মা - - সী !!!!!!!!!!!!!!!!!
বাংলার কথা কই
প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০১৭, ১১:৫৫
![](/assets/news_photos/2017/07/04/image-23666.jpg)
ছুটে চলেছেন সৈয়দ। সুবিশাল ভারতবর্ষের, দিল্লীর তখত-এর গোপন প্রতিনিধি।
কখনো আলো, কখনো, অন্ধকার। ধূলি-ধূসরিত প্রান্তর, শস্যশ্যামল বসতি, গহন বন। ভ্রুক্ষেপ নেই সৈয়দের। তার উপায়ও নেই। প্রাণ হাতে ক’রে ঘড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছেন তিনি বাংলার দিকে। শতশত মাইল পথ, কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ নেই। কারণ ওদিকে ছুটছে জোয়ানপুরের (জৌনপুর?) নবাবের প্রতিনিধিও। দুই প্রবল বিরোধী পক্ষ ছুটে চলছে মরণপণ করে বাংলার দিকে সামরিক-রাজনীতির গোপনতম কাজ হাতে, এই একটি মাত্র সুতোর ওপরে ঝুলছে সুবিশাল ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ। কে আগে পৌঁছোয়। গল্প নয়। আমাদেরই পূর্বপুরুষের অসাধারণ ইতিহাস।
বিদ্রোহী জোয়ানপুরের সাথে লড়ছেন ভারত সম্রাট দিল্লীশ্বর সুলতান। জয় পরাজয়ের সাথে জীবন, মান-সম্মান, দিল্লীর মসনদ, অনেক কিছুই জড়িত। মরণ কামড়ে লড়ছে জোয়ানপুরও। কিন্তু দু’দলেই এখন হতাশা আর ক্লান্তি। শুরু হবার পর চব্বিশটা বছর কেটে গেছে, যুদ্ধ চলছেই। কত আর পারা যায়। দু’দলই হন্যে হয়ে খুঁজছে একটা কিছু, একটা অলৌকিক কিছু, যা দিয়ে অন্তহীন একঘেয়ে যুদ্ধটা স্ফূলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে হঠাৎ বিজয়ে শেষ হবে। অসম্ভব একটা আশা।
বিস্ফোরণ হলো বাংলায়। ফিরে তাকাল ভারতবর্ষ। চমকে তাকালেন ভারত সম্রাট। চমকে তাকালেন জোয়ানপুরের নবাব। অবিশ্বাসে উঠে দাঁড়ালেন দু’দলের সেনাপতি। পাওয়া গেছে ! রাতের নক্ষত্র খচিত আকাশের মতো বহু বহু সামরিক প্রতিভায় ঝিকমিক আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষ, তার মধ্যে পূর্ণচন্দ্র নয়, একেবারে দোর্দণ্ড মার্তণ্ড প্রতাপে জ্বলে জ্বলে উঠছে কে ও ? শক্তির সম্ভারের, সমরনীতির সমস্ত হিসেব পায়ে দ’লে উঠে দাঁড়িয়েছে এ কোন্ কালাপাহাড় ! এই তো সেই অলৌকিক, চির বিজয়ের গর্বতিলক খচিত সেই উদ্ধতললাট। একেই তো চাই ! ছুটল জোয়ানপুরের দূত। ছুটলেন ভারতসম্রাটের দূত সৈয়দ।
বাংলার চিরকালের রাজশাহী, মান্দা এলাকা। তখনো ছিল, এখনো আছে। সেখানেই জন্মেছিল জেদি ছেলেটা। কালাচাঁদ রায়, ডাকনাম রাজু। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, ছোটখাটো জমিদারবংশ। মা-মাসী মিলে কত আদরে বড় করেছে বাপহারা কন্দর্পকান্তি ছেলেটাকে। বড়ই মাসী-ন্যাওটা ছেলে, মায়ের চেয়ে মাসীর কাছেই তার যত আদর কুড়োনো, যত দাবী দাওয়া। মাসীও রাজু বলতে অজ্ঞান। চলনে বলনে গঠনে রঙ্গে রূপে, শাস্ত্রজ্ঞানে, অস্ত্রশিক্ষায় অতি অসাধারণ সুকণ্ঠ সেই তরুণ বাংলার অধিপতি বুরবক শাহ-এর দরবারে চাকরি নিয়েই তরতর করে উঠে গেল উপরে। তারপরে এল সেই বাঁক।
যেখানে ঘটনা ঘটে। টলমল করে ওঠে জীবনের পা। বিধবা মিসেস সিম্পসনকে বুকে জড়িয়ে অবহেলায় অর্ধ-পৃথিবীর সিংহাসন ত্যাগ করে যান ইংল্যাণ্ডের সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ড। সুবিশাল চীন সাম্রাজ্য পায়ে ঠেলে নামহীন পতিতাকে নিয়ে গ্রামে সুখী জীবন কাটান সম্রাট শু-চি। প্রকাশ্যে, গোপনে, গড়ে ওঠে লক্ষশত ছোটবড় তাজমহল, সর্বদেশে, সর্বকালে।
প্রতি সকালে মহানন্দায় স্নান সেরে “সুকণ্ঠে স্তোত্র আবৃত্তি করিতে করিতে” ঘরে ফেরে সুদর্শন কালাচাঁদ। জানে না, ঠিক তখনই রাজপ্রাসাদের বাতায়নে, গবাক্ষে নির্ভুল এসে দাঁড়ায় কেউ। প্রতিদিন। সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ। দেবলোকে নৃত্যছন্দে মনোহর পেখম তুলে ধরে কার্তিকের ময়ূর। অতনু শরবিদ্ধা হন সপ্তদশী রাজকন্যা। খবর চলে গেল রাজা-রাণীর কানে। খুশিই হলেন তাঁরা। কালাচাঁদের তুলনা নেই। তাছাড়া, যোগ্য হিন্দু পাত্র ইসলাম গ্রহণ করে রাজপরিবারে বিয়ে করছে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।
ঘটল সেটাই যা আগে ঘটেনি। বিয়ের প্রস্তাবে কালাচাঁদের খুশি এবং কৃতজ্ঞ হাসি আশা করেছিলেন বঙ্গেশ্বর বুরবক শাহ। উল্টে বঙ্গেশ্বরের মুখের ওপর তেলেবেগুনে ফেটে পড়ল কালাচাঁদ। রাজ্য, রাজকন্যার লোভ দেখিয়ে ধর্মত্যাগ ! প্রশ্নই ওঠে না। অপমানে কালো হয়ে গেল বঙ্গেশ্বরের মুখ। বাধল বিরোধ। কথায় কথা বেড়ে গেল। সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা চলল, কিন্তু না। ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু মচকাবার পাত্র নয় দৃঢ়চেতা জেদী কালাচাঁদ। ক্রোধে ক্ষিপ্ত অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন অপমানিত বুরবক শাহ্। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে দিলেন। জনসমক্ষে প্রস্তুত করা হলো মৃত্যুবেদী। প্রস্তুত হলো ঘাতক। প্রস্তুত হলো কালাচাঁদ, থমকে গেল সময়। ঠিক তখনই অন্তঃপুরের পর্দা ছুড়ে ফেলে হাহাকারে ছুটে এলেন রাজকন্যা। দেহ পেতে দিলেন ঘাতকের খড়গের নিচে। গল্প নয়, স্বপ্ন নয়। স্তম্ভিত চেয়ে রইল কালাচাঁদ।
“ফুলশরের আঘাতে ধর্মবেদী বিদীর্ণ হইল, কালাচাঁদ বিবাহে সম্মত হইলেন।”
বিয়ের পরই অবধারিতভাবে ধর্মীয়-সামাজিক স্টীম রোলারের সামনে পড়ে গেল কালাচাঁদ। সব ধর্মের ফতোয়াবাজরা চিরকাল নিপীড়নের মাত্রাকেই সওয়াবের মাত্রা মনে করে। কত পণ্ডিত-মহাপণ্ডিতের কাছে ধর্ণা দিল, সবাই কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিল। দিশেহারা কালাচাঁদ ছুটে গেল উড়িষ্যায়, বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরে। মুখের ওপর দরজা বন্ধ হলো। ধর্মের বেদীমূলে ভালোবাসার আশ্রয় হলো না। মানবতার আশ্রয় হলো না জগন্নাথের কাছে। জেদী কালাচাঁদ মন্দিরের দ্বারে অনশন করে পড়ে রইল সাত-সাতটা দিন। অনাহারক্লিষ্ট সেই দুর্বল শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল পণ্ডিত পাণ্ডার দল।
তারপর।
শরবিদ্ধ ক্রৌঞ্চমিথুনে মহাদস্যু রত্নাকর হয়েছিলেন মহাঋষি বাল্মিকী। এখানে ঘটলো উল্টো। স্বধর্মের অত্যাচারে হারিয়ে গেল কালাচাঁদ রায় - রাজু। প্রতিশোধের রক্তচক্ষু মেলে উঠে দাঁড়াল ভয়াবহ কালাপাহাড়। ‘হিন্দু’ জিনিসটাকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলবে সে। এ নামে না থাকবে কোনো মূর্তি, না থাকবে পণ্ডিত-পাণ্ডা। রাজ্যবিস্তারের আশায় সৈন্য দিলেন বুরবক শাহ্। এরপর যে চিত্র ফুটে উঠল তা একদিকে যেমন উন্মাদ ধর্মবিকার, অন্যদিকে তেমনি শক্তির ভারসাম্যের সমস্ত হিসেব পায়ে দলে ক্রমাগত বিজয়ের অসাধারণ সামরিক প্রতিভা। কালাচাঁদ ততদিনে মুসলমান হয়েছে, নাম নিয়েছে মুহম্মদ ফরমুলি। সে বজ্র প্রথমেই ভেঙে পড়ল উড়িষ্যার ওপর।
জগন্নাথ মন্দিরের ওপর, পুরুত-পাণ্ডার ওপর। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সবকিছু। এরপরের কাহিনী, ক্রুদ্ধ এক কালবৈশাখীর সামনে একের পর এক রাজ্য উড়ে যাবার কাহিনী। হিন্দুর বিরুদ্ধে বল্গাহীন এক সৈন্যদল আর তার উন্মত্ত প্রতিভাবান সেনাপতি। আতংকিত জনগণের মুখে মুখে কালাচাঁদ হয়ে গেল কালাপাহাড়। খবর পৌঁছে গেল ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে - জোয়ানপুরের রাজার কাছে। দিল্লীশ্বরের কাছে। ছুটল জোয়ানপুরের দূত। ছুটলেন সৈয়দ। জোয়ানপুরের ওপর টেক্কা মেরে চিরবিজয়ের বরপুত্রকে বগলদাবা করে সম্রাটের সামনে হাজির করলেন সৈয়দ।
পত্রপাঠ প্রধান সেনাপতির পদ, চব্বিশ বছরের যুদ্ধ পত্রপাঠ বিজয়ে সমাপ্ত। অবিশ্বাসের চোখে বাঙালির দিকে তাকিয়ে আছে ভারতবর্ষ!
“জোয়ানপুর হইতে আসিবার মুখে তিনি সেই প্রদেশের নিকটবর্তী সমস্ত দেবতা ও দেবমন্দির ভগ্ন করিয়াছিলেন”। ফেরার পথে কাছেই পড়ল মন্দির নগর কাশী। আর যায় কোথায়। হিংস্র নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল কালাপাহাড়। “পাণ্ডারা ত্রাহি ত্রহি ডাক ছাড়িল...।“ রক্তাক্ত হয়ে গেল মন্দির নগর আর হিন্দু জনসাধারণ। আর তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই বিয়োগান্ত নাটক। স্বপ্ন নয়। গল্পও নয়।
পাগলিনীর মতো ছুটে আসছে স্খলিত বসনা নারী। ভারত-ত্রাস মহাবিদ্রোহী কালাপাহাড় উঠে দাঁড়াল বিদ্যুতাহতের মতো। কম্পিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠতে চাইল - “মা----সী!!!!!!!!!!!!!!!!”
আশৈশব বালকের সেই চিরনির্ভয় নির্ভর, সে আশ্রয় হাহাকারে ভেঙে পড়ল চোখের সামনে। হাতের বিষ ঢেলে দিল গলায়, কয়েকটা তীব্র মোচড় খেয়ে স্থির হয়ে গেল দেহ। আদরের রাজুর সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত অপমানিত আদরের মাসীর দেহ। দু’হাতে মুখ ঢাকা বিশাল কালাপাহাড় তখন থরথর করে কাঁপছে, তার সমস্ত শরীর যেন ভেতর থেকে একের পর এক বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
মরণ-ছোবলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত কালনাগ, - তার মনিবের ওপরেই।
"তিমির দিগ ভরি, ঘোর যামিনী"। আদিগন্ত অন্ধকার নিশ্চুপ। নিস্তব্ধ নিঝুম রাত, নিস্পন্দ নীরব। সব রকম অত্যাচার বন্ধ করবার অপ্রত্যাশিত আদেশে বিস্মিত বিহ্বল গোটা সেনাবাহিনী। সবার অলক্ষ্যে নিশ্চুপে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল কেউ। আকাশ থেকে তারারা দেখল, সাগর গিরি অরণ্যানী সবাই দেখল, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের বিস্ময় চির অপরাজিত তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ সমরবিদ, রাজশাহীর মান্দা এলাকার ছেলেটা ভারসাম্যহীন উদভ্রান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে...... অন্ধকারে একা.......গন্তব্যহীন......
এরপর তাকে আর কখনো দেখেনি কেউ, জীবিত বা মৃত।
(সূত্র : বৃহৎ বঙ্গ - ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন - উড়িষ্যার জনগণের মুখে মুখে এখনো কালাপাহাড়ের নাম আতংকের সাথে ফেরে)