গন্তব্য যার স্বাধীনতা তাঁকে দাবায়ে রাখার সাধ্য কার?

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২২, ১৮:২৯

ড. এ. এস. এম সাইফুল্লাহ

স্বাধীনতা শব্দটিকে নিজের কিংবা জাতীয় জীবনে অর্থবহ করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত। এর জন্য অনেক জাতি যুদ্ধ, সংগ্রাম করেছে, করে যাচ্ছে, কেউ হেরে গেছে আর যারা ভাগ্যবান তাদের কাছে ধরা দিয়েছে স্বপ্নের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির চোখেও স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল জন্ম জন্মান্তরের। ইতিহাসের অনেক চড়াই উৎরাই পথে চলতে হয়েছে এ জাতিকে। স্বাধীন দেশ পাওয়ার আগে আমদের পরিচিতি ছিল ভারতীয়, পাকিস্তানি এরও আগে যদি বলা হয় ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন পরাস্ত হন তখন আমাদের নিজের মত করে স্বাধীকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল এই ২০০ বছরের অন্ধকারে হারিয়ে যায়ইংরেজদের শোষণের যাঁতাকলে। অনেক সংগ্রাম, যুদ্ধ আর রক্তক্ষয়ের পরে ১৯৪৭ এ ব্রিটিশরা চলে গেল, আর ভারত বর্ষ ভাগ হল পাকিস্তান ও ভারতে। যদিও ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে এমনটা চাওয়া ছিলনা। 

১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাদেশের(তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জনগন এক অদ্ভূত দ্বিধায় ছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আচার-আচরণ, সংস্কৃতি ও ভাষার মধ্যে ব্যাপক ফারাক। অথচ, পশ্চিমের ভাবনা এবং সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগনের উপর চাপানোর প্রবনতা ছিল শুরু থেকেই। ১৯৫২ সালে উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপানোর সিদ্ধান্ত পশ্চিমের কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরাট বহিঃপ্রকাশ ছিল এবং বাঙালি এর বিরোধিতা করতে গিয়ে রাজপথে জীবন পর্যন্ত দিয়েছে।

১৯৫২ সালে বাঙালির ভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধীনতার সূতিকাগার। আর সেখান থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রণ্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মত প্রতিটি পদক্ষেপ যার লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা এবং এসবের সব গুলোতেই শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ছিল লক্ষণীয় এবং প্রশ্নাতীত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাঁর পূরো জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষের কল্যাণে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় বাংলাভাষাকে মায়ের ভাষা হিসেবে রক্ষার জন্য কারাবরণ করেনতিনি। এই উদ্দমী ছাত্র নেতা কখনো সত্যের লড়াইয়ে পিছপা হননি বরং স্বচ্ছতা, সাম্যতা এবং আর্থ-রাজনৈতিক অখন্ডতা প্রতিষ্ঠায় তাঁর সংগ্রাম এবং নেতৃত্ব তরুন বয়স থেকেই সর্বজন বিদিত ও প্রশংসিত।

শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা চেতনা এবং কর্ম-কান্ডে ছিল শোষিত আর নীপিড়িত বাংগালী জাতির মুক্তি। জাতির সমস্ত ক্রান্তিলগ্নে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন জনতার কাতারে, কখনো বন্ধু কিংবা কখনো অভিভাবকের মত এবং এ কারণে জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় ভূষিত করেন। সেখান থেকে তিনি সকল মানুষের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ এর আগে বাঙালি জাতি অনেকবার স্বপ্ন দেখেছে স্বায়ত্ব শাসনের কিংবা স্বাধীনতার। স্বাধীকার কিংবা স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের অনেক মহান নেতা অবদান রেখেছেন জাতি তাঁদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব স্বাধীনতার স্বপ্নকে জাতির সামনে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি নিজের দেশের মানচিত্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ মূলত ছিল বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা। সব ধরণের নির্দেশনা ছিল তাঁর সেই অমর কবিতারূপী ভাষণে। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর লেখা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হল’ কবিতার এক অংশে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণের চিত্র এবং জনতার উপলব্ধিকে এভাবেই তুলে ধরেছেন-

‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, 
রবীন্দ্রণাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার 
সকল দুয়ার খোলা।কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী?
গণসূর্য্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
সেই থেকে 'স্বাধীনতা' শব্দটি আমাদের।

স্বাধীনতার জন্য বাঙালির এ সংগ্রাম তো শত বছরের। যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতাকে আদায় করে নেয়ার জন্য পুঞ্জীভূত বারুদের প্রজ্জলনের জন্য বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ যাদুর মত কাজ করেছিল। শত শত বছর ধরে স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য বুকের মাঝে জমিয়ে রাখা বারুদ ছড়িয়ে পড়েছিল মুক্তিপাগল সব জনতার মাঝে। স্বাধীনতাকে সত্যিকারভাবে নিজের করে পেতে এদেশের জনতাকে মরিয়া করে তুলেছিল । 
১৯৭১ এর মার্চ থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর ব্যাক্তিগত বাসভবনটি হয়ে ওঠে স্বাধীন হতে যাওয়া দেশের প্রাণ। দেশের কর্তৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এর বাড়ীটি।দেশ পরিচালনার সকল সিদ্ধান্ত আসতে থাকে সেখান থেকে। বিশ্বের ইতিহাসে এমনটা বিরল। মুলত পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ববাদের অবসান হয়ে যায় সে সময় থেকেই।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালে বাঙালিরা অস্ত্র হাতে নিয়েছিল, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ বিশ্ব মানচিত্রে যুক্ত হয়েছিল, যে ইতিহাস দেশপ্রেমী সকলের জানা। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পূরোটা সময় বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু, তাঁর যাদু মন্ত্রের নির্দেশনা এদেশের জনগনকে অমিত শক্তি যুগিয়েছে দীর্ঘ নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছে। 

পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘ ২৯০ দিন বন্দীদশায় থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। এরপর স্বাধীন দেশের মাটিতে ফেরার পথে লন্ডনে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশে ফেরার পথে তিনি ভারতে থামেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা এবং শরণার্থীদের আশ্রয় দানের জন্য ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।সাথে তাঁদেরকেযত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানান। প্রত্যাবর্তন পথের পূরোটা জুড়ে দেখা যায় একজন আদর্শ নেতা এবং একজন রাষ্ট্রণায়কের শিষ্টতা এবং পারঙ্গমতা। একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন তাঁকে কতটা তাড়িত করত পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারের বন্দীদশা থেকে থেকে ফেরার পথেরঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো থেকেও বোঝা যায়।

১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে ফিরে আসলেন। রেসকোর্স ময়দানে আবার দাঁড়ালেন লক্ষ জনতার সামনে, জল ভরা চোখে বললেন ‘আমার জীবনের স্বপ্ন আজ পুরণ হল। সোনার বাংলা এখন স্বাধীন, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব হল’। তিনি সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পূনর্গঠনে সকলকে কাজ করার আহবান জানালেন। ‘সোনারবাংলা’ বলে প্রকারান্তরে তিনি দরিদ্র দেশটিকে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করলেন।বঙ্গ বন্ধু স্বাধীন বলতে শুধমাত্র স্বাধীন ভূ-খন্ডের স্বপ্ন দেখেননি। স্বাধীন দেশে একটা আত্মমর্যাদাশীল একটি জাতিকে দেখেছেন। 

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে কবি শুভ দাশ গুপ্ত এর ‘আমি সুভাষ বলছি’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি আমাদের স্বাধীনতার নায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর কথাই বলছে-
‘সব রাইফেলে তোমার বুকের বারুদ
সব কুচকাওয়াজে তোমার সেনার ছন্দ
পরশ পাথরের মত স্বাধীনতাকে খুঁজেছে
তোমার অন্তরে লুকিয়ে থাকা খ্যাপা
তোমার গন্তব্য ছিল স্বাধীনতা
তোমার পথ ছিল স্বাধীনতা
তোমার প্রেম ছিল স্বাধীনতা’
কবিতার প্রতিটি চরণে যেন বঙ্গবন্ধুর মানসে লুক্কায়িত দৃঢ় প্রত্যয় আর গন্তব্যের প্রতিচ্ছবি। একাত্তরের আগে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকে, স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টাও ছিল অনেকের। কিন্তু সকলের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে স্থপতির মত ভিত দিতে পেরেছেন একজন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই নেতৃত্বের উপর ভর করে বাঙালি জাতির জন্ম জন্মান্তরের স্বপ্ন স্বাধীনতা ধরা দিয়েছে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। এদেশের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে জাতির পিতার মর্যাদা দিয়েছে। পিতার মত ভরসা যার উপর করা যায় শুধু তাঁকেই এমন অভিধায় অভিষিক্ত করা যায়। 

পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে ২৯০ দিন বন্দী থেকে জাতির পিতা তাঁর স্বাধীন দেশে ফিরে আসলেন ঠিকই কিন্তু, নিজ দেশে ছদ্মবেশধারী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রীরা মহান এই নেতাকে বেঁচে থাকতে দিলনা, বাঙালির ইতিহাসে লেপন করা হলো কালিমা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে খুন হলেন জাতির পিতা। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটি যখন জাতির পিতার হাত ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই জাতি হারালো তার অভিভাবক। বাস্তবিক অর্থে বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে আর বেঁচে নেই। কিন্তু, প্রকৃত নেতা সবসময় জনতার হৃদয়ে থাকেন। তেমনি বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার দু’টি পংক্তি জাতির মনের কথাই বলে দিল-
‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্নে একটি স্বাধীন জাতি, একটি স্বাধীন মানচিত্র এবং অর্থনৈতিকস্বাধীনতা ছিল। গন্তব্য যার স্বাধীনতা তাঁকে দাবায়ে রাখার সাধ্য কার?জাতিরপিতা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, নিজেদের মানচিত্র দিয়েছেন, আমাদের অর্থনীতি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন আর তলাহীন ঝুড়ি নয়। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই চোরাচালান, ঘুষ, কালোটাকা, অসাধু ব্যবসায়ী সহ সকল অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাঁর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে যা স্পষ্ট ভাবে মূর্ত। জাতিরপিতার সেই আকাঙ্ক্ষা গুলোও বাস্তবায়িত হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা। তাঁর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হলে তবেই তাঁর আত্মা শান্তি পাবে, আর আমরাও জাতি হিসেবে কিছুটা হলেও কালিমা মুক্ত হব। শোকাবহ এই আগষ্টে জাতির পিতা এবং তাঁর পরিবারের সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। 

লেখক: অধ্যাপক, এনভায়রণমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত