বিমান নিয়েই শেষ যাত্রা

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০১৮, ১৬:২১

আফসোস আবিদ সুলতানের সাথে আর দেখাটা হলো না। আমার সাথে ওর কোনদিন সাক্ষাৎ হয়নি। সম্ভাবনা ছিল- কয়েকটা দাওয়াতে যেখানে আবিদ আমন্ত্রিত ছিলেন সেখানে আমিও ছিলাম। যেদিন আবিদ গেছেন সেদিন আমি যাইনি আর আর যেখানে আমি গেছি সেদিন হয়তো আবিদ অনুপস্থিত। বছর দশেক আগে এক শুক্কুরবার চট্টগ্রাম যাচ্ছি কাজে। কোরিয়ান এক কোম্পানির নিজেদের প্লেনে করে যাবো, ছোট ছোট দুইটা প্রাইভেট জেট আছে ওদের। আগের রাতে একটা পার্টিতে গেছি, কোথায় কোথায় কে যেন বললো, আরে, আবিদ তো সেই কোরিয়ান কোম্পানির একটা প্রাইভেট জেট চালায় এখন। ভাবলাম সকালে দেখা হবে। না, সকালে প্লেনে উঠে দেখি যিনি প্লেন চালাচ্ছেন তিনি আরেকজন। ইউএসবাংলার প্লেনে করে আমি কখনো বিদেশে যাইনি- কিন্তু দেশের ভিতরে এখানে সেখানে গেছি। চট্টগ্রাম গেছি, রংপুরের পাশে এয়ারপোর্টটা- সেখানে গেছি, কক্সবাজার গেছি। ওরা যখনই পাইলটের নাম বলে, কান খাড়া করে শুনি- না, আবিদ না বা কামাল না।

আবিদের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছেটা কেন ছিল? কারণ কয়েকজন বন্ধুর কাছে আবিদের কথা অনেক শুনেছি। এরা আবিদেরও বন্ধু আবার আমারও বন্ধু। আবিদ বিমান বাহিনীতে ছিল, সেখানে আমার বন্ধুরা ওর দুই এক বছরের সিনিয়র ছিল। আর আবেদিন ভাই আছেন, তিনি এয়ারফোর্সে ছিলেন না বটে, কিন্তু সেখানে ওঁর অজস্র বন্ধুরা ছিল। এদের সকলের কাছে কোন না কোন সময় এই প্রতিভাবান পাইলটের কথা শুনেছি। আকাশে ওড়া ব্যাপারটা নাকি ছিল আবিদের রক্তে। একজন জাত বৈমানিক- ওর মৃত্যুটাও সেই অর্থে ভালোই হয়েছে, বিমান নিয়েই শেষ যাত্রা।

কি শুনেছি আবিদের কথা? কেন ওর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা ছিল এতো?

এয়ারফোর্সে পাইলট হিসাবে আবিদ ছিল অসাধারণ। কিন্তু ঐ বিমান ওড়ানোটাই ছিল ওর দক্ষতা আর ওর প্যাশন আর ওর শখ আর ওর সবকিছু। সামরিক বাহিনীতে থাকলে নানারকম পরীক্ষা দিতে হয়, ট্রেইনিং নিতে হয়, সেসব পরীক্ষায় নিয়মিত পাস করতে হয়- কতকিছু। আবিদ নাকি সেইসব পরীক্ষা ফরিক্ষা কোনটাতেই খুব একটা ভাল ছিল না- ভাল ছিল শুধু বিমান নিয়ে আকাশে উড়াল দেওয়ার ব্যাপারে। আর ফ্লাইংটা ও এতো ভালো পারতো যে ওর বন্ধুরা আর সিনিয়ররা সকলেই মানত- ওরার ব্যাপারটা আসলেই আবিদের রক্তে। এটা ওর সহজাত দক্ষতা।

এক অর্থে আকাশে ওড়ার ব্যাপারটা আসলেই ওর রক্তে ছিল। ওর বাবা ছিলেন দ্বিতীয় রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পাইলট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমারু বিমান চালিয়েছেন। জাপানীদের দখলে থাকা বার্মায় আবিদের বাবা কয়েকটি অভিযানে অংশ নিয়েছেন, বোমা ফেলেছেন আকিয়াবে, আরাকানের বিভিন্ন জায়গায় মিলিটারি ইনস্টলেশনে- বার্মার বিভিন্ন জায়গায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন আবিদ- ঠিকই একদম সময়মতো এসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে ভালো পাইলট হিসেবে নাম করেছিল। শুনেছি প্লেন চালাতে পছন্দ করেলেও সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ইত্যাদি এগুলি সম্ভবত ওর সেরকম পছন্দ ছিল না। কি করেছিল জানিনা, উইং কমান্ডার হিসাবে প্রমোশনের আগেই আবিদ এয়ারফোর্স থেকে চলে আসে। এয়ারফোর্সে চাকরীতে ওর শেষ পদবী কি ছিল আমি জানিনা, মিলিটারিদের র‍্যাঙ্কগুলি ঠিকঠাক মনে রাখতে পারি না- যতটুকু জানি উইং কামান্ডার হবার আগেই চাকরী শেষ।

উইং কমান্ডার ব্যাপারটা মনে আছে কেন? গল্প শুনেছি যে চাকরী থেকে চলে আসার পর ওর বাবা নাকি আবিদকে বলছিল, 'চাকরীতে ঠিকঠাকমতো থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই উইং কমান্ডার হয়ে যেতে আমি বটে পারতাম যে...', আবিদ নাকি বাবাকে বলেছিল, 'আপনি আমার হিরো, আপনি তো উইং কমান্ডার হবার আগেই অবসর পেয়ে গেছেন, আমি কি করে আপনার চেয়ে উপরের র‍্যাঙ্কে যাই'। সত্যি কিনা জানিনা।

গতকাল যখন কাঠমান্ডুর দুর্ঘটনার খবরটা পাই, প্রথমেই ফোন করেছিলাম সাইফুল্লাহকে। সাইফুল্লাহ তো পাইলট হিসাবে অনেক সিনিয়ার, এয়ারফোর্সে ছিল আগে, এখন একটা বেসরকারি এয়ারলাইনের ফ্লাইট অপারেশন পরিচালক। নিজেও ফ্লাইট করে। সাইফুল্লাহকে আর ফোনে পাই না। গুরুত্বপূর্ণ লোক- বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, নিশ্চয়ই ব্যাস্ত। ওকে ফোনে পেলাম রাতের বেলা। দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। আর জানতে চাইলাম আবিদ কেমন আছে। সাইফুল্লাহ জানালো আবিদ মারা গেছে। কিন্তু টেলিভিশনের স্ক্রলে তখনো দেখাচ্ছে পাইলট জীবিত আছে, ফার্স্ট অফিসার মারা গেছে! সাইফুল্লাহকে ধমক দিলাম, শালা তুই বাজে কথা বলিস। সাইফুল্লাহ কি একটু দ্বিধান্বিত? কিন্তু সে নাকি খবর পেয়েছে আবিদ আর নেই। আমার মতো হয়তো সাইফুল্লাহও বিশ্বাস করতে চাইছিল যে আবিদ বেচে আছে।

সকাল বেলা খবর এসেছে আবিদ আর নেই। যে প্রাণচঞ্চল বৈমানিকটির অনেক গল্প শুনেছি এতদিন সে আর নেই। যতবার আবেদিন ভাইয়ের কাছে ওর গল্প শুনেছি, ভেবেছি যে না, এর পরের সুযোগেই ছেলেটির সাথে দেখা করতে হবে- ওর সাথে আর দেখা হবে না।

দুর্ঘটনাটা কেন হয়েছে কিভাবে হয়েছে, কে দোষী, দায়টা কার এগুলি চট করে বলা কঠিন। আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষের জন্যে তো প্রায় অসম্ভব আরকি। এইসব নির্ধারণের জন্যে বিশেষজ্ঞ লোকজন আছে। আর অনেক সময়ও নাকি লাগতে পারে দুর্ঘটনার পুরো বৃত্তান্ত নির্ভুল জানতে। আমরা নিশ্চয়ই একদিন জানবো কেন কিভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেই থেকে সকলের শিক্ষা হবে- ভবিষ্যতে বিমান নিরাপত্তার জন্যে এই অভিজ্ঞতাও হয়তো কাজে লাগবে। কিন্তু যেসব মানুষ আজকে প্রাণ হারিয়েছে- যেসব জীবনের অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি ঘটেছে- সেসব জীবন তো আর ফিরে আসবে না। এত বড় মানবিক বিপর্যয়- এতো বড় মানবিক বিপর্যয়- আমাদের সবাইকে, বাংলাদেশের আর নেপালের সব মানুষকে গভীর শোকের মধ্যে ডুবিয়ে গেল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ