রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রধান অন্তরায় কি ভূ-রাজনীতি?

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২২, ১৮:৪৪

সাহস ডেস্ক

সময়ের পরিক্রমায় এটা স্পষ্ট হয়েছে রোহিঙ্গা সংকট শুধুমাত্র জাতিগত নির্মূল অভিযানই নয়, বরং এর সাথে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বৃহৎ স্বার্থ জড়িত। বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাজ্যগুলো পরাশক্তিগুলোর  ভূ-রাজনৈতিক দাবার অন্যতম গুটি। এতে চীন, ভারত ও রাশিয়ার পাশাপাশি পশ্চিমাদের কৌশলগত স্বার্থও নিহিত। আঞ্চলিক সংঘাতে মায়ানমারে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের মূল্যবান জ্বালানি সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্যই কি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে প্রধান অন্তরায় ভূ-রাজনীতি?

সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আকাশে মেঘের ঘনঘটা। দেশের বান্দরবান ও কক্সবাজার  সীমান্ত ঘেঁষে অস্থিরতা ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।  ইদানিং রাখাইনে আরাকান আর্মিসহ বিভিন্ন স্বশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাতও উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় মিয়ানমারসহ পুরো অঞ্চলে অস্থিরতার আলামত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অস্থিতিশীলতার এই সুযোগে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির খেলোয়াড়েরা নানা সমীকরণ নিয়ে সামনে এগোচ্ছে। ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরি’র মত আরাকানের ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদই কি তাদের সংকটের ভিত্তিমূল?

প্রকৃতপক্ষে, নানা কৌশল অবলম্বন করে বাংলাদেশকে যুদ্ধের ফাঁদে ফেলার অপচেষ্টার মাধ্যমে আরাকানে বসবাসকারী বাকি ছয় লাখ রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশের সীমানায় ঠেলে দেওয়ার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মায়ানমার। গত কয়েকমাস ধরে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইনের উত্তেজনা তারই ইঙ্গিত বহন করে। ইতোমধ্যে উক্ত অঞ্চলে কিছুদিন যাবৎ চলা অব্যাহত সংঘর্ষ এবং বাংলাদেশের ভেতরে মর্টার শেল পড়ে স্থানীয় বাসিন্দার নিহত ও আহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে  বাংলাদেশে মায়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টকে এক মাসের মধ্যে চতুর্থবার তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তিন দেশের সংযোগস্থলে বর্তমান উত্তপ্ত অবস্থা ভূরাজনৈতিক ক্রীড়নকদের পূর্বপরিকল্পিত কিনা তা নিয়ে অনেকের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সেইজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে যাতে ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড়েরা তাদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে।

অনেকের মতে বড় বড় ভূ-রাজনৈতিক ক্রীড়নকদের মাধ্যমেই নাকি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরও উসকে দেওয়া হচ্ছে। হয়তো অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে শতাব্দী ধরে চলা এ সংঘাতকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে পরাশক্তিগুলো। বিভিন্ন সময় আরাকানে জাতিগত নিধনের স্বীকার প্রায় ১২ লক্ষ শরনার্থীর সাথে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে নব্য ভূমিষ্ট প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও ভয়াবহ সহিংসতার পাঁচ বছর এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ঐতিহাসিক মামলার রায়ের পরও ভূ-রাজনৈতিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ নয় কি?

বাস্তবিক অর্থে, বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা আরাকান ও কক্সবাজার অঞ্চলে ২০০৪ সালে গভীর সমুদ্রে  প্রায় ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলে পরাশক্তিগুলোর কুনজর পড়তে শুরু করে। এরইমধ্যে অত্র অঞ্চলে চীন গ্যাসের পাইপলাইন স্থাপন করে সেই গ্যাস কুনমিংয়ে নিচ্ছে। উপরন্তু চীন রাখাইন রাজ্যের কাইয়াকুক পিউইয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে, যা ভারতের বিরোধিতায় কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি ভারত নিজেও আরাকান রাজ্যের পাশে আরেকটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন ও ভারত প্রতিবেশী মায়ানমারের পাশে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে চীন, ভারত ও রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোট দানে বিরত থেকে তারই প্রমাণ দিয়েছে। 
 

এদিকে পশ্চিমা শক্তিগুলো শতবছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে একটি নৌ ঘাঁটি নির্মাণের জন্য। তাই, রোহিঙ্গা প্রশ্নে মুখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে গলাবাজি করলেও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য পশ্চিমারা কি রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান করবে নাকি এর থেকে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন?

মানবতার খাতিরে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসিত হলেও এর নেতিবাচক দিক বহুমাত্রিক। সিরিয়া ও ইরাকের কিছু অংশ নিয়ে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট এর মত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো অনিয়ন্ত্রিত রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে আরাকানসহ বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারতের সীমান্তবর্তী একাধিক জেলাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। ইতোমধ্যে  মার্কিন গোপন দলিলে ইসরায়েলের মাধ্যমে তথাকথিত রোহিঙ্গা ল্যান্ড প্রতিষ্ঠার খবরও গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই এখন থেকেই খুব সাবধানে ভূরাজনৈতিক বিভিন্ন ফ্যাক্টর বিশ্লেষণ করে মায়ানমারের বহুমুখী ষড়যন্ত্রের পাতানো ফাঁদ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে বাংলাদেশকে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে কঠিন পরিস্থিতি অতি কৌশলে মোকাবেলা করতে হবে।

ইতোমধ্যে শুরু হওয়া মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি না ঘটলে তা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণে আলাদা বিশেষজ্ঞ ইউনিট গঠনের মাধ্যমে ঢাকাকে প্রমাণ করতে হবে মানবিকতার মত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের কূটনীতিতেও তারা সফল।

অভিশপ্ত ভূ-রাজনীতির অপকৌশলের ঘৃণ্য আবরণে কথিত প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত না হয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক ও বহুপক্ষীয় আলোচনার পাশাপাশি জাতিসংঘসহ বহির্বিশ্বে নানামুখী কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধার সমন্বিত চেষ্টার ফলে পরাশক্তিগুলোর অর্থপূর্ণ সম্পর্কের অর্থবহ সার্থক রূপায়ণে অচিরেই রোহিঙ্গা সংকটের যবনিকাপাত ঘটানো সম্ভব।

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক 
লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট 
সভাপতি - কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সাহস২৪.কম/এএম/এসকে.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ