প্রত্নগবেষক ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী

প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:৩৪

১৯১২ সালের ২৫ জুলাইয়ের সন্ধেবেলা। পুরনো ঢাকার নর্থব্রুক হলে নলিনী নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করা স্যার আশুতোষের এক অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র উঠলেন বক্তৃতা দিতে। সামনে বসে আছেন ঢাকার সুশীল সমাজ আর তৎকালীন ছোট লাট লর্ড কারমাইকেল। নলিনী বাবুর বক্তব্যের বিষয় "পূর্ববাংলার প্রত্নবস্তু সংরক্ষণের জন্য ঢাকায় একটা জাদুঘর স্থাপন করতে হবে"। এক ঘণ্টার বক্তব্য সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন । লর্ড কারমাইকেল এই ২৬ বছরের তরুণের আবেগে উজ্জ্বীবিত হয়ে নলিনীকে ২০০০ টাকা পুরস্কার দিলেন। এরপর ১৯১৪ সালে ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলে নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রতিষ্ঠানটির কিউরেটর হিসেবে যোগদান করলেন। এর আগে তিনি বছর খানেক বালুঘাট হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। নমস্য এই মানুষটি প্রত্নবস্তু সংগ্রহের জন্য হন্যে হয়ে পূর্ববাংলার প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে ক্লান্তিহীন ঘুরে বেড়িয়েছেন। সঙ্গে চিঁড়ে, মুড়ি, আখের গুড়, কাগজ, ক্যামেরা, চর্টলাইট আর একটি বেতারযন্ত্র। একশ বছর আগেকার পথঘাট আজকের দিনের মতো অতোখানি সুগম ছিল না মোটেই। পদ্মা-মেঘনার মতো বড় নদী পাড়ি দিতে হত নৌকায়। স্থলপথের বাহন বলতে ছিল হাতি, পালকি নয়তো গরুর গাড়ি। পথের কোনো প্রতিবন্ধকতাই এই তরুণ প্রত্নপাগল মানুষটিকে দমাতে পারে নি। শীতগ্রীষ্ম উপেক্ষা করে তিনি মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছেন অচেনা গ্রাম্যপথে। অথচ তাঁর এই প্রত্নগবেষনা কাজে বেতনের অর্থ ছিল খুবই সামান্য।

নলিনীকান্ত ভট্টশালী ছিলেন এক অনন্য চরিত্রের মানুষ। কোথাও কোনও মূর্তি আবিস্কার হয়েছে শুনলে সেটি সংগ্রহ করার জন্য তখনই সেখানে ছুটে যেতেন তিনি। প্রত্নবস্তুটি খুব সহজেই যে জাদুঘরে আনতে পারতেন, তা নয়। কৌশলের আশ্রয় নিতেন তিনি, কারণ গ্রামবাসী সে মূর্তিতে সিঁদুর লাগিয়ে পূজা করতো। তখন এই প্রত্নপাগল মানুষটি ওদের বলতেন, "এ মূর্তিটি তোমরা আমাকে দাও। আমি জাদুঘরে নিয়ে পূজা দেব।" জাদুঘর সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি দিনের পর দিন চিঁড়ে, মুড়ি আর আখের গুড় খেয়ে বসে থাকতেন পূর্ববাংলার কোনও নিভৃত গ্রামের পুকুরের পাড়ে। জনশ্রুতি, পুরাকীর্তি সংগ্রহের নেশায় একবার নাকি তিনি পুকুরের ধারে একনাগাড়ে চারদিন বসে রয়েছিলেন। যদিও জেলেদের দিয়ে জাল ফেলে বহু পরিশ্রমেও সেই পুরাকীর্তি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নলিনীকান্তর কাছে খবর পৌঁছেছিল যে, ওই পুকুরে তামার প্লেটের একটি ভাঙা টুকরো রাখা আছে। বলাবাহুল্য, সেবার নলিনীকান্তকে হতাশ হয়ে খালি হাতেই ঘরে ফিরতে হয়েছিল।

লোক মারফত খবর পেলে নলিনীকান্ত প্রথমেই জানতে চাইতেন নিদর্শনটি কীভাবে কার কাছে রক্ষিত আছে। যদি সংবাদ পেতেন যে প্রত্নবস্তুটি কোনো ব্রাহ্মণ পরিবারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে, তবে তিনি আদ্দি কাপড়ের পাঞ্জাবি, গলায় পুঁতির মালা এবং ধবধবে সাদা ধুতি পরে ব্রাহ্মণ বেশে হাজির হতেন। দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ ভট্টশালীকে ব্রাহ্মণের বেশে দেখে ওই পরিবার সন্তুষ্ট হয়েই ভাস্কর্যটি জাদুঘরে দান করতে রাজি হয়ে যেত। আবার থানার দারোগা অথবা জেলা প্রশাসকের কাছে যেতে হলে তিনি অফিসের উপযুক্ত পোশাকে শার্ট, প্যান্ট পরেই যেতেন। প্রয়োজন হলে নেকটাই ব্যবহার করতে দ্বিধা করতেন না। এমনিতে সচরাচর তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকতেন।

তিনি কোটালিপাড়া, সাভার, রামপাল, বজ্রযোগিনী, দেউলবাড়ি, বড়কামতা, ভারেল্লা, বিহারমন্ডল, লালমাই, ময়নামতির মত ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোকে নিয়ে প্রথম চর্চা শুরু করেন। গ্রামের মানুষের মুখে শুনতেন উপকথা, লোকগল্প শুনে ঝাড়াই-বাছাই করে খুঁজে নিতেন সত্যিটাকে। যে সত্যি দিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের বাংলার ইতিহাস। তাঁর সময়ে বাংলার ইতিহাস নিয়ে সর্বভারতীয় খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। সত্যিকার অর্থে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর গবেষণাই প্রথম সবার মনে আগ্রহ জাগিয়ে তোলে।

ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে রাখা হয়েছে এদেশের প্রাচীন মুদ্রা, মূর্তি, তাম্রলেখ, পাথর ও প্রাচীন পুঁথি। এসব দুর্লভ সংগ্রহ এই ভূখণ্ডের অতীত ইতিহাসকে বর্তমান সময়ের মানুষের কাছে তুলে ধরছে। এই অনন্য ইতিহাস তুলে ধরার ব্যবস্থা করেছেন ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী।

ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর জন্ম ১৮৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নয়ানন্ধ গ্রামের নানাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস একই জেলার পাইকপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম রোহিনীকান্ত ভট্টশালী আর মাতার নাম শরৎকামিনী। বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। কাকা অক্ষয় চন্দ্রের যত্নে তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পাইকপাড়া পাঠশালায়। এনট্রান্স পাস করেছেন ১৯০৫ সালে সোনারগাঁও হাইস্কুল থেকে। পাঁচ টাকা বৃত্তিসহ রৌপ্য পদকও পেয়েছিলেন নলিনীকান্ত ভালো ফলাফলের জন্য। ঢাকা কলেজ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। নলিনীকান্ত ভট্টশালী ১৯১২ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ১৯২২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সিফিত পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৩৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের বালুঘাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে।

১৯১১ সালে ছাত্রাবস্থায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ভারেল্লা গ্রামে প্রাপ্ত নটরাজ মূর্তির ছাপ বা লেখার পাঠোদ্ধার দিয়ে ইতিহাস গবেষণা ও চর্চা শুরু করেন । আমাদের দেশের ঐতিহাসিকেরা সাধারণত লিখতেন, বিক্রমপুরের সমস্ত কীর্তি ধ্বংস করে দিয়েছে কীর্তিনাশা পদ্মা । আসল ঘটনা হলো, তাঁরা বিক্রমপুর ভ্রমণ না করেই এ জাতীয় মন্তব্য করেন। বিক্রমপুর অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময় মূর্তি, ভাস্কর্য, তাম্রশাসন, ইট বা ইটের দেয়াল পাওয়া গেছে। দূরদর্শী গবেষক ভট্টশালী জোর দিয়ে বলতেন, বিক্রমপুরের রামপাল অঞ্চলই ছিল বাংলার প্রাচীন রাজধানী। বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের অপার সম্ভাবনাময় বিক্রমপুরে ভট্টশালীর জরিপ, খনন ও ব্যাখ্যা শত বছর পরও সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ভট্টশালী-নির্দেশিত রামপাল-বজ্রযোগিনী-নাটেশ্বর এলাকায় ২০১০ সাল থেকে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাচীন রাজধানীর বৌদ্ধবিহার, স্তূপ, মন্দির, রাস্তা প্রভৃতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত উয়ারী-বটেশ্বরের ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে ভট্টশালীর লেখা উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণার অনেক জটিল রহস্য উন্মোচনে অসাধারণ সাহায্য করছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন বিষয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাঁর নিজের কথায়, ‘মনে অহরহ ইচ্ছা জাগিতেছে যে, স্বহস্তে কোদাল ধরিয়া সমস্ত উচ্চভূমি খুঁড়িয়া সমান করিয়া দিই।’

আমাদের দেশের ইতিহাসচর্চার একদেশদর্শিতার কথা চোখে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে ভট্টশালী প্রবাসী পত্রিকায় ‘ভারতের ইতিহাসে প্রকৃতির প্রভাব’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। বিদেশিদের ভারত জয়ের মূলে এখানকার ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু দায়ী-ম্যাট্রিকুলেশনের পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত রমেশচন্দ্র মজুমদার ও খগেন্দ্রনাথ মিত্রের এ বক্তব্যকে অসার প্রমাণিত করেন তিনি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কীভাবে গ্রিক সেলিউকসকে পরাজিত করেন, মহাবীর স্কন্দ গুপ্ত কীভাবে হুনদের বিতাড়িত করেন, পৃথ্বীরাজ কীভাবে প্রথম তরাইনের যুদ্ধে ঘোরীকে পরাজিত করেন—এসব উদাহরণ দিয়ে দেখান। ইতিহাসের জটিল বিষয়কে তিনি প্রামাণিক ও সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ করেন।
ভট্টশালী শুধু প্রত্নবস্তু সংগ্রহ ও জাদুঘরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হননি। গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে প্রকাশ করেন চারটি মৌলিক গ্রন্থ। আইকনোগ্রাফি অব বুড্ডিস্ট স্কাল্পচার ইন দ্য ঢাকা মিউজিয়াম (১৯২৯) তাঁর একটি মাইলফলক গ্রন্থ। শুধু হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসন ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি গবেষণা সীমাবদ্ধ রাখেননি। ঢাকা জাদুঘরের সংগৃহীত মুসলিম শাসকদের মুদ্রা নিয়ে লেখা তাঁর কয়েনস অ্যান্ড ক্রনোলজি অব দ্য আর্লি ইনডিপেনডেন্ট সুলতানস অব বেঙ্গল (১৯২২) এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। দ্য রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি মুদ্রাবিষয়ক গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য প্রহণ করেছিল, কিন্তু যথেষ্ট তহবিল না থাকায় প্রকাশনার কাজ বিলম্বিত হয়। নিজের আর্থিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও ভট্টশালী নিজ খরচেই গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। দেশের ইতিহাসের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ হলে এ রকম কাজ করা সম্ভব, তা সহজে অনুমেয়।

চারটি মৌলিক বই ছাড়াও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা বিষয় নিয়ে ভট্টশালী শতাধিক প্রবন্ধ লেখেন। তিনি প্রাচীন হস্তলিপিবিশারদও ছিলেন। মূর্তিলিপি ও তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু শূন্যস্থান পূরণ করেন এবং নতুন বিশ্লেষণে তা সমৃদ্ধ করেন।

বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর নির্মাণ প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯১২ সালে ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য যে সম্মেলন হয় তার প্রধান ও প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন ডক্টর নলিনীকান্ত ভট্টশালী। আর সে জন্যই ১৯১৩ সালে ঢাকার নিমতলীতে প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ডক্টর নলিনীকান্ত ভট্টশালী ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর থাকা অবস্থায় মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, কোটালীপাড়া, যশোর, কলিকাতা, নরসিংদী, দিনাজপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, ভাওয়াল, পরিভ্রমণ করে মূর্তি, তাম্রশাসন, স্বর্ণমুদ্রা, পুঁথি সংগ্রহ করেছেন।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে নলিনীকান্তের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ভালো সম্পর্ক ছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও কবি জসিম উদ্দিনের সাথেও। পরিশ্রমী ও মেধাবী সংগঠক ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী ১৯৪৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জাদুঘরের বাণী কুটিরে মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত