চা-শিল্পে আশাজাগানিয়া সম্ভাবনা

প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৩, ১৩:১৮

এস এম মুকুল
সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনিছড়া বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয়

বাংলাদেশে উৎপাদিত চা দুই দশক আগেও বিশ্বের ২০-২২টি দেশে রফতানি করা হতো। বর্তমানে বিশ্বের ১৭টি চা রফতানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫ ।

জাতীয় অর্থনীতিতে শ্রম নিবিড় চা-শিল্প খাতটি ব্যাপক অবদান রাখবে- এমনটি প্রত্যাশা শিল্পোদ্যোক্তাদের। এ আশা জাগার কারণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের চাহিদা ও দাম দুই-ই বেড়ে চলেছে। 

দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তৃত হচ্ছে চায়ের আবাদ। এমনকি চট্টগ্রামের মিরসাইয়ের পাহাড়-টিলাভূমিতেও চা চাষের সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। বড় কথা হচ্ছে, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে চা আবাদ ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। 

চা বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে ১৬৬টি টি এস্টেট ও চা বাগানের মধ্যে নিবন্ধনকৃত টি এস্টেট ১২৯টি, স্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত চা বাগান ৩০টি এবং অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত চা বাগান সাতটি। সব মিলিয়ে চা আবাদকৃত মোট জমির পরিমাণ ২,৭৯,৪৩৯ দশমিক ৬৩ একর। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ১,৫৬,১৯১ দশমিক ৯৪ একর; হবিগঞ্জে ৫৪,১৬৪ দশমিক ১৬; সিলেটে ২৮,৯৩৬ দশমিক ৩২; চট্টগ্রামে ৩৪,৫৬০ দশমিক ৪৫ ; রাঙামাটিতে ৭৯৪ দশমিক ৯৪; পঞ্চগড়ে ৪৭৫১ দশমিক শূন্য ৫; ঠাকুরগাঁওয়ে ৪০ দশমিক ৭৭ একর আবাদযোগ্য জমিতে চা চাষ হচ্ছে। গত এক দশকে চা বোর্ডের নেওয়া সম্প্রসারণ কার্যক্রমের আওতায় পঞ্চগড় ও বান্দরবান জেলাকে চা চাষের আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড়ে বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন (কৃষিজমিতে চা চাষ বা সর্বোচ্চ ২০ একর জমিতে চা চাষ) চা চাষের ভূমির পরিমাণ ১ হাজার ৫৫৫ হেক্টর। আর পার্বত্য জেলা বান্দরবানে ১২৩ হেক্টর জমি রয়েছে চা চাষের আওতায়।

বাংলাদেশ চা বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাদের বিবৃতি অনুযায়ী, পরিমিত হারে বৃষ্টিপাত, উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক পদক্ষেপ, নতুন নতুন চা আবাদের এলাকা সম্প্রসারণ, উন্নততর ক্লোন চায়ের চারা লাগানোর হার বৃদ্ধি, সীমিত আকারে হলেও শ্রমিকদের প্রণোদনা প্রদানের ফলে চা উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে। 

আশার খবরটি হলো, গত ১০ বছরে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে চায়ের বাড়তি আবাদ ও উৎপাদন করা হয়েছে। সেখানে উন্নততর ক্লোন জাতের চায়ের চারাগাছ লাগানো হয়েছে, ফলনও দিচ্ছে ভালো। 

আরো আশার খবর চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের চেষ্টায় বর্তমানে চায়ের ১৮টি উচ্চফলনশীল ক্লোন, চারটি বায়োকোনাল ও একটি পলিকোনাল বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে; যা অধিক চা উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। পঞ্চগড় জেলাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে যেখানে তামাকের চাষ হতো সেসব এলাকায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চায়ের আবাদ বিস্তৃত হচ্ছে। চায়ের আবাদ বিস্স্তির ফলে চা-শিল্প বিকাশে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। নতুন নতুন এলাকায় গড়ে উঠছে চা বাগান। 

চা বোর্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে গুণগত মান বাড়িয়ে এ পর্যন্ত ১৮টি উচ্চফলনশীল ক্লোন অবমুক্ত করেছে, যাদের গড় উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৩ হাজার কেজির বেশি। এ ছাড়া বিটিআরআই হতে আরো চারটি বাই ক্লোনাল এবং একটি পলি ক্লোনাল বীজ অবমুক্ত করা হয়েছে। চা উৎপাদন ও রফতানিতে একসময় সারা বিশ্বে শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম ছিল বাংলাদেশের নামটি। দেশে চা পান করার ব্যাপকতা দ্রুত বাড়লেও উৎপাদনের গতি বাড়েনি। 

আশার কথা হলো, গত দুই বছরে চা উৎপাদনে বড় অগ্রগতি দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এক বছরের ব্যবধানে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি। জানা গেছে, ভারত ও চীনে হেক্টরপ্রতি চা উৎপাদন দুই হাজার কেজির বেশি। শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বেশকিছু দেশ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। দেশীয় বাগানগুলোয় হেক্টরপ্রতি চা উৎপাদন দীর্ঘদিন ১ হাজার ২০০ কেজির ঘরে থাকলেও গত বছর তা দেড় হাজার কেজি ছাড়ায়। ২০১৫ সালেও চায়ের হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল ১ হাজার ২৭০ কেজি। ২০১৬ সালে এ পরিমাণ বেড়ে রেকর্ড ১ হাজার ৫৮৭ কেজিতে দাঁড়ায়। চা বোর্ডের বার্ষিক চা উৎপাদন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জুন-অক্টোবর সময়ে দেশের ১৬২টি বাগান থেকে গড়ে ১০ মিলিয়ন কেজিরও বেশি চা উৎপাদন হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে চা উৎপাদন অচিরেই ১০০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন চা বোর্ডের কর্মকর্তারা।

১৯৫৭-১৯৫৮ সময়কালে চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন চা চাষাবাদ, কারখানা উন্নয়ন, অবকাঠামো এবং শ্রমকল্যাণের ক্ষেত্রে চা-শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চা বোর্ড চায়ের আবাদ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম আরো বেগবান করতে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান টি লাইসেন্সিং কমিটি বিলুপ্তির জন্য পাকিস্তান টি অ্যাক্ট ১৯৫০ এর ৭নং ধারায় সংশোধন আনেন এবং কমিটির কার্যক্রম চা বোর্ডে ন্যস্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে চা বোর্ডের অধীন পাকিস্তান টি রিসার্চ স্টেশন (বর্তমানে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট) শ্রীমঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি হস্তক্ষেপ ও তৎপরতায় এ প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। 

বঙ্গন্ধুর সময় চা বাগানের উন্নয়ন ও উন্নত জাতের চা উদ্ভাবনে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। চায়ের উচ্চতর ফলন নিশ্চিতকরণ, সর্বোচ্চ গুণগত মান অর্জন ও রোগবালাই দমনে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। আর এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং সিলেটের ভাড়াউড়া চা বাগানে ‘রেসিস্টেন্ট ক্লোন’ জাতের চারা লাগানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথমে ক্লোন এবং পরবর্তীতে ক্লোন থেকে ক্লোনাল সিডবাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ভারতের টোকলাইতে ১৯৪৯ সালে ক্লোন উদ্ভাবন করা হলেও বঙ্গবন্ধুর আগে পাকিস্তানে এ উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেননি। বঙ্গবন্ধু টি অ্যাক্ট এ সংশোধনীর মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করেছিলেন; যা এখনো চালু রয়েছে। 

এ ছাড়া তার প্রচেষ্টায় বোর্ডে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্র্যাচুয়েটি প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা চালু হয়। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের কল্যাণেও অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার প্রদান করেছিলেন।

পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীনতাত্তোর চা-শিল্পের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য চা বাগানগুলোর পুনর্বাসন, নতুন চা এলাকা সম্প্রসারণ, চা কারখানা আধুনিকীকরণ, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ জোরদারকরণের লক্ষ্যে সমীক্ষা পরিচালনা এবং চা-শিল্পের পুনর্বাসন ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য কমনওয়েলথ সচিবালয়কে অনুরোধ জানান। 

চা-শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। চা-কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য তিনি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ৩০ লাখ ভারতীয় মুদ্রা মূল্যের ঋণ নিয়ে চা-শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। বঙ্গবন্ধু চা বাগান মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি প্রদান করেন।

২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, দেশে বোতলজাত পানি, কার্বোনেটেড বেভারেজ ও কফিসহ বিভিন্ন পানীয় পণ্যের চাহিদা প্রতি বছরই বাড়ছে। 

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে আশাব্যঞ্জক হারে বাড়ছে চায়ের বাজার। কারণ দেশে এখনো মোট পানীয় পণ্যের ৭৬ শতাংশই চা। বিশ্বের মোট চাহিদার ৩ শতাংশ পূরণ করছে বাংলাদেশের চা। দেশে চা উৎপাদন ও বিপণনে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ইস্পাহানি, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউনিলিভারের তাজা ও ব্রুক বন্ড ব্র্যান্ড। এরপর রয়েছে আবুল খায়েরের সিলন, কাজী গ্রুপের কাজী টি, রাষ্ট্রায়ত্ত ন্যাশনাল টিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। চায়ের ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ অঞ্চলে প্রথম চা বাগান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৮২৮ সালে। 

বর্তমানে যেখানে চট্টগ্রাম ক্লাব ১৮৪০ সালে সেখানেই পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করা হয় প্রথম চা গাছ। তবে ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনিছড়া চা বাগানে চা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে প্রথম বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয়। 

তখন থেকে পর্যায়ক্রমে চা এ দেশে একটি কৃষিভিত্তিক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে চা এ দেশে একটি কৃষিভিত্তিক শ্রমঘন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর চা উৎপাদন শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। 

১৮৬০ সালে হবিগঞ্জের লালচান্দ চা বাগান ও মৌলভীবাজারের মির্তিঙ্গা চা বাগানে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। 

২০০০ সালে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়েও ছোট আঙ্গিকে চায়ের চাষ শুরু হয়। ২০০৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামেও শুরু হয় চায়ের চাষ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় বৃদ্ধি, আমদানির বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টিতে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে চা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন শুরু করে। বর্তমানে আমাদের দেশে যে পরিমাণ চা উৎপাদন হয়, তা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।

শতাব্দী প্রাচীন চা-শিল্প খাত টিকে আছে এর সঙ্গে জড়িত বনেদি উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা ও পেশাদারি উদ্যমী মনোবলের পাশাপাশি কয়েক লাখ চা শ্রমিকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের চাহিদা ও দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চট্টগ্রামের দেশের অর্ধশতাব্দীরও বেশি প্রাচীন আন্তর্জাতিক চা নিলাম বাজার অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালনাসহ অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে চায়ের রয়েছে প্রায় সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার বাজার। তবে আশার খবর হচ্ছে, দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তৃত হচ্ছে চায়ের আবাদ। পাশাপাশি আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে চা আবাদ ও উৎপাদনে।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ