কবি কাজী নজরুলের জন্মজয়ন্তী আজ

সত্য প্রকাশে সাহসের অপর নাম কবি কাজী নজরুল ইসলাম

প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৩, ০৯:৫৯

এস এম মুকুল
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক অভয়চিত্তের নাম। দুর্বার প্রতিবাদের আলোর মশাল জ্বেলেছেন তিনি তাঁর লেখনিতে।

আজ ২৫ মে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম  জন্মবার্ষিকী। কবি নজরুল সুখ্যাতি পান দ্রোহ-বিদ্রোহ, প্রেম-প্রণয়ের কবি হিসেবে। তাঁর কবিতা ছিলো সত্য প্রকাশে সাহসের অপর নাম।

নিপীড়িত মানুষের অধিকারের পক্ষে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মানুষের জয়গান গেয়ে আমাদের হৃদয়ের অন্ত স্থলে ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি। কবি কাজী নজরুলের লেখা আবশ্যিক গবেষণা পাঠ্য বিষয়ে হয়ে উঠেছে কালক্রমে। কবি কতনা সহসা সাহসে দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন-

‘আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,

আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের

আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,

চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!

আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,

আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন।

...

মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

 

এভাবেই বিদ্রোহী কবিতায় অসংকোচে সত্য প্রকাশের সাহস দেখিয়েছেন আমাদের বিদ্রোহী কবি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে অবলীলায় বর্ণনা করেন বিদ্রোহী হিসেবে। এই বিদ্রোহ মানে প্রতিবাদের সাহসী কন্ঠস্বর।

নজরুলের রচনায় ধ্বনিত হয়েছে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বার্তা। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ভুমিকায় ছিলেন ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে।

অসচ্ছল এক মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন অন্যন্য এক বিদ্রোহী কবি। তিনি আমাদের জাতীয় কবি- কাজী নজরুল ইসলাম। দুঃখ-দুদর্শা, অভাব-ক্লিস্টতা দমাতে পারেনি তাঁকে। দ্রোহের আগুনের মতো অভাবের আগুনে পুড়ে মহা বিদ্রোহীর খেতাব নিয়েছেন আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামের দুখু মিয়া। সেই দুখু মিয়াই আমাদের কবি নজরুল ইসলাম।

কবি পিতা ফকির আহমেদের তিন ছেলে আর এক মেয়ে। প্রথম সন্তানের জন্মের পরপর চারটি সন্তানের মৃত্যু হয়। এরপর ১৮৯৯ সালের ২৫ মে এই দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন দুখু মিয়া। তাঁর মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। দুখু মিয়ার জীবনের সাথে দুঃখ যেন পরম সাথী। হোটেলে কাজ করে পড়ার খরচ চালাতেন তিনি। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ধর্মীয়। এক পর্যায়ে তিনি স্থানীয় মসজিদে মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথেও কাজ করতেন।

তিনি অভয় চিত্তে মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন। কেবল কবিতা নয় পাশাপাশি বাংলা গানের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনিই প্রথম বাংলা গজলের প্রবর্তন করেন।  উত্তর ভারতীয় রাগসংগীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন।

ইংরেজি বর্ষের ২৫ মে পালিত হয় নজরুলের জন্মদিন। আর বাংলায় ১১ জ্যৈষ্ঠ। বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনাবিহীন। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি।

সে সময় বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে জাতীয় লেখক হওয়ার চিন্তা বিলাসিতা, তখন ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নামটি হাজারো তরুণকে লেখক হওয়ার সাহস জুগিয়েছিল। এখনো তাঁর লেখা আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়।

তাঁর জীবনটা খুবই বৈচিত্রময়। নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তিনি যেন হয়ে উঠেছেন গণমানুষের কবি। যৌবনে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। এসব নিয়মের ছকে বাধা জীবন-যাপন তাঁকে আকর্ষন করতে পারেনি। তাই তিনি চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন সাংবাদিকতায়। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ দিয়েছেন। এসময় বিদ্রোহী এবং ভাঙ্গার গান কবিতা লিখে কবি জেলও খেটেছেন।

কবি হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি থাকলেও ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন মজার মজার ছড়া। খুকি ও কাঠবিড়ালী, লিচুচোর, পিলে-পটকা’র মতো মজার মজার ছড়া খুব কম সংখ্যক কবিরাই লিখতে পেরেছেন। ছড়া কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন গান ও ইসলামী সঙ্গীত বা গজল। অসম্ভব সুরেলা কবি নজরুলের গজল। তিনি অভিনয়ও করেছেন। গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, সৈনিক, রাজনীতিবিদ এমনকি দার্শনিক হিসেবেও বিস্ময়কর বহুমুখি প্রতিভার স্মাক্ষর রেখেছেন তিনি।

অভাব, দুঃখ, বঞ্চনা, ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত নজরুলের কবি সত্তায় বারবার উঠে এসেছে অন্যায়ের প্রতিবাদ, বৈষম্য, দুঃশাসন আর শোষনের প্রতিবাদ। তাঁর লেখায় বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশের কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবির খেতাব দেয়া হয়েছে। খেয়ালী এই কবি সৈনিকের পোষাক পরে বিভিন্ন সভায় এসে হাজির হতেন। বড়ই বৈচিত্রময় তাঁর জীবন। কৈশোরে তিনি লেটোর দলে গান গেয়েছেন। যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন। যুদ্ধ করেছেন। মানুষ ও মনুষত্ববোধকে তিনি জাগরিত করেছেন। কিশোর নজরুল এসেছিলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে। সেখানে দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সপ্তম শ্রেণীর পাঠ শেষ করে আবারও বর্ধমানে চলে যান। তিনি বিয়ে করেছেন কুমিল্লায়।

আজো নজরুলের কবিতা ও গান তরুণদের হৃদয়ে জাগরণের সৃষ্টি করে। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম...’, ‘কারার ঐ লোহ কপাট’- এমনসব গানের কথায় রক্তে শিহরণ জাগে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এসব গান ও কবিতা বিশেষ ভুমিকা রেখেছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। এসময় তাঁকে জাতীয় কবি’র সম্মানে ভুষিত করা হয়। তাঁর রচিত চল্ চল্ চল্...উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল কবিতাকে বাংলাদেশের জাতীয় রণসঙ্গীতের মর্যাদা দেয় হয়।  আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। কিন্তু কেন রণ সঙ্গীত নয়? আমাদের জাতীয় কবির রচিত রণ সঙ্গীতে আছে ধমনী উন্মাদনা সুরের লহর। আছে চেতনার স্ফুলিঙ্গ। সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রণ সঙ্গীত গাওয়াকে বাধ্যতামূলক করা হোক। কেননা আমাদের জাতীয় কবি আমাদের সম্পদ এবং প্রেরণার শক্তি।

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে। এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন (আযান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারাত্মকভাবে স্নায়বিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে আকস্মিকভাবে তার সকল সক্রিয়তার অবসান হয়। ফলে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু অবধি সুদীর্ঘ ৩৪ বছর তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। ১৯৭৬ সালে ২৯ আগস্ট বিস্ময়কর প্রতিভাধর এই কবি বাংলাদেশে মৃত্যুবরণ করেন।

নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, "মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই":- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত