ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০১৯, ১২:৫০

১.
উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত বাঙালি কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কবি ১২১৮ বঙ্গাব্দের ২৫ ফাল্গুন (১৮১২ সালের ৬ মার্চ !) জন্মগ্রহণ করেন। নির্ভীক সাংবাদিক ও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৫৯ সালের ২৩ জানুয়ারি (১২৬৫ বঙ্গাব্দের ১০ মাঘ) মৃত্যুবরণ করেন।

২.
আমরা জানি, বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে। এই যুগের প্রথম কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর হাত ধরেই মধ্যযুগের গণ্ডি পেড়িয়ে বাংলা কবিতা আধুনিকতার পথে নাগরিক রূপ পেয়েছিল। তিনি "গুপ্ত কবি" নামেও সমধিক পরিচিত। তাঁর ছদ্মনাম 'ভ্রমণকারী বন্ধু'। এছাড়া তিনি 'সংবাদ প্রভাকর'সহ (বা 'সম্বাদ প্রভাকর') বহুবিধ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করে কবি-সাহিত্যিকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য সমসাময়িককালে তিনি "কবিগুরু" হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছ্নে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাঁর পরবর্তী সাহিত্যিকরা ঈশ্বর গুপ্তকে 'গুরু'পদে বরণ করেছিলেন। সামাজিক ও ব্যঙ্গ কবিতাগুলোর জন্য ঈশ্বর গুপ্তের সর্বাধিক খ্যাতি। তার রঙ্গরসপ্রবণতা ও লঘু চপলভঙ্গি কবিতাগুলোকে উৎকর্ষ দান করেছে। তাঁর কবিতায় স্বদেশ, স্বভাষা ও ধর্মের প্রতি গভীর ভালবাসা ফুটে ওঠে|

৩.
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সমালোচকদের মতে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (জন্ম : ১২১৮ বঙ্গাব্দের ২৫ ফাল্গুন, ৬ মার্চ, ১৮১২ - মৃত্যু: ১২৬৫ বঙ্গাব্দের ১০ মাঘ, ২৩ জানুয়ারি, ১৮৫৯) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত, কারণ তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়। মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন লুপ্ত হয়ে আসছিল, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে খন্ডকবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই ছিল তাঁর রচনার বিশেষত্ব। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের এ ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়ালদের নিকট থেকে। ব্যঙ্গের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয়ও তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতেন। আমরা তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গবিদ্রূপের বিষয়টি প্রবলভাবে লক্ষ্য করি। একদিকে আধুনিকতার প্রতি অনুরাগ অন্যদিকে প্রাচীন সংস্কারের প্রতি দুর্বলতা কবির দ্বৈতসত্তার বিষয়টিকে অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারপরও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আধুনিক চিন্তাকেই গ্রহণ করে কাব্যসাধনায় বিভিন্ন বিষয়কে কবিতার উপাদান করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম এবং নীতিমূলক কবিতাগুলোই অধিক জনপ্রিয় ছিল।

৪.
এবার একটু একান্ত বন্ধুকৃত্য করা যাক। কথায় কথায় বটতলার চায়ের আড্ডায় আমার সংশয়ী বন্ধুটি সেদিন বলছিলো, তার হৃদয়ে বেঁচে-বর্তে একজন সুপ্ত ঈশ্বর থাকেন, তিনিই নাকি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কেন ? বন্ধুটির জবাব- তার চারপাশের চতুর বাঙালির দেখেন আর তার সদাই মনে ভাসে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র কথিত মহাবাণীটি- ‘এত বড় প্রতিভা ইয়ার্কিতেই ফুরাইয়া গেলো।’সংশয়ী বন্ধুটির ভাষায়, ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ নাকি তার প্রতিভার প্রায় সবটুকুই ফাঁকিবাজি, চতুরতা আর ইয়ার্কিতেই শেষ করে ভবলীলা সাঙ্গ করে। মরার সময় অধিকাংশ বাঙালি নাকি জানতেও পারে না যে বুক পকেটে জোনাকি জ্বলতো, তার নিচে একটি বিশাল হৃদয় নিয়েও জন্মেছিলো। সংশয়ী বন্ধুটির সাথে আমি কথায়, যুক্তিতে প্রায় সময়ই পেরে উঠিনা বলে সেদিনও ‘লা জবাব’ ছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত থেকে একাধিক উদাহরণ দিতেও কসুর করেননি বন্ধু আমার। তবে স্মরণে রাখতে বললেন, ‘এ কিন্তু ভক্তের স্তুতি নহে—এ বাপের উপর বেটার অভিমান।’-
‘কাতর কিঙ্কর আমি, তোমার সন্তান।
আমার জনক তুমি, সবার প্রধান।।
বার বার ডাকিতেছি, কোথা ভগবান্।
একবার তাহে তুমি, নাহি দাও কান ।।
সর্বদিকে সর্বলোকে, কত কথা কয়।
শ্রবণে সে সব রব, প্রবেশ না হয় ।।
হায় হায় কব কায়, মটিল কি জ্বালা।।
জগতের পিতা হোয়ে, তুমি হলে কালা ।।
মনে সাধ কথা কই, নিকটে আনিয়া।
অধীর হ’লেম ভেবে, বধির জানিয়া ।।’

৫.
নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত 'মানুষ কে' কবিতাটি সিলেবাসে সংযোজিত আছে। এখানে প্রকৃত মানুষ্যত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে কবি তাঁর কবিতাটিকে অলংকৃত করেছেন। যার ভেতর দিয়ে মানব জীবনের বিভিন্ন চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সেটি পাঠ করা যাক।–
‘মানুষ কে?’
নিয়ত মানসধামে একরূপ ভাব।
জগতের সুখ-দুখে সুখ দুখ লাভ
পরপীড়া পরিহার, পূর্ণ পরিতোষ,
সদানন্দে পরিপূর্ণ স্বভাবের কোষ
নাহি চায় আপনার পরিবার সুখ।
রাজ্যের কুশলকার্যে সদা হাস্যমুখ
কেবল পরের হিতে প্রেম লাভ যার
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?
আবার, আমাদের ৫ম শ্রেণীতে পাঠ্য কবির 'কে' কবিতাটিও পাঠ করা যাক।–
‘বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়,
সর্বজীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়।
বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে,
সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে,
হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে,
বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে মূর্খ বলি কারে,
নিজ কার্য নষ্ট করে, মূর্খ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে,
পরের যে ভালো করে, সাধু বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে,
নিজ বোধ আছে যার, জ্ঞানী বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে সার বলি কারে,
ঈশ্বরের ভক্ত যেই, সার বলি তারে।’

৬.
ঈশ্বর গুপ্ত ভন্ড বা মেকির বড় শত্রু ছিলেন। মেকি মানুষের শত্রু এবং মেকি ধর্মের শত্রু। লোভী পরদ্বেষী অথচ ‘হবিষ্যাশী’ ভণ্ডের ধর্ম তিনি গ্রহণ করেননি। ভণ্ডের ধর্মকে ধর্ম বলে তিনি জানতেন না। তিনি মানতেন ‘ধর্ম ঈশ্বরানুরাগে, আহার ত্যাগে নহে’। যে ধর্মে ঈশ্বরানুরাগ ছেড়ে ‘পানাহারত্যাগকে ধর্মের স্থানে খাড়া করিতে চাহিত—তিনি তাহার শত্রু।’ ঈশ্বর গুপ্ত জীবন যাপনে কথায় যা, কাজেও তাই ছিলেন।“মাতৃসম মাতৃভাষা” যেমন বলছেন, তেমনি ঈশ্বর গুপ্তের দেশপ্রেমও ছিলো তীব্র ও বিশুদ্ধ। যেমন কয়েক ছত্র পাঠ করলেই বুঝতে সহজ হবে কবির স্বদেশানুরাগ।–
‘ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসিগণে,
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’

৭.
ঈশ্বর গুপ্ত ১২১৮ বঙ্গাব্দের ২৫ ফাল্গুন (৬ মার্চ ১৮১২!) পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কাঞ্চনপল্লী বা কাঁচড়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রপিতামহ নিধিরাম ছিলেন একজন সুবিখ্যাত কবিরাজ এবং তাঁর পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্ত প্রথমদিকে আয়ুর্বেদিক বা কবিরাজি চিকিৎসা করতেন; পরে শেয়ালডাঙ্গার কুঠিবাড়িতে চাকরি করেন। তাঁর মায়ের নাম শ্রীমতি দেবী। তাঁর বয়স যখন দশ তখন তাঁর মা পরলোকগমন করেন। পিতা ২য় বিয়ে করলে এর পর থেকে তিনি কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে মামার বাড়ীতে বাস করতে শুরু করেন। 

৮.
মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবী রেবার সঙ্গে। সঙ্গে। ঈশ্বর গুপ্তের সারাজীবন মোটেই সুখের হয়নি৷ ‘ঈশ্বরগুপ্ত, সাংবাদিক কবি ও গদ্যশিল্পী’তে ড. রেণুপদ ঘোষ লিখেছেন, “তাঁর সেই ব্যর্থ দাম্পত্যজীবনের দুঃখ বা গ্লানির মত অসুস্থতা থেকে ‘সংবাদ প্রভাকর’-ই ঈশ্বর গুপ্তকে মুক্তির নাসিংহোমের নির্ভুল ঠিকানা দিতে পেরেছিল৷’

৯.
রচনায় বৈচিত্র থাকলেও ঈশ্বর গুপ্ত কবি হিসেবেই পরিচিত। তার কবিতার সংখ্যা যেমন অগণিত, তেমনি বিষয়ের বৈচিত্রও কম নয়। বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাগুলোকে বিষয়ানুযায়ী কয়টি ভাগে বিভক্ত করেছিলেনঃ ১। পারমার্থিক ও নৈতিক বিষয়ক কবিতা, ২। সামাজিক ও ব্যঙ্গপ্রধান কবিতা, ৩।রসাত্মক কবিতা, ৪। যুদ্ধ বিষয়ক কবিতা, ৫। . ঋতুবর্ণনা প্রধান কবিতা, ৬। বিবিধ বিষয়ক কবিতা, ৭। শকুন্তলার কাহিনী নিয়ে রচিত কবিতা, ৮। সারদা-মঙ্গল বা উমা-মেনকার প্রসঙ্গে কবিতা, ৯। কাব্যকানন, ১০। রসলহরী ও ১১। কবিতাগুচ্ছ।’

১০.
শৈশবে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি, তবে অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে পারদর্শিতা লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রেরণায় এবং বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের আনুকূল্যে ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর প্রকাশ করেন। অর্থসংকটের কারণে মাঝে চার বছর বন্ধ থাকার পর ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট সপ্তাহে তিন সংখ্যা হিসেবে পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন থেকে এটি দৈনিক পত্রে রূপান্তরিত হয়। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিনি সংবাদ রত্নাবলী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সাপ্তাহিক পাষণ্ড পত্রিকার সঙ্গে সম্পাদক হিসাবে সংযুক্ত। পরবতী বৎসর তিনি সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকার দায়িত্বভার পালন করেন। তিনি গ্রাম গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এবং কবিগান বাঁধতেন। প্রায় বারো বৎসর গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রাচীন কবিদের তথ্য সংগ্রহ করে জীবনী রচনা করেছেন।

১১.
আধুনিক বাংলার সমাজ গঠনে সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের পক্ষভুক্ত ছিলেন। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষাপদ্ধতিরও বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু নবপর্যায়ে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনার সময় থেকে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হতে থাকে। তিনি দেশের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। হিন্দু থিয়ফিলানথ্রফিক সভা এবং তত্ত্ববোধিনী সভায় তিনি বক্তৃতাও করতেন। প্রথম দিকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে এ বিষয়ে নানা ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থন, ধর্মসভার বিরোধিতা, দেশের বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দরিদ্র জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন। এমনকি তিনি অক্ষতযোনি বিধবার বিবাহেও আর আপত্তি করেননি। 

১২.
স্বদেশ ও স্বসমাজের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরাগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন করেছেন তা আজ স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি সবসময় ইংরেজি প্রভাব বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। ভাষা ও ছন্দের ওপর তাঁর বিস্ময়কর অধিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) নাটকে।
 
১৩.
ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত, হরু ঠাকুর ও কয়েকজন কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করে প্রকাশ করা। পরবর্তীকালের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার কৃতিত্বও তাঁর। যদিও ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্যরীতি পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর অনুসৃত হয়নি, তথাপি এ কথা স্বীকার্য যে, ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের জন্য তাঁর গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। 

১৪.
ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত ছোটবেলা থেকেই মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন এবং কবিয়ালদের গান বেঁধে দিতেন। সমসাময়িক ঘটনাকে ব্যঙ্গ করে তিনি অসংখ্য খন্ডকবিতা সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগের এ কবি স্বদেশমূলক যেসব কবিতা রচনা করেছেন তার জন্যও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। 

১৫.
ঈশ্বরচন্দ্র সংবাদ প্রভাকর ছাড়াও সংবাদ রত্নাবলী, পাষন্ডপীড়ন ও সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তিনি রামপ্রসাদ সেন রচিত কালীকীর্তন (১৮৩৩) ও প্রবোধ প্রভাকর (১৮৫৮) সম্পাদনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর রচিত হিতপ্রভাকর (১৮৬১) ও বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর কবিতা সংগ্রহ (১৮৮৫) এবং সত্যনারায়ণ ব্রতকথা (১৯১৩)। 

১৬.
বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’ বিষয়ে কিছু না লিখলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বিষয়ে সবটা বলা হয় না । ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রথম প্রকাশের তারিখ ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি, শুক্রবার (১৬ মাঘ, ১২৩৭ বঙ্গাব্দ)। প্রকাশক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। পত্রিকাটি প্রকাশে পাথুরিয়া ঘাটার যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের ভূমিকা ও সহযোগিতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ও অপরিহার্য। তাঁর মৃত্যুর কারণে ১৮৩২ সালের ২৫ মে প্রকাশিত ৬৯তম সংখ্যার পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পুনরায় সংবাদ প্রভাকর প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট থেকে পত্রিকাটি বারত্রয়িক রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। পুনরায় পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার পত্রিকা প্রকাশে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে। ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন সংবাদ প্রভাকর বাংলায় প্রকাশিত সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকারূপে আবির্ভূত হয়। ১৮৫৩ সাল থেকে পত্রিকাটির মাসিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মাসিক সংবাদ প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্র প্রাচীন বাংলার ‘কবিয়াল’ ও গীতিকারদের জীবনী ও কর্মগাথা সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রামচন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক নিযুক্ত হন।

১৭.
বলা হয়ে থাকে, তাঁর কবি প্রতিভা কিছুটা 'সাংবাদিক' ধরনের।কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁর চিরস্থায়ী আসন লাভ সম্ভব হয়েছে কারণ একদিকে মধ্যযুগের দেবমাহাত্ম্য ব্যঞ্জক বিষয় থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করে তিনি যেমন অনায়াসে 'পাঁঠা', 'আনারস', 'তোপসে মাছ' ইত্যাদি বিষয় অবলম্বনে কবিতা লেখেন; তাঁর কবিতায় উঠে আসে সমসাময়িক রাজনইতিক,সামাজিক ঘটনাবলির চিত্ররূপ তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। তৎকালীন কবিওয়ালা দের জিম্মা থেকে বাংলা কবিতাকে তিনি নাগরিক বৈদগ্ধ ও মার্জিত রুচির আলোয় নিয়ে আসেন। সাংবাদিক রূপেও ঊনবিংশ শতকের এই আধুনিক মানুষটি যথাযোগ্য কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন।

১৮.
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি প্রিয় কাব্যকৌশল ‘যমক’ (একই বর্ণসমষ্টি একাধিকবার একাধিক অর্থে প্রয়োগ করা) বিষয়ে সামান্য ধারনা নেওয়া যাক। কতগুলো নমুনাঃ
১। অতনু শাসনে তনু তনু অনুদিন (১ম তনু= দেহ, ২য় তনু= কৃশ)
২। ভাবে নাহি ভাবি ভাবি (১ম ভাবি= ভাবনা করি, ২য় ভাবি= ভবিষ্যৎ)
৩। আনা দরে আনা যায় কত আনারস (১ম আনা= টাকার ১/১৬ অংশ, ২য় আনা= আনয়ন করা)
৪। প্রকাশিয়া প্রভাকর শুভ দিন দিন (১ম দিন= দিবস, ২য় দিন= প্রদান করুন)
৫। মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে (১ম ভ্রমে= ভুলে, ২য় ভ্রমে= ভ্রমণ করে)
৬। দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ, নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ (১ম দেহ= প্রদান কর, ২য় দেহ= শরীর)
৭। ওরে ভণ্ড হাতে দণ্ড এ কেমন রোগ। দণ্ডে দণ্ডে নিজ দণ্ডে দণ্ড কর ভোগ।। (অর্থঃ দণ্ডে দণ্ডে= সময়ে সময়ে, নিজ দণ্ডে= নিজের ডাণ্ডায়, দণ্ড= শাস্তি)
৮। কয় মাস খাও মাস উদর ভরিয়া। (অর্থঃ ১ম মাস= ৩০ দিন, ২য় মাস= মাংস)
৯। চিত্রকরে চিত্র করে করে তুলি তুলি। (অর্থঃ চিত্রকরে = চিত্রকর+ ৭মী বিভক্তি। চিত্র করে = ছবি আঁকে। করে= হাতে। ১ম তুলি = উত্তোলন করে, ২য় তুলি= আঁকার কাঠি)
১০। সেতার অনেক আছে, সে তার ত নাই। (অর্থঃ সেতার= বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, সে তার= সেই তন্ত্র)
১১। তানপুরা আছে মাত্র, তান পুরা নাই। (অর্থঃ তানপুরা= বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, তান পুরা= সম্পূর্ণ তান)

১৯.
ব্যঙ্গ অনেক সময় বিদ্বেষপ্রসূত হলেও ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন ব্যতিক্রম। সমালোচকদের কেউ বলছেন, ‘স্থূল কথা, ঈশ্বর গুপ্ত Realist এবং ঈশ্বর গুপ্ত Satirist। ইহা তাঁহার সাম্রাজ্য, এবং ইহাতে তিনি বাঙ্গালা সাহিত্যে অদ্বিতীয়।... ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গে কিছুমাত্র বিদ্বেষ নাই। শত্রুতা করিয়া তিনি কাহাকেও গালি দেন না। কাহারও অনিষ্ট কামনা করিয়া কাহাকেও গালি দেন না। মেকির উপর রাগ আছে বটে, তা ছাড়া সবটাই রঙ্গ, সবটা আনন্দ। কেবল ঘোর ইয়ারকি। গৌরীশঙ্করকে গালি দিবার সময়েও রাগ করিয়া গালি দেন না। সেটা কেবল জিগীষা—ব্রাহ্মণকে কুভাষার পরাজয় করিতে হইবে এই জিদ।’ যেমন লিখছেন-
‘তুমি মা কল্পতরু, আমরা সব পোষা গোরু,
শিখি নি সিং বাঁকানো,
কেবল খাব খোল বিচালি ঘাস।
যেন রাঙ্গা আমলা, তুলে মামলা,
গামলা ভাঙ্গে না।
আমরা ভুসি পেলেই খুসি হব,
ঘুসি খেলে বাঁচব না ।।’

২০.
সাহিত্যবোদ্ধাগণ তাই বলছেন, ‘তবে ইহা স্বীকার করিতে হয়, যে ঈশ্বর গুপ্ত মেকির উপর গালিগালাজ করিতেন। মেকির উপর যথার্থ রাগ ছিল। মেকি বাবুরা তাঁহার কাছে গালি খাইতেন, মেকি সাহেবেরা গালি খাইতেন, মেকি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা “নস্যলোসা দধি চোসার” দল, গালি খাইতেন। হিন্দুর ছেলে মেকি খ্রীষ্টীয়ান হইতে চলিল দেখিয়া তাঁহার রাগ সহ্য হইত না। ... অনেক সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের অশ্লীলতা এই ক্রোধসম্ভূত। অশ্লীলতা ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার একটি প্রধান দোষ। উহা বাদ দিতে গিয়া ঈশ্বর গুপ্তকে Bowdlerize করিতে গিয়া, আমরা তাঁহার কবিতাকে নিস্তেজ করিয়া ফেলিয়াছি। যিনি কাব্যরসে যথার্থ রসিক, তিনি আমাদিগকে নিন্দা করিবেন। কিন্তু এখনকার বাঙ্গালা লেখক বা পাঠকের যেরূপ অবস্থা তাহাতে কোনরূপেই অশ্লীলতার বিন্দুমাত্র রাখিতে পারি না। ইহাও জানি যে, ঈশ্বর গুপ্তের অশ্লীলতা, প্রকৃত অশ্লীলতা নহে। যাহা ইন্দ্রিয়াদির উদ্দীপনার্থ বা গ্রন্থকারের হৃদয়স্থিত কদর্যভাবের অভিব্যক্তি জন্য লিখিত হয়, তাহাই অশ্লীলতা। তাহা পবিত্র সভ্যভাষায় লিখিত হইলেও অশ্লীল। আর যাহার উদ্দেশ্য সেরূপ নহে, কেবল পাপকে তিরস্কৃত বা উপহসিত করা যাহার উদ্দেশ্য, তাহার ভাষা রুচি এবং সভ্যতার বিরুদ্ধ হইলেও অশ্লীল নহে। ঋষিরাও এরূপ ভাষা ব্যবহার করিতেন। সেকালের বাঙ্গালীদিগের ইহা এক প্রকার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। আমি এমন অনেক দেখিয়াছি। অশীতিপর বৃদ্ধ, ধর্মাত্মা, আজন্ম সংযতেন্দ্রিয় সভ্য, সুশীল, সজ্জন, এমন সকল লোকও, কুকাজ দেখিয়াই রাগিলেই “বদ্জোবান” আরম্ভ করিতেন। তখনকার রাগ প্রকাশের ভাষাই অশ্লীল ছিল। ফলে সে সময়ে ধর্মাত্মা এবং অধর্মাত্মা উভয়কেই অশ্লীলতায় সুপটু দেখিতাম—প্রভেদ এই দেখিতাম, যিনি রাগের বশীভূত হইয়া অশ্লীল, তিনি ধর্মাত্মা। যিনি ইন্দ্রিয়ান্তরের বশে অশ্লীল তিনি পাপাত্মা, সৌভাগ্যক্রমে সেরূপ সামাজিক অবস্থা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হইতেছে।’

২১.
ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় অশ্লীলতা বিষয়ে সমালোচকগণ লিখছেন, ‘ঈশ্বর গুপ্ত সংসারকে সমাজকে, স্বীয় বাহুবলে পরাস্ত করিয়া, তাহার নিকট হইতে ধন, যশ, সম্মান আদায় করিয়া লইলেন। কিন্তু অত্যাচারজনিত যে ক্রোধ তাহা মিটিল না। জ্যেঠা মহাশয়ের জুতা তিনি সমাজের জন্য তুলিয়া রাখিয়াছিলেন। এখন সমাজকে পদতলে পাইয়া বিলক্ষণ উত্তম মধ্যম দিতে লাগিলেন। সেকেলে বাঙ্গালীর ক্রোধ কদর্যের উপর কদর্য ভাষাতেই অভিব্যক্ত হইত। বোধ হয় ইহাদের মনে হইত, বিশুদ্ধ পবিত্র কথা, দেব দেবদ্বিজাদি প্রভৃতি যে বিশুদ্ধ ও পবিত্র তাহারই ব্যবহার্য—যে দুরাত্মা, তাহার জন্য এই কদর্য ভাষা। এইরূপে ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় অশ্লীলতা আসিয়া পড়িয়াছে। আমরা ইহাও স্বীকার করি যে, তাহা ছাড়া অন্যবিধ অশ্লীলতাও তাঁহার কবিতায় আছে। কেবল রঙ্গদারির জন্যে শুধু ইয়ারকির জন্য এক আধটু অশ্লীলতাও আছে। কিন্তু দেশ কাল বিবেচনা করিলে, তাহার জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের অপরাধ ক্ষমা করা যায়। সে কালে অশ্লীলতা ভিন্ন কথার আমোদ ছিল না। যে ব্যঙ্গ অশ্লীল নহে, তাহা সরস বলিয়া গণ্য হইত না। যে কথা অশ্লীল নহে, তাহা সতেজ বলিয়া গণ্য হইত না। যে গালি অশ্লীল নহে, তাহা কেহ গালি বলিয়া গণ্য করিত না। তখনকার সকল কাব্যই অশ্লীল। চোর, কবি, চোরপঞ্চাশৎ দুই পক্ষে অর্থ খাটাইয়া লিখিবেন—বিদ্যাপক্ষে এবং কালীপক্ষে—দুই পক্ষে সমান অশ্লীল। তখন পূজা পার্বণ অশ্লীল—উৎসবগুলি অশ্লীল—দুর্গোৎসবের নবমীর রাত্র বিখ্যাত ব্যাপার। যাত্রার সঙ অশ্লীল হইলেই লোকরঞ্জক হইত। পাঁচালি হাফআকড়াই অশ্লীলতার জন্যই রচিত। ঈশ্বর গুপ্ত সেই বাতাসের জীবন প্রাপ্ত ও বর্ধিত। অতএব ঈশ্বর গুপ্তকে আমরা অনায়াসে একটুখানি মার্জনা করিতে পারি।’

২২.
এ বিষয়ে আরো লিখছেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনীতে আমরা অবগত হইয়াছি যে, একজন অশিক্ষিত যুবা কলিকাতায় আসিয়া সাহিত্য ও সমাজে আধিপত্য সংস্থাপন করিল। কি শক্তিতে? তাহাও দেখিতে পাই—নিজ প্রতিভা গুণে। কিন্তু ইহা দেখিতে পাই যে, প্রতিভানুযায়ী ফল ফলে নাই। প্রভাকর মেঘাচ্ছন্ন। সে মেঘ কোথা হইতে আসিল? বিশুদ্ধ রুচির অভাবে। এখন ইহা এক প্রকার স্বাভাবিক নিয়ম যে, প্রতিভা ও সুরুচি পরস্পর সখী—প্রতিভার অনুগামিনী সুরুচি। ঈশ্বর গুপ্তের বেলা তাহা ঘটে নাই নাই কেন? এখানে দেশ, কাল পাত্র বুঝিয়া দেখিতে হইবে। তাই আমি দেশের রুচি বুঝাইলাম, কালের রুচি বুঝাইলাম, এবং পাত্রের রুচি বুঝাইলাম। বুঝাইলাম যে পাত্রের রুচির অভাবের কারণ, (১) পুস্তকদত্ত সুশিক্ষার অল্পতা, (২) মাতার পবিত্র সংসর্গের অভাব, (৩) সহধর্মিণী, অর্থাৎ যাঁহার সঙ্গে একত্রে ধর্ম শিক্ষা করি, তাঁহার পবিত্র সংসর্গের অভাব, (৪) সমাজের অত্যাচার এবং তজ্জনিত সমাজের উপর কবির জাতক্রোধ। যে মেঘে প্রভাকরের তেজোহ্রাস করিয়াছিল এই সকল উপাদানে তাহার জন্ম। স্থূল তাৎপর্য এই যে, ঈশ্বরচন্দ্র যখন অশ্লীল তখন কুরুচির বশীভূত হইয়াই অশ্লীল, ভারতচন্দ্রাদির ন্যায় কোথাও কুপ্রবৃত্তির বশীভূত হইয়া অশ্লীল নহেন। তাই দর্পণতলস্থ প্রতিবিম্বের সাহায্যে প্রতিবিম্বধারী সত্তাকে বুঝাইবার জন্য আমরা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অশ্লীলতা দোষ এত সবিস্তারে সমালোচনা করিলাম। ব্যাপারটা রুচিকর নহে।’

২৩.
বাংলার দুই জন সাধক, আমাদের বড় নিকট আপনজন, দুই জনই কবি। এক রামপ্রসাদ সেন, আর এক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তারা কেউই বৈষ্ণব ছিলেন না, ঈশ্বরকে প্রভু, সখা, পুত্র, বা কান্তভাবে দেখেননি। তাই বলা হয়- ‘রামপ্রসাদ ঈশ্বরকে সাক্ষাৎ মাতৃভাবে দেখিয়া ভক্তি সাধিত করিয়াছিলেন—ঈশ্বরচন্দ্র পিতৃভাবে। রামপ্রসাদের মাতৃপ্রেমে আর ঈশ্বরচন্দ্রের পিতৃপ্রেমে ভেদ বড় অল্প।’ যেমনটি লিখছেন-
‘তুমি হে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত ত্রিসংসার।
আমি হে ঈশ্বর গুপ্ত কুমার তোমার।।
পিতৃ নামে নাম পেয়ে, উপাধি পেয়েছি।
জন্মভূমি জননীর কোলেতে বসেছি ।।
তুমি গুপ্ত আমি গুপ্ত, গুপ্ত কিছু নয়।
তবে কেন গুপ্ত ভাবে ভাব গুপ্ত রয়?’

২৪.
সামাজিক ও ব্যঙ্গকবিতাগুলোর জন্যও ঈশ্বরগুপ্তের সর্বাধিক খ্যাতি। তার রঙ্গরসপ্রবণতা ও লঘু চপলভঙ্গি কবিতাগুলোকে উৎকর্ষ দান করেছে। সে আমলে ইংরেজি শিক্ষাসভ্যতার সংস্পর্শে বাঙালির সমাজ ও জীবনে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল ঈশ্বরগুপ্ত তাকে কবিতার উপজীব্য করেছেন। যেখানেই সামাজিক অনাচার, চারিত্রিক দৈন্য ও আদর্শহীনতা দেখেছেন সেখানেই তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন। ইংরেজদের আচার আচরণকে এ দেশের জন্য অকল্যাণকর মনে করে ইংরেজিয়ানা প্রীতির ব্যঙ্গ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তার ‘ইংরেজি নববর্ষ’ কবিতায়-
‘গোরার দঙ্গলে গিয়া কথা কহ হেসে। 
ঠেস মেরে বস গিয়া বিবিদের ঘেঁসে॥ 
রাঙ্গামুখ দেখে বাবা টেনে লও হ্যাম। 
ডোন্ট ক্যার হিন্দুয়ানী ড্যাম ড্যাম ড্যাম॥ 
পিঁড়ি পেতে ঝুরো লুসে মিছে ধরি নেম। 
মিসে নাহি মিস খায় কিসে হবে ফেম? 
শাড়িপরা এলোচুল আমাদের মেম। 
বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম্ ॥’ (সংক্ষেপিত) 

২৫.
আমরা জানি, এ অঞ্চলে পূর্বে জ্ঞানীমাত্রকেই কবি বলা হতো। শাস্ত্রবেত্তারা সকলেই ছিলেন “কবি”। তারা ছিলেন নমস্য। সেই নমস্য কবিকে নিয়ে, ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত’ নামক কবিতায় মধুকবি মাইকেলের তাই আক্ষেপ ছিলো, ‘নাহি কি কেহ তব বান্ধবের দলে, তব চিন্তা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে। স্নেহ-শিল্পে গড়ি মঠ, রাখে তার তলে’। মানতেই হবে, সঠিক অর্থে তিনি যুগস্রষ্টা নন। 

যুগের আজ্ঞাবহ মাত্র। তার স্নেহধন্য বঙ্কিমের উক্তি “তিনি সুশিক্ষিত হইলে, তাহার যে প্রতিভা ছিল, তাহার বিহীত প্রয়োগ হইলে, তাহার কবিত্ব, কার্য এবং সমাজের উপর আপত্য অনেক বেশি হইতো। বাংলা সাহিত্যও অনেক দূর অগ্রসর হইতো। তার ছিল মার্জিত রুচির অভাব এবং উচ্চ লক্ষ্যের অভাব।...দুঃখ যে একটা প্রতিভা ইয়ারকিতেই ফুরাইল।” প্রসঙ্গত বঙ্কিমের লেখনীশক্তির উন্মেষ ঘটেছিল ঈশ্বর গুপ্তেরই উৎসাহে। শিবনাথ শাস্ত্রী যথার্থই লিখেছেন, “তাহার অনুসরণে শিষ্য-প্রশিষ্য-শাখা-প্রশাখা সমন্বিত এক কবি সমপ্রদায়ের সৃষ্টি হয়। বঙ্কিম তার ভিতর সর্বাপেক্ষা বিদগ্ধ এবং সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠার জন্যই ঈশ্বর গুপ্ত সাহিত্য জগতে অমর হয়ে থাকবেন তার দোষত্রুটি সব নিয়েই। আলোচিত-সমালোচিত ‘কবি’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে আবারো জানাই শ্রদ্ধা।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক যুগান্তর, দেশ, বইয়ের দেশ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক মানব জমিন, দৈনিক জনকণ্ঠ, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিত ও কবিত্ব, বঙ্কিম রচনাবলী, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত