রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির গেরাকলে পাহাড়ের ভিন্ন ভাষাভাষী শিক্ষার্থী

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০১৯, ১১:৩৪

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামরিক শাসক আয়ুব খানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় অপ্রসাঙ্গিক ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা সংকোচন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছরে বছরে পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধি প্রস্তাবনা অন্যতম। পরবর্তী ছাত্র আদোলনের হাত ধরে নীতিমালা বন্ধ করো দেওয়া হয়। ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারন ছিল শিক্ষার সংকোচন অবস্থা থেকে মুক্তি এবং শিক্ষাকে সার্বজনীন করা।

এবার আসা যাক বর্তমান শিক্ষার অবস্থার দিকে। বর্তমান সময়ে শিক্ষা চলছে ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। যেখানে বাম ছাত্র সংগঠন গুলো একই ধারার শিক্ষানীতি দাবী করে আসলেও সরকার কর্ণপাতে নারাজ। ভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার কারনে রাষ্ট্রীয় যে মূল ধারার শিক্ষানীতি সেখানে রয়েছে এক বিশাল গলদ। এই গলদের মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এবং একূল না অকূল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে পাহাড়ের বিভিন্ন ভাষাবাসী সংখ্যায় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী গুলোকে।

চলমান স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য এটি সাম্প্রতিককালের সর্বোচ্চ বরাদ্দ। গত বছর শিক্ষাখাতের বাজেট ছিল ৫৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। শিক্ষাখাতে বাজেট প্রতি বছর বাড়বে এইটায় স্বাভাবিক কিন্ত দেখার বিষয় জাতীয় বাজেটের কত শতাংশ বেড়েছে। প্রতি বছরেই জাতীয় বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে বিদ্যমান যা থাকার কথা ২০ শতাংশ। অথচ দক্ষ জনশক্তি এবং সত্যিকারের উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরীত হচ্ছে শিক্ষার বিকল্প নেই। যেখানে আমাদের দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকার কথা সেখানে আমাদের আছে ২ শতাংশ বরাদ্দ এই হলো শিক্ষাখাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ। এর পরেও কথা থেকে যায়, এই বরাদ্দ গুলো কোন খাতে কিভাবে কোথায় যাচ্ছে এইটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এ বছরে এইচএসসি শিক্ষার ফলাফলে পার্বত্য জেলা গুলোতে ফলাফলের ধস, যেখানে একটা বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী হলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং ভিন্ন ভাষাবাসী। জিপিএ ফাইভের যুগে এসেও এই তিন জেলায় সর্বমোট জিপিএ ফাইভ পেয়েছে মাত্র ৪৪ জন। পাশের পরিমাণ ৪৫.৯৯% রাঙামাটিতে, ৩৬.৫১% খাগড়াছড়িতে ৬২.৩১ বান্দরবানে যেখানে মোট পাশের পরিমান ৭৩.৯৩%। সম্প্রতি ইংরেজী দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পার্বত্য জেলা গুলোর ২১০ স্কুলের শিক্ষকরা ৫ বছর ধরে কোনো বেতন বাতা পাচ্ছেন না যেখানে শিক্ষার্থীর পরিমাণ ১২০০। সাথে রয়েছে ক্লাস রুম সংকট, মান সম্পন্ন পাঠ প্রদান করতে পারা দক্ষ শিক্ষক স্বল্পতা এবং দমন মূলক টুরিজম ব্যবস্থা (যেসকল ট্যুরিস্টরা সাজেক, আলুটিলা, নীলগিরি, মেঘলা, নীলাচল এসব জায়গায় যাওয়ার পথে পড়া পাহাড়ি গ্রাম গুলোর ছোট বাচ্চাদের গাড়ি থেকে ১টা চকলেট ঢিল ছুড়ে মারে, বিনিময়ে ২টা গান গাওয়ায়, ৫০,১০০ টাকায় গাইড বানায় সেখানে আর বুঝে উঠতে না পারা বাচ্চা গুলোর মধ্যে শিক্ষা ওভাবে পৌঁছাতে পারে না)।

বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শিক্ষা পণ্যে রুপান্তরিত হয়েছে। টাকা যার শিক্ষা তার এই নীতিতে শিক্ষা বিক্রি হচ্ছে সেই নীতির গেরাকলে আটকে গিয়েছে দেশের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ গুলো এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠী গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী গুলো নিজ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রক্রিয়া চালুর দাবী জানালেও রাষ্ট্র রয়েছে কর্ণপাতহীন অবস্থায় এবং যে কয়েকটা জাতি গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হলেও তা চলছে ধীর গতিতে। অথচ আইএলও আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন ১৯৫৭ ও ১৯৮৯ এর ২৮ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা আছে, এই জনগোষ্ঠীর শিশুদের তাদের নিজস্ব আদিবাসী ভাষায় অথবা তাদের জনগোষ্ঠী কর্তৃক বহুল ব্যবহৃত ভাষায় পড়া ও শিক্ষার শিক্ষাদান দিতে হবে।। যখন এটা সম্ভব না হয় তখন এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যক্রম গ্রহণের উদ্দেশ্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এবং সেইসব জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা করতে হবে।

এই যে রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির এমন নাজুক অবস্থা যেখানে শিক্ষা সার্বজনীন থেকে এক পাক্ষিক রূপ নিয়েছে যার ভুক্তভোগী নিম্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং গেরাকলে পড়ে আছে পাহাড় আর পাহাড়ের ভিন্ন ভাষাবাসী শিক্ষার্থী। এই গেরাকল থেকে পাহাড়ি শিক্ষার্থী মুক্তি পাবে কবে?

লেখক : রাজনৈতিক কর্মী ও শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ