রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ

প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:১৯

১.
জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় রূপসী বাংলার কবি, বলা হয় নির্জনতার কবি, বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবিও বলা হয়। তবে রূপসী বাংলার কবি নামেই তিনি বেশি সুপরিচিত। জীবনানন্দ দাশ, যিনি কবিতার পংক্তিতে উঠিয়ে এনেছেন চিরায়ত বাংলার অপরূপ রূপকে। বলেছিলেন উপমাই কবিত্ব। বহুমুখী উপমায় বাংলার চিরায়ত রূপকে কে আঁকতে পেরেছেন তার চেয়ে বেশি? জীবনানন্দ দাশ তার লেখনীর মধ্য দিয়ে বাংলার রূপ-সৌন্দর্যকে এত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, যার তুলনা তিনি নিজেই। আর তাই আপন সৃষ্টিতে জীবনানন্দ দাশ হয়ে ওঠেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি, আমাদের প্রাণের কবি, জীবনের কবি। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবরে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। এই সময় তাঁকে শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর রাত্রি ১১ টা ৩৫ মিনিটে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’র সেই সত্যিকারের কবি, আমার মতোন আরো অনেকেরই প্রিয়তম এই কবির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। 

উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ কবি, শিক্ষাবিদ জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ১৮ ফেব্রুয়ারি) বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। আমাদের এই প্রিয় কবির জন্মদিন বা তারিখ নিয়েও বেশ বিপদে আছি। কোথাও পাই ১৭ ফেব্রুয়ারি আবার কোথাও পাই ১৮ ফেব্রুয়ারি। আবার কবির জন্মস্থান নিয়েও মতান্তর দেখি। কেউ বলছেন বরিশাল শহরের বগুড়া বোডের ‘ধানসিড়ি’ বাড়িতে, কেউ বলছেন মাতুলালয় বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার ফুল্লশ্রী গ্রামে (গৈলা)। আসলে কোনটি সঠিক তথ্য তা আমি আজো উদ্ধার করতে পারিনি, সুনিশ্চিত হতে পারছি না।
 
২.
আমাদের বোধ ও মননে সমানভাবে বিচরণ করেন বলে জীবনানন্দ দাশ বর্তমান সময় বিবেচনায়ও আধুনিক কবি। আর তাই অনেক দিনের সাধ মেটাতে প্রাণের টানে আমার প্রিয় এই কবির জন্মদিনে গত বছর (২০১৫) গিয়ে হাজির হয়েছিলাম তাঁর বরিশালের জন্মস্থানে। উল্লেখ্য, কবি জীবনানন্দ দাশের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বরিশালে আয়োজন করা হয় ১৭ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনদিনব্যাপী জীবনানন্দ উৎসব ২০১৫। বরিশাল জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নগরীর অশ্বিনী কুমার হলে সেবারই প্রথম জীবনানন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়। আগেও অনেকবার গিয়েছি সেখানে কিন্তু কোন জন্মদিনে উপস্থিত থাকার সুযোগ ঘটেনি। তিনদিনব্যাপী আয়োজিত জীবনানন্দ দাশ জন্ম উৎসবে একজন সাধারণ শ্রোতা হিসেবেও উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিলো প্রিয়তম এই কবির জন্মদিনে তাঁর জন্মস্থানে এবং তাঁকে নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজির থাকার সুযোগ হয়েছিলো বলে। সে স্মৃতি ভুলবো না কোন দিনই নানা কারণে। তবে অন্যতম একটি ‘অধ:পতনের’ কাহিনি না বললেই নয়। জীবনানন্দ দাশের জন্মদিনেই তাঁর বাড়িতে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি ভবনের, গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে বেশ চোট পেয়েও চিকিৎসকের আদেশ না মেনে বিছানায় বিশ্রাম না নিয়ে অনুষ্ঠানে থেকেছিলাম প্রচণ্ড পায়ে ব্যথা নিয়েও।জীবনানন্দে ঘোরে ভুলে গিয়েছিলাম শারীরিক ব্যথাও।

৩.
আমরা জানি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে কবি জীবনানন্দ দাশের (জন্ম: ১৭ ফেব্রুয়ারি/১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯, বরিশাল – মৃত্যু: ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪, বঙ্গাব্দ: ৬ ফাল্গুন, ১৩০৫–৫ কার্তিক, ১৩৬১) কবিতার ঐতিহাসিক ভূমিকার কথাও। ষাটের দশকে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংগ্রামী বাঙালি জনতাকে তাঁর রূপসী বাংলা তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করে। 

৪.
কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ সালে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন।তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। বহুমাত্রিক অনন্য প্রতিভার নামই জীবনানন্দ দাশ। 

৫.
‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি ; কবি – কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না ; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়। ” সেই আপ্তবাক্যকে বুঝতে, আমার মনে জীবনানন্দ দাশের শব্দে আঁকা অপরূপ জলছবি সুষ্পষ্টকরণে সহযোগিতা করে সতত শ্রদ্ধার আসন দখল করে আছেন বেশ কয়েকজন। তাঁরা সবাই আসলে জীবনানন্দ দাশ গবেষক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ভূমেন্দ্র গুহ, জামিল ভাই (জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী), সহ আরো বেশ কয়েকজন। কারণ একটু বোধসম্পন্ন না হলে আসল জীবনানন্দকে আবিষ্কার করা যায় না, আনন্দ-বেদনার স্বরূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। জীবনানন্দ দাশকে অনুকরণ করে আমার বলতে মন চায়, ‘সকলেই পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক’। অনুধাবনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার পাঠক হয়ে উঠতে হয় বলেই আমি মনে করি। আর তাই তাঁকে বুঝতে পারলেই তাঁর কবিতা আমাদের মনকে উদ্বেলিত করে।জীবনে রূপ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত মানসিকতা গড়তে অনুপ্রেরণা জোগায়। আর এখানেই একজন কবির সার্থকতা। জীবনানন্দ দাশ সে রকমই একজন গুণী কবি। 

৬.
জীবনানন্দ দাশের পূর্বপুরুষেরা ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণা নিবাসী ছিলেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের গাওপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত বিক্রমপুর থেকে বরিশালে এসে বসবাস শুরু করেন। সর্বানন্দ জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন। পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। এই সূত্রে জীবনানন্দ দাশ ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও সমাজসেবক। তিনি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। জীবনানন্দের মায়ের নাম ছিল কুসুমকুমারী দাশ। উল্লেখ্য তিনিও কবি ছিলেন। ১৮৯৫ সালে জীবনানন্দ’র মায়ের লেখা কবিতার দুইটি লাইন ‘ আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ প্রবাদের মতো আজো ফিরছে আমাদের সবার মুখে মুখে । জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তার ডাকনাম ছিল মিলু। তার ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ সালে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন, এই কারণে তিনি বাড়িতে মায়ের কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠেই তিনি প্রতিদিন পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের কণ্ঠে গান শুনতেন। শৈশব থেকে তিনি অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের ছিলেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই তিনি একবার কঠিন অসুখে পড়েন। পরে আরোগ্যলাভের পর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে মাতা ও মাতামহ কবি চন্দ্রনাথের সাথে লক্ষ্মৌ, আগ্রা, দিল্লী প্রভৃতি জায়গা ভ্রমণ করেন।

৭.
১৯০৮ সালের জানুয়ারি মাসে আট বছর বয়সে তাঁকে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। ১৯১৫ সালে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। দু' বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগসহ উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা আসেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ সালে তিনি এই কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। উল্লেখ্য ওই বছরেই ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিল বর্ষ-আবাহন। মজার বিষয় হলো– কবিতাটিতে কবির নাম ছাপা হয় নি। কেবল সম্মানসূচক শ্রী কথাটি লেখা ছিল। তবে ম্যাগাজিনটির বর্ষশেষের নির্ঘন্ট সূচিতে তার পূর্ণ নাম ছাপা হয়েছিল শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, বিএ।১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগ সহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপত তিনি কিছুকাল আইনশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। এই সময়ে তিনি হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে থাকতেন। তবে পরীক্ষার ঠিক আগেই তিনি ব্যাসিলারি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন, যা তার প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত করে।
 
৮.
জীবনানন্দ কলকাতা সিটি কলেজে ১৯২২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং আইনশাস্ত্র পড়া ছেড়ে দেন। ১৯২৯ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে যোগ দেন, কিন্তু কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ওই বছরই (১৯২৯) তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৩০-এ আবার দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে কিছুকাল বেকার থেকে জীবনানন্দ ১৯৩৫ সালে বরিশালের বিএম কলেজে যোগদান করেন। এভাবে তাঁর কর্মজীবন বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনায় এবং মাঝে মাঝে অন্য পেশায় অতিবাহিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের কিছু আগে তিনি সপরিবারে কলকাতা চলে যান।
 
৯.
সম্ভবতঃ মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯১৯ সালে তাঁর লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির নাম বর্ষা আবাহন। এটি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন তিনি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে লিখতেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি জীবনানন্দ দাশ নামে লিখতে শুরু করেন।

১০.
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ সালের জুন মাসে মৃত্যুবরণ করলে, তিনি তার স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' নামক একটি কবিতা রচনা করেন। এই কবিতাটি তৎকালীন বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৫ সালে তার প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ঐ বছরেই কল্লোলে 'নীলিমা' কবিতাটি প্রকাশিত হলে তা অনেক তরুণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্রমে ক্রমে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে। ১৯২৭ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি তার উপাধি দাশগুপ্তের বদলে কেবল দাশ লিখতে শুরু করেন।

১১.
জীবনানন্দ দাশ ১৯৩০ সালের ৯ই মে (বঙ্গাব্দ ১৩৩৭, ২৬শে বৈশাখ) ঢাকার ব্রাক্ষ্মসমাজ মন্দিরে রোহিণীকুমার গুপ্তের কন্যা লাবণ্য গুপ্তকে বিয়ে করেন। তাঁর কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ এবং পুত্র সমরানন্দ দাশ। তিনি বিয়ের পর আর দিল্লিতে ফিরে যান নি।এরপর প্রায় বছর পাঁচেক সময় তিনি কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। এর মাঝে কিছুদিন ইনশিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন, ছোট ভাই এর কাছ থেকে অর্থ ধার করে ব্যবসার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনটাই স্থায়ী হয় নি। ১৯৩১ সালে তাঁর প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। 

১২.
এই সময় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় তাঁর ক্যাম্পে কবিতাটি প্রকাশিত হলে এবং কলকাতার সাহিত্যসমাজ এই কবিতাটকে 'অশ্লীল কবিতা' হিসাবে চিহ্নিত করে ব্যাপক সমালোচনার করে। তিনি তার বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার ভিতরে এই সময় বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি রূপসী বাংলা কাব্যের কবিতাগুলো রচনা করেন। উল্লেখ্য ১৯৫৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। 

১৩.
১৯৩৫ সালে তিনি তার পুরানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোজন কলেজে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সে সময়ে কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেনের উদ্যোগে 'কবিতা' নামক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই তাঁর 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে (পৌষ ১৩৪২ সংখ্যা; ডিসে ১৯৩৪/জানু ১৯৩৫) তার বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেনপ্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ সালে র নভেম্বর মাসে তাঁর পুত্র সমরানন্দের জন্ম হয়। ১৯৪২ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয় এবং ঐ বছরেই তার তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ বনলতা সেন প্রকাশিত হয়। ১৯৪৪ সালে তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থমহাপৃথিবী প্রকাশিত হয়। 

১৪.
১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের কিছু আগে তিনি ব্রজমোহন কলেজ, কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে যান। পরে তিনি আর পূর্ববঙ্গে ফিরে যান নি। কলকাতায় তিনি দৈনিক স্বরাজপত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেন কয়েক মাস। ১৯৪৮ সালে তিনি দু'টি উপন্যাস লিখেছিলেন - মাল্যবান ও সুতীর্থ। তবে এই উপন্যাস দুটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় নি। এই বছরের ডিসেম্বরে মাসে তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হয়। এই সময় কলকাতায় তার মা মৃত্যবরণ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি 'সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র' নামে একটি সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই সংস্থার মুখপত্র দ্বন্দ্ব পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালে খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৫২ সালে এই কলেজ ত্যাগ করেন এবং ১৯৫৩ সালে বারিষা কলেজ অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। একই বৎসরে তিনি হাওড়া গার্লস কলেজে যোগদান করেন। এই কলেজে তিনি ছিলেন ১৯৫৪ সালেপর্যন্ত। এই বৎসরের মে মাসে প্রকাশিত হয়জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। বইটি ১৯৫৫ সালে ভারত সরকারের "সাহিত্য একাডেমি" পুরস্কার লাভ করে।

১৫.
সাহিত্য সমালোচকগণ স্বীকার করছেন, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ । বহুমাত্রিক অনন্য প্রতিভা জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। জীবনানন্দ ছিলেন বাংলা কাব্যান্দোলনে রবীন্দ্রবিরোধী তিরিশের কবিতা নামে খ্যাত কাব্যধারার অন্যতম কবি। পাশ্চাত্যের মডার্নিজম ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বঙ্গীয় সমাজের বিদগ্ধ মধ্যবিত্তের মনন ও চৈতন্যের সমন্বয় ঘটে ওই কাব্যান্দোলনে।

১৬.
কাব্যবোদ্ধাদের মতে, জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের কাব্যধারার প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। রবীন্দ্রনাথের নিবিড় প্রকৃতিচেতনা তাঁর কবিতায় গভীর দ্যোতনা লাভ করেছে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ তাঁর কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। বিশেষত, রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনুসূক্ষ্ম সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। তবে প্রকৃতির পাশাপাশি জীবনানন্দের শিল্পজগতে মূর্ত হয়েছে বিপন্ন মানবতার ছবি এবং আধুনিক নগরজীবনের অবক্ষয়, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও সংশয়বোধ। 

১৭.
সমালোচকগণ বলছেন, জীবনানন্দ ছিলেন একজন কালসচেতন ও ইতিহাসচেতন কবি। তিনি ইতিহাসচেতনা দিয়ে অতীত ও বর্তমানকে অচেচ্ছদ্য সম্পর্কসূত্রে বেঁধেছেন। তাঁর কবিস্বভাব ছিল অন্তর্মুখী, দৃষ্টিতে ছিল চেতনা থেকে নিশ্চেতনা ও পরাচেতনার শব্দরূপ আবিষ্কারের লক্ষ্য। এ সূত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন ইম্প্রেশনিস্টিক রীতি, পরাবাস্তবতা, ইন্দ্রিয়বিপর্যাস (synaesthesia) ও রঙের অত্যাশ্চর্য টেকনিক। আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দনিরীক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁর অনন্যতা বিস্ময়কর। বিশেষত, কবিতায় উপমা প্রয়োগে জীবনানন্দের নৈপুণ্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযু্ক্ত করেন, যা পরবর্তী কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্যজীবনের সঙ্কট, নরনারীর মনস্তত্ত্ব ও যৌনসম্পর্কের জটিলতা এবং সমকালের আর্থসামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়। তাঁর প্রায় গল্প-উপন্যাস আত্মজৈবনিকতার প্রকাশ। 

১৮.
জীবনানন্দের কাব্যচর্চার শুরু অল্পবয়স থেকেই। মূলত কবি হলেও তিনি অসংখ্য ছোটগল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলি হচ্ছে ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (রচনাকাল ১৯৩৪, প্রকাশকাল ১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)। এছাড়াও বহু অগ্রন্থিত কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। 

১৯.
ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে জীবনানন্দের স্বতন্ত্র প্রতিভা ও নিভৃত সাধনার উন্মোচন ঘটে মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত অসংখ্য পান্ডুলিপিতে। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মাল্যবান, সুতীর্থ, জলপাইহাটি, জীবনপ্রণালী, বাসমতীর উপাখ্যান ইত্যাদি। তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দুশতাধিক। কবিতার কথা (১৯৫৫) নামে তাঁর একটি মননশীল ও নন্দনভাবনামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ আছে। কলকাতা থেকে তাঁর গদ্যরচনা ও অপ্রকাশিত কবিতার সংকলনরূপে জীবনানন্দ সমগ্র (১৯৮৫-৯৬) নামে বারো খন্ড রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে।
 
২০.
জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। এছাড়া জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটিও ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৪) লাভ করে। 

২১.
জীবনানন্দ দাশ ১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দূর্ঘটনায় আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাঁকে উদ্ধার করে। তাঁকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধেই পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন যদিও এতে চিকিৎসার তেমন উন্নতি কিছু হয়নি। তবে জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। 

২২.
জীবনানন্দ গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ-সহ কেউ কেউ ধারণা করেছেন হয় আত্মহত্যা স্পৃহা ছিল দুর্ঘটনার মূল কারণ। জীবনানন্দ গবেষক ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। গত এক শত বৎসরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কোলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এ সময় দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রাম লাইন পার হচ্ছিলেন কবি। আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে গৃহে ফেরার সড়কে ওঠার জন্য ট্রাম লাইন পারি দেয়া খুব গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয়।

২৩.
জীবনানন্দ দাশের জন্মদিনে, প্রয়াণ দিনে শুধু নয়, সারা বছরই তার কবিতার চরণ স্মরণে আসে, মনে শিহরণ জাগায়, ক্ষণে ক্ষণে নানা রঙ হয়ে ধরা দেয়। ঠিক যেন ঘাস-লতা, গাছ-পাতা, বক, শঙ্খচিল একান্তভাবে কাছে এসে বলে- মনে রেখো সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যু নেই, কবিরা মরে না। তারা সবুজ পাতায় যেমন বেঁচে থাকে, তেমনি বেঁচে থাকে ঝরা পালকে, ঝরা পাতায়। জীবনের রঙ যখন পূর্ণতা পায় তখনও থাকেন কবি, আবার যখন শেষ হয় জীবনের সব লেনদেন তখনও জেগে থাকেন কবি। জাগরূক থাকেন, অম্লান থাকেন জীবনানন্দ দাশ। কারণ তিনিই তো বলতে পারেন, 'শেষ হল জীবনের সব লেনদেন, বনলতা সেন।’ না সবকিছুই শেষ হয় না। তোমাকে তাই তোমার মতো করেই আহ্বান করি- ফিরে এসো, ফিরে এসো, 'ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে; ফিরে এসো হৃদয়ে আমার।'

(তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সমকাল, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত