জর্ডানে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক কর্মী: সম্ভাবনার নতুন দ্বার

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:০২

রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) সেক্টরে বাংলাদেশের নাম আজ সারা পৃথিবীতে উচ্চারিত হয় নির্ভরতার প্রতীক হিসাবে। অসংখ্য চ্যালেঞ্জ, বাঁধা বিপত্তির পর ও বাংলাদেশ সগৌরবে মাথা উঁচু করে রাজত্ব করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অন্যতম পিলার এই খাত। ২০২১-২২ অর্থ বছরে শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্প থেকে ৪২.৬১৩ বিলিয়ন যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮১. ৮১ ভাগ। বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ২য়। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও তৈরি পোশাক শিল্প সাড়ে ২২ লাখ নারী সহ ৪০ লাখের বেশি শ্রমিকের জীবনযাত্রার লক্ষণীয় পরিবর্তন এনেছে যারা অর্থনীতিতে অবদান রাখছে প্রতিনিয়ত। শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করে রপ্তানিতে ভূমিকা পালন ই নয় , বরং দীর্ঘ ৪ দশক ধরে জড়িত এই শিল্পে কর্মরতরা এখন অবদান রাখতে পারেন ভিন্ন ভাবে।

রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) সেক্টরে উন্নতি করার সাথে সাথে এখন সময় হয় এই শিল্পের সাথে জড়িত কর্মীদের নিয়ে ভাবার। কারন এই শিল্প তখন ই বৃদ্ধি পাবে যখন এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের জীবনযাত্রা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন অটোমেটিক ফ্যাক্টরি স্থাপন করছে, যেখানে ভিন্ন আঙ্গিকে আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গার্মেন্টস কর্মীদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে , এইসব দেশগুলোর মধ্যে জর্ডান অন্যতম।

রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) সেক্টর বাংলাদেশী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে কাঙ্খিত শিল্প গুলির মধ্যে একটি। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মতে, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১,৯৮,১৪৮ জন বাংলাদেশী কর্মী জর্ডানে পাড়ি জমিয়েছেন, যার মধ্যে ১৩,৬৪৩ জন কর্মী শুধুমাত্র ২০২১ সালে মাইগ্রেট করেছেন। জর্ডান একটি মধ্যম আয়ের দেশ (মাথাপিছু আয় $৪,২৮২) হওয়া সত্ত্বেও, জর্ডান বাংলাদেশী আরএমজি কর্মী, বিশেষ করে মহিলাদের ভালো বেতন এবং সুযোগসুবিধা দিয়ে থাকে। জর্ডানের আরএমজি সেক্টর প্রতি বছর তাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ২০১৯ সালে, জর্ডানের মোট রপ্তানির ২৭.৫% আরএমজি সেক্টর থেকে এসেছিল , যা দেশের মোট জিডিপির ৮.১%। ১৭৬টি কারখানা থেকে মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল $১.৬৬ বিলিয়ন ডলার। ILOর মতে , জর্ডানে তাদের নিজস্ব আরএমজি কর্মী রয়েছে ৭৬,০০০ যা মোট কর্মীর মাত্র ৩০%। বর্তমানে, দেশে ৩,৫০,০০ নিবন্ধিত নন-জর্দানিয়ান কর্মী রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই মিশর, সিরিয়া এবং বাংলাদেশের। নিবন্ধিত নন-জর্দানিয়ান কর্মীদের মধ্যে ৫৭% হচ্ছে বাংলাদেশী শ্রমিক। দেশ ও বিদেশের কর্মীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরির মাধ্যমে জর্ডান ২০৩৩ সালের মধ্যে তাদের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা তিনগুণ বৃদ্ধি করেছে । এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য পরবর্তী ১০ বছরে জর্ডানের প্রয়োজন পড়বে আরও তিন লক্ষের ও অধিক পোশাক অধিক বাংলাদেশের অভিজ্ঞ গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য জর্ডানে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। 

জর্ডানে গার্মেন্টস কর্মীদের বর্তমান অবস্থা, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে গত অক্টোবর মাসে, প্রবাসী সেবার উদ্যোগে একটি সরেজমিন গবেষণা করা হয়। জর্ডানে বিভিন্ন ফ্যাক্টরির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা , মালিক বৃন্দ, কর্মী নিযুক্তকরন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে একটি প্রাথমিক আলোচনা করা হয়। এই গবেষণার মূল বিষয় ছিল কোন কোন খাতে বাংলাদেশী কর্মীরা দক্ষতা অর্জন করলে জর্ডানে তৈরি পোশাক শিল্পে আরও অধিক পরিমানে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। সঠিক দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশী কর্মীরা তৈরি পোশাক খাতে নিজেদের কর্মদক্ষতা দেখাতে পারে তাহলে আগামী দশ বছরে উন্মুক্ত হতে পারে এক বিশাল দক্ষ শ্রমবাজার যার ফলশ্রুতিতে অষ্টম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনাতে যে রেমিটেন্স লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার অনেকাংশ পূরণ করা সম্ভব তৈরি পোশাক শিল্প খাতের শ্রমিকদের রেমিটেন্সের মাধ্যমে। বাংলাদেশী এবং সারা বিশ্বে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে একটি দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি, যোগাযোগ পরিচালনা এবং প্রবাস সম্পর্কিত বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য প্রথম অনলাইন প্লাটফর্ম হলো “প্রবাসী”। 

অ্যাপটির মাধ্যমে বাংলাদেশের দক্ষ প্রবাসীরা তাদের দীর্ঘকালীন বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যমান কাজের সুযোগ ও বিদেশে উন্নত পড়াশোনার জন্য যাবতীয় তথ্য শেয়ার করতে পারবেন। বিদেশ গমন ইচ্ছুক এবং প্রবাসীদের নির্ভুল তথ্য সেবা প্রদানের মাধ্যমে একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘প্রবাসী’র নিরলস যাত্রা অব্যাহত। মাধ্যমটি বাংলাদেশী প্রবাসীদের এবং বাংলাদেশীদের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একটি বিরাট প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিদেশের মাটিতেও একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী বাংলাদেশী কমিউনিটি তৈরিতে এবং বিদেশে বেড়ে উঠা প্রজন্মকে দেশের সাথে সংযুক্ত করে দেশ গঠনে তাদেরকে সম্পৃক্ত করতেও প্রবাসী সেবা কাজ করে যাচ্ছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ২০০০ সালে স্বাক্ষরিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ফলে ২০০১ সালে জর্ডানের আরএমজি সেক্টর যাত্রা শুরু করে। মাত্র ৩ বছরের মধ্যে, এই সেক্টরে ১০,০০০ কর্মী ছিল, যাদের একটি বড় অংশ ছিল এশিয়া থেকে অভিবাসী। RMG শ্রমিকদের মজুরি ১১০ দিনার ছিল যদিও অন্যান্য শিল্পের আইনগত ন্যূনতম মজুরি ২০০৯ সালে ১৫০ জর্ডানিয়ান দিনারে উন্নীত করা হয়েছিল,। ২০১২ সালে, RMG কর্মীদের ন্যূনতম আইনি মজুরি ১৯০ জর্ডানিয়ান দিনারে পরিবর্তন করা হয়েছিল কিন্তু এটি অভিবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। বর্তমানে, স্থানীয় এবং অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম আইনি মজুরি হল যথাক্রমে ২৬০ জর্দানিয়ান দিনার ($ ৩৬৬.৫৬ ডিসেম্বর ২০২২) এবং ২৪৫ জর্দানিয়ান দিনার (২০২২ সালের ডিসেম্বরে ~ $ ৩৪৫.৪২)।

জর্ডানের বর্তমান কর্মশক্তির ৭৫% দক্ষিণ এশীয় শ্রমিক। তাদের মধ্যে ৪৫% বাংলাদেশী মহিলা কর্মী, বাকিরা ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মায়ানমারের। জর্ডানে, আরএমজি সেক্টরে একটি বিধান রয়েছে যা তাদের ৭৫% পর্যন্ত বিদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেয়। এ বিধনটি দক্ষিণ এশিয়া থেকে কর্মী নিয়োগের একটি বড় কারণ। এই শ্রমিকদের সাধারণত তিন বছরের কর্মসংস্থান চুক্তির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়, যার শেষে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। নিয়োগকর্তা বার্ষিক ভিত্তিতে এই চুক্তি গুলি বাড়ানোর অধিকার রাখেন।

স্থানীয় এবং অভিবাসী শ্রমিক উভয়ের জন্যই মৌলিক মজুরি একই কিন্তু অভিবাসী শ্রমিকরা ওভারটাইমের জন্য ঝুঁকে পড়ে, যা তাদের মজুরি বাড়িতে যা উপার্জন করতেন তার চেয়ে বেশি করে তোলে। জর্ডানে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য আদর্শ কাজের ঘন্টা সপ্তাহে ৬০-৭২ ঘন্টা, দৈনিক ওভারটাইম ৩-৪ ঘন্টা সহ। ওভারটাইমের মজুরি নির্দিষ্ট মজুরির তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে থাকে। অধিকন্তু, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা এবং উপস্থিতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সংযুক্ত করে অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রদান করা হয়। কিছু কারখানায়, শ্রমিকরা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ( ILO, ২০২২) পূরণ করতে ব্যর্থ হলে এক ঘন্টা পর্যন্ত মজুরি কমানোর বিধান রয়েছে। জর্ডান কঠোরভাবে তাদের শ্রমিকদের সুবিধার সাথে সম্পর্কিত শিল্প বিধিগুলি মেনে চলে, এটি একটি প্রধান কারণ যা বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে শ্রমিকদের আকর্ষণ করে৷ সুবিধার মধ্যে রয়েছে বাসস্থান, বিমান ভাড়া এবং স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা। সৌদি আরবের মতো অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির তুলনায় , জর্ডান মহিলাদের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ এবং অনুকূল পরিবেশ প্রদান করে। এটি জর্ডানকে বাংলাদেশী নারী অভিবাসী আরএমজি কর্মীদের জন্য সবচেয়ে কাঙ্খিত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে। RMG কর্মীদের প্রায় ৭৫% মহিলা এবং গড়ে ৫১% সুপারভাইজার মহিলা। অধিকন্তু, এই বিষয়ে কঠোর আইনের পাশাপাশি কর্মীদের যৌন হয়রানি এবং অভিযোগের পদ্ধতি সম্পর্কে প্রাক-কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশ ২০১০ সাল থেকে জর্ডানে দক্ষ আরএমজি কর্মী পাঠাচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অনুসারে, ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত, মোট ১৭৫,৯৩০ জন মহিলা কর্মী বাংলাদেশ থেকে জর্ডানে চলে গেছে। ২০১৭ সালে জর্ডানে অভিবাসী নারী আরএমজি কর্মীদের সংখ্যা ছিল ২০৪৪৯, ২০১৮ সালে ৯৭২৪ জন, ২০১৯ সালে ২০৩৪৭ জন, ২০২০ সালে ৩৭৬৯ জন এবং ২০২১ সালে ১৩৮১৬ জন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে জর্ডান থেকে প্রতি বছর গড়ে ১৭০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠানো হয়। যা প্রাপ্ত মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ১.৪৫%। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক এবং তাদের বেতন-ভাতা অনুপাতে এই রেমিট্যান্স তুলনামূলকভাবে অনেক কম। দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ এবং সঠিক মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে এই রেমিট্যান্স বর্তমানের তুলনায় অনেক গুন বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয় পরবর্তী সময় প্রয়োজনীয় দক্ষ শ্রমিক সঠিকভাবে প্রেরণ করতে পারলে জর্ডান সরকারের ২০৩৩ সালের লক্ষ্য মাত্রা অনুযায়ী যে শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে তাতে বাংলাদেশী শ্রমিকরা একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। প্রয়োজনীয় তিন লক্ষের ও অধিক তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মাঝে কমপক্ষে দেড় লক্ষ্ বাংলাদেশী শ্রমিক নিজেদের দক্ষতার প্রমান রাখতে পারে তাহলে কিন্তু ২০৩৩ সালের মধ্যে এই রেমিট্যান্সের পরিমান প্রায় $৮৫০ মিলিয়নের কাছাকাছি করা সম্ভব।

২০২০ সালে, জর্ডান বাংলাদেশ থেকে ১২,০০০ আরএমজি কর্মী নিয়োগের তাদের অভিপ্রায় ঘোষণা করেছিল এবং বাংলাদেশ ও তার প্রেক্ষিতে সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিল কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই সংখ্যাটি অনেক কম। আমরা যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে এবং দক্ষ শ্রমিক গঠন করে একই সাথে জর্ডানের নিয়োগ কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বৃদ্ধি করে আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতার কথা তাদের কাছে তুলতে পারলে এই সংখ্যাটি আগামী দশ বছরে দশ গুন করা সম্ভব। 

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রবাসি সেবা লিমিটেড

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত