সজিব তুষার

বৈশাখের প্রস্তুতি: চারুকলায় ত্রিমাত্রিক ভাষ্কর্য

প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৫৩

পুরোদমে চলছে চারুকলার বাংলা নববর্ষ বরণে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। ছবি: এফসি বাঁধন

দুদিন বাদেই বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। নতুন বাংলা বছরকে স্বাগত জানাতে ১৪২৯ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে উল্লাসে মাতোয়ারা হবে সারা দেশ। তবে, মুসলিমদের পবিত্র রমজানের জন্য এবছর থাকছে না রমনার পান্তা ইলিশের ভোজ। শুকনা মরিচের ঝাঁজে সকালটা শুরু করতে না পারলেও অনেকেই বলছেন ইফতার ও সেহরীতে মেটাবেন সে আফসোস।

চারুকলার একটি কক্ষে চড়কি, হাতপাখা বানানো ও রঙ করার কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: এফসি বাঁধন

নতুন বছরকে বরণ করতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন করে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। করোনার কারণে বিগত দুই বছরের তৃপ্তির সঙ্গে প্রাণের বৈশাখ উদযাপন করতে পারেনি কেউ। এবছর সে ঘাটতি পূরণ করে সার্বজনীন বাঙালিয়ানাকে তুলে ধরতে চান চারুকলার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।

মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুতকৃত মুখোশের রঙ শুকাতে রাখা ছড়িয়ে রেখেছেন শিক্ষার্থী। ছবি: এফসি বাঁধন

প্রস্তুতিকালীন সময়ে ঢাবির চারুকলা অনুষদে ঢুঁ দিলে দেখা যায়, মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতির মহাসমারোহে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা। মেইন গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় জয়নুল গ্যালারির মুখে ছবি আঁকছেন একদল শিক্ষার্থী। জলরঙ ও প্যাস্টেল সহ নানান সরঞ্জামাদি নিয়ে বিভিন্ন রকমের ছবি আঁকছেন তারা। পাশেই শিল্পী নাফিউজ্জামান নাফি আঁকছেন সাপ নিয়ে মেটাফোরিক কিছু একটা চিত্র। আরেক দল শিক্ষার্থী ব্যস্ত হয়ে লেগে আছেন সরাচিত্রে।

চারুকলায় চলছে বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। সে অনুযায়ী শিল্পাচার্য্য জয়নুল ভবনের গ্যালারিতে চলছে জোড়ে সোড়ে ছবি আঁকার কাজ। ছবি: এফসি বাঁধন

ছবির ডান দিকে আছেন সুমিত রায়। চারুকলা অনুষদের ভাষ্কর্য বিভাগ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। চারুকলার সহপাঠীদের সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে কাজ করছেন প্রথমবারের মত। ছবি: এফসি বাঁধন

প্রথমবারের মত চারুকলার বৈশাখী আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সুমিত রায়। চারুকলা অনুষদের  ভাষ্কর্য বিভাগ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট বেলা থেকে বৈশাখী শোভাযাত্রার জন্য পেঁচা-বাঘের মুখোশ, বড়ো বড়ো স্ট্রাকচার বানানো দেখেছেন টিভি পর্দাতেই। সরাসরি এই প্রথমবারের মত নিজের ক্যাম্পাসে কাজ করা তার জন্য ‘অসাধারণ অনুভূতি’।

চারুকলার মাঠে পাখির অরিগামী, টেপা পুতুলের ঘোরা, মাছপাখি ইত্যাদির ভাষ্কর্য্য তৈরি করতে কাঠামোর কাজে ব্যস্ত একদল শিক্ষার্থী। ছবি: এফসি বাঁধন

সুমিত বলেন, "ত্রিমাত্রিক কিছু স্কাল্পচার তৈরি করছি আমরা। যার প্রতিটা বিষয়ই ফুটিয়ে তোলে বাঙালির হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে। এবারের শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে আছে টেপা পুতুল, পোড়ামাটির ঘোড়া, মাছপাখি, পায়রা। সবকিছু মিলিয়ে বাঙলাকে উদযাপন করা বাঙালিইয়ানাকে উদযাপন করা"।

চারুকলার মাঠে মাছপাখির ভাষ্কর্য্য তৈরি করতে কাঠামোর কাজে ব্যস্ত একজন শিক্ষার্থী। ছবি: এফসি বাঁধন

সুমিত জানান, এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নির্মল কর, মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে’। বিগত দুই বছরে করোনার মহামারী কালীন অসুস্থ সময় পাড় করে শান্তির বারতাকে আহবান জানানোই মূলত এবারের মূল বিষয়।

চারুকলার ভেতরের একটি দেওয়ালে ছবি আঁকছেন একজন শিক্ষার্থী। ছবি: এফসি বাঁধন

দোকানে হালখাতার গন্ধ না থাকলেও পান্তা ইলিশ আর রঙ বাহারী পোশাকেই নিজেদের পহেলা বৈশাখ পালন করবেন বাঙালিরা, দেশে ও প্রবাসে। শিশুদের লাল সাদা ফতুয়ার সঙ্গে গালে গালে ভরে উঠবে ‘এসো হে বৈশাখ’ কিম্বা ‘মেলায় যাইরে’সহ নানান গানের কলি। তরুণ-তরুণীরা ঘুরতে বের হবে বাঙালিয়ানা সাজে। শহরগুলোর প্রশস্ত সড়ক ও শিল্পকলার প্রাঙ্গণে থাকবে শিল্পীদের তুলির ছোঁয়ায় হরেক রকমের আলপনা। সবকিছু বাদ দিলেও জেগে ওঠা সূর্যের রশ্মি ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রার ঢাকের নেশাতুর শব্দ, বর্ণিল মুখোশ আর নানান কারুকার্যখচিত আসবাবের ঝলমলে বহরই যেন বৈশাখের প্রাণ।

শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকার জন্য প্রস্তুতকৃত রঙের কৌটা। ছবি: এফসি বাঁধন

ইতিমধ্যে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য গঠিত হয়েছে আয়োজন কমিটি। মঙ্গল শোভাযাত্রা মহাকর্মযজ্ঞের দায়িত্বে এবার রয়েছেন চারুকলার ২২ ও ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছরের মধ্যে একবার সীমিত পরিসরে হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। আরেকবার অনুষ্ঠিতই হয়নি। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় রাজধানীবাসী রাজপথে নামতে পারবে, অংশ নিবে শোভাযাত্রায়।

চারুকলার ভেতরের একটি দেওয়ালে ছবি আঁকছেন একজন শিক্ষার্থী। ছবি: এফসি বাঁধন

এবার মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে শুরু না হয়ে টিএসসির সামনে থেকে সকাল নয়টায় শুরু হবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

চারুকলার একটি কক্ষে চড়কি, হাতপাখা বানানো ও রঙ করার কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: এফসি বাঁধন

মেট্রোরেলের কাজ চলার কারণে  সংকুচিত হয়ে আছে চারুকলার সামনের রাস্তাটি। তাই টিএসসি থেকে শুরু হয়ে উপাচার্যের বাসভবন মোড়টা ঘুরবে শোভাযাত্রাটি। পহেলা বৈশাখে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মুখোশ পরা যাবে না। এমনকি নিষেধাজ্ঞা আছে ব্যাগ বহনেও। তবে, চারুকলা অনুষদের প্রস্তুত করা মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিরত থাকতে বলা হয়েছে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা থেকে।

মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুতকৃত চারুকলার শিক্ষার্থীদের তৈরি করা মুখোশ। ছবি: এফসি বাঁধন

সাধারণত বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের তৈরি করা পণ্য বিক্রয়ের অর্থ দিয়েই চলে চারুকলার উৎসবের আয়োজন। আয়োজক কমিটি জানান, বিগত করোনার ধাক্কায় বিকিকিনিও কমে গেছে অনুষদের। আর্থিক সংকট ও টানাপোড়েন নিয়েই চলছে এবারের আয়োজন। তবে এ টানাপোড়েন আয়োজনে নূন্যতম বিঘ্ন ঘটাবে না বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্ট সকলেই।

শিল্পাচার্য্য জয়নুল গ্যালারির একটি কক্ষে মাউন বোর্ডে মাটির অবয়ব তৈরি করছেন একজন শিক্ষার্থী। ছবি: এফসি বাঁধন

জয়নুল গ্যালারির ডান দিকে প্রথম কক্ষেই চলছে মুখোশ বানানোর কাজ। বাঘ সিংহ হাতি  পেঁচাসহ নানা কিছুর লোকজ মিজাজের মুখোশে- রং নিয়েই ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা। চারুকলার জয়নুল স্কুল ঘরে বেশ ক'জন শিক্ষার্থী মাউনবোর্ড দিয়ে বানাচ্ছেন বিভিন্ন অবয়ব। একইসঙ্গে চলছে এসবে রং লাগানোর কাজ। হাতপাখা, চড়কি বানানো এবং রঙিন করায় মনোযোগ আরেকদল শিক্ষার্থী।

মাউন বোর্ডের উপর চলছে কাগজের ফুল লাগানোর কাজ। ছবি: এফসি বাঁধন

জয়নুল গ্যালারীর পেছন দিকের মাঠে চোখ গেলেই দেখা যাচ্ছে বাঁশ দিয়ে বানানো কাঠামোতে চলছে কাগজ মোড়ার কাজ। মিস্ত্রি ও শিক্ষার্থীরা মিলে দাঁড় করেছেন স্ট্রাকচারগুলো।

চারুকলার মাঠে টেপা পুতুলের ঘোড়ার ভাষ্কর্য্য তৈরি করতে একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কাঠামোর কাজে ব্যস্ত একজন মিস্ত্রি। ছবি: এফসি বাঁধন

নির্ভর‍যোগ্য সূত্রে জানা যায়, নিজেদের মধ্যে চারটি অংশে ভাগ করে কাজ করছে শিক্ষার্থীরা। স্ট্রাকচার, পাখির অরিগামি, মুখোশ এবং সরাচিত্র ও পেন্টিং। মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবার পাঁচটি বড় মোটিভ থাকবে। এসবের মধ্যে রয়েছে ঘোড়া, পাখি ও টেপা পুতুল। এছাড়াও তাঁরা তৈরি করছেন হাতপাখা, চড়কিসহ আরও কিছু বৈশাখী অনুষঙ্গ।

চারুকলার মাঠে ভাষ্কর্য্য তৈরির কাজ পরিদর্শন করছেন একদল শিক্ষার্থী। ছবি: এফসি বাঁধন

বৈশাখ আয়োজন কমিটির আহবায়ক নুর মুনজেরীন রিমঝিম; চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে পড়াশোনা করছেন। তিনি বলেন, "'২০ সালে করোনার জন্য বন্ধই ছিলো। '২১ এ হয়েছে প্রতীকী রূপে। আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রাটা চারুকলার বাইরে যায় নি"।

শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি প্রদর্শনের জন্য প্রতুত করা হচ্ছে শিল্পাচার্য্য জয়নুল ভবনের গ্যালারী। ছবি: এফসি বাঁধন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বৈশাখের আলোচনা সমালোচনা ভাবাচ্ছে রিমঝিমকে। বাঙালির ঐতিহ্যই পহেলা বৈশাখ। ইউনেস্কোও এই স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বলেন, “ধর্মের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। ধর্ম এক জায়গায় সংস্কৃতি এক জায়গায়।"

বাঙালি ঐতিহ্য বলতে এই পয়েলা বৈশাখ এই লোকজ সংস্কৃতিগুলোই আছে। সেগুলোই তুলে ধরতে হবে। না হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমরা হারিয়েই যাবো, বলেন রিমঝিম।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত