জীবন ও সৃষ্টির গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০১৯, ১১:১০

আজ থেকে ১৫৬ বছর আগে ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় এবং মাতা প্রসন্নময়ী দেবীর গৃহে কবি, নাট্যকার, গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

ডি এল রায় নামে খ্যাত এই কবি, নাট্যকার, গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় হুগলি কলেজ থেকে বিএ এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (১৮৮৪) পাস করেন। পরে কিছুদিন চাকরি করে তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য লন্ডন যান এবং সেখানে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। লন্ডনের সিসিটার কলেজ থেকে তিনি কৃষিবিদ্যায় এফ.আর.এ.এস ডিগ্রি এবং রয়েল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটির এম.আর.এ.সি ও এম.আর.এস.এ উপাধি লাভ করেন। বিলেত থেকে ফিরে তিনি মধ্যপ্রদেশে জরিপ ও রাজস্ব নিরূপণ ট্রেনিং নেন এবং সরকারি ডেপুটির চাকরি পান; পরে তিনি দিনাজপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বাধীনচেতা মানসিকতা কর্মক্ষেত্রে তাকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। তবুও ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুটা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসারের দায়িত্ব পালনকালে প্রজাদের স্বার্থে ছোটলাটের বিরোধিতা করতেও কুণ্ঠিত হননি তিনি। বিলেত যাবার কারণে সামাজিক ভাবেও তাকে অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়।

দ্বিজেন্দ্রলালের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হাতেখড়ি নেন সুকণ্ঠ গায়ক পিতার কাছে। বিলেতে থাকাকালে তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিক্ষার মাধ্যমে তার সঙ্গীত প্রতিভাকে শাণিত করেন। উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলা গানের আধুনিকীকরণে যে পঞ্চ গীতিকবি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, দ্বিজেন্দ্রলাল তাদের অন্যতম। রবীন্দ্রযুগে বাংলা কাব্যসঙ্গীতে বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ ও আধুনিক গান রচনায় তিনি ছিলেন একজন সার্থক রূপকার। নাটক রচনা ও পরিচালনায় তাঁর অসামান্য অবদান থাকলেও তিনি সঙ্গীতকার হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি প্রায় পাঁচশত গান রচনা করেন। প্রথমদিকে তার গান ‘দ্বিজুবাবুর গান’ নামে পরিচিতি ছিল; পরবর্তীকালে তা ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ নামে পরিচিত হয়।

দ্বিজেন্দ্রলাল খুব অল্পবয়স থেকেই গান রচনা করতেন এবং নিজেই সুর দিয়ে গাইতেন। বিলেত যাওয়ার আগে মাত্র সতেরো বছর বয়সের মধ্যে লেখা একশো আটটি গান নিয়ে তার প্রথম গীতসংকলন আর্য্যগাথা (প্রথম ভাগ) ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে  বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে যে গণজাগরণমূলক গান রচনার প্রচলন শুরু হয়, তাতে দ্বিজেন্দ্রলালের অবদান ছিল অসামান্য। এ সময় তিনি অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন যা দেশবাসীকে প্রচন্ডভাবে উদ্দীপিত করে। পরবর্তীকালে দেশাত্মবোধক গান রচনাতেই তার সঙ্গীতপ্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। দ্বিজেন্দ্রলাল রচিত জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

দ্বিজেন্দ্রলাল ১৯০৫ সালে কলকাতায় ‘পূর্ণিমা মিলন’ নামে একটি সাহিত্যিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি তখনকার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিসেবী বাঙালিদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। এ সময় তিনি ‘ইভনিং ক্লাব’ নামে অপর একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এবং এর মাধ্যমে তিনি প্রথম অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন।

দ্বিজেন্দ্রলাল কৈশোরেই কাব্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০৩ সাল পর্যন্ত তিনি মূলত কাব্যই রচনা করেন এবং এ সময় পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ছিল বারো। এরমধ্যে  প্রহসন, কাব্যনাট্য, ব্যঙ্গ ও হাস্যরসাত্মক কবিতাও রয়েছে। তবে জীবনের শেষ দশ বছর তিনি প্রধানত নাটক রচনা করেন। পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক সব ধরনের নাটক রচনায় তিনি অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। স্বদেশী আন্দোলনের ফলে তার মধ্যে যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়েছিল, ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে তার প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি ষোলোটি নাটক রচনা করেন।

দ্বিজেন্দ্রলালের অসাধারণ প্রতিভার সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছিল বিদেশী শাসকদের প্রতি তার বিদ্বেষী মনোভাব, যার প্রতিফলন ঘটেছে তার বিভিন্ন রচনায়। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের চিত্তাকর্ষক দিকগুলো আত্মস্থ করে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তিনি তা প্রয়োগ করেন বাংলা গানে।

১৯১৩ সালের ১৭ মে কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত