দ্বিগুন দামে ছোলা, চিনি, খেজুর

প্রকাশ | ২০ মে ২০১৭, ১৪:৫৪

অনলাইন ডেস্ক

রমজানকে সামনে রেখে ছোলা, চিনি, ডাল, খেজুর, ভোজ্যতেল ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই ভোক্তার চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় জোগান দিতে ব্যবসায়ীদের আগে থেকেই পণ্যগুলো মজুদ করতে হয়। চলতি বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। 

দেখা যায় যে, রোজাকে কেন্দ্র করে গত ছয় বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ রযেছে। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৪২ ব্যবসায়ীর গুদামে ছোলা, চিনি, ডাল, খেজুর ও ভোজ্যতেলে ভর্তি রয়েছে। কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীর এ ক’জন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করছেন। বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সিন্ডিকেট প্রথমে সর্বোচ্চ পণ্য আমদানি করে গুদামজাত করেছে। তারপর কেউ কেউ বন্ধ কারখানা রেখেছেন। ফলে দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও কিছু ব্যবসায়ীর এমন নেতিবাচক তৎপরতায় সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তাসাধারণ। 

ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পাইকারি ও খুচরা বাজারে ছোলা এবং চিনি বিক্রির সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। 
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়েছে ভালো মানের প্রতি কেজি ছোলা ৮০ এবং মাঝারি মানের ছোলা ৭৫ টাকায় পাইকারি বিক্রি হবে। আর খোলাবাজারে খুচরা মূল্য হবে যথাক্রমে ৮৫ ও ৮০ টাকা। একইভাবে প্রতি কেজি চিনি পাইকারি ৫৮ থেকে ৬০ এবং খুচরায় ৬২ থেকে ৬৩ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের বাজারে নির্ধারিত এ দামের চেয়ে প্রতিটি পণ্য কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। 

এ প্রসঙ্গে ছোলার অন্যতম আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণের সুযোগ নেই। তারপরও প্রশাসনের অনুরোধে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ছোলা ও চিনির পাইকারি এবং খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছেন। পাইকারিতে মানা হলেও খুচরা বাজারে নিয়ন্ত্রণ কারোরই নেই। ফলে পর্যাপ্ত পণ্য আমদানির পরও সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। আবার শুধু চট্টগ্রামে দাম নির্ধারণের যে কৌশল নেওয়া হয়েছে সেটিও ভুল। ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালের মতো বিভাগীয় শহরে দাম নির্ধারণ করে না দিয়ে শুধু চট্টগ্রামে পণ্যমূল্য নির্ধারণের বিষয়টি অযৌক্তিক। 

গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে  দু’সপ্তাহ আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীর ক'জন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করছেন রমজানে বাজার অস্থির করতে। তবে গত ৩০ এপ্রিল (রবিবার) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা কমিটির সভায় রমজানে পণ্য সরবরাহ ঠিক রেখে দাম না বাড়ানোর অঙ্গীকার করেন ব্যবসায়ীরা। 

রমজানে ছোলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন নয় ব্যবসায়ী। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৭৪ জন ব্যবসায়ী ৯৫০ কোটি টাকা মূল্যের দুই লাখ ১৫ হাজার টন ছোলা আমদানি করেন। এ হিসেবে প্রতি কেজি ছোলার দাম পড়ে ৪৪ টাকা। কিন্তু বাজারে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। আমদানি করা ছোলার ৬০ শতাংশ এনেছেন ৯ ব্যবসায়ী। এর মধ্যে সর্বাধিক ৫৭ হাজার টন ছোলা এনেছে আবুল খায়ের গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড। ২৮ হাজার টন ছোলা এনেছে সিলভার ডাল অ্যান্ড মিলস লিমিটেড। মেসার্স এনআর ট্রেডিং ২৪ হাজার টন, চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার রুবি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড ১৬ হাজার ৩৪৫ টন, গাজী ট্রেডিং সাড়ে ৯ হাজার টন, ফ্লেটচার ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোর্ট লিমিটেড ৮ হাজার ৮০০ টন, লাকী ট্রেডিং প্রায় ৮ হাজার টন, ইসলাম ব্রাদার্স ১৭ কোটি টাকা মূল্যে ২ হাজার ৭০০ টন ও রিলায়েন্স করপোরেশন ১৭ কোটি টাকা মূল্যে ২ হাজার ৪০০ টন ছোলা আমদানি করেছে। গত বছরের একই সময়ে দেশে ছোলা আমদানি হয়েছে ৭৮০ কোটি টাকা মূল্যের এক লাখ ৬৫ হাজার টন। 

চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন পাঁচ ব্যবসায়ী। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১১ লাখ ২৬ হাজার টন চিনি আমদানি হলেও এবার ওই সময়ে আমদানি হয়েছে প্রায় ১৬ লাখ টন। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ৪ লাখ টন বেশি চিনির কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। দেখা গেছে ওই পাঁচ ব্যবসায়ী এই চিনি আমদানি করে নিয়ন্ত্রণ করছেন বাজার। আমদানি চিনির ৩৫ শতাংশ এনেছে মেঘনা গ্রুপ। প্রায় ৩১ শতাংশ এনেছে সিটি গ্রুপ। এস আলম গ্রুপ ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ, আবদুল মোনেম গ্রুপ ১০ শতাংশ ও দেশবন্ধু গ্রুপ এনেছে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। এ হিসাবে মোট আমদানি করা চিনির ৯৪ দশমিক ৬২ শতাংশ এনেছেন এই পাঁচ ব্যবসায়ী। বাজার অস্থির করতে তাদের মধ্যে দুই আমদানিকারক রমজানের আগে বন্ধ রেখেছেন তাদের পরিশোধন কারখানা। ফলে বাজারে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট। এ সুযোগে বাড়ানো হয়েছে চিনির দাম। 

ভোজ্যতেল আট ব্যবসায়ী হাতে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।  চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪২০ টন ক্রুড সয়াবিন আমদানি হয়েছে। আর রিফাইন্ড পাম অয়েল আমদানি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টন। আমদানি করা এই ভোজ্যতেল মজুদ রয়েছে ৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে তানভির অয়েলস লিমিটেড ৭৬২ কোটি টাকায় সর্বাধিক এক লাখ ১৬ টন, বাংলাদেশ এডিবয়েল ৬৬৮ কোটি টাকায় এক লাখ তিন হাজার টন, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ৬২৯ কোটি টাকায় ৯৯ হাজার টন, দীপা ফুড প্রোডাক্ট ৫৩২ কোটি টাকায় ৮৫ হাজার টন, সুপার অয়েল রিফাইনারি ৩৮২ কোটি টাকায় ৬০ হাজার টন, এস আলম সুপার এডিবয়েল ২৬১ কোটি টাকায় ৩৭ হাজার টন, ভিওটিটি অয়েল রিফাইনারি ২২৬ কোটি টাকায় ৩৬ হাজার টন ক্রুড সয়াবিন আমদানি করেছে। 

রমজানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে খেজুরের। আর এই খেজুরের মজুদ করেছে ৯ প্রতিষ্ঠানের হাতে।  অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ১২০ কোটি ২৯ লাখ টাকায় ২৭ হাজার ৫০৪ টন ভেজা খেজুর আমদানি করেছে। এবার আমদানি করা খেজুরের পরিমাণ আরও বেশি। গত বছরের মতো এবারও বেশির ভাগ খেজুর আমদানি করেছে ৯টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে- রয়েল ফ্রেশ ফ্রুটস, ইসলাম অ্যান্ড ব্রাদার্স, আল্লার দান ফ্রুট এজেন্সি, মেসার্স মদিনা ট্রেডিং, মেসার্স রামীসা এন্টারপ্রাইজ, জিতু ইন্টারন্যাশনাল, সিয়াম ফ্রুট কালেকশন, আরএম এন্টারপ্রাইজ ও এরাবিয়ান ডেটস ফ্যাক্টরি।