দেশের বিজ্ঞান গবেষণার অগ্রপথিক ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া

প্রকাশ | ০৯ মে ২০২২, ১৩:২০ | আপডেট: ০৯ মে ২০২২, ১৩:৩৬

ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম টিপু

বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা দেশপ্রেমিক পরমাণুবিজ্ঞানীর নাম ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। তিনি বাঙালি জাতির এক গর্বিত ও আলোকিত মানুষ। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর এই নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি একাধারে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণুবিজ্ঞানী, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং স্পষ্টবাদী রাজনৈতিক লেখক ও কলামিস্ট। তিনি তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও কম্পিউটারবিজ্ঞানী সজীব ওয়াজেদ জয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের গর্বিত পিতা। ২০০৯ সালের ৯ মে তিনি ৬৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, দেশদরদি এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এই নিরহংকার ও বরেণ্য প্রয়াত বিজ্ঞানীর স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।

পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুল কাদের মিয়া এবং মা ময়েজুন্নেসার তিন মেয়ে ও চার ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। প্রাথমিক পর্যায়ে পীরগঞ্জে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও পীরগঞ্জ থানা উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করলেও ১৯৫৬ সালে তিনি রংপুর জিলা স্কুল থেকে ডিসটিংকশনসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বিভাগে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনি লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালে যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনের সব পর্যায়েই তিনি বরাবরই অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হয়েও তিনি তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও অধ্যবসায়ের জোরে বন্ধুর পথ অতিক্রম করে দেশ তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন প্রথিতযশা বরেণ্য পরমাণুবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃত হন।
বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১ এপ্রিল ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং সুদীর্ঘ গৌরবময় কর্মজীবন শেষে ১৯৯৯ সালে ওই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৯, ১৯৭৩ ও ১৯৮৩ সালে তিনি ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবার ছয় মাসের জন্য গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯-৭০ সময়কালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার গবেষণাগারে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে আণবিক রিঅ্যাক্টর বিষয়ে তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি বাধ্য হয়েই ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লি কেন্দ্রে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। পারমাণুবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি বহু জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছেন। তাঁর বহুসংখ্যক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় ও সাময়িকীতে প্রকাশিত ও প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের পদার্থবিজ্ঞান, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি দুটি বই লিখেছেন।

এই কর্মদক্ষ বিজ্ঞানী বিচিত্র অভিজ্ঞতার এক বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী ছিলেন। তিনি ১৯৭২-৭৩ সময়ে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৮৩-৮৫, ১৯৯১-৯২ সময়ে সভাপতি, ১৯৮৫-৮৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ পদার্থবিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৯৭-২০০১ সাল পর্যন্ত সভাপতি, ১৯৮৯-১৯৯৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও ১৯৯৪-৯৬ পর্যন্ত সভাপতি, ১৯৮৯-১৯৯৩ সময়কালে বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি অসংখ্য সমিতি, সংসদ এবং শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে নিরলসভাবে দেশমাতৃকার ও বিজ্ঞানপিপাসুদের সেবা করে গেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় তিনি ছাত্ররাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হন। ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ১৯৬১-৬২ সেশনে তিনি ফজলুল হক হলের ছাত্রসংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। একই সালে আইয়ুববিরোধী ও শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে কারাবরণ করেন। তিনি একজন দক্ষ ও সাহসী সংগঠক ছিলেন। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করেন এবং পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানান। পরবর্তী সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। স্বাধীনতার পরে তিনি যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের বিচারপ্রক্রিয়ায় অন্যতম প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হয়ে শীর্ষ ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেও তিনি কখনো বাংলাদেশের ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ হননি। ক্ষমতা চর্চায় উচ্চাভিলাষী না হয়ে তাঁর নির্মোহ জীবনযাপন তাঁকে চির অমর করেছে। ক্ষমতার উত্তাপের বিপরীতে তিনি ছিলেন ধীরস্থির, নিভৃতচারী ও নিষ্কলুষ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। জীবনের শেষ দিকে তিনি কলামিস্ট ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবে জাতির পিতার সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অবিরাম লিখে গেছেন। তিনি বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেন এবং দেশের উন্নয়নকল্পে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামে দুটি অমূল্য বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন।
অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই মনীষীর বিশেষ দিক হলো, তিনি সব কথা সরাসরি স্পষ্টভাবে বলতেন, যা উন্নত জাতি গঠনের অন্যতম নিয়ামক। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ বিজ্ঞানী ও নিখাদ দেশপ্রেমিক। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কদরহীন পরিস্থিতিতেও দেশের বিজ্ঞানের উন্নয়ন, বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাঠামো নির্মাণ ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে তাঁর অনেক সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন ছিল। তাঁর আজীবনের স্বপ্ন ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি হবে, দেশের বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে তাঁদের গবেষণায় মগ্ন থাকবেন, দেশ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যাবে। আমৃত্যু তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ নানা কারণে তাঁর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়ায় তিনি তাঁর হতাশা ব্যক্ত করতেও পিছপা হননি। আজকে স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়িত করে জাতি এই নির্ভৃতচারী বিজ্ঞানীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলে তিনি যে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান তা তাঁর সৃজনশীল জীবন থেকে কয়েক বছর কেড়ে নেয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তাঁকে দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়, হারিয়ে যায় তাঁর জীবনের কর্মোদীপ্ত সোনালি দিনগুলো, জাতি বঞ্চিত হয় তাঁর নিরলস গবেষণা সেবা থেকে।

সুযোগ ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ড. ওয়াজেদ মিয়া তাঁর নিজস্ব গবেষণা ক্ষেত্র, অদম্য বিশ্বাস ও দক্ষতার বাইরে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রদর্শন করেননি। তিনি এ দেশের অসাধারণ মেধাবী সন্তানদের অন্যতম। সাদামাটা নিরহংকারী বাঙালি জীবন যাপনেই তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ও বিজ্ঞান গবেষণায় দেশের তরুণসমাজের কাছে তিনি একজন আদর্শবান অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ও পথপ্রদর্শক। তিনি একজন মানবিক পরমাণুবিজ্ঞানী, লেখক ও কলামিস্ট, চিন্তাবিদ, নির্ভীক দেশদরদি, সৎ ও একনিষ্ঠ কর্মকর্তা, সুযোগ্য প্রশাসক এবং সর্বোপরি জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক: ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়