বাংলাদেশ-জাপান প্রীতি

‘গানবাত্তে কুদাসাই’ বা ‘হাল ছেড়ো না’ নীতি

প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৩, ১৩:৪৩

এস এম মুকুল :
জাপানিরা বিনয়ী জাতি হিসেবে সুপরিচিত

পৃথিবীতে সহনশীল, সহিষ্ণু জাতি হিসেবে জাপানিদের সুনাম রয়েছে। জাপানিদের সহনশীলতা ও কষ্টসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একজন পর্যবেক্ষক তাঁদের সংস্কৃতির একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় তুলে ধরেন, আর তা হলো- জাপানিরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায়ের সময় বলে থাকে ‘গানবাত্তে কুদাসাই’, যার কাছাকাছি অর্থ ‘হাল ছেড়ো না’।

পারস্পরিক সহযোগিতার ধারণাটিও জাপানিদের মধ্যে প্রবল। এ প্রসঙ্গে টোকিওর টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ কিংসটন বলেন, বড় বিপর্যয়ে জাপানিদের ভেতরটা কান্নায় মোচড়ালেও তারা মুখে হাসি ধরে রাখে। এমনও শোনা গেছে, কোনো স্বজন মারা যাওয়ার পরও অনেকে জোরে কান্নাকাটি করেনা পাশের বাড়ির লোকজনের অসুবিধা হতে পারে ভেবে।

বলা হয়ে থাকে- জাপানিদের মধ্যে দুর্যোগ ও বিপদ-আপদে আতঙ্কিত হওয়ার প্রবণতা খুব কম। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেন্দাই শহরের পৌর কর্মকর্তা মাচিকো কুনো বলছিলেন, তাঁরা ভাবেন, কেউ আতঙ্কিত হলে দেখাদেখি অন্যরাও ভয় পেয়ে যাবে।

এতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। তাই শত বিপদেও তাঁরা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন। ধারণা করা হয়, সম্ভবত একারণেই দুটি বিশ্বযুদ্ধ সামাল দিয়ে দ্বীপ দেশ জাপান অনেক দিন ধরেই বিশ্বের কয়েকটি শীর্ষ ধনী দেশের মধ্য অবস্থান করছে। জাপানিরা ভূখন্ড বা প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা না থাকা সত্তে¡ও শুধুমাত্র পরিশ্রম, মেধা ও কর্মনিপুণতার শক্তিতে উন্নতির শিখরে ঠাঁই করে নিয়েছে। অনেকের ধারণা- এর পেছনে তাদের অন্যতম মন্ত্র হয়তোবা ‘গানবাত্তে কুদাসাই’ বা ‘হাল ছেড়োনা’।

১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়া কয়েকটি দেশের মধ্যে জাপান অন্যতম। সম্প্রতি জাপানে সফররত অবস্থায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানকে বাংলাদেশের দীর্ঘকালের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন- স্বাধীনতা অর্জনের দুই মাসের মধ্যেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া কয়েকটি দেশের মধ্যে এই দেশটি তার হৃদয়ের খুব কাছের।

প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে কৃষি, শুল্ক বিষয়ক, প্রতিরক্ষা, আইসিটি ও সাইবার-নিরাপত্তা, শিল্প আপগ্রেডিং, বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ, জাহাজ পুনর্ব্যবহার এবং মেট্রোরেল বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে ৮ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও জাপান।

চুক্তি সাক্ষরকালে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উদ্ভাবন, গবেষণা, মানব সম্পদ উন্নয়ন, সাইবার সিকিউরিটিসহ তথ্যপ্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একযোগে কাজ করার প্রত্যয় ঘোষণা করে বাংলাদেশ ও জাপান।

জাপানিরা জন্মগতভাবেই পরিশ্রমী। প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয় প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ফলে ছুটির দিনে ঘুরে বেড়িয়ে মানসিক ক্লান্তি দূর করে জাপানিরা। যোগাযোগের ক্ষেত্রে জাপানকে রেলের দেশ বললেও ভুল বলা হবেনা।

জাপানজুড়ে রেলওয়ে মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে আছে। ফলে অভ্যন্তরীণ পর্যটনে এক বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে অর্থনৈতিকভাবে। এই দেশে যে কত স্থান আছে ঘুরেবেড়ানোর জন্য তার হিসেব নেই। রেলগুলো যেমন আরামদায়ক তেমনি নিয়মমেনে চলাই তাদের নীতি। এক মিনিট কোনো কারণে বিলম্ব হলে কতবার যে ক্ষমা চেয়ে ঘোষণা দেন চালক, বিশ্বাস করাই মুশকিল।

কারাতে মূলত জাপানি শব্দ। দুটো শব্দের সমন্বয়ে কারাতে শব্দটির গঠন। কারাতে মূলত এক ধরনের মার্শাল আর্ট যা খালি হাতে প্রয়োগ ঘটানো হয়। কারাতে দক্ষ হতে হলে একজন ব্যক্তিকে সারাবছর সর্বদাই কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতার মাঝে থাকতে হয়।

জাপানের প্রত্যন্ত দীপাঞ্চল থেকে কারাতের জন্ম। আদিকাল থেকেই জাপানিরা পরিশ্রমী, তাদের সর্বদাই প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করেই বাঁচতে হয়েছে। আর সে কারণেই মূলত আত্মরক্ষার তাগিদ থেকেই মার্শাল আর্টের জনপ্রিয়তা পায় জাপানিদের মধ্যে। আর মার্শাল আর্টের একটা সংস্করণ কারাতে খেলা হিসেবে কারাতে প্রতিষ্ঠিত করা আর টিকিয়ে রাখা জাপানিদের অবদান।

আমরা জানি, পৃথিবীর দ্রুত শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে জাপান পরিচিত। জাপানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যাবে গত সত্তুর বছর আগে জাপানও অতি দরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিল। তখন জাপানে রাস্তাঘাটে ভিখারী ছিল। মানুষ গাছের নীচে বসে চুল, দাড়ি কাটাত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপান দারিদ্র্যসীমার নিচে স্থান পায়। সেই দারিদ্র্য অবস্থা থেকে প্রত্যয়ী জাপানিরা পৃথিবীর অতি উন্নত অর্থনৈতিক সীমারেখায় পৌঁছেছে। 

জাপানিরা পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছ থেকে ‘অতি পরিশ্রমী’ হিসেবে বিদ্রুপও শুনেছে। কিন্তু দরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে পরিশ্রম করে গেছে। তার পেছনের মন্ত্র হয়তোবা ‘হাল ছেড়োনা’। যুদ্ধ বিধ্বস্থ জাপানের ১০০ মিলিয়ন মানুষ ভয়ংঙ্কর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়।

একদিকে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা অপরদিকে ধ্বংস্তুপের অর্থনীতি পুর্ণগঠন এবং আধুনিকীকরণ ছিলো জাপানীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই বিধ্বস্ত ধ্বংস স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে কে বলতে পারত পারতো মাত্র চার দশকে বিধ্বস্ত জাতিটি একটি আধুনিক সমৃদ্ধ জাপান গড়ে তুলবে! 

চার দশক পর জাপানের উত্থান নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন হলো- ‘প্রতিকূলতাই জাপানীদের জন্য আর্শীবাদ। বিশ্লেষকদের মতে-

১. একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ এলাকায় বিপুল জনগণের বসবাস ছিলো জাপানীদের জন্য প্রথম আর্শীবাদ। বাঁচার তাগিদে প্রচন্ড রকমের কর্মপ্রেরণা এবং প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিলো তাদের মধ্যে।

২. কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকাটা ছিলো জাপানীদের জন্য দ্বিতীয় আর্শীবাদ। ফলে জাপানীরা সারা পৃথিবীর অঢেল সম্পদ আহরণে সচেষ্ট হয়েছিলো।

৩. দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে সব শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা ছিলো জাপানীদের জন্য তৃতীয় আর্শীবাদ। পরে নতুন এবং অত্যাধুরিক পদ্ধতিতে তারা প্রতিটি শিল্প কারখানা গড়ে তুলল।

এবার আসুন বাংলাদেশের কথায়। বাঙালিরাও হাল না ছাড়ার জাতি। জাপানিরা যেমন পরিশ্রমী, বাংঙালিরাও তেমনি প্রত্যয়ী জাতি। 

বাঙালিরা যা ভাবে তা করেই ছাড়ে। একারণে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাঙালি জাতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার কথা ভাবছে উন্নত দেশগুলো।

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে জাপানি আকিরা জুকো বলছিলেন, ‘পৃথিবীর দ্রুত শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত জাপান। জাপানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। 

কিন্তু অতীত ইতিহাসের দিকে পেছন ফিরে তাকালে গত পঞ্চাশ বছর আগে জাপানও অতি দরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিল।

পক্ষান্তরে নির্ধিদ্বায় বলা যায়, বাঙালী মানুষ বড়ই কাজের। কাজের সুযোগ পেলেই হলো। উপার্জনের পথ পেলেই হলো। নির্দ্বিধায় কাজ করে আমাদের দেশের মানুষ। প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যে যার ভুমিকায় কাজ করতে পটুয়া বাঙালিরাও। 

কৃষকের কথাই ধরা যাক। কী বন্যা, কী খরা কতভাবেই কত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে স্বপ্ন মিশ্রিত ঘাম ঝরানো সোনার ফসল।

তবু থামেননি কৃষক। কোনো বিপর্যয়ই তাদের দমাতে পারেনি। বন্যার পর দেখা যায় বন্যার জল সরতে না সরতেই নতুন ফসল বোনার জন্য আবারও মাঠে নামে কৃষক। 

ফসল রক্ষায় তারা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়। নিঃস্ব, শুন্য অবস্থান থেকেও বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার কৃষক। ফলিয়েছে সোনার ফসল।

এদেশের মানুষ অলস অকর্মণ্য নয়। এসব আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পই তার প্রমাণ বহন করে। শুধু এখনই নয়, যুগ যুগ ধরেই এদেশের মানুষ হাতের কাজ, কুটির শিল্প এমনি নানা কাজকর্মে নিয়োজিত থেকেছে। 

এধারা এখনও প্রবাহিত হচ্ছে। বংশ পরম্পরায় আমাদের ঐতিহ্য বহনকারী কিছু পেশাকে উপজীব্য করে ধরে রেখেছেন দেশের মানুষ।


এসব পেশা দেশীয় ঐতিহ্যের সুনাম অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং স্বাবলম্বনের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল একসময়। উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনা, সহযোগিতা 
আর সুনজরের অভাবে এসব শিল্প সম্ভাবনার পথকে ক্ষীণ করে রেখেছে। চাইলেই এই পরম্পরায় দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিল্প সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলা অসম্ভব কিছু নয়।

আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক তৎপরতাও সৃষ্টি হচ্ছে। সবাই ভালো থাকতে চায়। সচ্ছল থাকতে চায়। ভাল থাকার স্বপ্ন দেখে। এটি আশার কথা। এজন্য প্রয়োজন কাজের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করা। 

সমাজের নিম্নস্তরে যারা আছে যাদের সচ্ছলতাহীন অর্থনৈতিক জীবন, তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

এদেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা সামান্য। অল্পে তুষ্ট মানুষেরা খেয়ে পড়ে নিরাপদে বেঁচে থাকতে চায়। এদেশের মানুষ মাঠে- ঘাটে কাজ করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। 

এসব উদ্যোগী ও পরিশ্রমী লোকদের সংগঠিত করা গেলে এবং তাদের সহযোগিতা করা হলে সার্বিকভাবে দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। খুলে যাবে সম্ভাবনার দুয়ার।

কাজেই সম্ভাবনা আমাদেরও আছে। বাংলাদেশ এখন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জিডিপি অর্জনকারী দেশ। আমাদের উচিত কথা কম বলে কাজ বেশি করা। বিদ্যমান সমস্যা মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সুবিধা দিতে হবে। 

দেশ গড়তে তরুণ সমাজকে প্রযুক্তি জ্ঞান সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলতে হবে। দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জাগরণ ঘটাতে হবে।

বিজয় অর্জন ও স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই এগিয়ে যাবার নেপথ্য দেশের আপামর জনগণ। প্রয়োজন ভিশনারি নেতৃত্বের। দেশের সম্পদ-সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। জাগিয়ে তুলতে হবে শিল্প সম্ভাবনা। 

দেশের উদ্যোক্তাদের অধিক সুবিধা আর কাজের অনূকুল সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশের মানুষই দেশ গড়বে। সুতরাং মানুষের জন্য ব্যাপক কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত। তবেই গড়ে উঠবে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।


এস এম মুকুল : বিশ্লেষক, উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট, [email protected]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ