ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০১৯, ১২:৪১

১.
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রগতিশীল সাহসী নারী, প্রখ্যাত ভাস্কর এবং সজীব প্রাণের মানুষ। তিনি এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর যোদ্ধা। প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা-ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ২০১৮ সালের ৬ মার্চ, ২০১৮ বেলা পৌনে ১টায় রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালের সিসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, না ফেরার দেশে চলে যান। প্রয়াণকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে যান। একজন প্রগতিশীল মানুষের প্রতিকৃতি, মুক্তিযোদ্ধা, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। 

উল্লেখ্য যে, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় নানা বাড়িতে। একাত্তরের বীরাঙ্গনা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী নীরবে নিভৃতে কাজের মাধ্যমে বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে গেছেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন অনেকদিন। বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য আমরা তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ। ভাস্কর্যচর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেননি, কিন্তু বাংলাদেশে যে কজন ভাস্করের নাম আসে তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। 

শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ২০১০ সালে শিল্প ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সর্ব্বোচ বেসামরিক সম্মান ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ লাভ করেন। তাছাড়া বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদ এই মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষ্করকে সংবর্ধনা প্রদান করে। ২০১৪ সালে একুশের বইমেলায় তাঁর আত্মজীবনী ‘নিন্দিত নন্দন’ প্রকাশিত হয়।

২.
সমাজ সচেতন ও সংবেদনশীল মানুষ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কীভাবে পাকসেনাদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, প্রথম তা জনসমক্ষে তুলে ধরেন সাহসের সাথে। এ বিষয়ে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেছিলেন, আমি মানুষের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এ নির্যাতনের কথা সবাইকে বলিনি। আমার মতো নির্যাতিত আরও লাখো মা-বোনের কথা ভেবে এ কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরি। যাতে তারা শক্তি পায়, সাহস পায়। দুঃস্বপ্নময় জীবন থেকে বেরিয়ে এসে বীরের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো থেকে তিনি পালিয়ে বেড়াননি, বরং সামনে এগিয়ে চলার পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন। সেই অভিব্যক্তি তার শিল্পকর্মেও প্রকাশ পেয়েছে। আমরা জানি, বাংলাদেশে ভাস্কর্য চর্চার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। মাধ্যমের ব্যয়সাপেক্ষতা, সুপরিসর স্থানের অভাব, সময় ও শ্রমসাপেক্ষ চর্চা পদ্ধতির তুলনায় অনিশ্চিত বাজার ইত্যাদি কারণে ভাস্কর্য চর্চার পরিসর সময়ের সঙ্গে বিস্তৃত হয়নি। তবে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী কিন্তু চর্চা করে গেছেন অক্লান্তভাবেই লাভক্ষতির হিসাব আর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাবকে এক পাশে সরিয়ে রেখেই। তিনি একজন প্রকৃতির পরিব্রাজক, প্রকৃতির ভাস্কর, তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি বোধহয় অনুভূতির ভাস্কর। আমাদের চিরচেনা প্রকৃতির নানা তুচ্ছ আর প্রচ্ছন্ন অবয়বে তিনি যে বিভাসিত বিন্যাসের সন্ধান করেন এবং তারপর সেই অবয়বে নিজের বোধ আর শিল্পিত রূপকল্পের সম্মিলন ঘটিয়ে যে অমর্ত্য রূপ প্রদান করেন আর সেই রূপে যে বেগ থাকে, আবেগ থাকে, প্রণয় থাকে, মায়া থাকে, বেদনা থাকে, আলোর আলোড়ন থাকে – সেটি তো তাঁর অভ্রান্ত অনুভূতির কারণেই। প্রিয়ভাষিণীর নির্মাণশৈলী মাধ্যমে হিসেবে ভাস্কর্যকে আমাদের সামনে নতুনভাবে উপস্হাপন করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদ্যেও তিনি আশ্রয় খুঁজে পান, আশার বসতি গড়ে তোলেন, অনিঃশেষ সৃষ্টির জন্য অনিবারিত উদ্দীপনার জোগান পান। অতি তুচ্ছ বিষয়কে আশ্রয় করে তিনি যা সৃজন করেন তা শিল্পগুণে ও সৃজনধর্মীতায় হয়ে ওঠে অসামান্য। আর তারই প্রতিফলন দেখি তাঁর সৃজনীসৃষ্টিতে। একাত্তরের পাকবাহিনীর নির্যাতনের নির্মম শিকার এই শিল্পী একাত্তরের যন্ত্রণাদায়ক দিনগুলোর চিত্রমূর্ত করে তুলেছেন তাঁর নানা শিল্পকর্মে। প্রিয়ভাষিণী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে তাঁর শিল্পকর্মে প্রকাশ করেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতি থেকে তিনি সৃষ্টি করেন শকুনের দিনগুলো (১৯৮৮), ২৫ মার্চ ১৯৭১ (১৯৮৮), বধ্যভূমি রায়েরবাজার (১৯৮৮), শরণার্থী (১৯৯০), বিধ্বস্ত মা ‘৭১ (১৯৯১), একাত্তরের নির্যাতিত নারী (১৯৯৪), গণহত্যা ‘৭১, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা। 

৩.
সৈয়দ মাহবুবুল হক এবং রওশন হাসিনা এর ১১ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি পড়াশোনা শুরু করেন টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে। এরপরে ভর্তি হন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন তখন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ১৯৫৬ সালে ৯ বছর বয়সে প্রিয়ভাষিণীকে বাবার কাছে চলে যেতে হয় খুলনায়। খুব ছোটবেলা থেকেই অনেক মহৎ মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন তিনি। অম্লান দত্ত, সুফিয়া কামাল, এস এম সুলতান থেকে শুরু করে খান সারওয়ার মুর্শিদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ছাড়াও আরো অনেকের নৈকট্য লাভ করেছেন।
 
৪.
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জীবনের একটি বড় অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দ্বারা বন্দী হন। তিনি সাড়ে সাত মাস ধরে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি অসংখ্য মর্মান্তিক এবং পাশবিক মৃত্যু দেখেছেন। তাঁকে নকশাল অপবাদ দিয়ে একটি খুনের মিথ্যা অপবাদে আটক করা হয়। বাংলার চার লাখ বীরাঙ্গনার মতো তাঁকেও অসহনীয় বর্বর শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। মানবিক এই মানুষটি কুমারী মায়েদের পুনর্বাসন এবং আশ্রয়হীন শিশুদের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছেন । যুদ্ধকালীন নির্যাতনে বিধ্বস্ত প্রিয়ভাষিণী ধৈর্য্য আর পরিশ্রমকে পূঁজি করে সমাজে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কারু শিল্পের একজন নিপুন কারিগর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে তাঁর কাজ স্থায়ী জায়গা করে নেবে বলে বিশ্বাস করি।

৫.
রক্ষণশীল সমাজ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ১৭ বছর বয়সে প্রিয়ভাষিণী বিয়ে করেন নিজের পছন্দ করা পাত্রকে। ভাবলেন, সমমনা হলে জীবন সুখের হবে। স্বামী ভালো ছাত্র ছিলেন, গান গাইতেন, ছবি আঁকতেন। বিয়ের পর স্বামী তাকে উপহার হিসেবে হাতে তুলে দেন বোরকা। স্বামীর এই উপহার পেয়ে আঁতকে উঠেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন ধীরে ধীরে কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবেন। কিন্তু নানা কথা নিয়ে সংসারে অশান্তি নেমে আসে। বেকার স্বামীর সংসারের হাল ধরার জন্য বিয়ের সাত দিনের মধ্যে ফেরদৌসী সেক্রেটারিয়েল কাম টেলিফোন অপারেটর পদে যোগদান করেন। নিজের সংসার চালানোর পাশাপাশি ভাই-বোনদেরও আর্থিক সহযোগিতা করতেন। পাঁচ বছরের সংসার জীবনে তিন সন্তানের মা হন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি অনেকটা পেটের দায়ে চাকরি করেছেন। কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। টেলিফোন অপারেটর হিসেবে যেমন কারখানায় কাজ করেছেন, তেমনি UNDP, UNICEF, FAO, কানাডিয়ান দূতাবাস প্রভৃতি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করেছেন। শেষ বয়সে এসে নানা শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন এবং তা অবিরামভাবে অব্যাহত রেখেছেন।

৬.
একাত্তরে জুটমিলের অবাঙালি কর্মকর্তাদের লালসায় তছনছ হল তার বেঁচে থাকারআকাক্সক্ষাটুকুও। কিন্তু তারপরও অদম্য সংগ্রাম করেছেন জীবনের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের নয় মাস হায়েনাদের সঙ্গে প্রাণপণ লড়েছেন। যুদ্ধের পর সামাজিক অবমাননা তার বাড়তেই থাকে। অনাদরে, কলংকে, অসম্মানে, আচ্ছন্ন বিষন্ন হয়ে যায় তার জীবন। জনসান্নিধ্য থেকে তাই নিজেকে গুটিয়ে নিলেন আপন ভুবনে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মানুষ ভাবল, তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করেছেন। মানুষ তাকে কুপ্রস্তাব দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। এই পরিস্থিতিতে ফেরদৌসী আবার বিয়ে করলেন বন্ধু আহসানউল্লাহ আহমেদকে। এবারও সামাজিক কষাঘাতে জর্জরিত হলেন। কিন্তু স্বামী এসব থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন তাকে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাঁকে পদে পদে হয়রানী, অসম্মান এবং অবমাননার শিকার হতে হয়েছে। শুধুমাত্র বাহিরের মানুষের দ্বারা নয় বরং নিজ পরিবারের বহু সদস্যদের দ্বারাও। এমতাবস্থায় তাঁর সাথে থেকে তাঁকে নির্ভরতা এবং সাহস যুগিয়েছেন তাঁর স্বামী আহসান উল্লাহ আহমেদ। তাঁর ছয় সন্তান- বড় ছেলে কারু তিতাস, মেঝো ছেলে কাজী মহম্মদ নাসের, ছোট ছেলে কাজী মহম্মদ শাকের (তুর্য্য)। তিন মেয়ে রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনী, রত্নেশ্বরী প্রিয়দর্শিনী ও ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী। 

৭.
তীব্র বঞ্চনাবোধ থেকেই বের হয়ে এসেছে প্রিয়ভাষিণীর শিল্প। ১৯৭৭ সালে তিনি নিজেকে আবার ফিরে পেলেন। তিনি সে সময় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতেন। তাঁর বিষন্নতা, মোহময়তা তাঁর মাঝে নানা ছবি গড়ে তুলতে শুরু করে। তখনই তিনি ঝরা পাতা, মরাডাল আর গাছের গুড়িতে অবয়ব খুঁজে পেলেন। স্বামীর চাকরির কারণে যখন গ্রামে থাকতেন তখন চারপাশের প্রকৃতিতে যা কিছু পেতেন তাই দিয়ে সুন্দর করে ঘর সাজাতে চেষ্টা করতেন। মূলতঃ ঘর সাজানো এবং নিজেকে সাজানোর জন্য দামী জিনিসের পরিবর্তে সহজলভ্য জিনিস দিয়ে কিভাবে সাজানো যায় তার সন্ধান থেকেই তাঁর শিল্প চর্চার শুরু। প্রিয়ভাষিণী যেভাবে ফেলে দেওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া কাঠের টুকরা, শেকড়, গাছের গুড়িকে তুলে এনে নতুন জীবন দিয়ে থাকেন, তা অসাধারণ। কৃতজ্ঞতাসহকারে তিনি স্বীকার করেন, আমাকে আবিষ্কার করেন এস এম সুলতান।

৮.
ফেরদৌসি একাত্তরের ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এখনও তিনি নানান সামাজিক রাজনৈতিক ইস্যুতে স্পষ্টবক্তা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার করেছিল সোরওয়ার্দি উদ্যানে স্থাপিত গণ আদালত, সেই সময়েও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বাংলাদেশের প্রথম নারী যিনি মুক্তিযুদ্ধের ২৮ বছর পর তাঁর উপরে পাকিস্তানী হানাদারদের পাশবিক অত্যাচারের সাক্ষ্য দেন। তাঁর এই জবানবন্দি পরবর্তীতে Tormenting Seventy One নামে একটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাস্কর এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের হাতে নির্যাতিত ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২০১৬ সালের স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশের সরকার। স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে চার দশক পর তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেলেন। তাঁর সাথে আরও ১২৩ বীরাঙ্গনাকেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয় সরকার। 

৯.
প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয় যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে। এস এম সুলতান সে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর অনেকবার তাঁর কাজের প্রদর্শনী হয়েছে। নাম না জানা ফুল, গাছের গুঁড়ি থেকে ১৯৯৪ সালে এ ফর্মটি তৈরি করেছেন তিনি। বিধ্বস্ত মা ফুলগাছের ডাল থেকে তৈরি করেন ১৯৯১ সালে।এভাবেই উপড়ে পড়া গাছের গুঁড়িকে শিল্পের ছোঁয়ায় জীবন্ত করে তোলেন তিনি। তেমনি নিজের জীবনের মোড়ও এই শিল্পকর্মের মতো ঘুরিয়ে দেন। ভাস্কর ও প্রগতিশীল আন্দোলনের পরিচিত মুখ ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে ২০০২ সালে একাত্তরের যুদ্ধনারী হিসেবে জাপান যান তিনি।

১০.
নিজের ভাস্কর্যচর্চা শুরু করা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘আমি যখন সিলেট শহরে ছিলাম, আমার বাচ্চা কোলে একটা আর একটা হাত ধরতো এই নিয়ে আমার কোন জীবন ছিলোনা, সংসারে কাজ করতে করতে আমার জীবন যেতো, আমার হাসবেন্ড আবার এসব ব্যাপারে খুব সহমর্মিতা দেখাতো, উনি অফিসে চলে যেতেন, আমি হাপিয়ে উঠতাম একা বাসার মধ্যে, আমি বসে বসে দেখতাম কী...। এটা ১৯৭৪ কিংবা ৭৫ সালের দিকে হবে। আমার ডাইনিং টেবিল থেকে চেরাপুঞ্জি পাহাড়টা রঙ বদলাচ্ছে, কখনো ওপারে আধা ঘন্টা বেশি তো, এপারে আধা ঘন্টা কম, দেখতাম কী চেরাপুঞ্জি রঙ বদলাতে বদলাতে সোনালী একটা পারের মত তৈরি হইছে সূর্যের আলো পরে, আর নেভি-ব্লু কালারে একটা পাহাড় আমি ভাবতাম কি আমি যেন এখানে বসে খেতে খেতে আমার জীবনটা চলে যায়, এই দৃশ্য থেকে যেন আমাকে ছেড়ে সরে পরতে না হয়। তবে সিলেটের অনেক ভালো ভালো জায়গা আছে, যেখানে গেলে আমার হাসবেন্ড আমাকে কখনো রেখে যেতো না, মাধবকুন্ড, বড়লেখা, জাফ্লং, সমস্ত চা বাগানে- সব জায়গাতে উনি আমাকে নিয়ে যেতো, এটা উনার খুব ভালো গুন ছিলো। সে বেড়াতে ভালোবাসতো, সে কোথায় আমাকে ছাড়া যেতেন না, আমিও উনার সাথে বেড়াতাম, সংসার খুব মন দিয়ে করেছি আমি, সবচেয়ে ভালোবাসি ঘরে থাকতে, সবচেয়ে মন ভালো করার জায়গা ঘর, আমি আমার গাছ দেখি, আমাকে কেউ দাওয়াত করলে মনে মনে বিব্রত হই- যেতে দুঘন্টা, সেখানে থাকতে হবে দুঘন্টা, আবার আসতে হবে, এই চার পাচ ঘন্টা আমি আমার গাছ দেখবো না, ঘর দেখবো না, আসলে একটা টান আছে বুঝেছো?’ 

১১.
সত্তরের দশক থেকেই কি কাজ শুরু করেন। তাঁর ভাষায়, ‘১৯৭৪ সাল থেকে- অবশ্য তখন বুঝতাম না খুব বেশি, তখন পেপার কেটে কেটে বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ এগুলো করতাম, ওটা ভালো লাগতো, তারপর দেখি যে শুকনো পাতার সাথে একটু সবুজ পাতা রাখি, কেমন লাগে দেখি, ঘর সাজাতাম- গৃহশৈলী। তারপর শিল্পী এস এম সুলতান আমাকে আবিস্কার করলেন, উনি জিজ্ঞেস করেন, এগুলো কী? আমি বলি এগুলো...। শিল্পী এস এম সুলতানের সঙ্গে তাঁর দেখা কত হয় সাতাত্তর সালের দিকে। তিনি বলছেন, সুলতান ভাই খুব বড় অনুপ্রেরণা, আমাকে নিয়ে উনি একজন কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার মত ঘুরতেন, সুবীর তখন সুবীর দা শিল্পকলাতে, উনি তাকে বলতেন, এই মেয়েটিকে দেখো, এ কিন্তু একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে, তোমরা বুঝতে পারছো না, একে একটু দেখো, তখন কেউ দেখতো না আমাকে (হাসি)। তারপর আরো একটা বড় অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন আমাকে ফয়েজ ভাই। আমার একটু শিশুবৃত্তি ছিলো, মনের মধ্যে পোর্টফলিও তৈরি করে করে সব জায়গায় যেতাম- ‘আমার একটা এক্সিবিশন করে দিবেন’ এরকম বলতাম, ফয়েজ ভাই তখন প্রথম গ্যালারী করলেন শিল্পাঙ্গন। তখন সবাই বলল, আপনি ফয়েজ ভাইয়ের কাছে যান। অনেক ঘুরতাম একটু দেখা পাওয়ার জন্য। একদিন সন্ধ্যায় সময় দিলেন। আমার কাজ দেখে-টেকে আমাকে অনেক কাপ চাও খাওলানে। প্রায় তিন কাপ চা শেষ করলাম, তো লোকজন আসছে চলে যাচ্ছে, তারপর উনি বললেন, একটা কথা বলবো, ইউ আর টু জুনিয়র একটা এক্সিবিশন করার জন্য। তখন এই কথাটা শুনে আমার মনে হলো, আমি অনেক কাজ করবো তারপর নিজের যোগ্যতায় একটা জায়গায় পৌঁছুবো। এরপর আমি দাঁত চেপে কাজ শুরু করলাম। আজকে পর্যন্ত, ১৯৭৫ থেকে, আমার ছুরি কাঁচি থামে নাই, কোনোদিন আপনি যদি যান, দেখবেন আমি আমার বারান্দায় এলোমেলো করে কাজ করছি, এই অবস্থায় আমাকে সবাই দেখেছে।’

১২.
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর রচনা ‘অন্ধকারের উৎস থেকে’ শেষাংশ উল্লেখ করে ইতি টানতে চাই। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে লিখছেন,`মুক্তির যুদ্ধ নিরন্তর। নয় মাসের যুদ্ধ ছিল অস্ত্রের, লড়াইয়ের এ পর্ব মননের। আমাদেরকে তার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। সাংস্কৃতিক জাগরণ হতে পারে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সাথে সর্বাত্মক সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার। সবার আগে ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উজ্জ্বল অতীতকে। তার জন্য তরুণদেরই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। আমি নিশ্চিত জানি, তারা পারবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ-মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রেরণা আর তারুণ্যের শক্তি আমাদেরকে সেই ভোর এনে দিবে যার জন্য দুই চোখে আকাশ ধরেছিল আমার মতো একাত্তরের প্রিয়ভাষিণীরা।’

১৩.
আবারো মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত