যুদ্ধোত্তর ইউরোপের এক জীবন্ত চিত্র। ‘বিমুগ্ধ আত্মা’ উপন্যাস এর প্রথম দুই খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে, তৃতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে, চতুর্থ খন্ড ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে। ‘বিমুগ্ধ আত্মা’ রোলাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা জাঁ ক্রিস্তভে রোলাঁ পূর্ণতা লাভ করেননি। কিন্তু ‘বিমুগ্ধ আত্মা’-তে এসে পেলেন সেই পূর্ণতা এই উপন্যাসটি জাঁ ক্রিস্তফ এর চাইতে অনেক পরিণত। এ কাহিনীর নায়িকা আনেৎ। সে এক শিল্পীর সুন্দরী কন্যা, ধনী পরিবারে তার বিয়ে স্থির হল। কিন্তু বিয়ের ঠিক পূর্বে তার প্রেমিক বিয়োর মানসিকতার সাথে একমত হতে পারল না। আসলে সে চেয়েছিল স্বাধীনতা, পূর্ণ নারীত্ব। স্ত্রী হিসেবে দাসত্ব নয়। তখন সে সন্তান সম্ভবা। সন্তানের কথা ভেবেও বিয়ে করলন না। নিজের সন্তান মার্ককে নিয়ে শুরু হল তার জীবন সংগ্রাম। আনেৎ যেন চিরন্তন নারী সংগ্রামের প্রতীক। দেশে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। তারই মধ্যে আনেৎ দেখেছে মানুষের কদর্যরূপ। অবশেষে যুদ্ধ শেষ হল। আনেৎ নতুন যুগের স্বপ্ন দেখে। তার বিশ্বাস- একদিন এ অন্ধকার পৃথিবী থেকে মানুষের সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই উত্তরণ ঘটবে। এ উপন্যাস শেষ হয়েছে সে সংগ্রামের ডাক দিয়ে “ন্যায় পরায়ণ হওয়াতো ভাল কিন্তু প্রকৃত ন্যায় বিচার কি শুধু দাঁড়িপাল্লার কাছে বসে থাকে, আর দেখে সন্তুষ্টি হয় ? তাকে বিচার করতে দাও, সে হানুক আঘাত। স্বপ্নতো যথেষ্ট দেখেছি আমরা, এবার আসুক জাগার পালা।”

১২.
রোলাঁর মূলমন্ত্র হচ্ছে- Energy, তার মানস পুত্র জাঁ ক্রিস্তফ (Johan Christopher) শক্তির প্রতিমূর্তি- The embodiment of Virile Energy, আঘাতে আঘাতে তার জীবন হয়ে গেছে ক্ষত বিক্ষত কিন্তু ক্ষতি তার কাছে বহন করে এনেছে অমূল্য উপহার; বিদীর্ণ অন্তরের বাতায়ন পথে এসেছে নবজীবনের সমীরণ প্রবাহ। পরাজিত ক্রিস্তফ, অবনতির ধুলিতলে অবলুণ্ঠিত ক্রিস্তফ চারিদিকে দেখেছে মৃত্যুর অন্ধকার! যে বন্ধু চরম দুর্দিনে আশ্রয় দিয়ে তাকে বাচাঁলো তারই পত্নীর সঙ্গে গোপন ব্যভিচারের কালিমায় তার জীবন হল কলঙ্কিত; ক্রিস্তফ অবশেষে বিশ্বাসঘাতক! ক্রিস্তফ ব্যাভিচারী! কিন্তু রোলাঁর মানসপুত্র বেদনার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, তবুও নিশ্চিন্ত মনে কাদার মধ্যে থাকবে না ঘুমিয়ে! ! Burn if you will; But do not Soil yourself ! আপন দুর্বলতাকে অতিক্রম করে প্রাণের মুক্তিকে ফিরে পাওয়ার জন্য ক্রিস্তফের সেকি প্রাণপণ প্রয়াস! আপনার সঙ্গে আপনার সেই নিদারুণ সংগ্রামের ছবি প্রতিভার সোনার কাঠির স্পর্শে চমৎকারভাবে ফুটে উঠছে! তারপর সেই সংগ্রামের মধ্য থেকে বিজয়ীর বেশে ক্রিস্তফ যেদিন বেরিয়ে এলো- সেদিন জীবন তার বিধ্বস্ত; সেই বিধ্বস্ত জীবনের ধ্বংসস্তুপের উপরে বসে ক্রিস্তফ শুনলো জীবন দেবতার বাণী; আপনার সঙ্গে আপনার কেন এই অহর্নিশ সংগ্রাম, জীবনের মঞ্চে কেন এই জয়-পরাজয়ের বিচিত্র নাট্যলীলা ক্রিস্তফ জেনে নিল তার রহস্য।

১৩.
যাদের লেখা রোলাঁর মনের উপরে গভীরতম রেখাপাত করেছে, তাদের মধ্যে হুইটম্যানকে আর টলস্টয়কে তিনি সকলের উচ্চাসন দান করেছেন। তাই আমেরিকার মহাকবি লেখার মধ্যে যে সংগ্রামের গান আমরা শুনতে পাই- রোঁলার উপন্যাসগুলিতেও সেই সংগ্রামের আহ্বানই উদ্ঘোষিত হয়ে উঠেছে! রোলাঁর কাছে জীবন ‘বাড়া ভাতের মত’ উপভোগ্য নয়; জীবনকে ভোগ করতে কোথাও বারণ করেননি তিনি, কিন্তু ভোগ করতে হলে জীবনকে সাধনা দ্বারা সৃষ্ট করা চাই। কবিতার মত আর সঙ্গীতের মত সুন্দর করে। বারে বারে তাল কেটে যাবে, সরু মোটা দু’টো তারে জড়িয়ে বারে বারে জীবন বীণা বেসুরে বেজে উঠবে। তবু নতুন করে আরম্ভ করতে হবে আবার ভুল হবে পদে পদে, পরাজয়ের পর আসবে পরাজয়! ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা! কিন্তু এই পরাজয়কে কখনও চরম বলে স্বীকার করে নেবো না। “বাচঁতে গেলে প্রত্যহ অন্যের প্রতি এবং নিজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা অনিবার্য। নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন থাকলেই যথেষ্ট”। রোজ প্রভাতে নিজের কাছে একথা যেন বলতে পারি “আমি পরাজিত-আবার শুরু করবো আমার সংগ্রাম”। উপরের কথাগুলো রোলাঁরই কথা। সকলের চেয়ে তিনি ঘৃণা করেন পৌরুষের অভাবকে ‘আমি পাপী, আমি পাপী’ এ রকমের একটা তামসিক মনোভাবকে সৃষ্টি করে খৃষ্টান পাদ্রীদের উপদেশ। রোলাঁর লেখার মধ্যে কোথাও এই তামাসিকতা নেই। মানুষ দেবতা নয়, বাচঁতে গেলেই পদস্খলন অনিবার্য! কিন্তু তার জন্য অনুতাপের এত বাড়াবাড়ি কেন? পরাজয় এসেছে জীবনে? নতুন করে শুরু হোক আবার সংগ্রাম। উপরের দিকে উঠবার এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবার এই যে দুর্নিবার উন্মাদনা, এই উন্মাদনা হচ্ছে রোলাঁর মানসপুত্র এবং মানস কন্যাদের প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। সত্য শিবসুন্দরের প্রতি এক দুর্বার আকর্ষণ, তাদের ঠেলে নিয়ে চলছে অশান্তির মধ্যে, সংগ্রামের মধ্যে, মৃত্যুর মধ্যে। ভাবের ঘরে চুরি করে, সত্যের আহ্বানকে, কল্যাণের দাবীকে উপেক্ষা করবার দুর্বলতা রোলাঁর চোখে অমার্জনীয় অপরাধ। সেই জন্যই ‘The Soul Enchanted’- এর নায়ক মার্ক নিজেকে কেবল ভাবরাজ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারলনা কর্মসাগরে তাকে ঝাঁপ দিতে হল। শ্রমিকের মুক্তি তার কাছে যেদিন থেকে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল সেদিন থেকে কোন কিছুই আর তাকে পিছনে বেঁধে রাখতে পারলনা। বিশ্বাসকে, কালচারকে, যুক্তিকে, সমাজ ব্যবস্থাকে একই নতুন নীতির উপর দাঁড় করাবার জন্য সে পাগল হয়ে উঠলো- যার ভিত্তি হচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিকের মুক্তি। অবশেষে সেই মুক্তির বেদীমূলে মার্ক ঢেলে দিল আপনার বুকের রক্ত। সাহস, বীর্য, প্রচন্ড কর্মশক্তি, অদম্য গতিবেগ, সত্যের প্রতি নিবিড় অনুরাগ রোলাঁর নায়ক-নায়িকাদের চরিত্রের এই গুণগুলি হচ্ছে বিশেষত্ব। ‘The Soul Enchanted’-এর নায়িকা Annete এর চরিত্র ও এই সকল গুণের সমন্বয়ে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। 

১৪.
ভুলত্রুটি মানুষের হবেই কিন্তু মনের মধ্যে যদি শৌর্য থাকে, ভীরুতাকে যদি বর্জন করি, জীবনের সমস্ত কালিমা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে শৌর্যের সূর্যালোকের মধ্যে। চাঁদের কিরণরাশির মধ্যে যেমন তার কলঙ্ক ঢাকা পড়ে যায়- ক্ষত্রিয়োচিত তেজস্বিতা থাকলেও তার আড়ালে আর সব দুর্বলতা লজ্জায় আত্মগোপন করে। বীর হতে হবে জীবনে; মৃত্যুকে বেছে নিতে হবে- কলঙ্কের মধ্যে ক্রীতদাসের মৃত্যুকে নয়, যে মৃত্যু হচ্ছে মুক্ত মানবের যার মধ্যে আছে প্রতিশোধ কামনার তৃপ্তি- সেই মৃত্যুকে বরণ করা চাই। রোলাঁর লেখার মধ্যে প্রবল কর্মোন্মাদনার এবং ক্ষত্রিয় তেজের আদর্শকে এতখানি উচ্চ আসনে দান করা হয়েছে বলেই সকল দেশের যৌবনের কাছে তাঁর আকর্ষণ এতখানি বেশি। যৌবন চায় বাধা বিঘ্নের সঙ্গে সংগ্রাম করে স্বাধীনতার আদর্শের পানে অকুতোভয়ে চলতে, পুরাতন জগতকে ভেঙ্গেচুরে তাকে নতুন করে গড়তে, মৃত্যু প্রেমে মুগ্ধ হয়ে গলায় তার বরণ মালা পরাতে, বিসুবিয়স পর্বতের সানুদেশে অমঙ্গলের সম্মুখে তার ঘরখানিকে বাঁধতে, সাগরের অকুল নীরে তুফানের ডাকে ছুটতে। রোলাঁর তূর্য্যনাদের মধ্যে তারুণ্যের এই চিরন্তন সুর- বাস্তবের কঠিন জগতে দাঁড়িয়ে তাঁর নির্নিমেষ চক্ষু দুটিকে তিনি নিবন্ধ রেখেছেন সুদূরের আদর্শের উপর। কর্মের প্রাঙ্গণে কোলাহলের আজ অন্ত নেই; লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবন যাচ্ছে ক্লান্তির মধ্যে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে। এই মৃত্যুর আর কোলাহলের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি না- নতুন পিরামিডের সৃষ্টি- যার মাথা উঠছে উপরের দিকে ঠেলে। দেখতে পাচ্ছি না বিজ্ঞানের নব নব জয়ের আর আবিষ্কারের মহিমাকে, বিপ্লবী আত্মার আর ধর্মের অভ্যূদয়কে দেখতে পাচ্ছি না, ভারতবর্ষের আর চীনের মত যে সকল প্রাচীন জাতি সমাহিত ছিল কবরের মধ্যে- তাদের পুনরুত্থানকে। দেখতে পাচ্ছি না গান্ধী, সানিয়াৎ সেন আর লেনিনের মত নেতাদের। যারা এক একটা জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতিমূর্তি। মানুষের ভবিষ্যতে যার আশা, অবিচলিত দৃষ্টি যার নিবদ্ধ উদয় গিরির শিখরে-সেখানে সূর্য ওঠার চির নবীন দেশ- তাকে আমরা না ভালবেসে পারি না।

১৫.
মনীষী রম্যাঁ রঁলাকে নিয়ে যতীন সরকার স্যার আরো লিখছেন, ‘ফরাসি মনীষী রম্যাঁ রলাঁকে হয়ত অনেকেই বিপ্লবী বলে মানতে চাইবেন না। তবু, এই রম্যাঁ রলাঁর অনেক লেখাই আমার (এবং আমার মতো অনেকের) মধ্যে এক সময় এক ধরনের বিপ্লবী ভাবনার সঞ্চার করেছিল। রলাঁর ‘আই উইল নট রেস্ট’-এর বাংলা অনুবাদ ‘শিল্পীর নবজন্ম’ পড়ে কৈশোরেই আমি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। এর পরে তার ‘রামকৃষ্ণ চরিত’, ‘বিবেকানন্দ চরিত’ ও ‘গান্ধী চরিত’ আমার মনের গভীরে ছাপ ফেলে। এরও পরে হাতে আসে তার ‘ভারতবর্ষ’ নামক বইটি। ১৯১৪ থেকে ১৯৪৪-এর সময়সীমায় রচিত রলাঁর দিনলিপি থেকে ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় ভাবনাগুলোকে পৃথক করে প্রকাশিত হয়েছিল ‘এঁদ্’ নামে একটি গ্রন্থ। মূল ফরাসি থেকে এটিকে বাংলায় অনুবাদ করে অবন্তী কুমার সান্যাল প্রকাশ করেছেন ‘ভারতবর্ষ’। এই বইটি থেকে শুধু ভারতবর্ষ সম্পর্কে নয়, ধর্ম, সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজতন্ত্র বিপ্লব ইত্যাদি বহু বিষয় সম্পর্কে রলাঁর মতামতের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর ধারণাগুলো যেমন স্বচ্ছ, তেমনই যুক্তিগ্রাহ্য। আবেগকে তিনি যুক্তি দিয়ে এমনভাবে শোধন করে নেন যে তাঁকে কোনো মতেই আবেগপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা যায় না। আবেগ আর যুক্তিকে একান্ত সুসমন্বিত করে নিতে পারেন তিনি। আর সে কারণেই একই সঙ্গে তিনি ভাববাদী গান্ধী ও বস্তুবাদী লেনিনের গুণগ্রাহী হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে জানতে চান ভারতবর্ষকে জানতে হলে তাকে কী করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, সে-জন্য বিবেকানন্দের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। কারণ বিবেকানন্দের ভেতর কোনো নেতিবাচকতা নেই- সবই ইতিবাচক। রলাঁ নিজেও তো তা-ই ছিলেন। তার ভেতরেও সবই ছিল ‘পজিটিভ’। ‘নেগেটিভ’ কিছুই ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ তাঁর মনে ধরেছিল এবং সেই পরামর্শের সূত্র ধরেই বিবেকানন্দের গুরু রামকৃষ্ণের সাধনা সম্পর্কে তিনি অবহিত হলেন এবং রচনা করলেন ‘রামকৃষ্ণ চরিত’ ও ‘বিবেকানন্দ চরিত’। নিজে ‘পজিটিভ’ ছিলেন বলেই অন্য সকলের ভেতরকার পজিটিভকে তিনি নিংড়ে বের করে আনতে জানতেন। কারোরই ‘নেগেটিভ’-এর ছিদ্রান্বেষণ করে নিজের শক্তির অপচয় করেননি। এই পজিটিভই যে তিনি নিষ্কাশন করেন মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীর ভেতর থেকেও, তাঁর ‘গান্ধী চরিত’তারই প্রমাণবহ। … রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে এই কবি মনীষীর সদর্থক সকল ভাবনাকে নিজের চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছেন তিনি। আবার এক সময় রবীন্দ্রনাথকেও তিনি ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বিভ্রান্তির হাত থেকে মুক্ত করে আনেন। অর্থাৎ রম্যাঁ রলাঁ সব দিক দিয়েই ছিলেন পজিটিভ বা সদর্থক। অন্যের সদর্থকতাকে নিজের ভেতর ও নিজের সদর্থকতাকে অন্যের ভেতর সঞ্চারিত করে দেয়ার অনন্যসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। এই অনন্যসাধারণ ক্ষমতার দরুনই ভারতবর্ষের আধ্যাত্মবাদী মনীষীদের ভাবান্দোলনের প্রতি তিনি যেমন শ্রদ্ধাবান হতে পেরেছেন, তেমনই শ্রদ্ধাবান হয়েছেন রাশিয়ার বস্তুবাদী বিপ্লবীদের বিপ্লবসাধনার প্রতিও। গান্ধী ও লেনিনের মতো সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চরিত্রের প্রতি সমান শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারেন,- রম্যাঁ রলাঁর মতো এমন মানুষ খুব বেশি নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসন-কর্তৃপক্ষ তথা কম্যুনিস্ট পার্টির সকল দোষত্রুটি সম্পর্কে সচেতন থেকেও তিনি মানুষের ভবিষ্যতের জন্য ভরসা রেখেছিলেন ওই সোভিয়েত ও কমিউনিস্টদের ওপরই। তাই ফ্যাসিবাদের আক্রমণে বিপন্ন সোভিয়েতকে রক্ষা করার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, সোভিয়েতকে ধ্বংস হতে দেয়া মানে যে মানবসভ্যতার আলোটিকেই নিভিয়ে দেয়া-এ কথাই বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন।’

১৬.
যতীন স্যার লিখছেন, ‘কী আশ্চর্য স্বচ্ছ দৃষ্টির পরিচয়ই না দিয়েছেন ফরাসি মনীষী রম্যাঁ রলাঁ। কোনোদিন এই উপমেহাদেশে তিনি পা রাখেননি, এখানকার কোনো ভাষাও তিনি জানতেন না, এমনকি আধুনিক পাশ্চাত্যের সঙ্গে উপমহাদেশের সংযোগ যে ভাষার মাধ্যমে সেই ইংরেজিও তাঁর জানা ছিল না। তাহলে, সুদূর ফ্রান্সে বসে কী করে তিনি ভারতবর্ষের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে গেলেন? বাংলার রামকৃষ্ণের মতো একজন প্রায়-নিরক্ষর গ্রাম্য ধর্মসাধকের সাধনার মর্ম নিজে উপলব্ধি করে অপরের মর্মে মর্মে সঞ্চারিত করে দিতে পারলেন কী করে? রামকৃষ্ণ-শিষ্য বিবেকানন্দের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় না-থাকা সত্ত্বেও তাঁর জীবনবেদ রম্যাঁ রলাঁর হৃদয়বেদ্য হলো কীভাবে? আধ্যাত্মবাদী ও অহিংসাবাদী গান্ধীর মধ্যে কীভাবে একজন বিপ্লবীকে শনাক্ত করলেন তিনি? রম্যাঁ রলাঁ সম্বন্ধে যখনই এ-সব কথা ভাবি, তখনই অপার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। কবি রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন তিনি। এই দুই কবি ও বিজ্ঞানীর ভেতর ভারতবর্ষের নবীন অভ্যুদয় তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁদের স্বদেশের সুধীজনদের অনেকের কাছে এখনো যা প্রত্যক্ষ হয়নি, রম্যাঁ রলাঁর কাছে তখনই তা হয়েছিল। শুধু রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ চন্দ্র নন, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম খন্ডের সঙ্গে পরিচিত হয়েই এটিকে ‘নোবেল প্রাইজ পাওয়ার উপযুক্ত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। আবার অজপাড়াগাঁয়ের নিম্নবর্গের নিরক্ষর কবি মনসুর বয়াতি বিরচিত ‘দেওয়ানা মদিনা’র করুণ কাহিনী পড়েও হয়ে পড়েন একান্ত অভিভূত। বোঝা যায় : বাংলা তথা ভারতবর্ষের সমাজ-জীবনে নাগরিক ও উচ্চবর্গের অন্তর্গত চিন্তাবিদদের ভূমিকার পাশাপাশি গ্রামীণ নিম্নবর্গের গুরুত্ব সম্পর্কেও অবহিত ও সচেতন ছিলেন একান্ত প্রজ্ঞাবান মনীষী রম্যাঁ রলাঁ। কিন্তু, কী আশ্চর্য, আজ আমরা এই মনীষীকে প্রায় ভুলেই গিয়েছি। অথচ, তাঁর প্রজ্ঞার শরণ নিয়ে একুশ শতকের এই দুর্বিনীত কালেও আমাদের পথচলা অনেক স্বচ্ছন্দ হতে পারে। আজকে যাঁরা ফুকো-দেরিদার গুণগ্রাহী হয়েছেন তাঁরা যদি এঁদের পূর্বসূরি রলাঁর ভাবনাবৃত্তে ক্ষণিকের জন্যও প্রবেশ করেন তবে তাঁদের চিন্তার অনেক জট খুলে যাবে, উত্তর-আধুনিকতার ভ্রান্তিবিলাসেও মগ্ন হয়ে থাকতে হবে না তাঁদের। ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও আধিপত্যকে পোক্ত করে তোলার লক্ষ্যেই প্রাচ্যকে জানার প্রয়াসে পশ্চিমাদের হাতে যে ‘প্রাচ্যবাদে’র সৃষ্টি হয়েছিল, রম্যাঁ রলাঁর প্রাচ্যদর্শন তা থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। বর্তমানকালের এডওয়ার্ড সাঈদের কাছ থেকে যে শিক্ষা আমরা গ্রহণ করছি, তার পরিপূরক শিক্ষাই আমাদের জন্য রেখে গেছেন বিগতকালের রম্যাঁ রলাঁ। মনীষী রম্যাঁ রলাঁর শিক্ষা আমাদের চিন্তাচর্চাকে একদেশদর্শিতার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে, সামগ্রিকতার বোধে আমাদের চিত্তকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।’

(তথ্যসূত্র / অকৃপণ ঋণ : উইকপিডিয়া, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক কালের কণ্ঠ, কালি ও কলম, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত