সুরজিৎ দাশগুপ্ত

জানা অজানার মাঝে যা কিছু রেখে গেলেন তিনি

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:১০

সাহস ডেস্ক

সুরজিৎ দাশগুপ্ত: ঠিকই। আমার জন্ম ১৯৩৪ সালে ২০ এপ্রিল। সেটা ছিল গুড ফ্রাইডে। মা ছিলেন নর্থ সাবার্বান হসপিটালের লেডি ডক্টর। আমার জন্মের সময় মা অশ্রুবালা দাশগুপ্ত মেটারনিটি লিভে রতনবাবুর ঘাটের কাছে একটা ভাড়া বাসাতে ছিলেন। বাবা তখন মুঙ্গেরে। ঠাকুরদা-ঠাকুরমা মুঙ্গেরে বাস করছিলেন। বাবা ভূমিকম্পের খবর পেয়ে কাশীপুর থেকে মুঙ্গেরে যান। তারপর তাঁর খোঁজ ছিল না। মুঙ্গের তখন পৃথিবী-বিচ্ছিন্ন। মা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। বাসা ছেড়ে যেতে পারছেন না। সেই অবস্থায় একা বাসাতে আমাকে ঘরের মেঝেতে জন্ম দেন। দাদার পরিচারিকা, যাঁকে আমরা ঝিমা বলতাম, তিনি মায়ের প্রসব ব্যথা উঠলে দাদাকে নিয়ে হাসপাতালে যান ডাক্তার বা নার্স ডাকতে। একেবারে একা বাড়িতে মা আমাকে জন্ম দেন। ঝিমা খবর দিয়েই চলে আসে। এসে দেখেন আমি মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছি। ঝিমা মায়ের ব্যাগ এনে দিলে মা নাড়ি কাটেন। এসব কথার কিছু ঝিমার মুখে , কিছু মায়ের মুখে শুনেছি পরে। বাবা অনেক পরে মুঙ্গের থেকে ফিরে এসে আমাকে দেখেন।

প্র: বাবার পেশা কী ছিল?

উ: তিনি ছিলেন সিটি কলেজে কেমিস্ট্রির ডেমনস্ট্রেটর। মায়ের মেটারনিটি লিভের সময়, যিনি সাময়িকভাবে লেডি ডাক্তার হন, তিনি পরবর্তীকালে আর চাকরিটা ছাড়লেন না। অগত্যা, মা পাবনাতে লেডি ডাক্তারের চাকরি নিয়ে চলে এলেন। বাবাও পাবনাতে এলেন, তবে বেকার।

পাবনা হসপিটালে একটা ইন্সপেকশনে এসেছিলেন কয়েকজন ইংরেজ ও একজন বাঙালি, তাঁর নাম বিপুল ব্যানার্জি। তাঁর খেতাব ছিল ‘ফ্রেন্ড অফ ব্রিটিশ এম্পায়ার’। এই বিপুল ব্যানার্জি মাকে নিয়ে আসেন জলপাইগুড়ি হসপিটালের লেডি ডাক্তার করে, আর বাবাকে আনেন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে ল্যাবরেটরির চিফ কেমিস্ট করে।

প্র: জলপাইগুড়িতে এলেন কবে?

উ: ১৯৩৭ সালে। তখন জলপাইগুড়িতে হসপিটাল ছিল, জ্যাকসন মেডিক্যাল স্কুল ছিল, মেডিক্যাল স্কুলের শিক্ষকরাই হসপিটালের ডাক্তার ছিলেন। এমনকী, লেডি ডক্টরস কোয়ার্টার্সও ছিল, কিন্তু লেডি ডক্টর ছিলেন না। মা-ই প্রথম লেডি ডক্টর। সেই বাড়িতে আমাদের প্রথম প্রবেশ ও বাস।

কোয়ার্টার্সের থেকে হাত সাতেক দূরে একদিকে হসপিটাল, অন্যদিকে মুসলমানদের বস্তি। বস্তির একপ্রান্তে পাকা চওড়া পিচের রাস্তা, অন্যদিকে করলা নদী। ওই রাস্তা পেরোলে জ্যাকসন মেডিক্যাল স্কুল। রাস্তাটা ধরধরা নদীর পুল পেরিয়ে গেছে ডিসি প্রমুখের বাড়ি, কোর্ট, ট্রেজ়ারি ছাড়িয়ে তিস্তা নদী। মায়ের কোয়ার্টার্স ছিল ধরধরা ও করলা নদী দিয়ে ঘেরা। তিস্তাও হাঁটাপথে বিশ-ত্রিশ মিনিট। আমি যখন বাড়ি থেকে একা বের হলাম, তখন আমার সঙ্গী ছিল পাশের মুসলমান বস্তির ছেলেমেয়েরা। তাদের সঙ্গে খেলাধুলো, মারামারি, করলা নদীতে স্নান ও সাঁতার শেখা। বাবার শাসন ও মায়ের প্রশ্রয়।

প্র: বাঃ! ছবির মতো বর্ণনা।

উ: (থেমে) বাবার ঝোঁক ছিল প্রতি রবিবার করলা নদীর ওপারে ব্রাহ্ম সমাজে দাদাকে নিয়ে যাওয়া, কোনও কোনও রবিবার মা সমাজে গেলে আমিও যেতাম এবং উপাসনার চেয়ে গানগুলো ভাল লাগত। গায়িকাদেরও ভাল লাগত। ওই মুসলমান বস্তি আর ব্রাহ্মসমাজের গান মিলেই আমার ছোটবেলা।

প্র: ম্যাট্রিক পাশ তো ওখানকার জেলা স্কুল থেকেই...

উ: হ্যাঁ। ১৯৫০ সালে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজে আই-এ ক্লাসে পড়াশোনা শুরু করি। স্কুলের জানালা থেকে দেখা যেত তিস্তা নদী। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘আকাশের আতঙ্ক’ গল্পে তিস্তার উল্লেখ, তা যথার্থ নয়। তাঁকে চিঠি লিখি।

প্র: সাহিত্যের জগতের সঙ্গে এভাবেই প্রথম আপনার পত্রালাপ শুরু...

উ: হ্যাঁ। তিনি পোস্টকার্ডে উত্তর দেন, ভুল স্বীকার করে লেখেন, ‘কলকাতায় এলে দেখা কোরো’। সেটা বোধ হয় ১৯৪৬ সালে। ১৯৪৭-এ আমি ‘দ্বীপময় ভারত’ পড়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি দিই। তিনিও উত্তর দেন। একজনকে লিখেছিলাম ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর ঠিকানায়, অন্যজনকে ‘বুকল্যান্ড’-এর ঠিকানায়’।

প্র: কী ধরনের বই পড়ছিলেন তখন?

উ: ১৯৫০-এর মে মাসে মা’র সঙ্গে আমরা বেড়াতে যাই দার্জিলিংয়ে। আটকে যাই ধসে। তখন চকবাজারে একটা বইয়ের দোকান ছিল। ‘ঘোষ বুক স্টোর্স’ বা ওইরকম কিছু নাম। সেখানে একটি বই পাই ‘আঠারো বসন্ত’। তাতে প্রথম গল্প ছিল ‘দার্জিলিঙে’, লেখক মণীন্দ্রলাল বসু। কিনে ফেললাম। আরও গল্প ছিল— বিভূতি বন্দোপাধ্যায়ের ‘রোমান্স’, আরও কারও কারও গল্প ছিল। কবিতা ছিল সুধীর চৌধুরী, অন্নদাশঙ্কর রায়, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের। জীবনানন্দর নাম শুনিনি বা পাইনি আগে। কবিতাটি অদ্ভুত— ‘বনলতা সেন’। যেমন অদ্ভুত কবিতার নাম— কোনও ব্যক্তির নামে কবিতা লেখা যায় কি? তেমনই অদ্ভুত কথা সব— ‘সব পাখি ঘরে আসে’ বোঝা যায়, ‘সব নদী, ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন’ মানে কী? ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ অদ্ভুত কবিতা! কে এই অদ্ভুত কবি?

দার্জিলিং থেকে ফিরে জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজে ভর্তি হলাম। নতুন বন্ধু সব। জিজ্ঞেস করে জানলাম, কেউ জীবনানন্দ দাশের নাম জানে না, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায় প্রমুখের নাম জানে।

প্র: তা তো হবেই। তারপর শান্তিনিকেতনে গেলেন... অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা।

উ: হ্যাঁ। কলেজে গরমের ছুটিতে নিত্যানন্দ ও আমি বেড়াতে বের হলাম। গেলাম শান্তিনিকেতন। প্রথমেই টের পেলাম— গরম, প্রচণ্ড গরম। গেস্ট হাউসে চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে স্নান করে কী আরাম! মাছ-ভাত খেয়ে ঘুম। ঘুম থেকে উঠে গেস্ট হাউসের ম্যানেজারের কাছ থেকে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়ির হদিশ নিয়ে, গেলাম। অন্নদাশঙ্কর তখন সাদা হাফ শার্ট, সাদা ট্রাউজার্স, সাদা কেডস পরে, টেনিস র্যাকেট হাতে টেনিস খেলতে যাচ্ছিলেন। আমরা জলপাইগুড়ি থেকে এসেছি জেনে, ঘরে গিয়ে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এলেন, হাতে টর্চ। তিনজনে হাঁটতে চললাম।

প্র: সেই প্রথম দিন ওঁর সঙ্গে কী নিয়ে কথা হয়েছিল?

উ: বেশিটাই গাঁধীজির অর্থনীতি ও ভারতের অখণ্ডতা (দেশভাগের) প্রসঙ্গে, মাঝে মাঝে সাহিত্য প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রসঙ্গে কিছু। বললেন যে, সবাই জীবনকে নিয়ে শিল্প গড়ে, নিজের জীবনকে শিল্পের মতো গড়েছেন দু’জন— জার্মানির গ্যেটে, বাংলার রবীন্দ্রনাথ। আমি জিজ্ঞেস করি, জীবনানন্দ দাশ সম্বন্ধে আপনার কী মত? আচমকা প্রশ্নে উনি কিছুক্ষণই চুপ করে থেকে বললেন, “ওঁর কবিতাতে একটা সুর আছে।” কয়েক সেকেন্ড পরে বললেন, “আমাদের শুদ্ধতম কবি।” তখন আমার বন্ধু যোগ করল, “সুরজিৎ একটা কবিতা পড়েই জীবনানন্দের অন্ধ ভক্ত হয়েছে।” অন্নদাশঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “অন্ধ ভক্তি ভাল নয়।”

প্র: অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে গভীর বন্ধনের সেই শুরু?

উ: সেই শুরু। বাসায় ফিরে লীলা রায়, অন্নদাশঙ্কর ও আমরা দু’জন চা ও কেক খেলাম। অন্ধ ভক্তি নিয়েও কথা হল। সেদিনই অন্নদাশঙ্কর হলেন মেসোমশাই, লীলা রায় মাসিমা। চা খেয়ে মাসিমা আমাদের নিয়ে গেলেন অন্ধকারে ভূতের মতো কয়েকটা গাছের নীচে। বললেন, “এই হল ছাটিমটলা। এই এক টির্ঠ। শান্টিনিকেটনে এলে, আগে এখানে আসবে।”

শান্তিনিকেতনে তিন-চারদিন থেকে, কলকাতায় এলাম, উঠলাম প্রেমেন্দ্র মিত্রর বাড়ি।

প্র: প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়ি!

উ: হ্যাঁ। সেই ১৯৪৬-এ দাঙ্গার পরে এসেই জেনে গিয়েছিলাম, এ বাড়ি একটা ধর্মশালা। বড় ছেলে মৃন্ময় তার ঘর ছেড়ে দিল। দু’জনের সে-ঘরে ঠাঁই হল।

প্রত্যাশিত ভাবেই জীবনানন্দের কথা উঠল। প্রেমেনদা বললেন “খুব অন্য ধরনের কবি। মানব ইতিহাসের কবি। তবে একটা ‘বনলতা সেন’ পড়ে বিচার কোরো না। বই বেশি লেখেননি, তবে ‘কবিতা’-তে, ‘পূর্ব্বাশা’-তে, ‘নিরুক্ত’-তে লিখেছেন অনেক। আমাদের ‘কল্লোল’, ‘কালি ও কলম’-এ লিখেছেন। বুদ্ধদেবের ‘প্রগতি’-তেও লিখেছেন। ‘পূর্ব্বাশা’ থেকে বেরিয়েছে ‘মহাপৃথিবী’ নামে একটা বই, বুদ্ধদেব (বসু) বের করেছেন এক ফর্মার ‘বনলতা সেন’। নিজে খরচ করে বের করেছেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। তোমার যখন এত আগ্রহ, খুঁজে দ্যাখো, ক’টা বই পাওয়া যায়।”

পেলাম শুধু ‘সাতটি তারার তিমির’। বইটি হাতে নিয়েই ধীরাজদা...

প্র: অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য? জীবনানন্দের কবিতা ভালবাসতেন? জানতাম না তো।

উ: হ্যাঁ। তিনি প্রথম কবিতাটি জোরে জোরে পড়া শুরু করলেন, “সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি,/ বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে।” আবৃত্তি শেষ করে বললেন, “জীবনানন্দের কাছে গেলে বোলো, বড় ভাল লেগেছে আমার।” প্রেমেনদা বলে দিলেন ল্যান্সডাউন রোডে জীবনানন্দের বাড়ি কেমন করে যেতে হবে।

প্র: তার মানে প্রেমেন মিত্রের মাধ্যমেই জীবনানন্দের সঙ্গে সম্পর্কের শুরু?

উ: হ্যাঁ। এভাবেই শুরু হল জীবনানন্দের সঙ্গে সম্পর্ক।

কিন্তু জীবনানন্দর কথায় পরে আসব। তার আগে বলি আমার শান্তিনিকেতন পর্বের কথা। জলপাইগুড়ি কলেজে ইংরেজি অনার্স ছিল না। জলপাইগুড়ির এক বন্ধু নির্মল সান্যাল ম্যাট্রিক পাশ করেই কলকাতায় গিয়ে স্কটিশে ভর্তি হয়, তার দাদা থাকত নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিটে। বাসার কাছে দু’টি কলেজ— মেয়েদের বেথুন, ছেলেমেয়েদের কো-এড কলেজ স্কটিশ চার্চ। নিমু স্কটিশে। আমি আই-এ পাশ করে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম স্কটিশ চার্চ কলেজে। কিন্তু হস্টেলে জায়গা না পেয়ে আশ্রয় নিলাম ‘দ্য রেসিডেন্স’ নামে হরি ঘোষ স্ট্রিটের মেস-এ। আমরা বোর্ডাররাই বলতাম হরি ঘোষের গোয়াল! কলেজ থেকে হাঁটা পথ। কলেজে সহপাঠী পেলাম সাহিত্য-পাগল দীপক মজুমদার, তারও ইংরেজি অনার্স। তার মামা শান্তিদেব ঘোষ, সাগরময় ঘোষ, শুভময় ঘোষ সব শান্তিনিকেতনের।

দীপকের পাল্লায় পরে এক জুন মাসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দীপকের গান— ‘...এসো নীপবনে, করো স্নান নব ধারাতলে’— শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম শান্তিনিকেতনে। দীপক চলে গেল মামা শান্তিদেবের বাড়িতে, আমি মেসোমশায় অন্নদাশঙ্করের বাড়িতে। প্রথমে মুষল বকুনি মাসিমার। পরে মেসোমশায় আমার কলকাতার হস্টেলের সমস্যার কথা শুনে বললেন, “এখানে হস্টেলে অঢেল জায়গা। চলে এসো এখানে।” পরদিন তাঁর চিঠি নিয়ে দেখা করলাম রেজিস্টার নিশিকান্ত সেনের সঙ্গে। তিনি বললেন, “অনেকদিন সেশন শুরু হয়ে গেছে, তোমাকে অনেক মেকআপ করতে হবে।” তারপর আজব কাণ্ড— আমি সেদিনই বিশ্বভারতীর শিক্ষাভবনের ছাত্র হলাম ও হস্টেলে জায়গা পেলাম সেদিনই, কোনও টাকা না-দিয়েই।

প্র: বলেন কী!

উ: টাকা দিই অনেক পরে। নিশিকান্তদার সৌজন্যে তা সম্ভব হল।

প্র: তারপর? শান্তিনিকেতনকে কেমন লাগল তরুণ সুরজিতের...

উ: শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ না থাকলেও তাঁর আলোতে শান্তিনিকেতন ছিল আলোকিত। সব শুনে প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুনীতিকুমার, জীবনানন্দ খুশি হলেন। কিন্তু বিশ্বভারতীতে আমি অনার্স নিই ইতিহাসে, তাতে সুনীতিকুমার বিরক্ত হন। তিনি চেয়েছিলেন আমি ইংরেজিতে অনার্স নিই, তবে অন্নদাশঙ্কর বলেছিলেন, ঠিকই করেছ। তিনি নিজেও ইংরেজি ছেড়ে ইতিহাসে অনার্স নিয়েছিলেন। সাহিত্য অথই পাথার, ইতিহাসের সময় একটা সীমারেখা দিয়ে ঘেরা। বড়জোর তার দেশ বদল হয়।

শিক্ষাভবনের অধ্যক্ষ হীরেন্দ্রনাথ দত্ত একদিন আমার এক সহপাঠীকে বললেন, “গুরুদেবের আদর্শ ভাল ছাত্র নয়, ভাল ছেলে, যার সবেতে আগ্রহ, সবেতে অংশ নেওয়া, যেমন ছিলেন অমর্ত্য সেন। এখান থেকেই তিনি চলে গেছেন ইকনমিক্সে অনার্স পড়তে প্রেসিডেন্সি কলেজে।” আমার সে সহপাঠী বাসুদেব মুখার্জির অনার্স ছিল বাংলায়, হস্টেলেই থাকত, সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে থাকত। সিউড়ির ছেলে। আমাদের সঙ্গে মিশত না।

প্র: পঞ্চাশের দশকের শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে গ্রহণ করছেন তরুণ সুরজিৎ?

উ: শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে রবীন্দ্রনাথ। গান, নাচ, অভিনয়— মানব সংস্কৃতির সব কিছুর চর্চা। আর কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এতগুলো বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় কি না জানি না। সার্বিক বিদ্যাচর্চা। বিদ্যাচর্চার সঙ্গে দেহচর্চাও। বিরাট খেলার মাঠ, উত্তরায়ণ-এর ভেতরে টেনিস কোর্ট। খেলাধুলোর দায়িত্বে ছিলেন মন্টুদা। আর ছিল গৌর প্রাঙ্গণের উলটো দিকে লাইব্রেরি। মুখ্য গ্রন্থাগারিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। দাড়িচুলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেন— তিনি বই বাছাইয়ে সাহায্য করতেন। আবার শিক্ষাভবনের দপ্তরেও একটা ছোট লাইব্রেরি ছিল। শিক্ষাভবনের লাইব্রেরি থেকে এনে পড়েছিলাম জেমস জয়েস-এর ‘A Portrait of the Artist as a Young Man’, এবং ফ্রানৎস কাফকার ‘The Castle’। জয়েস-এর উপন্যাস পড়ে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হই, শুরু করি একটি উপন্যাস লেখা। নায়কের নাম দিই ‘সুচেতন’। কিন্তু বেশ কয়েক বছর পড়ে ডি এম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয় ‘একই সমুদ্র’ নামে। অন্নদাশঙ্করের সুপারিশে ডি এম লাইব্রেরির গোপালদাস মজুমদার আমাকে কোনও রয়্যালটি না দিলেও তিনি আমাকে বহু কপি বই দেন, নিজেও পাঠান দু’-একজনকে।

প্র: হীরেন মুখোপাধ্যায় বইটি পড়ে প্রশংসা করেছিলেন শুনেছি।

উ: গোপালদাই দিল্লিতে পাঠান অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে। তিনি উত্তর দেন গোপালদাকে, “মনে হয় বাংলা সাহিত্যে এক নতুন কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।” চিঠিটা আমাকে দিয়ে তিনি বললেন, “এটা যত্ন করে রেখো।” কিন্তু সে চিঠি কীভাবে যে হারিয়ে গেল জানি না। পরের উপন্যাস ‘গরল’। রমাপদ চৌধুরী বললেন, “বাংলাসাহিত্য এ ধরনের উপন্যাস স্বীকার করবে না।” রমাদার প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো—‘প্রথম প্রহর’, ‘লালবাই’ ইত্যাদি গোপালদাই ছেপেছিলেন।

এর পরে আমি ডি এম লাইব্রেরি থেকে লিখি ‘দান্তে, গ্যেটে, রবীন্দ্র’— তিন দেশের তিন মহাকবি।

প্র: সেটা ১৯৬৬ সালে। অন্নদাশঙ্করের প্রভাবে লেখা বলব?

উ: অন্নদাশঙ্করের অনুপ্রেরণাতে। তিনি এর একটা বড় আলোচনা লেখেন ‘জয়শ্রী’ পত্রিকাতে। এই আলোচনাটি তিনি তাঁর একাধিক প্রবন্ধগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন। শান্তিনিকেতনেই মনে হয়েছিল তিন দেশের তিন মহাকবির উপর একটা বই লিখব। গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ শান্তিনিকেতনে পড়ি এবং তখনই স্থির করি জার্মান ভাষা শিখব। বোধ হয়, ১৯৫৯ সালে ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্স-এ ইমগার্ড ভাদুড়ীর কাছে জার্মান শিখি, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ পড়ি জীবনানন্দর দাশের উপদেশে।

প্র: জীবনানন্দের উপদেশে?

উ: হ্যাঁ। কিন্তু ইতালীয় ভাষা শেখার তাগিদ অনুভব করিনি। বড্ড ধর্মতত্ত্ব। তবে জীবনানন্দ দান্তের সঙ্গে জয়েসের তুলনা করেন।

প্র: ইংরেজি সাহিত্যে মডার্নিজ়মে দান্তের গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছিল তখন। এলিয়ট বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন দান্তের কথা। জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথকেও লিখেছিলেন দান্তের কথা...আর জয়েস তো ছিলেনই, ইউরোপীয় আধুনিকতার অন্যতম সেরা ফসল...

উ: দান্তের ‘ভিটা নুভা’, জয়েস-এর ‘স্টেফান হিরো’, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’-র তিন খণ্ড, জয়েসের ‘পোট্রেট অফ অ্যান আর্টিস্ট’, ‘ইউলিসিস’ আর ‘ফিনেগান্স ওয়েক’ পড়ে আমি দান্তেকে নিয়ে লিখি, জয়েসকে নিয়েও লিখি। দান্তের ওপর লেখাটা ‘দান্তে গ্যেটে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়, জয়েসের ওপর প্রবন্ধগুলো পরে সংকলিত হয় ‘প্রবন্ধ সংগ্রহে’।

প্র: জীবনানন্দের কথায় আসি। আপনি তাঁর এত কাছে এসেছেন।

উ: জীবনানন্দ লাজুক ও স্বল্পভাষী ছিলেন, কিন্তু কোনও কারণে আমায় পছন্দ করতেন। তিনি কথা বলতেন থেমে থেমে, ভেবে ভেবে, মনে মনে খসড়া করে বা লিখে। কিছু উক্ত হত, কিছু অনুক্ত থাকত। তাঁর কথার মতো কবিতাতেও অনেক ফাঁক থাকে, ফাঁকগুলো পাঠককে পূরণ করতে হয়। তাঁর ‘ঝরা পালক’ ও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-তে এইরকম ফাঁক কম, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’-এ প্রচুর।

তিনি একদিন জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর কবিতা আমার কেন ভাল লাগে। আমি বলেছিলাম, “পাঠকের কল্পনাশক্তিকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা কী বলা হল, তার চেয়ে বেশি না-বলা কথা, সেটা পাঠককে কল্পনা করে নিতে হয়। যেমন সিনেমার ট্রেলার। কিছু চুম্বক হিসেবে দেখানো হয়, যাতে দর্শক পুরো ছবিটা দেখতে আগ্রহী হয়,” আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসি থামিয়ে বললেন, “প্রেমেনের পাল্লায় পড়ে সব কিছু সিনেমার চশমাতে দ্যাখো।”

আমি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন থাকতাম গোলপার্কে সাউথ সিটি কলেজের সামনে প্রণব দাস-বিজয়া দাসের বাসাতে। এঁরা দু’জনেই ছিলেন ব্রাহ্ম ও জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। বিজয়া দত্ত ছিলেন গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা, প্রণব দাস জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম সুপারিন্টেনডেন্ট। দু’জনে আমার মায়ের অনুরক্ত। মায়ের কোয়ার্টারে আসতেন। এখানেই পরিচয় থেকে পরিণয়। থাকার খরচ নেই, শুধু খাওয়ার খরচ যৎসামান্য। একইসঙ্গে রান্না ও খাওয়া।

আমি জীবনানন্দ দাশের কাছে যাই। খেতে খেতে আমাদের সে সব গল্প হত। একদিন প্রণবদা বললেন, তোমার জীবনানন্দ ব্রাহ্ম হয়ে অমন সব কবিতা লেখেন কেন, যে সবের মাথামুন্ডু নেই?

কিন্তু প্রশ্নটা জীবনানন্দকে গিয়ে বলতে বলতে পুজোর ছুটি এসে গেল। পুজোতে জলপাইগুড়ি যাওয়ার আগে জীবনানন্দকে প্রশ্নটা করলাম। তিনি একটু ভেবে বললেন, “ব্রাহ্ম হতে গেলে ব্রহ্মে বিশ্বাস করতে হয়,” জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি ব্রহ্মে বিশ্বাস করেন না?” তিনি সময় নিয়ে বললেন, “আমি ব্রহ্মবাদী নই, আমি মানববাদী।” যখন চলে আসছি, তখন বললেন, “এবার পুজোয় আনন্দবাজারে একটা কবিতা লিখেছি, পোড়ো। পড়ে আমাকে জানাবে।”

শিয়ালদহ স্টেশনে পুজোর আনন্দবাজার কিনলাম। কবিতাটির নাম ‘মহাজিজ্ঞাসা’। একেবারে নতুন ধরনের কবিতা— যেন তাঁর কাব্যে একটা নতুন পর্ব আসছে। ‘ছিলাম কোথায় যেন নীলিমার নিচে’— ওই কবিতার প্রথম পঙ্‌ক্তি।

প্র: অগ্রন্থিত এই কবিতাটি পরে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ছিলাম কোথায় যেন নীলিমার নিচে/ সৃষ্টির মনের কথা সেইখানে আবছায়ে কবে/প্রথম রচিত হতে চেয়েছিল যেন।’

উ: এর পর জলপাইগুড়িতে এসে, বোধ হয় পুজোর ঠিক আগে, একদিন রাতে শুতে গেছি, হঠাৎ কাশি, মুখ ভরে গেল নোনতা স্বাদের থুতুতে। বাথরুমে থুতু ফেলতে গিয়ে দেখি রক্ত। মা কী-সব ইঞ্জেকশন দিলেন, ঘুমিয়ে পড়লাম। নির্ণীত হল যক্ষ্মা। মা আমাকে নিয়ে এলেন কলকাতায়, উঠলাম মির্জাপুর স্ট্রিটের আইডিয়াল হোম-এ। দেখানো হল নীলরতন সরকার হসপিটালের মেডিসিনের প্রফেসর অরুণকুমার নন্দীকে। হোটেলে একদিন এলেন সুভাষদা (কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়)। বললেন, “আমাকে আর জীবনানন্দের বিরোধী বলতে পারবে না। আমিও শ্রদ্ধা জানাতে শ্মশানে গিয়েছিলাম।” সব শুনে মা ও আমি দু’জনেই স্তম্ভিত। ট্রাম অ্যাক্সিডেন্টের কথা কোথা থেকে জেনে কার্তিকদা (লাহিড়ি) বলেছিলেন। বলেই চলে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর কথা জানতাম না। জীবনানন্দের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্বেরও শেষ।

প্র: আচ্ছা, জীবনানন্দ যে কবিতার পাশাপাশি নিভৃতে এত গল্প উপন্যাস লিখেছেন, আপনাকে বলেছেন কখনও?

উ: না। একবার শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কোনও প্রকাশককে চিনি কি না, যিনি তাঁর একটি উপন্যাস প্রকাশ করবেন। আমি বললাম, আপনি লিখেছেন নাকি? উনি বললেন, “না, হয়তো লিখব। উপন্যাস লিখলে টাকা হয়। নীহাররঞ্জন গুপ্ত ডাক্তার হয়েও যদি উপন্যাস লিখে এত টাকা উপার্জন করতে পারেন...”

প্র: জীবনানন্দের সঙ্গে আপনার এত সহজ পত্রবিনিময়। এমনটা বোধ হয় আর হয়নি।

উ: ওঁর চিঠিগুলো প্রকাশিত হয়েছে ‘এবং মুশায়েরা’ থেকে। ‘পত্রালাপ’ নামে প্রভাতকুমার দাস যত্ন করে সম্পাদনা করেছেন। জীবনানন্দের সঙ্গে অন্যান্যদের চিঠিও আছে।

প্র: গুরুত্বপূর্ণ বই। আপনার সঙ্গে আরও কত সাহিত্যিকের চিঠি আছে। বাকি চিঠিপত্র, প্রেমেন মিত্র, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বা অন্যদের সঙ্গে... সেগুলো একসঙ্গে প্রকাশিত হওয়া দরকার। সাহিত্যের অন্দরমহলের এক অন্য ইতিহাস লুকিয়ে আছে সেখানে।

উ: প্রকাশ করতে যাচ্ছেন এক তরুণ প্রকাশক। রূপালি।

প্র: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা হচ্ছিল...

উ: সুভাষদার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা শান্তিনিকেতন থেকে। না, আরও আগে— পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে তিনি আত্মগোপন করতে চলে আসেন জলপাইগুড়ি। মায়ের কাছে আসেন একদিন মাথায় গামছা জড়ানো বিহারি মজুর সেজে। কিন্তু পরে ধরা পড়েন। মায়ের কাছে আসতেন চারু মজুমদারও। তাঁকে বলতাম চারুমামা। এসব বিষয়ে মা ছিলেন সৃষ্টিছাড়া! এখনও জলপাইগুড়ির দু’-একজন মা’র কথা আমাকে বলেন। সুভাষদা পরে কোথাও কীভাবে ধরা পড়েন জানি না। বোধ হয় বিচারের জন্য আনীত হলে অন্নদাশঙ্কর তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করেন। সরকারের আইনি পরমার্শদাতা রূপে।

প্র: আপনার সঙ্গে সুধীন দত্তের যোগাযোগ হল কীভাবে? আপনি কোথাও লিখেছেন, আপনি তাঁকে তোয়ালে পরিহিত অবস্থায় দেখেছেন। খুবই বিরল অভিজ্ঞতা বলতে হবে।

উ: হ্যাঁ, সেটা পরে। তাঁর রাসেল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। পরিচারক জানাল, মালিক গোসল করতে গিয়েছেন। অকস্মাৎ সুধীন্দ্রনাথ বেরোলেন, তোয়ালে পরিহিত এক অপূর্ব সুঠাম রূপবান মানুষ। বললেন, আসছি। ফিরলেন সাহেবি পোশাকে। এই বিরল দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

প্র: সুধীন দত্ত নাকি আপনার কবিতা পড়ে প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন?

উ: হ্যাঁ। ‘কুড়ি বৈশাখের অঙ্গীকার’ কবিতাটি পড়ে। যাই হোক, সুধীন্দ্রনাথের ‘তন্বী’ প্রথম হাতে আসে শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগারে। ‘তন্বী’-র সেই কপিটি ছিল রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া উপহার। উৎসর্গও করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে ‘ঋণ স্বীকারের জন্য’, নীচে সুধীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর। প্রেমেনদার কাছে দেখলাম ‘অর্কেস্ট্রা’। যদিও প্রেমেনদা বাংলায় গদ্যকবিতা প্রচলন করেন, কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ গদ্যকবিতা বা গদ্যছন্দের বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রেমেনদার প্রথম গদ্যকবিতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের শোকযাত্রা দেখে।

প্র: অত আগে ১৯২৫ সালে! কী নাম ছিল সেই কবিতার?

উ: ১৯২৫। কবিতার নাম ‘পাওঁদল’, ‘বিজলী’ পত্রিকায় বেরিয়ে ছিল। তারপরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘পুনশ্চ’-র গদ্যকবিতা।

সুধীন্দ্রনাথকে দেখি প্রেমেনদার ছোটগল্পের অনুরাগী। সুধীন্দ্রনাথের কাছে আমি কৃতজ্ঞ একটা কারণে— আমি যক্ষ্মা থেকে নিরাময় হয়ে কলকাতার সেন্ট্রাল পার্কে প্রণবদার তত্ত্বাবধানে ও ব্যবস্থাপনায় নির্মিত বাড়িতে বাস শুরু করলে সুধীনবাবু বলেন, “তুমি যে-কাজ শুরু করেছিলে সেই কাজটা শেষ করো।” অর্থাৎ আবার এম এ-টা পড়তে বললেন। সেই সঙ্গে যোগ করলেন, “তুমি যখন যাদবপুরেই আছ, তখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ো। ওখানে লেজেন্ডারি প্রফেসর সুশোভন সরকার হিস্ট্রির হেড। গিয়ে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করো। তোমার তো অলরেডি তিনবছর লস হয়েছে।” প্রেমেনদা ও বউদি বললেন, আবার এম এ-টা পড়লে ভালই হয়— ওঁর কথা শোনাই উচিত। বিশেষত, যখন সুধীনবাবুর বিয়ে নিয়ে সুধীনবাবুর সঙ্গে সুশোভনবাবুর বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে গেছে...

প্র: তাই নাকি! কী হয়েছিল?

উ: প্রথম স্ত্রী থাকতে তিনি রাজেশ্বরী বাসুদেবকে বিয়ে করায় সুশোভনবাবু ও সত্যেন বসু ক্ষুব্ধ হন এবং সুধীন দত্তের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেন। অবশ্য সুধীন দত্তের মৃত্যুর পর দেখি, কেওড়াতলায় সত্যেন বসু আগেই এসে অপেক্ষা করছেন!

যাই হোক, সুধীনবাবু তাঁর বন্ধু সুমন্তকে বললেন, “ওকে সুশোভনের বাসাটার ডিরেকশন দাও তো।” সুমন্তবাবু এলগিন রোডের ঠিকানা বুঝিয়ে দিলেন। গিয়ে দেখি এলগিন রোডের ফ্ল্যাটে আসবাবপত্র বিরল— বেশি চলে গেছে নাকতলাতে তাঁর নিজস্ব বাড়িতে। তিনি বললেন কত টাকা নিয়ে এসে ভর্তি হতে হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্র: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রথম পর্বে...

উ: হ্যাঁ। আমি যাদবপুরে ভর্তি হবার কয়েকদিন পরেই ক্লাস শুরু হল। বিশ্বভারতীর প্রথম পর্বেই আমি ছাত্র হই, আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম পর্বে। দুপুরে যাদবপুরে ক্লাস, বিকেলে ৮বি বাসে বিবেকানন্দ রোড-কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ে ডি এম লাইব্রেরিতে। সেখানে বিজ্ঞাপন লেখা, প্রুফ দেখা, বিনিময়ে যৎসামান্য অর্থপ্রাপ্তি। মনে আশা যে, একদিন এখান থেকে আমার বই বেরোবে। বেরও হয় প্রথমে ‘একই সমুদ্র’, পরে ‘গরল’। তারপরে ‘দিনরাত্রি’। ‘দিনরাত্রি’-র আলোচনা করেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও লোকেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (মানব বন্দ্যোপাধ্যায়)। এবার রমাপদ চৌধুরীর হাত ধরেই প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে প্রবেশ। খুলে গেল আলিবাবার গুহা। রমাপদ চৌধুরীর কথামতো লিখলাম আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘বিদ্ধ করো’। বের হল দোলসংখ্যায়। তখনকার দিনে দোলের সময় বের হত বার্ষিক সংখ্যা। প্রেমেনদা ও ভবানী মুখোপাধ্যায় ভূয়সী প্রশংসা করলেন। ভবানীবাবু বললেন, “এটার পরের অংশ লেখো। একটা সিকোয়েল করো।”

প্র: যাদবপুরেই বউদির সঙ্গে পরিচয়, তাই তো?

উ: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শীতের সন্ধে। ডি এম লাইব্রেরি থেকে ফিরছি ৮-বি বাসে। বাস থেকে নেমে ভাবলাম, বাড়ি ফেরার আগে একবার ঢুঁ মারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তখন কনভোকেশনের পরে একটা এগজ়িবিশন হচ্ছিল, প্রধানত ইঞ্জিনিয়ারিং এগজ়িবিশন। আর্টসও স্টল দিতে পারে। সুশোভনবাবুর উদ্যোগে ইতিহাসও স্টল দেয়। বোধ হয় বাংলাও দেয়। যাই হোক, ৮বি থেকে নেমে ভাবলাম, একবার গিয়ে দেখি ইতিহাসের স্টলে কারা আছে। নিশ্চয়ই রজত-দিলীপরা আছে। গিয়ে দেখলাম, আমাদের স্টলের সামনে একটা ভিড়। রজত-দিলীপ ও ফিফথ ইয়ারের দু’-একজন হাতজোড় করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দু’টি ষন্ডামার্কা ছেলেকে কিছু অনুনয় করছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম, স্টলের দু’টি ফিফ্থ ইয়ারের মেয়েকে ওই ছেলে দু’টি জ্বালাতন করছে। রজতরা তাদের চলে যেতে অনুনয় করে। একপলকে আমার মাথায় ছোটবেলার বস্তি জেগে উঠল। আমি তাদের কলার ধরে বললাম, “লিভ দিস প্লেস ইমিডিয়েটলি।” কলার ধরেই বুঝলাম, ভুল জায়গায় হাত দিয়েছি। কিন্তু তারাও কেমন হকচকিয়ে গেল। তারা দু’জনেই বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। সবাই তাদের সমীহ করত। তারা ভাবেইনি কেউ এমন করার সাহস পাবে। তারা হকচকিয়ে সুড়সুড় করে চলে গেল। দু’দিন পরে ডাকা হল ছাত্র সমিতির বিচারসভা। একদিকে কলা বিভাগ, অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। ছাত্র সমিতির সম্পাদক সেও কলা বিভাগের। আমি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অপমান করেছি তাদের গায়ে হাত দিয়ে। শেষে অবশ্য পর্বতের মূষিক প্রসব। কিন্তু যে-মেয়েটি তাদের আসল লক্ষ্য ছিল, সেই মঞ্জু চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাঁধা হয়ে গেল। সে-ও সুশোভনবাবুর টানে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে যাদবপুরে এসেছিল। প্রেসিডেন্সিতে

বি এ অনার্স পড়ার সময় তার এক বন্ধু ছিল, সে ব্যারিস্টারের ছেলে, মোটরে করে কলেজে আসত, ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে গেলে তার গাড়ি ও ড্রাইভার মঞ্জুকে দিয়ে বলে যায়, “ব্যবহার কোরো।” তিনি এখন নামকরা ব্যারিস্টার, দিল্লিতে থাকেন। তাঁর নাম ফাঁস করার সাহস পাচ্ছিনে।

প্র: আপনি তো এক বছরের সিনিয়র ছিলেন...

উ: আমি ড্রপ করে এক বছর পরে মঞ্জুর সঙ্গে এম এ দিই। কিন্তু কেউই পরীক্ষা দিয়ে বিয়ে করব বলে সবুর করিনি। আজ মঞ্জু নেই, অন্নদাশঙ্করমেসো বলতেন, “তুমি মহাভাগ্যবান, মঞ্জুর মতো বউ পেয়েছ।” প্রেমেনদার স্ত্রী বীণাবউদি বলতেন, “মঞ্জুর মতো মেয়ে হয় না।” আমার মা বলতেন, “তিন-চার বছর বয়সে যে-মাকে হারিয়েছিলাম সে-ই আবার ফিরে এসেছে।” মঞ্জু বলত, “বাঁচাটাই সবচেয়ে বড় কাজ।” কিন্তু সে-ই চলে গেল মাত্র ঘণ্টা চারেক বুকে ব্যথা পেয়ে— কার্ডিয়াক অ্যাটাকে ২০১৭-র ২৬ জুলাই। কোনও কাজ, কারও কোনও পাওনা বাকি রেখে যায়নি, সবার পাওনা মিটিয়ে, দু’ছেলেকে সম্পত্তি দানপত্র করে। ৪ জুলাই আগমন, ২৬ জুলাই প্রয়াণ। আষাঢ়ে এসে শ্রাবণে বিদায়। আমার চেয়ে চার বছরের ছোট। বিয়ের সময় সুনীতিবাবু বলেছিলেন, “যাক, তোমার বুড়োবয়সে তোমাকে দেখতে পারবে।” তাঁর নিজের স্ত্রীও তাঁর অনেক আগেই চলে যান। মঞ্জু ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল, ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ডের চেয়ে ৩৪ নম্বর বেশি পেয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট। তার সে রেকর্ড অক্ষুণ্ণ ছিল ২০১২ পর্যন্ত। তারপরে কেউ মঞ্জুর রেকর্ড ভেঙেছে কি না জানিনে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি ২০১২-র পরে।

প্র: উনি তো আগাগোড়া অধ্যাপনা করেছেন।

উ: মঞ্জুর চাকরির অভাব হয়নি। প্রথমে বাসন্তী দেবী কলেজ। ছুটি হলেই আমি জলপাইগুড়ি ছুঁয়ে দার্জিলিং যেতে চাইতাম। যেতামও। মঞ্জু শেষে ঠিক করল দার্জিলিংয়েই চাকরি নেবে। দার্জিলিং লোরেটো কলেজে চাকরির দরখাস্ত করল। আমি ইতিমধ্যে মঞ্জুর দাদা শান্তিপ্রসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ফিল্মের কাজে যোগ দিই তাঁর সহকারী হিসেবে। তিনি তখন ফিল্মস ডিভিশনের হয়ে হ্যান্ডিক্র্যাফটস অফ রাজস্থান-এর ওপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম করবেন। জয়পুরে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ফোন করে বম্বে থেকে হুনার ফিল্মস-এর ক্লেমেন্ট ব্যাপটিস্টাকে আনালেন। ছবি তৈরি হলে তা জাতীয় পুরস্কারও পায়, শর্ট ফিল্ম হিসেবে। রাজস্থানে জয়সলমির পোখরান ছিল একরকম কম্বলের জন্য বিখ্যাত— উটের লোম দিয়ে তৈরি, লোমগুলোকে লাল-নীল রং করে কম্বল তৈরি হয়। তারই শুটিং করে ফেরা। পাশেই পাকিস্তান সীমানা। পাকিস্তান সীমানা পেরিয়ে দু’-তিন জন এল শুটিং দেখতে। আমি আমার ছ’মাসের শিশুপুত্রের জন্য ওই কম্বলের একটা স্যুট নিয়ে এলাম। সবাই হাসতে লাগল— ছ’মাসের শিশুর জন্যে স্যুট! রাজস্থানি দরজি কিন্তু হাসেনি। সে বলল, এখন পরতে পারবে না, কিন্তু হাঁটতে পারলে পারবে। সগর্বে সেটা নিয়ে এলাম কলকাতা। এবার দার্জিলিং যাত্রা। তখন ফরাক্কা ব্যারেজ হয়নি, স্টিমারে গঙ্গা পেরোতে হত। ১৯৬৯ থেকে শিয়ালদা-শিলিগুড়ি সোজা রেলযাত্রা শেষ হয়। ঘুরপথে গঙ্গা পেরিয়ে যেতে হত। না হলে আকাশপথে। তখন জলপাইগুড়ির পাঙ্গাতে এয়ারপোর্ট ছিল। জামেয়ার কোম্পানির ডাকোটা প্লেন পাঙ্গা-দমদম যাওয়া-আসা করত। কিন্তু এবার লটবহর নিয়ে বহুদিনের জন্যে দার্জিলিং যাওয়া, সঙ্গে ছ’বছরের বাচ্চা। তাই সেন্ট্রাল পার্কের মান্তুমামা চললেন আমাদের পৌঁছে দিতে। পেছনে আনন্দবাজার, ডি এম লাইব্রেরি, সিনেমার কাজ ফেলে চললাম শীতের দেশ দার্জিলিংয়ে। তখন ১৯৬৬-র মার্চ মাস।

দার্জিলিংয়ে থাকতাম ম্যালের কয়েক পা নীচে অজিত ম্যানশন অ্যানেক্সে। জানালার পরদা সরালেই সান্দাকফু পাহাড়, তার মাথায় তুষার-মুকুট। একবার বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে ম্যালে দেখা, আমাদের ফ্ল্যাটে এসে বললেন, “এরকম ভিউ সিনেমাতেই দেখা যায়। বাস্তবেও যে দেখা যায়, জানতাম না।” ম্যালে অজিত ম্যানশনের ওপরে থাকতেন দীপক চৌধুরী ও নমিতাদি। নমিতাদি ইংরেজি পড়াতেন লোরেটোতে। দীপক চৌধুরী ‘পাতালে এক ঋতু’ লিখে নাম করেন, পরে দু’খণ্ডে লেখেন ‘দাগ’। ‘দাগ’ ডি এম লাইব্রেরি থেকে বেরোয়। মঞ্জু লোরেটো কলেজে পড়াত ইতিহাস। আমাদের ঠিক ওপরে ছিল শামসুর দরজির দোকান, সে নেপালের ও সিকিমের মহারাজার স্যুট বানাত। মঞ্জু কলেজ থেকে এনে দিত ইতিহাসের নানা বই—সুলতানেট অফ গজনি, জাহাঙ্গিরনামা, আকবরনামা, অলবিরুণীর হিন্দুস্তান ইত্যাদি।

একদিন ছেলের আয়া বিষ্ণু এসে বলল, সে আর আসবে না, কোম্পানি অনেক টাকা দিয়েছে, সে সিকিম চলে যাচ্ছে, এবার সিকিমেই বাস করবে। তার স্বামী থাকবে এখানে, সে সিকিমে জমি কিনে সিকিমেই বাস করবে। শুধু সে নয়, তার মতো অনেক নেপালিই কোম্পানির কাছ থেকে টাকা পেয়ে সিকিমে যাচ্ছে। কোন কোম্পানি টাকা দিচ্ছে, কেন নেপালি হিন্দুরা লেপচা বৌদ্ধদের দেশে যাচ্ছে, তা সেই ষাটের দশকে বুঝতে পারিনি, বুঝলাম দশ বছর পরে, যখন সিকিম হল ভারতেরই একটি রাজ্য এবং সিকিমের মহারাজা সস্ত্রীক পালালেন আমেরিকায়।

কিন্তু ততদিনে আমরা কলকাতায়। আমরা স্থির করেছিলাম দার্জিলিংয়েই স্থায়ীভাবে বাস করব। ‘তপোবন’ নামে একটা বাড়িও পছন্দ করা হয়। কার্ট রোডের উপরে, বাড়ির সবদিক থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, আমার মা ও মঞ্জুর ছোড়দা এসে পছন্দ করেন। বাঙালি মালিক, কলকাতায় ত্রিকোণ পার্কের কাছে থাকেন। মঞ্জুর ছোড়দাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় দরাদরি করার। তার মধ্যেই পুজোর পরে মুষল বৃষ্টিতে দারুণ ধস। আমি যতদূর জানি, দার্জিলিংয়ের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় ধস। দার্জিলিংয়ে ধস, ‘তপোবন’-এর কিছুটা ধসে যায়। জলপাইগুড়ি শহরের ইতিহাসেও একসঙ্গে সবচেয়ে বড় বন্যা। সেটা বোধ হয় ১৯৬৮-র অক্টোবরে।

আমরা কলকাতায় এসে ছোড়দার কাছে যোধপুর পার্কে বাস শুরু করলাম। যোধপুর পার্ক থেকে রিজেন্ট এস্টেটে। মায়ের রিটায়ারমেন্টের গ্র্যাচুয়িটির টাকা আর মঞ্জুর লোরেটোর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাতেই রিজেন্ট এস্টেটে চার কাঠা জমি কেনা হয়, সেখানেই মান্তুমামার তত্ত্বাবধানে আমাদের বাড়ি বানানো হয়। আবার নতুন জীবন। আমি পুরনো কাজ শুরু করলাম, মানে ফিল্মে এবং আনন্দবাজারে গল্প লেখা—অধিকাংশ গল্পের বিষয় তখনকার অশান্ত কলকাতার জীবন। বিশেষত, আমাদের পাড়াতে। মঞ্জু তার মধ্যেই লোরেটো কলেজ যেত-আসত খুবই ঝুঁকি নিয়ে। আমি দার্জিলিংয়ে ইতিহাস নিয়ে চর্চা শুরু করি, ভারতে ইসলাম আসার ইতিহাস ও তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি। প্রথমে অধ্যাপক ক্ষিতীন্দ্র ঘোষালের ‘আলেখ্য’-তে, পরে তার থেকেই লিখি ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’, সেই আমার মৌলবাদ সম্বন্ধে অন্বেষণের শুরু। সেই সূত্রে হয়তো নিমাইসাধন বসুর সুপারিশে আমার হুমবোল্ট ইউনিভার্সিটিতে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নিয়ে সেমিনারে অংশ নেওয়া। অন্য যাঁরা বক্তা ছিলেন যতদূর মনে পড়ে— সুনীল সেনগুপ্ত, পবিত্র সরকার, স্বপন মজুমদার এবং আরও কয়েকজন—সকলেই ডক্টরেট ভূষিত।

আমাকেও দেওয়া হল সাম্মানিক ডক্টরেট। সুনীলদা বললেন “এবার থেকে এটা ব্যবহার কোরো।” সেই সার্টিফিকেট আমি হারিয়ে ফেলি, পরে খুঁজে পাই ২০১৭ সালে হায়দরাবাদে আমার বড় ছেলের কাছে। আমার যাওয়ার খরচ দিয়েছিলেন রণেন আয়ন দত্তর স্ত্রী ম্যাডাম হিল্লোলা। দুঃখের বিষয়, আমার গ্যেটেতীর্থ হ্বাইমার যাওয়া হয়নি। হ্বাইমার না-যাওয়ার সান্ত্বনা খুঁজি বারবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে।

প্র: বিশ্বভারতী ছাড়লেও শান্তিনিকেতন ছাড়েননি?

উ: শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না, কিন্তু অন্নদাশঙ্কর ছিলেন। তিনি প্রথমে ছিলেন লালবাঁধের কাছে, তারপর মুকুল দে-র বাড়ি, তারপরে অবনপল্লিতে, শেষে সেবাপল্লিতে নিজের বাড়িতে। তারপর কলকাতার যোধপুর পার্কে, অবশেষে বালিগঞ্জের বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে। তাঁর এই ফ্ল্যাটেই আমার ছোট ছেলে অভিমন্যু ও ছোট বউমা চান্দ্রেয়ীর বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হয় ১৯৯৯-এ। সার্টিফিকেটে প্রথম সাক্ষীর জায়গায় স্বাক্ষর করেন অন্নদাশঙ্কর। এই ফ্ল্যাট এখন তাঁর ছোট ছেলে আনন্দরূপ রায় ও স্ত্রী এষার। এই ফ্ল্যাট থেকে তিনি পিজি হাসপাতালে যান, আমার কথায় আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেক্রেটারি তপন বন্দ্যোপাধ্যায় সব ব্যবস্থা করেন। দু’মেয়ের আপত্তি ছিল, অল্প সায় ছিল বড় মেয়ের, প্রবল আপত্তি ছিল ছোট মেয়ের, ছোট মেয়ে অবশ্য বেশি থাকত বম্বেতে। বড় ছেলে আগেই মারা গিয়েছিলেন, ছোট ছেলে আনন্দরূপ ও স্ত্রী এষা রায় আমেরিকাতে থাকলেও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে এবং এষা আবার মঞ্জুকে ভাল করে চিনত প্রেসিডেন্সি কলেজের সময় থেকে। আনন্দ ও এষা, মঞ্জুর প্রয়াণের পরে আমাদের রিজেন্ট এস্টেটে এসেছে, হায়দরাবাদেও এসেছে, বড় ছেলের ফ্ল্যাটে। বম্বেতে এসেছে, ছোট ছেলের ফ্ল্যাটে। মূল উৎস— অন্নদাশঙ্কর ও লীলা রায়। লীলামাসি খুব ভালবাসতেন আমার বড় ছেলেকে, যখন সে ছোট ছিল। মাসিমা অবশ্য আমার ছোট ছেলেকে দেখেননি। ছোট ছেলের জন্ম ১৯৭৭-এ, দু’জনের মধ্যে বারো বছরের তফাত। ১৯৬৫ আর ১৯৭৭।

প্র: ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে একটু বলুন... কলকাতা ছাড়লেন কেন?

উ: ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমার যোগাযোগ বহুদিন ছিল। আমি অ্যাসিস্ট করেছি ব্যাপটিস্টার সহযোগী বিজয় করকে, শ্যামা হাবিবুল্লাকে। দু’জনেই বম্বের ডিরেক্টর। পরে মকবুল ফিদা হুসেনকে। তাঁর রাজস্থানের ওপর ছবির জন্যে তিনি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পান। পরের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি হরিয়ানার ওপর। এই ছবির সহকারী ছিলাম আমি, পরে হিন্দুত্ববাদীর দাপটে তাঁর বহু কাজ ধ্বংস করা হয়, তিনি ভারত ছাড়তে বাধ্য হন। তবে, তাঁর স্মরণে কলকাতায় একটা উৎসব হয়, তাতে আমাকে ডাকা হয়। আমি তখন কলকাতার বারুইপুর অঞ্চলে একটা বৃদ্ধাবাসে পঙ্গু দশায়। আমার বদলে মঞ্জু যায়। তাকেও উত্তরীয় দিয়ে এবং হুসেনের একটা ছবির প্রিন্ট দিয়ে সম্মান জানানো হয়। তাঁর এক ছেলে মুস্তাফা মঞ্জুকে দুবাইয়ের ফোন নম্বর দেয়। কত স্মৃতি যে ধ্বংস হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই! ...

 -সাক্ষাৎকারে দেশ পত্রিকার পক্ষে চিন্ময় গুহ

 
 
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত