বোহেমিয়ান লাল মিয়ার সন্ধানে

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৯, ১৬:৪৩

“আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলছি৷ আমার সকল চিন্তা, সবটুকু মেধা, সবটুকু শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করি তা কেবল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য। আমার ছবির মানুষেরা, এরা তো মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে স্ট্রাগল করেই এরা বেঁচে থাকে এদের শরীর যদি শুকনো থাকে, মনটা রোগা হয়, তাহলে এই যে কোটি কোটি টন মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুসকল আসে কোত্থেকে? ওদের হাতেই তো এসবের জন্ম শুকনো, শক্তিহীন শরীর হলে মাটির নিচে লাঙলটাই দাব্বে না এক ইঞ্চি আসলে, মূল ব্যাপারটা হচ্ছে এনার্জি, সেটাই তো দরকার ঐ যে কৃষক, ওদের শরীরের অ্যানাটমি আর আমাদের ফিগারের অ্যানাটমি, দুটো দুই রকমওদের মাসল যদি অতো শক্তিশালী না হয় তাহলে দেশটা দাঁড়িয়ে আছে কার উপর ওই পেশীর ওপরেই তো আজকের টোটাল সভ্যতা

বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের উক্তিটি দিয়ে শুরু করে, একটা ধারণা দিয়েই আমার এই লেখা শুরু করতে হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য নাম এস এম সুলতান। পুরো নাম শেখ মোহম্মদ সুলতান হলেও তিনি এস এম সুলতান নামেই বিশ্বখ্যাত। বাবা শেখ মোহম্মদ মেসের আলী ছেলের নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া। লাল মিয়ার জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট, মাছিমদিয়া, নড়াইল, ব্রিটিশ ভারত বর্তমান বাংলাদেশে। নড়াইলের কোলজুড়ে রয়েছে খরস্রোতা অপরূপ এক নদী, চিত্রা। সেই চিত্রার সঙ্গে একসাথেই বেড়ে উঠেন লাল মিয়া। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। অবধারিতভবে তাঁকে বিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো সামর্থ্য দরিদ্র পিতার ছিল না। তবুও বহু কষ্টে মেসের আলি তার সন্তান লাল মিয়াকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করান। এস এম সুলতান এখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। এরপর স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরে বাবার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। রাজমিস্ত্রীর কাজ করার পাশাপাশি তিনি সেই দালানগুলোর ছবি আঁকতেন। ১০ বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময় ড. শাম্যপ্রসাদ মুখার্জ্জী স্কুল পরিদর্শনে এলে তাঁর আঁকা ছবি দেখে প্রশংসা করেছিলেন।

S M Sultan's Art work

গ্রাম্য কৃষককে পেশীবহুল করে দেখিয়েছেন সুলতান। (ছবি-সংগৃহিত)

লাল মিয়া ওরফে সুলতানের বাল্যবয়সের চরিত্র-গঠন সম্পর্কে আহমদ ছফা লিখছেন:

“কোনো কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ যাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এরকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বাভাবিক আকুতি। …শেখ মুহাম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দূর্ভাগ্যের বরে অভিশপ্তও।”

লাল মিয়ার খুব ইচ্ছা ছিলো ছবি আঁকা শিখবেন, এজন্যে দরকার হলে কলকাতায় যাবেন। কিন্তু এরকম আর্থিক সঙ্গতি তাঁর পরিবারের কখনোই ছিলো না অতঃপর তাঁর এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। জমিদারের সাহায্য নিয়ে সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান।

S M Sultan With Ahmad Chafa & Samsur Rahman

চিত্রসাধক এস এম সুলতানের সাথে সাহিত্যিক আহমদ ছফা ও কবি শামসুর রাহমান। (ছবি-সংগৃহিত)

লাল মিয়া কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা তার ছিলো না। কলকাতায় গিয়ে অর্থ উপার্জনের কোনো চেষ্টা করার পাশাপাশি চিত্রশিল্পের শিক্ষা চালিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিলো লাল মিয়ার। এইজন্য প্রথমে ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের কলকাতার বাড়িতে উঠেন। পরবর্তীতে তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সোহরাওয়ার্দী, সুলতানকে সব ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন এবং তাঁর গ্রন্থাগার সুলতানের জন্য সব সময় উন্মুক্ত ছিলো। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় সব যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় তিনি ভর্তি হতে পেরেছিলেন। শাহেদ সোহরাওয়ার্দী তখন তার লাল মিয়া নাম পাল্টে এস এম সুলতান (শেখ মোহাম্মদ সুলতান) রাখেন। এখানে তিন বছর পড়াশোনা করেন এবং পাশ করে তিনি ফ্রিল্যান্স চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। আর্ট স্কুলে পড়লেও সেখানকার বাঁধাধরা জীবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার কঠোর রীতিনীতি তাঁর জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলোনা। তিনি সবসময় ছিলেন বোহেমীয় জীবনাচারের অনুসারী।

S M Sultan's Art Work 2

সুলতানের শিল্প সাধনা সম্পর্কে আহমদ ছফা বলেন:

“সুলতানকে বাংলার প্রকৃতিতে, বাংলার ইতিহাসে এবং বাংলার মানুষের শ্রম, ঘাম, সংঘাতের ভেতর  সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করার জন্য পাড়ি দিতে হযেছে দুস্তর পথ, পেরিয়ে আসতে হয়েছে সাধনা ও নিরীক্ষার অনেক গুলো পর্যায়। তার ব্যক্তি জীবন এবং শিল্পী জীবনের সমান্তরাল যে অগ্রগতি তাও কম বিস্ময়কর নয়।”

মননে, মগজে সুলতান ছিলেন ব্যক্তিস্বাধীন এবং প্রকৃতিগতভাবে ভবঘুরে এবং ছন্নছাড়া। প্রকৃতিকে সবসময় রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন একই সাথে যান্ত্রিক নগর জীবনকে ঘৃণা করেছেন। ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর অব্যবহিত পরেই বেরিয়ে পড়েন এবং উপমাহাদেশের পথে পথে ঘুরে তাঁর অনেকটা সময় কেটে যায়। তখন ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাই অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্য ছিলো ভারতবর্ষে। তিনি ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকে তা সৈন্যদের কাছে বিক্রি করতেন। এভাবেই জীবনধারণ করেছেন অবশ্য মাঝে মাঝে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি শিল্পী হিসেবে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু সুলতানের চরিত্রে পার্থিব বিষয়ের প্রতি যে অনীহা এবং যে খামখেয়ালীপনা ছিলো তাঁর কারণে সেই ছবিগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সেগুলোর কোনো আলোকচিত্রও এখন পাওয়া যায় না। এছাড়া তিনি কখনও এক জায়গায় বেশি দিন থাকতেন না। তিনি যখন শ্রীনগরে অবস্থান করছেন তখন পাকিস্তান সৃষ্টি হলো আর তিনি ‘৪৮-এ সেখান থেকে ফিরে এলেন। কোনো জিনিসই তো সেখান থেকে আনতে পারেননি। একটা কনভয় সবাইকে এনে পাকিস্তান বর্ডারে ছেড়ে দিয়ে গেল। তাঁর সমস্ত কাজগুলোই সেখানে রয়ে গেলো যা তিনি সেখানে থাকাকালে এঁকেছিলেন।

১৯৪৬ সালে সিমলায় তাঁর আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিলো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষ পাকিস্তান ও ভারতে বিভক্ত হলে এস এম সুলতান কিছু দিনের জন্য নিজ দেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এখানে কিছুদিন থেকেই করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলের শিল্প শিক্ষক হিসেবে দুই বছর চাকুরি করেন। সেখানে চাকুরিরত অবস্থায় তাঁর সাথে পরিচয় হয় চুঘতাই এবং শাকের আলীর মত বিখ্যাত শিল্পীদের। এর কিছু আগে ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো এবং বোস্টনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। এরপর লন্ডনেও তিনি প্রদর্শনী করেন।

দেশ-বিদেশের খ্যাতি তাকে গ্রাম থেকে দূরে রাখতে পারেনি। তার চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল ভিন্ন আঙ্গিকের। তিনি শহর আঁকতেন না। তথাকথিত আধুনিক চিত্রকলার অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ধরন তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি সেভাবেই ছবি এঁকেছেন যা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। তিনি আঁকতেন মানুষ, কৃষক, নারী, শিশু, গাছপালা, গ্রামের দৃশ্য এসব। তাঁর ছবি দেখলেই বোঝা যায় প্রকৃতির প্রতি তাঁর সমর্পণ কেমন ছিল।

শিশুদের ছবি আকার প্রতি আকৃষ্ট করতে এই নৌকা তৈরী করেছিলেন সুলতান।(ছবি-সংগৃহিত)

তাঁর কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা কেমন ছিলো তা বলতে গিয়ে লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখছেন:

“তার কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি। তার আধুনিকতা ছিল জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তার কাছে ছিল ‘আধুনিকতা’, অর্থাৎ তিনি ইউরোকেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।”

১৯৫৩ সালে সুলতান আবার নড়াইলে ফিরে আসেন। এবার এসে তিনি শিশু শিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করেন যা নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিলো। শেষ বয়সে তিনি নড়াইলে শিশুস্বর্গ এবং চারুপীঠ নামে দুটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এছাড়া সেখানে “নন্দন কানন” নামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং “নন্দন কানন স্কুল অব ফাইন আর্টস” নামে একটি আর্ট স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন এবং অনেকটা সময় তাঁর নড়াইলেই কেটে যায়।

S M Sultan Art Work 8

সুলতানের আঁকার ধরন ছিল বৈচিত্র্যতা। তার হাতে গ্রামের কৃষক, তাদের স্ত্রী সন্তান সন্ততি এমনকি কোনো পোষাপ্রাণী পর্যন্ত হয়ে উঠতো সাধারণের চেয়ে অনেক বড়। পেশীবহুল পুরুষ এবং স্বাস্থ্যবান নারী তার ছবিতে ফুটে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে কৃষকরা সুবিধা বঞ্চিত। তারা কৃশকায়, তাদের বলদগুলোও কৃশকায়। তাই সুলতান তার কল্পনায় তাদেরকে বলশালী করেছেন। কারণ দেশ গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে কৃষকেরা।  তিনি তাঁর চিত্রকলার এই ধরন সম্বন্ধে তিনি বলেন-

“আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃশকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো- সেগুলোও রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার কল্পনার ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি সেভাবেই তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের এই কৃষক সম্প্রদায়ই একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিল। দেশের অর্থবিত্ত এরাই যোগান দেয়। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়। ওদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিত।”

সুলতানের ছবিতে গ্রামীণ রমণীদের দেখা যায় সুডৌল ও সুঠাম গড়নে। নারীর মধ্যে উপস্থিত চিরাচরিত রূপলাবণ্যের সাথে তিনি শক্তির সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। একই সাথে তাঁর এ ছবিগুলোতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ক্রুর বাস্তবতা উঠে এসেছে। তাঁর এরকম দুটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে: হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) এবং চরদখল(১৯৮৮)। ১৯৭৬ সালে তাঁর আঁকা শিল্পকর্ম নিয়ে শিল্পকলা একাডেমীর প্রদর্শনীতে তাঁর ছবির মহিমা নতুন করে প্রস্ফুটিত হয়। এই ছবিগুলোর মধ্যে দেখা যায় বিশ্বের কেন্দ্র হচ্ছে গ্রাম আর সেই কেন্দ্রের রূপকার কৃষককে আপন মহিমায় সেখানে অধিষ্ঠিত দেখা যায়। গ্রাম ও গ্রামের মানুষ ছিলো তাঁর শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা আর উপকরণ ছিলো কৃষক এবং কৃষকের জীবন চেতনা। এস এম সুলতান তেলরঙ এবং জলরঙ-এ ছবি আঁকতেন। আঁকার জন্য তিনি একেবারে সাধারণ কাগজ, রঙ এবং চটের ক্যানভাস ব্যবহার করতেন। এজন্য তাঁর অনেক ছবিরই রঙ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, যদিও এসবের প্রতি তিনি তেমন ভ্রুক্ষেপ করতেন না। এস এম সুলতান আধুনিকতার একটি নিজস্ব সংজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর তেমন কোনো অনুসারী ছিলো না যারা একই সংজ্ঞা মেনে শিল্পচর্চা করতেন। একারণেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত আধুনিকতার স্বরূপ নিয়ে নতুন কোনো ধারার সৃষ্টি হয়নি। কেউ তাঁর মতো করে আধুনিকতার ব্যাখ্যাও দেননি। এছাড়া তাঁর মতো মাটির জীবন তখনকার কোনো শিল্পী যাপন করেননি।

S M Sultan Art Work 3

সুলতানের ছবিতে গ্রাম্য নারী (ছবি-সংগৃহিত)

ঢাকায় আধুনিক চিত্রশিল্পের বিকাশের সময়টায় তিনি প্রায় সকলের অজ্ঞাতেই ছিলেন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি শিল্পরসিকদের চোখের আড়ালেই থেকে যান। সত্তরের দশকের মধ্যভাগে তাঁর কিছু শুভানুধ্যায়ী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি কিছু ছবি আঁকেন। তাঁর আঁকা সেসব ছবি নিয়ে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমেই তিনি নতুন করে শিল্পসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। অবশ্য আশির দশক থেকে তিনি আবার নড়াইলেই বাস করতে থাকেন। তাঁর কাছে যেসব মানুষ এবং শিশু আশ্রয় নিয়েছিলো তাদের জন্য তিনি নিজের ঘর ছেড়ে দেন। জীবজন্তুর প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি একটি চিড়িয়াখানা তৈরি করেন এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে শিশুদের জন্য সুন্দরী কাঠ দিয়ে একটি বড় আকারের নৌকাও তৈরি করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিলো শিশুরা সেই নৌকায় চড়ে সমুদ্র পরিভ্রমণে বের হবে আর শিল্পচর্চার উপকরণ খুঁজে পাবে।

শিল্পী এস এম সুলতান  এভাবে হয়ে ওঠেন অন্য এক মাত্রার অনন্য শিল্পী। বাঙালির একান্ত নিজস্ব ঘরানার শিল্পী। সাহিত্যিক আহমদ ছফা এজন্য শিল্পী এস এম সুলতান কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে  লিখছেন:

“সুলতানের কৃষকেরা জীবন সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশির শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গম করে প্রকৃতিকে ফলে –ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে। এইখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা. আকাঙ্খা এবং স্বপ্ন, আজ এবং আগামীকাল একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে। সুলতানের কৃষকেরা নেহায়েত মাটির করুণা কাঙাল নয়। রামচন্দ্র যেমন অহল্যা পাষাণীকে স্পর্শ করে মানবী রূপদান করেছিলেন, তেমনি তার মেহনতি মানুষদের পরশ লাগা মাত্রই ভেতর থেকে মাটির প্রাণ সুন্দর মধুর স্বপ্নে  ভাপিয়ে উঠতে থাকে। এ মানুষগুলো পাখা থাকলে দেবদূতের মতো  আকাশের অভিমুখে উড়াল দিতে পারতো। কিন্তু একটি বিশেষ ব্রতে,  একটি বিশেষ অঙ্গিকারে আবদ্ধ বলেই তারা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে আছে। সে অঙ্গিকারটি, সে ব্রতটি মাটিকে গর্ভবতী ও ফসলশালিণী করা।  মাথার উপরে স্বর্গলোকের যা কিছু প্রতিশ্রুতি, যা কিছু প্রেরণা তার সবটুকু আকাশে নীল থেকে, রামধণু বর্ণের সুষমা থেকে ছেঁকে এনে মাটির ভেতরে চারিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই মানুষ-মানুষীর দল।” 

এ অনন্য সাধারণ শিল্পী ও শিল্পীর সাধনাকে  অনুভব করতে হলে আহমদ ছাফা’র আরো একটি মূল্যায়ন মনে রাখা জরুরী:

“শেখ সুলতানের মধ্যে দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ শিল্পীর প্রকান্ড কল্পনা এবং কল্পনার বলিষ্ঠ চাপ এত গভীর এবং অনপনেয় যে মনে হবে এ চিত্রসমূহ, কোনোরকমের মধ্যবর্তিতার বালাই ছাড়া, সরাসরি রেনেসাঁস যুগের চেতনার বলয় থেকে ছিটকে  পড়ে এই উনিশ শ’ সাতাত্তর সালে বাংলাদেশের কৃষক সমাজে  এসে নতুন ভাবে জন্মগ্রহণ করেছে। এই ছবিগুলো আঁকার মত মানসিক স্থিতাবস্থা অর্জন করার জন্য শেখ সুলতানকে সব দিতে হয়েছে। পরিবারের মায়া, বংশধারার মধ্যদিয়ে নিজের অস্তিত্বকে প্রবাহিত করার স্বাভাবিক জৈবিক আকাঙ্খা ভেতর থেকে ছেঁটে দিয়ে, এই চিত্র সন্তান জন্ম দেয়ার একাগ্রপ্রায় কাপালিক সাধনায় নিযুক্ত থাকতে হয়েছে সারাজীবন। শেষ পর্যন্ত অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। বাংলার শিল্পীর হাত দিয়ে বাংলার প্রকৃতি এবং  বাংলার ইতিহাসের একেবারে ভেতর থেকে রেনেসাঁস যুগের ফুল ফুটেছে। 

এইখানে সুলতানের অনন্যতা। এই খানে বাংলার কোন শিল্পীর  সঙ্গে ভারতবর্ষের কোন  শিল্পীর সঙ্গে সুলতানের তুলনা চলে না। অবনীন্দ্রনাথ,যামিনী রায়, নন্দলাল, জয়নুল অবেদীন, আবদার রহমান চাঘতাই, নাদী, এ সকল দিকপাল শিল্পীর মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক, তবু সকলের মধ্যে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র অবশ্যই রয়ে গেছে। হ্যাভেল ভারতীয়  শিল্পদর্শনের যে সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, কেউ তার আওতা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি একমাত্র সুলতান ছাড়া।”

SM Sultan Art Work 4

এস এম সুলতান শুধু বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী’ই নন, তাঁকে বিশ্বজুড়ে কাল্পনিক কৃষিসভ্যতার জনক বলা হয়। তিনি জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই খেটে খাওয়া কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তাঁর চিত্রকর্মে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির সংগ্রামীরূপ ফুটে উঠেছে শিল্পীর নিজের একান্ত নিজস্ব মহিমায় ও স্বকীয়তায়। তাঁর ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার জীবনকে কৃষি এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি শেষ জীবনে তার পরিপূর্ণতা নিয়ে এইভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন-

“আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।”

বাংলার গ্রামীণ জীবনকে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু করার মূলে রয়েছে এই জীবনের প্রতি তাঁর প্রচন্ড আকর্ষণ, সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভালবাসা। রং-তুলি সেখানেই সক্রিয়, প্রাণবন্ত, যেখানে চাষা লাঙ্গল গরু নিয়ে জমিতে যাচ্ছে, শক্ত হাতে হাল বইছে, কাস্তে হাতে ধান কাটছে, জাল দিয়ে মাছ ধরছে, মাঝি পাল তুলে ভাটিয়ালী গাইছে, পল্লীবধূ ধান ভানছে, শাপলা তুলছে, এইসব কিছুই তাঁর ছবির উপকরণ। তাঁর ছবিতে কোন কৃত্রিমতার ছাপ নেই, নেই কোন বিদেশী উপকরণ। এমনকি একাত্তরের যুদ্ধের ছবিতেও কোন বিদেশি বন্ধুক, রাইফেল, মেশিনগান স্থান পায়নি। সেখানেও কৃষক শ্রমিকের হাতে বল্লম, শড়কি, রামদা, ঢাল দিয়েই সংগ্রামের ছবি এঁকেছেন তিনি।

সুলতানের চিত্রকর্ম’র মধ্যে জমি কর্ষণ-১, জমি কর্ষণ-২ (তেল রং ১৯৮৬, ১৯৮৭), হত্যাযজ্ঞ (তেল রং ১৯৮৭), মাছ কাটা (তেল রং ১৯৮৭), জমি কর্ষণে যাত্রা-১ এবং ২ (তেল রং ১৯৮৭, ১৯৮৯), যাত্রা (তেল রং ১৯৮৭), ধান মাড়াই (তেল রং ১৯৯২), গাঁতায় কৃষক (তেল রং ১৯৭৫), প্রথম বৃক্ষ রোপন (তেল রং ১৯৭৬ ), চর দখল (তেল রং ১৯৭৬) পৃথিবীর মানচিত্র (তেল রং) উল্লেখযোগ্য ।

SM Sultan Art Work 5

তিনি ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫১ সালে নিউইয়র্কে, ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন৷ এছাড়াও ১৯৮১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক জুরী কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হন। তিনি ১৯৮২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৮২ সালে তাঁকে এশিয়ার ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি তাঁকে আবাসিক শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৬ সালে চারুশিল্পী সংসদ শিল্পী এস এম সুলতানকে সম্মাননা প্রদান করে। ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সাত বছর ধরে সুলতানের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয় আদম সুরত। তারেক মাসুদের প্রযোজনা এবং পরিচালনায় এই প্রামাণ্যচিত্রে সুলতানের দৈনন্দিন কর্মজীবন তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষিচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।

আশির দশকের শেষদিকে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বিকেল ৪ টা ৩৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ রেখে যান তার সৃষ্টির অনবদ্য আখ্যান সমূহ। তার আঁকা ছবি শুধু ছবি হিসেবেই নয়, একটা গভীর আদর্শের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়। যেখানে আছে মানবিক বোধের শ্রেষ্ঠ উপাদান, ভালোবাসা।

তথ্যসূত্র:
ইস্টিশন ব্লগ
আদমসুরত ডকু ফিল্ম (তারেক মাসুদ)
বাংলার চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা- আহমদ ছফা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ