রাষ্ট্রকে একই রকম 'অপ্রস্তুত' কেন দেখায়?

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:৪১

রামু, সাঁথিয়া, নাসিরনগর বলতে গেলে প্রায় একই ধাঁচের সহিংস ঘটনা। একইরকম গুজব, মুহুর্তের মধ্যে সংঘবদ্ধ ফ্যানাটিক মব তৈরি হয়ে যাওয়া। তো, এই সহিংস ঘটনাগুলো ঘটার পর এইদেশের কথিত 'আলেম সমাজ' এর এসেসমেন্ট কী?

কেন একই রকম ঘটনা ঘটতে পারছে? কেন একজন নিরীহ হিন্দু/বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর নামে ফেইক আইডি খুলে বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা লিখে তারপর সেটাকে ভাইরাল করা, মব তৈরি করার মত ঘটনা প্রায় একই রকমভাবে ঘটতে পারছে? 'আলেম সমাজ' কি তা ভেবে দেখেছেন?

যদি ভেবে দেখতেন, তাহলে এরকম ঘটনা যেন না ঘটতে পারে সেজন্য সবার আগে ব্যবস্থা নিতেন তারা। সামাজিক সচেতনা তৈরি করতেন।

মসজিদে মসজিদে বয়ানের মাধ্যমে সাধারণ মুসুল্লিদের বলতেন নবীর অবমাননার ধোঁয়া তুলে এই দেশকে অশান্ত করতে চায় কোন স্বার্থান্বেষী মহল। মুসুল্লিদের সজাগ থাকতে বলতেন।

তারা যদি মনেই করেন, ইসলামকে নিয়ে কোন চক্রান্ত চলছে, সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতিকে উস্কে দিয়ে কোন চক্র ফায়দা লুটতে চাইছে, তাহলে এই 'আলেম সমাজ' এমন কৌশল অবলম্বন করতেন যেন সকল ধরনের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়ে যায়।

তাতে করে আলেম সমাজের প্রজ্ঞার পরিচয় মিলত। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে তারা দাবি করেন, সেই দাবিটাই প্রতিষ্ঠিত হত।

কিন্তু ধর্মের নামে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল সহিংস ঘটনা ঘটে চলেছে বাংলাদেশে, তাতে কথিত 'আলেম সমাজ' এর দায়িত্বশীল ভূমিকা তো দেখা যায় নি, বরং সাধারণ মুসুল্লিকে 'তৌহিদি জনতা'তে পরিণত করার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রণী ভূমিকা দেখা গেছে।

আপনার ঘাড়ে উপর নিঃশ্বাস ফেলা চরম উগ্র হিন্দুত্ববাদ বিকশিত হওয়ার যুক্তি খোঁজে আপনার চরম উগ্র ইসলামিজমের মধ্যে।

আপনি যত বেশি (রাজনৈতিক অর্থে) 'মুসলমান' হবেন, দক্ষিণ এশিয়াকে তছনছ করে দিতে চাওয়া হিন্দুত্ববাদ তত বেশি (রাজনৈতিক অর্থে) 'হিন্দু' হওয়ার বাহানা পাবে। আপনি তাহলে তাকে সেই সুযোগ দিতে চান কেন?

বরং, আপনার ধর্মের মধ্য থেকেই চাইলে আপনি এমন ন্যারেটিভ, এমন বয়ান খুঁজে বার করতে পারেন, যা পরমতসহিষ্ণুতাকে প্রমোট করতে পারে।

এই দেশের হিন্দুরা এতটা উগ্র কিংবা নির্বোধ হয়ে যায়নি যে আপনার প্রাণের নবীকে নিয়ে কটূক্তি করবে। যদি কেউ করেও, সেই একজনের দায় গোটা সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন চালানোর দোহাই হিশেবে ব্যবহার করা চরম অন্যায়, ভন্ডামো।

ধর্ম যদি আপনার কাছে প্রতিক্রিয়াশীল পলিটিকস না হয়ে থাকে, আপনি যদি এরকম সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে 'তৌহিদি জনতা' উত্তেজনার উপর ভর করে আপনার পলিটিকাল এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করার মানসিকতা ধারণ না করেন, তাহলে ইসলাম ধর্মকে তথাকথিত কটূক্তি>উস্কানি> সহিংসতা>প্রাণহানি>রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ>ফের প্রাণহানির চক্র থেকে বার করে আনতে উদ্যত হবেন।

কিন্তু সেই লক্ষণ তো দেখিনা! উল্টো দেখি ব্লাসফেমির মত চরম প্রতিক্রিয়াশীল দাবি জানিয়ে রাষ্ট্রকে আরো শক্তিশালী, আরো কর্তৃত্বপরায়ণ করে তুলতে দাবি জানাতে।

এই চরম কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার উপর ভর করেই রাষ্ট্র আপনার তৈরি করা ইনসেইন মবকে গুলি চালায়। আপনার তারপরেও মোহভঙ্গ হয়না?

ধর্ম-বর্ণ-মতাদর্শ নির্বিশেষ বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের এখন এই ধরনের সহিংস ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, যদি আমরা মনে করে থাকি আমাদের বর্তমান, ভবিষ্যত সবকিছুর জন্য আমরা বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল।

আমরা ধর্মের নামে কোন সহিংসতাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিব না, এরকম ঘটনাকে ক্যাশ করে দক্ষিণ এশিয়ার কোন দানবীয় মতাদর্শকে মহাদানবে পরিণত করতে ভূমিকা রাখব না।

মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি কোনভাবেই ইতোমধ্যেই প্রচণ্ড সহিংস রাষ্ট্রকে আরো সহিংস, আরো কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়ার সুযোগ করে দিব না। পাশাপাশি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও আমাদের জোরেশোরে তুলতে হবে :

>ম্যানুফ্যাকচার করা 'উসকানি' 'গুজব' ইত্যাদি মোকাবেলায় পুলিশিং ছাড়া রাষ্ট্র আর কোন পন্থা নিতে পারে না কেন? আইন দণ্ডবিধি আর গুলি কি আদৌ কোন পন্থা?

>এবং একই রকম, একই প্যাটার্নের ঘটনা রামু, সাঁথিয়া, মালোপাড়া, নাসিরনগর, বোরহানউদ্দিমে বারবার ঘটলেও রাষ্ট্রকে একই রকম 'অপ্রস্তুত' কেন দেখায়? দণ্ডবিধি ছাড়া, দণ্ডিবিধির হুমকি দেয়া ছাড়া গুজব, উস্কানিরোধে রাষ্ট্র আর কোন ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবতে পারেনা কেন?

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

 

মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। সাহস২৪.কমের সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা এক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় আমাদের নেই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ