আলবেয়ার কামুর ' দ্যা প্লেগ' -- কিছু কথা

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২০, ১৬:৪৬

মুরশেদুল হাকিম শুভ্র
  ( এক)
আলবেয়ার কামু ( Albert Camus ) জন্মেছিলেন আলজেরিয়ায় ১৯১৩ সালে একতি নিম্নবিত্ত পরিবারে ।  ২৫ বছর বয়সে তিনি ফ্রান্সে আসেন  । তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় । জার্মান কতৃক ফ্রান্স দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন ।১৯৫৮ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পান । ১৯৬০ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যু বরন করেন ।
 
মূলত  যুদ্ধ, দখল, অবরোধ, আপস, কালবাজারী, ষড়যন্ত্র, মহামারি, মৃত্যু - এই সকলকে কেন্দ্র করে কামুর যে দার্শনিক উপলব্ধি তা থেকেই ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস, " দ্যা প্লেগ " ( La Peste)। 'The Greatest European Novel of the second half of the 20th century .'
 
১৯৪০ সাল ।আলজেরিয়ার উপকূলে ফ্রান্সের বন্দর শহর অরান ।  এখান থেকেই উপন্যাসের শুরু ।
 
 " অরানে শীত আর গ্রিস্ম দুটোই প্রচন্ড । প্রকৃতি অত্যান্ত নির্মম আর প্রতিকুল । রাত নামে হঠাত করে । সৌন্দর্য বলতে কিছুই নেই শহরে । গাছে লতা নেই ,পাতায় নেই মর্মর ।কবুতর চোখে পড়ে না । শোনা যায় না পাখীর ডানার ঝাপ্টানি । অন্যান্য শহরে যা হয় , এখানেও মানুষ কাজকর্ম করে ,প্রেম করে, মারা যায় ,এবং এসব তারা করে একই ঢঙে ।সবকিছুর মধ্যে তড়িঘড়ি আর নির্লিপ্ত ভাব । জীবন এখানে ভীষণ একঘেয়ে , অবসাদময় । সবাই শুধু অভ্যাস চর্চা করে । মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে কেবলমাত্র  বড়লোক হওয়ার জন্য । এখানে জীবনের প্রধান লক্ষ বানিজ্য । "
 
এপ্রিল মাসে ঘটনার শুরু । বসন্ত আসছে । গায়ে লাগছে মৃদু হাওয়া আর  ফুল বিক্রেতারা  ফুল নিয়ে আসছে শহরে। ডাক্তার রিও লক্ষ্য করলেন রহস্যজনক ভাবে ইদুর মরতে শুরু করেছে শহরে। একদিন দুদিন তারপর  সিঁড়িকোঠা , মাটির নীচ ,নর্দমা সব জায়গা থেকে সারিবদ্ধ ভাবে বেরিয়ে এসে মরে যাচ্ছে সব ইঁদুর।  শহরের সব ইদুর মরে যাওয়ায় আশ্বস্ত হোল সবাই । তারপর  অস্বাভাবিক জর আর কিছু উপসর্গ  নিয়ে দুই তিন দিনের মধ্যে মরে গেলেন ডাক্তার রিওর দারোয়ান মিশেল ।
 
ইঁদুর মারা যাওয়ার পর  আশ্বস্ত হয়েছিলেন শহরবাসী  । মিশেলের মৃত্যু সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলল ।
 
তারপর শহরে ইঁদুরের মত দলেদলে মরতে আরম্ভ করল মানুষ।  এর ভয়াবহতা  অতখানি কেউ বুঝতে পারল না। বুঝল ডাক্তাররা। ওরা বুঝতে পারল মহামারী শুরু হয়েছে। 
 
''জানালায় দাঁড়িয়ে  নীচে শহরেরে দিকে তাকিয়ে আছে ডাক্তার রিও । মনে করতে চেস্টা করছে প্লেগ নিয়ে কোথায় কি পড়েছে । ইতিহাসের পাতা  ঘেটে  দেখল আজ পর্যন্ত তিরিশটা বড় বড় প্লেগ এসেছে পৃথিবীতে । প্লেগে  কনস্টান্টিনোপলে একদিনে দশ হাজার লোক মারা গিয়েছিল।  সত্তুর বছর আগে ক্যান্টনে দেখা দিয়েছিল প্লেগ । মানুষের  মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আগে মরেছিল চল্লিশ হাজার  ইঁদুর । লাশে ভরে গিয়েছিল এথেন্স নগরী । ফ্রান্সের মারসাই শহরে  বিরাট গর্তে গলিত লাশ ছুড়ে ফেলেছিল কয়েদীরা ।ইতালীর  মীলান শহরে  ঘটেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম বিকৃত ঘটনা । একদিকে প্লেগের প্রকপে মানুষ আক্রান্ত , অন্যদিকে উদাসীন নরনারী কবরস্থানে মিলিত হয়েছে  সঙ্গমে । লন্ডনে  রাস্তায় রাস্তায় শোনা যেত শবদেহ বাহী যানের নিরন্তর শব্দের প্রতিধ্বনি । রাতের আধারে এথেন্সের সমুদ্র তীরে  আত্মীয়স্বজনের মরদেহ কাধে নিয়ে  কবর দিতে এসেছিল অগনিত মানুষ । তাদের হাতে ছিল মশাল । কবর দেয়ার শুকনো মাটি না পেয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করেছিল ওরা ।'' 
 
                                                              (দুই )
 
শহরে আলোচনা শুরু হোল  । কেউ বললেন  আরো কিছুদিন  লক্ষ্য করতে যে রোগটা  আসলে  প্লেগের মহামারি কিনা  তা যাচাই করতে । কেউ বললেন অপেক্ষা করলে শহরের অর্ধেক মানুষ মারা যাবে । 
 
সকলকে আতঙ্কিত না হয়ে , জীবাণুমুক্ত হয়ে  সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হোল । শহরের মুল দরজা বন্ধ করে দেয়া হোল।
 
মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পরস্পর থেকে । এমনকি চিঠি লেখাও বন্ধ হয়ে গেল , জীবানু ছড়িয়ে পরতে পারে সেই  ভয়ে ।  বন্দরে জাহাজ ভেড়া বন্ধ হয়ে গেলো , বন্ধ হোল দোকানপাট , ব্যাবসা বাণিজ্য ।  এইভাবে প্লেগ শহরবাসীকে ঠেলে দিল নির্বাসিত  এক সংকটময়  জীবনে ।
                                                               ( তিন)
 
এই সময় চার্চ  কতৃপক্ষ ঠিক করলেন  ধর্মের বানী নিয়ে প্লেগের বিরুদ্ধে  নামবেন তারা  । রোববার ফাদার প্যানালুর বানী শোনার জন্য অনেক মানুষ জড়ো হলেন । সেদিন সকাল থেকে আরম্ভ হোল প্রবল বর্ষণ । গির্জার  ভেতরটা ভরে উঠল ধুপের ম্রিদু সুবাসে । মঞ্চে দাড়ালেন ফাদার প্যানালু । উদার কন্ঠে বানী প্রচার করতে থাকলেন ...... "ভায়েরা  , এক কঠিন বিপদ নেমে এসেছে আপনাদের  ওপর । কিন্তু এই বিপর্যয় আপনাদেরই কৃত কর্মের  প্রতিফল । ইতিহাসে যখন এই বিপর্যয়ের আবির্ভাব হয় , তখন একে ব্যাবহার করা হয়েছিল আঘাত হানার অস্ত্র হিসেবে । ফেরাউন ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে  প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিল , তাই প্লেগের বিপর্যয় নেমে এসেছিল তার উপর । যেন সে ঈশ্বরের কাছে অনুনয় করতে বাধ্য হয় ।
 
আমাদের ভেবে দেখতে হবে  কেন আবির্ভাব হয়েছে প্লেগের ? যারা ন্যায় ও সত্যের পথে চলেন তাদের শঙ্কিত হবার কিছু নেই । যারা অন্যায় ও অবৈধ কাজে লিপ্ত তাদের রিদয় এখন কাঁপবেই ।  দীর্ঘদিন তিনি অপার করুনার দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন এই শহরের দিকে । কিন্তু কতদিন আর অপেক্ষা করতে পারেন ? তার যে চিরন্তন আশা তা আমারা দীর্ঘদিন পূরণ হতে দেইনি । তারই ফলে আজ তিনি ভয়ংকর  রেগে গেছেন ।  
 
 রাজা এম্বারটোর আমলে সারা ইতালী জুড়ে এক ভয়ঙ্কর প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে । লাশ  সৎকারের মত  যথেষ্ট লোক আর জীবিত ছিল না । এমন সময় সেখানে নেমে আসে দুজন স্বর্গীয় দূত । একজন সৎ অন্যজন অসৎ । সৎ প্রকৃতির দুত অসৎ প্রকৃতির দুতকে বিভিন্ন বাড়িতে আঘাত হানার আদেশ করত । আর অসৎ দুতের হাতে থাকত বর্শা । তাই দিয়ে  একটা বাড়িতে যতবার আঘাত করত সেই বাড়ী থেকে ততটা লাশ আপনি অদৃশ্য হয়ে যেত ।
 
ফাদার প্যানালুর শরীর কাঁপছে থরথর করে  । তিনি বলে চলেন ...আমরা বারবার বিশ্বাস করে এসেছি রবিবার গির্জায় যোগ দিলে সপ্তাহের বাকী দিন গুলোর জন্য আমরা মুক্ত । যতেচ্ছাভাবে চলাফেরা করতে  কোন বাধা নেই । কিন্তু স্রষ্টা এই ধরনের উপহাসের পাত্র নন । তিনি আরও ঘন ঘন দীর্ঘ সময় আমাদের কাছে পেতে চান ।"
 
                                                                          (চার)
 
এদিকে মানুষের  মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে ।  হাসপাতাল ভরে উঠল রোগীতে ।  ডাক্তার রিও এবং আরো কয়েকজন  ডাক্তার মিলে দিনরাত মহামারির চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও প্রতিষেধকের জন্য কাজ করছেন । তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন  নিবেদীতপ্রান কয়েকজন শহরবাসী । তাদের মধ্যে আছেন  সুন্দর মনের  বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী কিছু সাংবাদিক , লেখক  ও  সাধারন মানুষ ।  তারপর অনেক মৃত্যুর পর  অক্টোবরের শেষে তৈরী হোল প্লেগের প্রতিষেধক । কমে আসতে শুরু করল মৃতের সংখ্যা ।
                                                                      
জানুয়ারি থেকে বইতে শুরু হোল ঠাণ্ডা হাওয়া ।  ঝিমিয়ে পড়ল প্লেগের স্বৈরশাসন । কাজ করতে শুরু করেছে প্রতিষেধক । কতৃপক্ষ ঘোষণা করল  'প্লেগ  এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে' ।
 
২৫শে জানুয়ারির রাত পরিনত হল উৎসবের রাতে । আলোকিত শহরের রাস্তায় নেমে আসল উৎসব মুখর উৎফুল্ল মানুষ ।
 
                                                                  (পাঁচ)
 
এখন আসা যাক মূল  প্রসঙ্গে ।  কামু কি  বলতে চেয়েছেন এই উপন্যাসে ? কামু কি শুধু ওরান শহরের প্লেগ নিয়েই কাহিনী করেছেন ? প্লেগের রুপক ব্যাবহার করে তিনি কি বলতে চেয়েছেন  জার্মানির  নাৎসি  বাহিনীর ফ্রান্স অবরোধের কথা  ?
 
শুধু তাই না ।  কামুর দার্শনিক ভাবনা এই যে , আমাদের অজান্তেই  যুগে যুগে আমরা  প্লেগ বা প্লেগের মত কিছুর সাথে বাস করছি । 'plague or no plague ,there is, as it were always , 'The plague" /যা নিয়ত আমাদের সুখ বা সুখের জীবনকে বিপন্ন করতে পারে যেকোন সময় ।  প্লেগের মতই অন্য কোন জীবাণু বা দুর্ঘটনা, বা যুদ্ধ যা আমাদের জীবনকে সংকটাপন্ন করতে পারে। আমরা  আসলে প্লেগের সাথেই , প্লেগের ভেতর দিয়েই  যাচ্ছি  ।আমাদের  জীবন  বা  জীবনের প্রবাহমান ধারা , জীবনের আনন্দ  স্থির বা স্থায়ী  বা স্থিতিশীল  মোটেও নয়।  "we are vulnarable to being randomly exterminated by a Bacillus , an accident  or the actions of our fellow human like war ." । যেমন  বর্তমান সময়ে  ভয়াবহ  করনা ভাইরাস Covid 19 মহামারী , পরিবেশ  বিপর্যয় , দুর্ভিক্ষ , যুদ্ধ ।
 
কামুর কাছে এই সকল মৃত্যু  মহামারি প্রাকৃতিক  ।  অযৌক্তিক ,অর্থহীন  এই দুর্যোগ দুর্ভোগ মৃত্যু ।   " Absurd "  ।   তার মানে কি জড়তা, হতাশা ?  মহা পৃথিবীর অলৌকিক শক্তির "    কাছে  আত্মসমর্পণ করা ? কামুর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এই যে, মানুষ যুগেযুগে  যেভাবে তার  মানবতাবোধ , সচেতনতা ,দায়িত্ত, প্রেম ভালবাসা , শালীনতা , সৌন্দর্যবোধ , 'Decency' নিয়ে  যেকোন দুর্যোগ, মহামারী  মোকাবেলা করেছে ,আগামীতেও সে  একই ভাবে  তাই করবে । সেই সকল সাধারন মানুষ যারা মানবতার পাশে দাঁড়াবে তারাই হবে অসাধারন। তারাই ডাক্তার  রিও এবং সাধারন কিছু মানুষ  যারা দিনরাত  জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহামারী আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে  অতীতের মত। দাঁড়াবে  বর্তমানে  এবং আগামীতেও।
 
 
মুরশেদুল হাকিম শুভ্র 
স্কারবোরো ।টরন্টো । [email protected] 
 
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত