জেনে নিন ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের ক্ষতিকর দিকগুলো!

প্রকাশ : ২৩ মে ২০২১, ০১:৫৮

সাহস ডেস্ক

সৌন্দর্যের প্রতি জন্মগত আকর্ষণের জন্য হরহামেশাই আপনি ফর্সা হওয়ার ক্রিম ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। যেকোনও পার্টিতে যাওয়ার পূর্বে সবার নিকট নিজেকে দর্শনীয় করার জন্য নির্ভর করেন বাজারের ফেয়ারনেস ক্রিমগুলোর ওপর।

কিন্তু এ ধরনের ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম সাময়িকভাবে ফর্সা ভাব দিলেও আপনার ত্বকের জন্য এগুলো খুবই ক্ষতিকর। আপনি প্রায়ই বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে দ্রুত রং ফর্সা করার লোভনীয় অফার দেখে থাকবেন। এগুলো কোনটাই দীর্ঘ মেয়াদী নয়। ত্বক বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই এই সাবধানবাণী দিয়ে আসছেন।

বাংলাদেশে বিশেষ করে কোরিয়ান সৌন্দর্য বর্ধক পণ্যগুলোর অনেক চাহিদা। মনে রাখতে হবে, কোরিয়ান পণ্য মানেই কিন্তু ভালো পণ্য নয়। চলুন, এ ধরনের ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারে কি কি ক্ষতি হতে পারে তা জেনে নেয়া যাক।

ফর্সা হওয়ার ক্রিম ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো
লালচে ফুস্কুড়ি

এর আরেক নাম রোসেসিয়া, যা আপনার মুখে লালচে ফুস্কুড়ি সৃষ্টি করে এবং চামড়ার ভেতরের রক্তনালীকে দৃশ্যমান করে তোলে। আপনার ত্বক যদি হাল্কা হয়ে থাকে আর সেই ত্বকে আপনি নিয়মিত ক্রিম ব্যবহার করেন, তাহলে আপনি এই সমস্যার সম্মুখীন হবেন।

ত্বকের রং হারিয়ে ফেলা
এটি ক্রিম ব্যবহারের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে একটি। এর ফলে আপনার শুধু ত্বক-ই নয়, ধীরে ধীরে সমস্ত শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যেতে শুরু করবে। চূড়ান্ত অবস্থায় এটি স্কিন ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যায়।

চুলকানি
ঘন ঘন ক্রিম ব্যবহার আপনার ত্বকে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হওয়া তেল শুষে নেয়। ফলে ত্বক হয়ে পড়ে শুষ্ক। আর চুলকানি মাত্রা ছাড়ায় এই শুষ্ক ত্বকেই। আপনার সংবেদনশীল ত্বককে চুলকানির মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে নষ্ট করার জন্য একটি ক্রিম-ই যথেষ্ঠ।

ব্রণ
‘আপনার ব্রণের দাগ দূর করবে’ আপনি হয়ত ক্রিমের গায়ে এই কথাটি দেখেই কিনে ফেলছেন। কিন্তু এই ধরনের ক্রিমগুলোতে থাকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। এগুলো প্রতিদিন ব্যবহারে আপনার ব্রণের কালচে দাগ দূর করবে না। বরং পরবর্তীতে যখন আপনি ব্রণের চিকিৎসার জন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করবেন, তখন সেগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দিবে।

রোদে জ্বালা পোড়া
অতিরিক্ত মাত্রায় ফর্সা হওয়ার ক্রিম ব্যবহারে আপনার ত্বক হয়ে যায় পাতলা। আর পাতলা ত্বক সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি দ্বারা তুলনামুলকভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতঃপর এর প্রভাবে খুব কম বয়সেই মুখে বলিরেখা পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে স্কিন ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

ত্বকে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
মুখে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারের ফলে ত্বকের উপরই যে শুধু আলাদা একটা স্তর পড়ে- তা নয়। বরং তা আপনার ত্বকের রোগ প্রতিরোধী কোষগুলোর স্বাভাবিক ক্ষমতাও নষ্ট করে দেয়। ফলশ্রুতিতে আপনার ত্বক অরক্ষিত হয়ে পড়ে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গালের কাছে।

কিডনী এবং স্নায়ুজনিত জটিলতা
বাজারে আপনি যে ফেয়ারনেস ক্রিমগুলো পাচ্ছেন তার অধিকাংশগুলোতেই অধিক মাত্রায় থাকে পারদ। আর এই পারদ আপনার কিডনী নষ্ট করে দেয়ার পাশাপাশি স্নায়ুজনিত নানাবিধ সমস্যার জন্য দায়ী।

ফর্সা হওয়ার ক্রিম সম্পর্কিত কিছু ভুল ধারণা
ফেয়ারনেস ক্রিম দ্রুত রং ফর্সা করে
এটি সমাজে প্রচলিত সবচেয়ে পুরোনো ধ্যান-ধারণা। ফেয়ারনেস ক্রিম মুখের রং ফর্সা করতে পারে না। এটা শুধুমাত্র ত্বকের ওপরে একটি স্তর তৈরি করে যা স্বাভাবিক শ্যাম বর্ণকে ঢেকে দেয়। পাশাপাশি মুখের রোদে পোড়া অংশকে সরিয়ে দেয়। অতঃপর ত্বকে বিদ্যমান মেলানিন নামক উপকারী রঞ্জক পদার্থের বৃদ্ধি রোধ করে। এ ধরনের ক্রিম ত্বককে ব্লিচিংয়ের মাধ্যমে উজ্জ্বল করে যা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর।

হারবাল ফেয়ারনেস ক্রিমে কোনো কেমিক্যাল থাকে না
আয়ুর্বেদিক বা হারবাল ফেয়ারনেস ক্রিমে কোনো কেমিক্যাল নেই- এমন ধারণা অনেকেই পোষণ করেন। ভেষজ উপাদান ছাড়া এসব ক্রিমে আর কোন ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে না। এমনটা ভেবে ত্বক ফর্সা করার জন্য অনেকেই এই ক্রিমগুলোর উপর নির্ভর করেন। কিন্তু এই ক্রিমগুলো ক্ষতিকর কেমিক্যাল বেইজ এবং প্রিজারভেটিভে ভরপুর। এগুলো আপনার ত্বকে এলার্জি সৃষ্টির জন্য দায়ী।

ক্রিমের ভেতরের সব উপকরণ প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে
আপনি হয়ত খুব সতর্কতার সাথে পণ্য কেনার সময় পণ্যের গায়ে উপকরণগুলোর নাম দেখে নেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্যাকেটের গায়ে সবগুলো উপকরণের নাম লেখা থাকে না। প্রায় কিছু কিছু ক্ষতিকারক উপাদানের কথা আড়াল করা হয়। আবার যদি লেখা থাকেও, নামের পাশে নির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করা থাকে না।

জীবাণু প্রতিরোধকারী সাবান ত্বক সুস্থ রাখে
বাজারে আপনি অনেক অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল সাবান পাবেন, যেগুলো সুস্থতা ও সুরক্ষার সহায়ক হিসেবে প্রচার করা হয়। এগুলো মুলত নিত্য দিনের ব্যবহারের জন্য নয়। ত্বকে বিদ্যমান সব কটি ব্যাকটেরিয়াই ক্ষতিকারক নয়। বরং এ ধরনের সাবান প্রতিদিন ব্যবহারের ফলে ত্বকের উপকারী জীবাণুও ধ্বংস হয়ে যায়।

তৈলাক্ত খাবার খেলে ব্রণ হয়
অনেকেই মনে করেন, ভাজাপোড়া বা অতিরিক্ত তেল দিয়ে বানানো খাবার খেলে ব্রণ বাড়ে। এর স্পষ্ট কোনও প্রমাণ নেই। সিবাম নামে একটি তৈলাক্ত পদার্থ ত্বকে বেশি তৈরি হওয়ার কারণে মুলত ব্রণ হয়। কিন্তু খাবারের তেলের সাথে মুখের ব্রণের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে এটা ঠিক যে, ভাজাপোড়া খেলে ওজন বাড়ে। আর বাড়ন্ত বয়সে হঠাৎ ওজন বৃদ্ধির ফলে হরমোনগত কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এই জটিলতাগুলোই ব্রন বেশি হওয়ার কারণ হয়ে দাড়ায়।

ভিটামিন-ই যুক্ত ক্রিম ত্বকের দাগ দূর করার জন্য যথেষ্ঠ
ত্বকে দাগ হয় বিভিন্ন কারণে। হরমোনজনিত সমস্যা, কাটা-ছেঁড়া অথবা কখনো কোনো রোগের কারণেও হতে পারে। শুধুমাত্র একটি ভিটামিন-ই যুক্ত ক্রিমেই ত্বকের দাগ দূর করা সম্ভব নয়।

ফর্সা হওয়া ক্রিম ব্যবহারের বিকল্প উপায়গুলো
পরিষ্কার ঠান্ডা পানি ব্যবহার
প্রতিদিন অন্তত তিনবার পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করুন। বর্তমানে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ময়েশ্চারাইজার ও ক্লিনজার ব্যবহার আবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ভালো মানের ওয়াটার বেস্ড ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন। বাইরে থেকে ঘরে ফেরার সাথে সাথেই ক্লিনজার অথবা শুধু পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখের ময়লা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন।

নিয়মিত ভালো ঘুম ও প্রফুল্ল থাকা
সৌন্দর্যের জন্য সুস্থ মানসিক অবস্থার কোন বিকল্প নেই। তাই ক্লান্তি দূরীকরণে যথাযথ ঘুম দরকার। পাশাপাশি প্রয়োজন দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকার জন্য যেকোনো কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রফুল্ল রাখা। সপ্তাহান্তে কোথাও ঘুরে আসা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মজার আড্ডা, নিজের প্রিয় কাজে মনোনিবেশ করা। এগুলো আপনার মনকে সুস্থ রাখে।

নিয়মিত শরীরচর্চা
সুস্থ শরীর সুন্দর মন একে অন্যের পরিপূরক। শরীর ভালো থাকলে ভালো থাকবে আপনার মন। আর এর প্রভাব পড়বে আপনার চেহারায়।

স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেনে চলা
আপনার শরীরের চাহিদা সঠিকভাবে মেটানোর জন্য অনুসরণ করুন একটা ব্যালান্সড ডায়েট। পরিমিত খাদ্যাভ্যাস স্বাভাবিকভাবেই ত্বককে সুস্থ ও জেল্লাদার রাখে। সুষম খাদ্যের একটি তালিকা তৈরি করুন যেখানে ফলমুল, সবুজ শাকসবজি, মাছ-মাংস সহ প্রতিটি খাদ্য উপাদান পরিমিত পরিমাণে থাকবে। অ্যালকোহল, কড়া করে ভাজা খাবার, খুব বেশি চিনি বা শর্করা যুক্ত খাবার কম খাবেন।

নেশাজাত দ্রব্য এড়িয়ে চলা
ধূমপানসহ অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্য সেবন পরিত্যাগ করুন। সৌন্দর্য নিয়ে আপনার অভিমত যা-ই হোক না কেনো, শুধুমাত্র এই এক মাদকসেবন আপনার দেহ-মন এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে আপনার নিকট বিষাক্ত করে তুলবে।

পরিশিষ্ট
ফর্সা হওয়ার ক্রিম এড়িয়ে চলা মানেই এ নয় যে, ত্বক পরিচর্যার জন্য আপনাকে অন্য কোনও কিছু ব্যবহার করতে হবে। সব কিছুর মূলে হলো আপনার মানসিক অবস্থা। সৌন্দর্য নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সবার নিকট আপনাকে দর্শনীয় করে তুলতে সাহায্য করবে। তবে হ্যা, তার জন্য অবশ্যই আগে আপনার নিজের চোখে নিজেকে সুন্দর হতে হবে। ভালবাসতে হবে নিজেকে। একমাত্র তখনি আপনি সুন্দর করে নিজেকে সবার সামনে উপস্থাপন করতে পারবেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত