এইদিনে রাউফুন বসুনিয়াকে মনে পড়ে

প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০১৯, ১৫:২২

অবিভক্ত ভারতের জেলা কোচবিহারের দীনহাটায় জন্ম নেওয়া মানুষটি সেনাপ্রধান ছিলেন, প্রেসিডেন্ট ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ছিলেন, বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন কিন্তু সকল পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি কবি হয়ে উঠতে চাইতেন। একজন রাষ্ট্রপতির এমন প্রাণপণ কবি হওয়ার প্রচেষ্টা দেখলে বুঝা যায় ওইসব কোন পরিচয়ই টেকসই নয়। খুব সাময়িক। খুব ক্ষণস্থায়ী। মানুষের মৌলিক সৃষ্টিই অমর। শিল্পস্রষ্টাকে বাঁচিয়ে রাখে। ঠাই করে দেয় মহাকালের নির্মোহ সোনারতরীতে। মাত্র দিন তিনেক আগেও এরশাদের ঢাউস সাইজের জীবনী দেখছিলাম।

বাংলাদেশের রাজনীতি, এ অঞ্চলের মানুষের মন ও মনস্তত্ত্ব বুঝার জন্য এরশাদ অনেক বড় ‘পলিটিক্যাল স্যাম্পল/কারেক্টার’ হয়ে থাকবেন। তাঁর মত সফল স্বৈরাচার পৃথিবীর রাজনীতির ইতিহাসে বিরল। একই চরিত্রে এতো বিপুল বৈচিত্র্য সহজে চোখে পড়ে না। ক্ষমতার বাই প্রোডাক্ট হিসেবে জেনারেলের সুন্দরী নারীসঙ্গ, মদ; মার্কসীয় তত্ত্বে বেবাক জনগণের আফিম হিসেবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সচেতনভাবে ধর্মচর্চার নিবিড় সংস্রব সবই করেছেন তিনি। নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সেও দুর্দান্ত প্রেমিক ছিলেন। নারীসঙ্গ উপভোগ করতেন। সুন্দরী সুশ্রী বিদিশাদের নিশা ছিল প্রবল। প্রবল ছিল ক্ষমতার প্রতি মোহও। রংপুরের এক আইনজীবীর সন্তান তাই ক্ষমতার পাদপ্রদীপে থাকার জন্য একসময় ছিলেন বেপরোয়া, জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ছিলেন মরিয়া। অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় রাজনীতিতে একটা অনস্বীকার্য আবেদন ছিল। ফলে কেউ তাকে অস্বীকার করতে পারেন নি। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনই সম্মিলিতভাবে নব্বইয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক জমানায় তাকে কাছে টেনেছেন।

গল্পটা ছোটবেলায় শোনা। নব্বইয়ে দেশব্যাপী প্রবল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এরশাদ জেলে। খালেদা জিয়ার আমল। তিনি নাকি জেলে একটা বরই গাছ রোপন করলেন। একদিন খালেদা জিয়াকে জেলে বরই খাওয়াবেন বলে। আইরনি অব ফেইট মনে হয় একেই বলে, সে সময়ের ক্ষমতাসীন খালেদা জিয়া আজ সত্যিই জেলে। সত্যি সত্যি সে বরই গাছের অস্তিত্ত্ব আছে কিনা জানি না। তবে পল্লীবন্ধু কবি আলহাজ্ব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাগ্যবান ও সফল(!) রাজনীতিবিদ তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যথেষ্ট পরিণত বয়স ও স্বাভাবিক মৃত্যুর দিয়েও তিনি সেটা প্রমাণ করলেন। বলা হয়, দেশে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিশেষ করে দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক পাপ সব ম্লান করে দিয়েছে। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ শেখায় - মৃত্যুর পর কারও সমালোচনা না করা। কিন্তু তিনি আরও আট দশজন মানুষের মত ছিলেন না। ছিলেন আমাদের রাজনীতির আলোচিত চরিত্র। তাঁর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর দেশ ও মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হত। তাই তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। সঙ্গতকারণেই আলোচনা সমালোচনা চলবে। 

তবু তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি শহীদ নূর হোসেনসহ জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ নাম না জানা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অনেক শহীদের। বিশেষ করে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি স্বৈরাচারের আতঙ্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান শেষ বর্ষের ছাত্র রাউফুন বসুনিয়ার। উত্তরবঙ্গের জেলা কুড়িগ্রামের রাজারহাটের প্রত্যন্ত এক গ্রাম পাইকপাড়ার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের সন্তান ছিলেন বসু। ছিলেন বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। পহেলা ফাল্গুন। তাঁর রক্তে লাল হয়েছিল ক্যাম্পাস। রক্ত রঙের শিমুল ফুলও ফুটে ছিল সেদিন ক্যাম্পাসজুড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মহসিন হলের গেট সংলগ্ন রাউফুন বসুনিয়া স্মরণে নির্মিত তোরণের দিকে রোজই তাকাতাম। দেখতাম শোকার্ত কালো অক্ষরে উৎকীর্ণ আছে বিচিন্তা সম্পাদক মিনার মাহমুদের লেখা সেই আলোচিত বিস্মৃত কবিতা, 
"তোমার মৃত্যুতে পৃথিবীর তিন ভাগ জল অশ্রু হয়ে গেছে/
রাজপথ হয়েছে সাহসী মিছিল।"
এরশাদের চলে যাওয়ার দিনে সেই রাউফুন বসুনিয়ার কথাও তো মনে পড়ে।

আলমগীর শাহরিয়ার, লেখক ও গবেষক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ