‘দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাসের হাসি কেনা যায় না’

প্রকাশ : ১৪ মে ২০২২, ০২:০১

সাহস ডেস্ক

‘দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাসের গোলাম কেনা চলে, বন্দী কেনা সম্ভব, কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি না।’ ক্রীতদাসের হাসি কেনার অর্থ আর তাঁর মূল্য যে কত অধিক হিসেবে চুকাতে হয় তাঁর পাই পাই হিসেব পাণ্ডুলিপিতে তুলে গিয়েছেন শওকত ওসমান। বিংশ শতাব্দীর স্বনামধন্য কথা সাহিত্যিক তিনি। বাংলা সাহিত্যকে জানান দিয়ে গেছেন জননী’র কথা। জনমভরে দুখিনী মায়ের কষ্টের বর্ণনা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বলে গেছেন অনায়াসে। নির্যাতিত, নিপীড়িত জনতার মুখের ভাষা হয়ে বাংলা সাহিত্যে অমর জায়গা ধরে রেখেছেন শওকত ওসমান। আজ তাঁর ২৪ তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলার ইতিহাসে শতাব্দির ঐতিহাসিক সকল ঘটনার প্রেক্ষাপটে এই কথাকার অবিভক্ত বাংলার পরিবর্তনের সাক্ষী ছিলেন। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্রের সংগ্রামসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার স্পর্শে স্নাত তাঁর জীবন ও সাহিত্য।

শওকত ওসমান একাধারে বিভিন্ন ধরণের গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রাজনৈতিক লেখাসহ শিশু-কিশোর বিষয়ক সাহিত্য রচনা  করেছেন। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত দুটি বই হচ্ছে ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত ‘জননী’ এবং ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘ক্রীতদাসের হাসি’। এছাড়াও মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর ছিল সমধিক পরিচিতি। জননী উপন্যাসের গল্প গ্রাম ও শহরের জীবনের সংঘর্ষের কারণে একটি পরিবারের ভেঙে যাওয়া নিয়ে। অপর দিকে ক্রীতদাসের হাসি একনায়কতন্ত্রের আধিপত্য, নির্যাতন এবং এর বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতীকী বিদ্রোহের উপন্যাস। এগুলো ছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে জাহান্নাম হইতে বিদায় ( ১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩), আর্তনাদ (১৯৮৫), রাজপুরুষ (১৯৯২)। এছাড়া তিনি লিখেছেন প্রবন্ধ,স্মৃতিমূলক গল্পসহ ছোটদের জন্য বই। অনুবাদ করেছেন বহু উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটক।

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৭), ১৯৮৩ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গের (তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা) হুগলী জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর প্রকৃত নাম শেখ আজিজুর রহমান। তা শেখ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মাতা গুলজান বেগম। শওকতের প্রারম্ভিক শিক্ষাজীবন মক্তব-মাদ্রাসা থেকেই। তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা শুরু করেন। পরবর্তীতে মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্যেশ্যে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। আইএ পাস করার পর ১৯৩৬ সালে কলকাতা করপোরেশনে কেরানির চাকুরি দিয়ে কর্মজীবনের শুরু হয় শওকত ওসমানের। তিনি কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন এবং বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। এমএ পাস করার পর ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে প্রভাষক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি চলে আসেন পুর্ববঙ্গে। পরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্সে (বর্তমানে সরকারি কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম) যোগ দেন এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে কিছুকাল তিনি ‘কৃষক’ পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন।

শওকত ওসমান বাংলা সংস্কৃতির একজন বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন এবং একনায়কত্ব এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ সেরিব্রাল অ্যাটাকে আক্রান্ত হন আমৃত্যু স্বৈরাচার, মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী শওকত ওসমান। ওই বছরই ১৪ মে তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত