অসচেতনতাই প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম কারণ
প্রকাশ | ০৫ জুন ২০২৩, ১২:১৯ | আপডেট: ০৫ জুন ২০২৩, ১২:৫৩
সারাবিশ্বে পরিবেশ নিয়ে ভয়ঙ্কর উদ্বেগ, উৎকন্ঠার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ ৫ জুন ২০২৩ বিশ্ব পরিবেশ পালিত হচ্ছে। এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- 'প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে সামিল হই সকলে।' আর পরিবেশ দিবসের স্লোগান 'সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ।'
আজকের আলোচনা প্লাস্টিকের ভয়াবহতা নিয়ে। পৃথিবীজুড়ে প্লাস্টিক সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার পর থেকেই প্লাস্টিক বর্জ্যে পরিত্যাগ নিয়ে বরাবরই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিকের কণাগুলো এতোই ক্ষুদ্র যে, মাছ খাদ্য হিসেবে সেগুলো খেয়ে বড় হচ্ছে আর আমরা ওই মাছগুলো খাচ্ছি, যা ক্যান্সার রোগের অন্যতম কারণ।
নিয়মিত প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে ভয়াবহ করে তুলছে। পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালি প্লাস্টিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না।
এগুলো পরিবেশ থেকে বর্জ্যের আকার ধারণ করে। মানুষের অসচেতনতাই প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম কারণ। প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা পঁচতে বা পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে।
আমরা ধারণাও করতে পারিনা যে, সাবান, মুখের ক্রিম, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট এবং অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্যাদির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক পরিবেশের সাথে ছড়িয়ে পড়ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে।
পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো স্থানে ফেলে দেওয়া চিপসের প্যাকেট, কিংবা প্লাস্টিকের বোতল তার গন্তব্য হিসেবে খুঁজে নিচ্ছে সমুদ্রকে। যার ফলে ভয়ানকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশে থাকা জীবেরা।
সমুদ্র দূষণের ভয়াবহতা দিনে দিনে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চেয়ে বেশি থাকবে প্লাস্টিক। এই ভয়াবহ খবরটি জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম জার্নাল। সংস্থাটি বলছে, গত ৫০ বছরে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়েছে যা আগামী ২০ বছরে এর পরিমাণ দ্বিগুন হতে পারে। প্রত্যেক বছর প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ছে ৪.৮ শতাংশ।
সংস্থাটি আরও জানায়, প্রতি মিনিটে মানুষ যত পরিমাণ প্লাস্টিক জমা করছে তা একটা গারবেজ ট্রাকের সমান। জানাগেছে- বর্তমানে মাছ ও প্লাস্টিকের অনুপাত ১:৫। ২০৩০ -এ অনুপাত হবে ১:৩।
এক সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে ১৫ হাজার মেট্রিকটন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, যা ২০১০ সালে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০ বছরে ব্যবহার ৫০ গুণ বেড়েছে।
বর্তমানে ছোট, মাঝারি, বড় ৫ হাজার শিল্পকারখানায় ১২ লক্ষ মেট্রিকটনের বেশি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। সে হিসাবে প্লাস্টিক পণ্যের জনপ্রতি ব্যবহার বছরে ৭.৫ কেজি। ব্যাপারটি অবশ্য ভাবনীয়।
এক গবেষণা অনুযায়ী, সামুদ্রিক পাখিদের প্রায় নব্বই শতাংশ সরাসরি প্লাস্টিক দূষণের শিকার। গবেষণা বলছে, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সামুদ্রিক পাখির পাকস্থলীতেই পাওয়া যায় প্লাস্টিক।
সাধারণত উদ্ভিদ কূল, জলজপ্রাণী, দ্বীপ অঞ্চলের প্রাণীরা প্লাস্টিক বর্জ্যর জন্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য ওই সকল প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহের স্থান ও উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র উদ্ভিদ বা জলজ প্রাণী নয়, মানুষ প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের জন্য প্লাস্টিক দূষণ পরোক্ষভাবে দায়ী। ভয়ানক খবরটি হচ্ছে- গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির ব্যবহার ৮০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।
১৯৯০ সালের দিকে বাংলাদেশে ১৫ হাজার মেট্রিকটন প্লাস্টিকের ব্যবহার হলেও ২০১৮ সালে ব্যবহৃত হচ্ছে ১২ লাখ মেট্রিকটন। কোমল পানীয় থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের বোতল তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। শুধু ২০১৬ সালেই ১১০ বিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল বানিয়েছে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কোমল পানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা। আর এই বোতলের বেশিরভাগই উন্মুক্তভাবে পরিবেশে পরিত্যাগ করেছেন ভোক্তারা। তাই অনেক পরিবেশবিদের দাবি, এখনই যদি প্লাস্টিক বোতলের বিকল্প না চিন্তা করা যায় তবে মানবজাতির সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ এক দুর্যোগ।
আশ্চর্যজনক ব্যাপারটি হচ্ছে- বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আইন থাকলেও অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্যে ক্ষেত্রে তা নেই। একারণে দেশে প্লাস্টিকের বস্তা ও পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।
পরিবেশ সচেতনরা বাজেয়াপ্ত প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য জিনিস ফেলে না দিয়ে কী করে এসব ব্যবহার করে সৃজনশীল উপকরণ তৈরি করা যায় তারই চেষ্টা চালায় ইকোব্রিকস নামক একটি পরিবেশ সচেতনতাবাদী প্রতিষ্ঠান।
তারা মানুষকে প্লাস্টিক বোতলের মধ্যে নরম প্লাস্টিক বর্জ্য ভরে বøক তৈরির জন্য উৎসাহিত করছে। এসব বøক দিয়ে ভবন, দেয়াল ও আসবাবপত্র তৈরি করা যায়।
ইকোব্রিকস এর মতে, প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে খরচবিহীন পন্থা এটি, ফলে এ মুহূর্ত থেকে মানুষ তা গ্রহণ করতে পারে। ইকোব্রিকস ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ গাইডটি বর্তমানে ফিলিপাইনের আট হাজার স্কুলের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ফিলিপাইনে গড়ে উঠেছে আরো অনেক খেলার মাঠ, বাগান ও ভবন যা ইকোব্রিক বা পরিবেশ বান্ধব উপায়ে প্লাস্টিক বøক দিয়ে তৈরি।
কেবল ফিলিপাইন নয়, পরিবেশের প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকাও এরই মধ্যে ইকোব্রিক ব্যবহার শুরু করেছে।
আমরা জানি, পরিবেশ দূষণের উপাদানগুলোর মধ্যে পলিথিন ও প্লাস্টিক অন্যতম। প্লাস্টিক নিয়ে একটি ভালো জানাতে পারি পাঠকদের।
ঢাকা শহরের চারতলা বাড়ি বিক্রি করে গ্রামে ফিরে বানিয়েছেন প্লাস্টিক বোতলের বাড়ি। গ্রামের ছোট ছোট দোকান থেকে কিনেছেন নানা ধরনের প্লাস্টিকের বোতল।
সেই বোতলের বাড়ি তৈরি করে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন এক দম্পতি। ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করেছেন দু’জনে।
তাদের স্বপ্ন ছিল পরিবেশবান্ধব একটি বাড়ি তৈরির। অবশেষে প্লাস্টিকের বোতলে বালি ভরে দেয়াল তৈরিতে তারা সফল হন। বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষ কাঁচা ঘরবাড়িতে বসবাস করে। বাঁশ, কাঠ, টিনের বেড়া দিতে যে টাকা দরকার, তা দিয়ে নিজেরাই ইচ্ছা করলে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে পাকা দেয়াল নির্মাণ করতে পারবেন। একটি বাড়ির ৬টি রুম করতে খরচ হচ্ছে মাত্র ৪ লক্ষ টাকা।
এবার আসা যাক পলিথিনের কথায়। পরিবেশ বিষয়ে আমাদের অসচেতনতার অন্যতম উদাহরণটি হলো- আমরা সচেতনভাবে খালি হাতে বাজারে গিয়ে ৫ থেকে ১০টি পলিথিন ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফিরি। পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি, যা থেকে বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়।
পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকা শহরেরই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে। অপর এক জরিপে বলা হয়েছে ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে।
সে হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকার ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।
ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার জন্য ৮০ শতাংশ দায়ী এই পলিথিন ব্যাগ। পলিথিন মাটির সঙ্গে মেশে না বরং উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট করে। এই পলিথিন পোড়ালে বায়ুদূষণ হয়।
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় ধান ও চালের বিপণন শুধু পাটের বস্তায় করা বাধ্যতামূলক করা। এ ছাড়া পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক আইন করে। কিন্তু এসব আইন-নির্দেশ উপেক্ষা করে চাল ও মিলমালিকেরা আগের মতো প্লাস্টিকের বস্তায় বিপণন করছেন।
২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে এবং ১ মার্চ থেকে সারা দেশে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে কিছুদিন চটের ও কাগজের ব্যাগের ব্যবহার লক্ষ্য করা গেলেও প্রচার এবং মানুষের অসচেতনতার অভাবে আবার পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
তাই এখনই দরকার কাগজ ও পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়ানো। এবার জানুন পলিথিন ও প্লাস্টিক বিষয়ে একটি ভালো খবর। পলিথিন ও প্লাষ্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি গ্যাস, তেল ও পিচ্ছিলকারক পদার্থ উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন পটুয়াখালীর মোহাম্মদ হালিম।
স্থানীয়ভাবে তৈরি এ যন্ত্রের মাধ্যমে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব বলছেন হালিম। ১১ বছর জার্মানিতে ছিলেন তিনি। ওয়ার্কশপে কাজের সময় এমন প্রযুক্তির কথা চিন্তা করেন তিনি। দেশে ফিরেই তৈরি করেন একটি যন্ত্র। এর মাধ্যমে পলিথিন ও প্লাষ্টিক বর্জ্য দিয়ে তৈরি করছেন জ্বালানি গ্যাস, তেল ও বিভিন্ন পিচ্ছিলকারক দ্রব্য। বর্জ্যকে মূল্যবান সম্পদে রূপান্তরের এ কৌশল দেখে অভিভূত এলাকাবাসী।
দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এ প্রযুক্তি গ্রহণ করা যায় কি-না তা খতিয়ে দেখার কথা বলছেন স্থানীয়রা। আবার জামালপুরের তৌহিদুল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৭’তে তার নিজের ওই উদ্ভাবন নিয়ে এসে সব শ্রেণি-পেশার মানুষদের নজর কেড়েছেন।
পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে জ্বালানি তেল উৎপাদন করেছেন তিনি। শুধুমাত্র তেলই নয়, মিথেন গ্যাস ও ছাপাকাজে ব্যবহারের জন্য কালিও বানিয়েছেন তিনি পলিথিন থেকেই।
ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক থেকেও একইভাবে জ্বালানি তেল তৈরি করেছেন তৌহিদুল। ২০১১ সালে তিনি সফলভাবে প্রথম তেল উৎপাদন করেছিলেন।
নিজ অধ্যবসায় এবং মেধা দিয়ে নব উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছেন তিনি। তৌহিদুল ইসলামের বয়স মাত্র ২৫।
জামালপুর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন তৌহিদুল। তৌহিদুলের মতে, ১০০ কেজি পলিথিন থেকে ৭০ কেজি জ্বালানি তেল, ১০ কেজি মিথেন গ্যাস ও ২০ কেজি ছাপাকাজের কালি তৈরি করা যায়।
এভাবে উৎপাদিত ১ কেজি জ্বালানি তেলের খরচ পড়ে মাত্র ১৭ টাকা। তার উদ্ভাবিত যন্ত্র জ্বালানি তেল পরিশোধনও করতে পারে। পলিথিন পুড়িয়ে প্রথম যে তেলটা আসে সেটা হয় কালচে রঙের। পরিশোধিত করার পর তা দেখতে হয়ে যায় হলুদ রঙের।
- এস এম মুকুল: কলাম লেখক ও উন্নয়ন গবেষক