খ্যাপা শিল্পস্রষ্টা ঋত্বিক ঘটক

প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:২৯

আজ মহান চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের চলে যাওয়ার দিন। উল্কার মতোই জ্বলে ওঠে ধপ্ করে নিভে যাওয়া এক খ্যাপা শিল্পস্রষ্টা ঋত্বিক ঘটক। তাঁর সৃজনশীলতার সূচনা হয় কবি এবং গল্প লেখক হিসেবেই। এরপর তিনি মঞ্চের সাথে যুক্ত হন আর ধীরে ধীরে গণনাট্যসংঘের সাথে জড়িয়ে পড়েন। সেখানেই সেলুলয়েডের হাতছানি তাঁকে পেয়ে বসে।

অনন্য সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার ঋষিকেশ দাশ লেনে ঐতিহ্যময় ঘটক পরিবারে । যদিও তাঁদের আদি নিবাস ছিলো বাংলাদেশের পাবনা জেলার ভারেঙ্গা'য়, এক সময়ের উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত নগরবাড়ী ঘাটের অদূরে। তাঁর পরিবারের মধ্যে আগে থেকেই শিল্প-সাহিত্যের চর্চা ছিল। তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক এবং মায়ের নাম ইন্দুবালা দেবী। তিনি বাবা-মায়ের ১১তম এবং কনিষ্ঠতম সন্তান ছিলেন। আদি পুরুষ পণ্ডিত কবি ভট্টনারায়ণ। তারই বারেন্দ্রশ্রেণীর শাণ্ডিল্য গোত্রের জমিদার বংশের নীলরক্ত ধারণ করেই জন্মেছিলেন ঋত্বিক। তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। কবি ও নাট্যকার হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তাঁর বড় ভাই মনীশ ঘটক ছিলেন ওই সময়ের খ্যাতিমান এবং ব্যতিক্রমী লেখক। একই সাথে তিনি ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক এবং একজন সমাজকর্মী। আইপিটিএ থিয়েটার মুভমেন্ট এবং তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গেও মনীশ ঘটক জড়িত ছিলেন। মনীশ ঘটকের মেয়ে বিখ্যাত লেখিকা ও সমাজকর্মী মহাশ্বেতা দেবী। 

ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং সর্বোপরি ১৯৪৭ এর ভারত ভাগের ফলে ঘটক পরিবার কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হয়। নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে শরণার্থী হবার মর্মবেদনা ঋত্বিক কোনদিন ভুলতে পারেননি এবং তাঁর জীবন-দর্শন নির্মাণে এই ঘটনা ছিল সবচেয়ে বড় প্রভাবক যা পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বারংবার ফুটে ওঠে। শরণার্থী জীবনের অস্তিত্বের সংকট তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করে এবং পরবর্তী জীবনে তাঁর চলচ্চিত্রে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

ঋত্বিক ঘটক ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম.এ কোর্স শেষ করেও পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি। নাটকের প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে যে নাটকের নেশাতেই এম.এ কোর্স শেষ করেও পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি।

ছাত্র অবস্থাতেই লেখালেখির সাথে যুক্ত ঋত্বিক ঘটক। ১৯৪৮ সালে ঋত্বিক ঘটক লেখেন তাঁর প্রথম নাটক কালো সায়র। একই বছর তিনি নবান্ন নামক পুণর্জাগরণমূলক নাটকে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে (আইপিটিএ) যোগদান করেন। এসময় তিনি নাটক লেখেন, পরিচালনা করেন ও অভিনয় করেন এবং বের্টোল্ট ব্রেখট ও নিকোলাই গগোল-এর রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করেন। ঋত্বিক ঘটক ১৯৫১ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের 'ছিন্নমূল' সিনেমার মধ্য দিয়ে। তিনি এই ছবিতে একই সাথে অভিনয় এবং বিমল রায়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। এর দু'বছর পর ১৯৫৩ সালে তাঁর একক পরিচালনায় প্রথম ছবি 'নাগরিক'।

বাংলা চলচ্চিত্র আকাশের এক উজ্জল নক্ষত্রের নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক। মাত্র ৫১ বছরের জীবদ্দশায় ঋত্বিক কুমার ঘটক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন ৮টি। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন সব মিলিয়ে ১০টি। আরও অনেকগুলো কাহিনীচিত্র, তথ্যচিত্রের কাজে হাত দিয়েও শেষ করতে পারেননি। পঞ্চাশের দশকে শিল্প সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে বিপ্লবের ছোয়া আনতে যে কয়টি নাম উচ্চারিত হয় তার মধ্যে ঋত্বিক ঘটক অন্যতম। সিনেমা জগতে রীতিমত ‘ভাংচুর’ করে স্থানটা গড়ে নিয়েছেন তিনি। সেলুলয়েডের এই যোদ্ধার অনবদ্য সব সৃষ্টিগুলো শুধু সিনেমা দর্শন নয় জীবন পাঠও হয়ে উঠেছে। পরিচালনা, অভিনয়, নাটক, চিত্রনাট্যসহ বিভিন্ন অঙ্গনে ছিলো তাঁর অবাধ বিচরণ।

নাগরিকের ছয় বছর পর ১৯৫৭ তৈরি হয় ঋত্বিকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’, যা মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। ছবির নায়ক ড্রাইভার এবং নায়িকা তার গাড়ি। ‘অযান্ত্রিক’ এর গল্প এগিয়ে গেছে এভাবেই। সেসময় পুরো ভারত জুড়েই অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করে ছিলো ছবিটি। অযান্ত্রিক প্রসঙ্গে আরেক জ্বল জ্বলে তারা সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন,
‘ঋত্বিক ঘটকের দ্বিতীয় ছবি অযান্ত্রিক যারা দেখেছিলেন,তারা ঋত্বিকের অসামান্য বৈশিষ্ট ও মৌলিকতার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন’। ট্যাক্সি ড্রাইভার বিমলের যে চরিত্র ঋত্বিক নির্মাণ করেন তার সাথে পরবর্তীতে মিল পাওয়া যায় সত্যজিৎ এর অভিযান(১৯৬২) সিনেমার ট্যাক্সি চালক নারা সিং ও মার্টিন স্করসেসির ট্যাক্সি ড্রাইভার(১৯৭৬) এর ট্রাভিস বিকেল চরিত্রের। ‘অযান্ত্রিক’ ১৯৫৯ সালের ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়। সেখানে ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা বিখ্যাত সমালোচক জর্জেস সাডৌল বর্ণনা করেন এভাবে, "অযান্ত্রিক কথাটার অর্থ কি? আমার জানা নেই এবং আমার বিশ্বাস ভেনিস ফেস্টিভালের কারোরই এটা জানা ছিল না। আমি পুরো গল্পটাও বলতে পারব না, কারণ সেখানে কোন সাবটাইটেল ছিল না। কিন্তু এতদস্বত্বেও আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি দেখেছিলাম"।

ঋত্বিক ঘটকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অযান্ত্রিক’ তৈরী হয়েছিলো সুবোধ ঘোষের প্রথম ছোটগল্প ‘অযান্ত্রিক’ থেকে। একজন মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্ক নিয়েই তৈরী এই সিনেমাটি। সত্যজিৎ রায় এ ছবিটি দেখে ঋত্বিককে বলেছিলেন, "ঋত্বিকবাবু, সিনেমাটা সময় মত রিলিজ করলে আপনি পথিকৃৎ হতেন"।‘চলচ্চিত্র সাহিত্য ও আমার ছবি’ নিবন্ধে ঋত্বিককুমার ঘটক ‘অযান্ত্রিক’ সম্পর্কে বলেছিলেন -"কতখানি সার্থক হয়েছি সেটা আপনারা বলবেন-তবে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। সুবোধ বাবুর মূল বক্তব্যের প্রতি আমি চেষ্টা করেছি বিশ্বস্ত থাকতে। জানি না কতখানি কৃতকার্য হয়েছি।"

একই বছর অর্থাৎ ১৯৫৮ সালেই ঋত্বিক মুক্তি দেন তার তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’। মূল গল্প শিবরাম চক্রবর্তীর। মূল চরিত্র কাঞ্চনের চোখ দিয়ে তৎকালীন কলকাতার বাস্তব চালচিত্র দেখা যায়। এই চলচ্চিত্রে ঐ সময়ের নিম্নবিত্ত মানুষের অভাবের ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যায়। সিনেমাটোগ্রাফিতে ডীপ ফোকাসের ব্যবহার লক্ষনীয়। এই সিনেমার সাথে ফ্রান্সের ন্যুভেল ভাগের বিখ্যাত সিনেমা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ (১৯৫৯) -এর কাহিনীর সাদৃশ্য রয়েছে।

১৯৫৯ সালে ‘কত অজানারে’ নামের একটি সিনেমার কাজ অনেকদূর সম্পন্ন করেও অর্থনৈতিক কারণে সেটা আর শেষ করতে পারেননি ঋত্বিক। এক সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলেছিলেন, "মানুষের অবক্ষয় আমাকে আকর্ষণ করে। তার কারণ এর মধ্য দিয়ে আমি দেখি জীবনের গতিকে,স্বাস্থ্যকে। আমি বিশ্বাস করি জীবনের প্রবাহমানতায়। আমার ছবির চরিত্ররা চিৎকার করে বলে আমাকে বাঁচতে দাও। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সে বাঁচতে চায় -এ তো মৃত্যু নয়,জীবনেরই জয় ঘোষণা।" এই জয় ঘোষনার সূত্রপাত হয়েছিল ১৪ এপ্রিল ১৯৬০ সালে কলকাতায় মুক্তি পাওয়া ঋত্বিক ঘটকের বাংলা ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মাধ্যমেই। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ঋত্বিকের চতুর্থ ছবি আর বক্স অফিসে তাঁর প্রথম সাফল্য। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের বার্ষিক চিত্রবীক্ষণ পত্রিকায় ঋত্বিক ঘটক জানান, দেশবিভাগের পেক্ষাপটে নির্মিত মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২) এই তিনটি চলচ্চিত্র মিলে ট্রিলজি নির্মিত হয়েছে। তাঁর ভাষ্যে, "একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের দেখা হলো-এ ধরনের পুতু পুতু গল্পে আমার রুচি নেই। আমি আপনাদের ঘা দেব এবং বোঝাবো, এ কাহিনী কাল্পনিক নয়। বলবো, চোখের সামনে যা দেখছেন তার অন্তর্নিহিত বক্তব্য, আমার বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করুন। যদি সচেতন হন এবং আমার উত্থাপিত প্রতিবাদটি উপলব্ধি করতে পারেন, তবে বাইরে বেরিয়ে বাস্তবকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেন,তাহলেই স্বার্থক আমার ছবি করা।"

‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্র সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটক বলেন, "মেঘে ঢাকা তারা নামটি আমার দেয়া, মূলগল্পটি ‘চেনামুখ’ নামে নামকরা একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পটার ভেতর কিছু একটা ছিল যা আমাকে খোঁচা দিচ্ছিল, যে কারনে শেক্সপিয়রের ‘দ্য ক্লাউড ক্যাপড স্টার’ নামটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল এবং সাথে সাথে নতুন চিত্রনাট্য লেখায় হাত দিয়ে দিলাম ”। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মূল গল্পকার শক্তিপদ রাজগুরুর ভাষ্যমতে, “ সাত বছর আমি ঋত্বিকের সঙ্গে ঘর করেছি। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কুমারী মন’,‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে ছিলাম। পরে আমি অন্য কাজে মুম্বাই চলে যাই শক্তি সামন্তের কাছে। আমাদের একটা জমাটি টিম ছিল। কোমল গান্ধারের পর থেকে টিম ভাঙতে শুরু করে।” এই চলচ্চিত্রে ঋত্বিক শব্দ নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। দক্ষিণ ভারতীয় হংসধ্বনি রাগ এবং এ রাগভিত্তিক খেয়াল ব্যবহার করেন সিনেমার আবহ সংগীত হিসেবে। ঋত্বিক প্রথমবারের মত রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেন এই ছবিতে, এছাড়াও বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। ভারতের এক জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার সাম্প্রতিক জরিপে প্রকাশ যে, নীতার মুখে এ ছবির সংলাপ ‘দাদা,আমি বাঁচতে চাই’ বাংলা ছবির সবচেয়ে প্রচলিত সংলাপ। ঋত্বিক ঘটকের এই সিনেমায় ভারত বিভাজনের সেই করুণ সময়কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ‘পথের পাঁচালী’র পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চর্চিত এই সিনেমাটি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ট ধ্রুপদী সিনেমা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ চলচ্চিত্র বিষয়ক মাসিক সাময়িকীতে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় এটি ২৩১ নম্বরে অবস্থান পেয়েছে।

ঋত্বিকের নিজের ভাষায়, "বাংলা ভাগটাকে আমি কিছুতেই গ্রহন করতে পারিনি– আজও পারিনা। ইতিহাসে যা হয়ে গেছে তা পাল্টানো ভীষন মুশকিল, সেটা আমার কাজও নয়। সাংস্কৃতিক মিলনের পথে যে বাধা, যে ছেদ,যার মধ্যে রাজনীতি-অর্থনীতি সবই এসে পড়ে, সেটাই আমাকে প্রচণ্ড ব্যথা দিয়েছিল"।

ঋত্বিক যে সাংস্কৃতিক মিলনের কথা বলেছেন সেটা তিনি চিত্রায়ণ করেছিলেন তাঁর পরের সিনেমাতে যার নাম ‘কোমল গান্ধার’। ‘কোমল গান্ধার’ চলচ্চিত্রের নির্মানসাল ১৯৬১।

‘কোমল গান্ধার’ উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রাগ বিশেষ। এই রাগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই সিনেমার এই নামকরণ। এ ছবির মূলসুর দুই বাংলার মিলনের। এই ছবিতে ঋত্বিক দুইটি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি’ গানটি ব্যবহার করেন,এছাড়াও বিয়ের প্রাচীন সুরের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।

‘কোমল গান্ধার’ যেমন সাংস্কৃতিক মিলনের কথা বলে,তেমনভাবে ঋত্বিকের পরের ছবি ‘সুবর্ণরেখা’ বর্ণনা করে দেশভাগের কুফলসমূহ। ১৯৬২ সালে তৈরী হলেও মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৫ সালে। ঋত্বিক তিনটি প্রজন্মের গল্প বলেছেন এই সিনেমাতে। প্রথম প্রজন্ম ঈশ্বর, হরপ্রসাদ। দ্বিতীয় প্রজন্ম সীতা, অভিরাম। তৃতীয় প্রজন্ম বিনু। দেশভাগ ও তার ফলাফলের কারণে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে প্রথম দুইটি প্রজন্মের স্বপ্ন-আকাঙ্খা। তৃতীয় প্রজন্ম মাত্র তাঁর যাত্রা শুরু করেছে, তাঁর ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা আমরা জানি না। তবে ঋত্বিক চেয়েছিলেন যেন তা সুন্দর হয়, তাই সিনেমার শেষে লিখে দিয়েছিলেন, "জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের"।

ঋত্বিকের এই ট্রিলজিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি বড় ভূমিকা আছে। একটি সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া আমি কিছুই প্রকাশ করতে পারি না। আমার জন্মের অনেক আগেই তিনি আমার সমস্ত অনুভূতি জড়ো করে ফেলেছিলেন। তিনি আমাকে বুঝেছিলেন এবং সেসব লিখেও ফেলেছিলেন। আমি যখন তাঁর লেখা পড়ি তখন আমার মনে হয় যে সবকিছুই বলা হয়ে গেছে এবং নতুন করে আমার আর কিছুই বলার নেই’।
১৯৬২ সালে বানালেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সিজর্স’ ও ১৯৬৩ সালে ডকুমেন্টরী ‘ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান’। এই সময় ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ নামে একটি সিনেমার কাজ শুরু করলেও আর শেষ করতে পারেননি। ১৯৬৫ সালের দিকে বাংলা মদ ধরলেন, এমনকি স্নান করাও ছেড়ে দিলেন। তাঁর এমন জীবনযাত্রার ফলে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হলেন। ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৫ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনেতে বসবাস করেন। ১৯৬৫/৬৬ সালের দিকে ঋত্বিক পুনের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন, দু’বছর কাজ করেছেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন আরও ৩ মাস। এখানে শিক্ষকতা করার সময় তিনি শিক্ষার্থীদের নির্মিত ‘ফিয়ার’ ও ‘রঁদেভূ’ নামের দুইটি সিনেমার সাথে যুক্ত ছিলেন।

ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মণি কাউল, কুমার সাহানি এবং প্রসিদ্ধ আলোকচিত্রী কে কে মহাজন তাঁরই ছাত্র। ঋত্বিক তাঁর এই শিক্ষকতা জীবনকে চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের উপরেই স্থান দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য, "আমি মনে করি, আমার জীবনে যে সামান্য কয়েকটি ছবি করেছি সেগুলো যদি পাল্লার একদিকে রাখা হয়, আর মাস্টারি যদি আরেক দিকে রাখা হয় তবে মাস্টারিটাই ওজনে অনেক বেশি হবে। কারণ কাশ্মীর থেকে কেরালা, মাদ্রাজ থেকে আসাম পর্যন্ত সর্বত্র আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আজকে ছড়িয়ে গেছে। তাদের জন্য আমি যে সামান্য অবদান রাখতে পেরেছি সেটা আমার নিজের সিনেমা বানানোর থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ"।

এরপর ১৯৬৯ সালের দিকে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় ঋত্বিককে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শ্রীমতি সুরমা ঘটকের এক লেখায় জানা যায়, ঋত্বিকের সিজোফ্রোনিয়া ছিলো। এর কারণও সুবোধ্য। ‘সুবর্ণরেখা’ সৃষ্টির পর দীর্ঘদিন তার হাতে কোনো ছবি ছিলো না। নিজের প্রতি অত্যাচারের জেদ ঐ সময় থেকেই। মদ তখন তার ব্যর্থতা ভোলার অনুষঙ্গ। ঐ সময়ে তিনি একবার মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং দীর্ঘদিন তাঁকে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছিলো। এই অত্যাচারের ফলেই ঋত্বিকের দেহে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি। ১৯৬৯ সালেই ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন।

ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে এই সময়কালে কোন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে না পারলেও তিনি কিছু তথ্যচিত্র ও শর্টফিল্মের কাজ করেন। এর মধ্যে আছে, সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো(১৯৬৭), ইয়ে কিঁউ(১৯৭০), পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য নিয়ে পুরুলিয়ার ছৌ(১৯৭০), লেনিনের ১০০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমার লেনিন(১৯৭০), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে দূর্বার গতি পদ্মা(১৯৭১) এবং আরও পরে ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে তথ্যচিত্র রামকিঙ্কর(১৯৭৫, অসমাপ্ত)।

'তিতাস একটি নদীর নাম' চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহের কারণ হিসেবে ঋত্বিক কুমার ঘটক বলেন, "এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো, সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল। … অদ্বৈতবাবু অনেক অতিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে প্রাণ থেকে, ভেতর থেকে লেখা। আমি নিজেও বাবুর চোখ দিয়ে না দেখে ওইভাবে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পুনর্জীবনটা দেখতে যাননি। আমি দেখাতে চাই যে,মৃত্যুর পরেও এই পুনর্জীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা’। এই চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে দেখা যায়,চরে গজিয়ে ওঠা নতুন ঘাসের মধ্যে দিয়ে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে একটি শিশু। নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়ে সিনেমাটি শেষ হয়। ঋত্বিকের ভাষায়, "একটি সভ্যতাকে কি চিরতরে ধ্বংস করে ফেলা যায়? না, যায় না। এর শুধু রূপান্তর ঘটে। এটাই আমি এই ফিল্মের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলাম"।

ছবিটিতে বাংলাদেশের তখনকার তরুণী নায়িকা কবরীকে চরিত্রের প্রয়োজনে বলতে গেলে একেবারে ভেঙ্গেই গড়েছিলেন ঋত্বিক। ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেন বাংলাদেশের শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রবীর মিত্র এভাবেই বলেন, "এই মাকড়া, এই ছোঁড়া এদিকে আয়, এই সব বলেই তিনি(ঋত্বিক) আমাকে ডাকতেন। কখনোই আমার নাম ধরে ডাকতেন না। বলতেন, এডিটিংয়ের সময় তুই আসিস। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি কিছুই বলেন না। কাজের ভেতরেই ডুবে থাকেন। মুখ তুলেন না। ঋত্বিক-দা চলে গেলেন। তার না-বলা কথাটা আমার আর শোনা হয়নি।" ২০০৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা দর্শক,চলচ্চিত্র সমালোচকদের ভোটে এ চলচ্চিত্রটি সেরা বাংলাদেশী ছবির মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে। ঋত্বিকের মূল্যায়ন, "আমি ছাড়া তিতাস হতো না। তিতাস ছিলো আমার স্বপ্ন। আমার মতো মমতা নিয়ে এই কাহিনীকে কেউ তুলে ধরতে আগ্রহী হতেন না"।

১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এই সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। মূল চরিত্র একজন মাতাল বুদ্ধিজীবী নীলকণ্ঠ বাগচী, যে তাঁর বন্ধুদের মত সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নিজেকে বিক্রি করে দেয়নি। নীলকণ্ঠ চরিত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক স্বয়ং। সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক হলেও এটা ১৯৪৭ এর দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আর নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সময়ের একটি নির্মোহ-নির্মম সমালোচনাও বটে। সুশীল লেখক সত্যজিৎ বসু যখন তাঁকে বলছেন বাংলাদেশ নিয়ে তার ভাবনার কথা, নীলকণ্ঠ বাগচীর কণ্ঠে তখন চরম উপহাস, "ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো।" এই ছবির ব্যাপারে ঋত্বিক বলেন, "১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমি যেমনটি দেখেছি, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে আমি ঠিক সেটাই দেখাতে চেয়েছি। এটাতে কোন ভাবাদর্শের বর্ণনা নেই। আমি কোন রাজনীতিকের দৃষ্টিতে এটাকে দেখিনি। কোন রাজনৈতিক ভাবাদর্শকে তুষ্ট করা আমার কাজ নয়"। মাত্র দুইদিনে ঋত্বিক ঘটক এ ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঋত্বিকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনায় নির্মিত ছবিতে নিজেরই চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

ঋত্বিকের চলচ্চিত্র জগতে আসার অনেকগুলো কারণ ছিল। তাঁর মেজদা (সুধীশ ঘটক) ছিলেন ‘টেলিভিশন এক্সপার্ট’। তিনি গ্রেটব্রিটেনে ডকুমেন্টারি ক্যামেরাম্যান হিসেবে ছ’বছর কাজ করেন। পরে সুধীশবাবু নিউ থিয়েটার্সে যুক্ত হন। বহু ছবিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি,তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাননবালা-সায়গলের ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। বাড়িতে আসতেন বড়ুয়াসাহেব থেকে বিমল রায় পর্যন্ত অনেকেই। আর পাঁচজন যেমন ওঁদের ছবি দেখেন তেমনই ঋত্বিক ওই সব ছবি দেখে বিশেষ উৎসাহ পেতেন। কারণ দাদার সঙ্গে তাঁদের আড্ডা চলত বাড়িতেই।

হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র চলচ্চিত্র দিয়েই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের কাতারে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি।স্বদেশ পালের মতো বিশ্ব চলচ্চিত্রের বোদ্ধারা ঋত্বিককে এই সম্মানের জায়গাটুকু বরাবরই দিয়ে এসেছেন। ব্যক্তি ঋত্বিক ঘটককে কখনোই কেবল চলচ্চিত্রকার পরিচয়ে আটকে রাখা যায় না। এই উপমহাদেশের শিল্পাঙ্গনে ঋত্বিক ঘটকের নামটি এমন এক শিল্পীর যিনি ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’ (Art for arts sake) - এই তত্ত্বকথায় বিশ্বাস না করে শিল্পকে ব্যবহার করেছেন মানবতার স্বার্থে কাজে লাগানোর এক মাধ্যম হিসেবে। একজন ঋত্বিক ঘটককে আমরা তাই বারবার দেখতে পাই গল্পকার, নাট্যকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকারসহ দৃশ্য শিল্পের প্রায় সব রূপেই। গণমানুষের কাছে নিজের বার্তা পৌঁছে দিতে তার সৃজনশীলতার পক্ষে সম্ভব এমন সবগুলো মাধ্যমেই কাজ করে গেছেন তিনি। শিল্পের এই বিদ্রোহী শিশু জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও খুঁজে গেছেন শিল্পের নবতম মাধ্যমকে যা দিয়ে মানুষের আরও কাছে পৌঁছানো যায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত