একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ভাষা সংগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রুপান্তরের গল্প

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩, ১৪:২২

শেখ কামরুল হাসান
ছবি- সাহস

আমরা সবাই জানি যে, ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১ শে ফেব্রুয়ারীর ভাষা দিবসকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় কিন্তু কিভাবে একটি দেশের অভ্যন্তরীন ভাষা সংগ্রাম ও ভাষা দিবস আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো তা আমাদের অনেকেরই অজানা।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি কথা বলে নেওয়া ভালো যে, ভাষা দিবসকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্বে (১৯৯৯ সালে ১৭ই নভেম্বর এর পূর্বে) দুই জন বাঙালী ব্যক্তি বাংলা ভাষাকে বিশ্ব পরিমন্ডলে পরিচিত করান। দুই জনের একজন হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আরেকজন হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলায় রচিত অমর কাব্যগন্থ গীতাঞ্জলির মাধ্যমে বাংলাকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করান। ১৯১০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি কলকাতার “ইন্ডিয়ানপাবলিশিং হাউস” থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। যদিও ১৯১২ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অমর কাব্যগন্থ গীতাঞ্জলি ইংরেজীতে অনুবাদ করে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে প্রকাশ করা হয়। ১৯১৩ সালে  এই গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। 
 
এবার আসা যাক আরেকজন বাঙালী মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কথায়। এই মহাপুরুষ ১৯৭৪ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ২৯ তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে সারা বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব জানান দিয়েছিলেন। সেই দিন বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় দেওয়া ভাষনের মাধ্যমে জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানতে পারে বাংলা ভাষার কথা, জানতে পারেস্বাধীন ও সর্বোভৌম বাংলাদেশের কথা।
 
এবার আসাযাক ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবস কিভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রুপান্তর হলো তার ইতিহাসে। ভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দানের যে চিন্তা সেটা প্রথমে আসে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে (যে শহরটা মাল্টিকালচারের জন্য বিখ্যাত) বসবাসকারী বাংলাদেশী নাগরিক রফিকুল ইসলামের মাথা থেকে। রফিকুল ইসলাম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পাড়ি জমান কানাডাতে।
 
১৯৯৮ সালে ৯ই জানুয়ারী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম জাতি সংঘের তদানিন্দন মহাসচিব কফি আনান কে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী জীবন দিয়ে বাঙালী তাদের মাতৃভাষার অস্থিত্ব রক্ষা করেছিলেন। মাতৃভাষার জন্য আত্মহুতি দেওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। চিঠিতে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটিকে বিশ্বের সব বিপন্ন মাতৃভাষার আত্মরক্ষার সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে যেন বিবেচনা করা হয়। রফিকুল ইসলাম ২ সপ্তাহের মধ্যে তার আবেদনের উত্তর পেলেন। উত্তরটি লিখেছিলেন জাতিসংঘের পাবলিক ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের পাবলিক ইনকুয়ারী ইউনিটের অফিসার (ইন-চাজর্) হাসান ফেরদৌস। তিনি একজন বাঙালী ছিলেন। তিনি লিখলেন জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী এই সংস্থা কোনো ব্যক্তির আবেদন বিবেচনায় নিতে পারে না। আবেদন আসতে হবে জাতিসংঘের যে কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে। রফিকুল ইসলামের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো জানাশোনা ছিল না।
 
তাই তিনি কানাডায় বসবাসকারী তার একজন ঘনিষ্ট বন্ধু আব্দুস সালামের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আব্দুস সালাম ছিলেন পেশায় একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। এরপর দুই বন্ধু মিলে অন্য ভাষাভাষী আরো কয়েকজনের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। সবাই এই মহৎ উদ্যোগটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দেন। প্রাথমিক ভাবে ৭টি ভিন্ন ভাষাভাষীর ১০ জন সদস্য নিয়ে দুই বন্ধু একটি সংগঠন গড়ে তুলেন।  সংগঠনটির নাম দেওয়া হয় ``The Mother Language Lovers of the World” এই সংগঠনের সাতটি ভাষাভাষী সদস্যদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম ছিলেন বাংলাভাষী, দুই জন ছিলেন ইংরেজীভাষী, দুই জন ছিলেন ফিলিপিনো ভাষী, একজন ছিলেন হিন্দীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন চীনের ক্যান্টলিজভাষী, এবং একজন ছিলেন ভারত-পাকিস্তানের কিছু কিছু এলাকার জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা কাচিছভাষী। এই সংগঠনের মাধ্যমে পরবর্তীতে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম। এই সংগঠনের পক্ষথেকে ২৯শে মে ১৯৯৮ সালে দশ সদস্যের স্বাক্ষর সম্বলিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাব আবারো জাতিসংঘে পাঠানো হয়।
 
এবার কোনো সাড়া না পেয়ে রফিকুল ইসলাম ফোন করেন সেই হাসান ফেরদৌসকে তাদের আবেদনের অগ্রগতি জানার জন্য। জাতিসংঘের পাবলিক ইনকুয়ারীজ ইউনিটের অফিসার (ইন-চার্জ) হাসান ফেরদৌস এবার তাদেরকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরামর্শ দেন। তিনি বলেন ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিদানের যে অনুরোধ তারা করেছে সেটা জাতিসংঘ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছে তবে হাসান ফেরদৌস আরো উল্লেখ করেন যে, এই বিষয়ে বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত জায়গা জাতিসংঘ নয় বরং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঠিক জায়গা হচ্ছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো। দুই বন্ধু এবার ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের প্রোগ্রাম স্পেশালিষ্ট আন্না মারিয়া মাইলফের সাথে ৩রা মার্চ, ১৯৯৯ সালে যোগাযোগ করেন। ভদ্রমহিলা দুই বন্ধুর প্রস্তাবের কথা শুনে বলেন আপনাদের চিন্তাধারাটা অত্যন্ত চমৎকার। আমরা আপনাদের প্রস্তাবটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখছি এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবো। 
 
৪টা এপ্রিল, ১৯৯৯ রফিকুল ইসলামকে ফ্যাক্স পাঠান আন্না মারিয়া। ফ্যাক্সে ভদ্র মহিলা ৫ টি দেশের নাম এবং তাদের ইউনেস্কো অফিসের ঠিকানা দিয়ে ঐ সব দেশকে প্রস্তাবটি জাতিসংঘের ইউনেস্কোতে আনুষ্ঠানিক ভাবে উত্থাপন করার অনুরোধ জানান। সেই পাঁচটি দেশ হচ্ছে কানাডা, ভারত, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরী, এবং বাংলাদেশ। দুই বন্ধু এবার যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই পাঁচটি দেশের ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোকে চিঠি পাঠান। চিঠিতে তারা এটাও উল্লেখ করেন যে, তাদের এই প্রস্তাবটি আসন্ন ইউনেস্কোর  সাধারণ অধিবেশনে উত্থাপন করা হবে এবং এই প্রস্তাব পাঠানোর ডেডলাইন হচ্ছে ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯। হাঙ্গেরী হচ্ছে সেই দেশ যারা ১৬ই আগস্ট, ১৯৯৯ সালে প্রথম এই প্রস্তাবে সাড়া দেন। তারা জানান যে, তারা নিজেরা প্রস্তাব করবে না ঠিকই তবে অন্য কোনো দেশ যদি এই প্রস্তাব করে তবে তারা তার সমর্থন করবে। দুই বন্ধুর মধ্যে এবার কিছুটা আশার সঞ্চার হলো ।
 
দুই বন্ধু অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশ থেকে উত্তর পাওয়ার আশায়। দেরি দেখে রফিকুল ইসলাম এবার বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কাজী রফিক উদ্দিন আহমদের সাথে যোগাযোগ করেন। যোগাযোগ করে বুঝতে পারেন যে, তাদের চিঠিটা বাংলাদেশ সরকার তখনও পান নাই।  দুই বন্ধু সেই দিন চিঠির আরেকটা কপি ফ্যাক্সে পাঠিয়ে দেন। শিক্ষা সচিব ফ্যাক্স পেয়ে যোগাযোগ করলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সাদেক সাহেবের সাথে।  সাদেক সাহেব বিষয়টি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নজরে আনেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি শোনার পর বিষয়টির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে জরুরী ভিত্তিতে আন্তঃমন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন এবং অনেক প্রকার আনুষ্ঠানিকতা উপেক্ষা করে যতদ্রুত সম্ভব প্রস্তাবটিকে প্যারিসের ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।  প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে ডেডলাইনের একদিন আগে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে এসে পৌছে। এবার শুরু হয়ে গেলো সমর্থন আদায়ের জন্য বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তি ও কূটনীতিকদের টানা কয়েক দিনের তৎপরতা।
 
প্যারিসে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, ইউনেস্কো মহাসচিবের সিনিয়র এডভাইজার তোজাম্মেল হক, প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর ইসতিয়াক চৌধুরী এবং বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী সাদেক হোসেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। দুই বন্ধুর মিলিত প্রচেষ্ঠা এবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রুপান্তরিত হলো। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের এই প্রচেষ্টার ফলে ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাবের পক্ষে ইউনেস্কোর ২৯টি সদস্য রাষ্ট্র সমর্থন করে এবং স্বাক্ষর প্রদান করেন। 
 
শুনলে অবাক হবেন যে, এই ২৯ টি রাষ্ট্রের মধ্যে পাকিস্তানও ছিল। সেই পাকিস্তান যেই পাকিস্তানকে নিয়ে এত ঘটনা। যারা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে বর্বরতা ও নির্মমতার চরম বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন যার ফলস্বরূপ ২১শে ফেব্রুয়ারীরমত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচিত হয়। 
 
১৯৯৯ সালের ২৬শে অক্টোবর থেকে ১৭ই নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় ইউনেস্কোর ৩০ তম দ্বিবার্ষিক সাধারণ সম্মেলন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সাদেক হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ইউনেস্কোর সেই সম্মেলনে যোগদান করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা প্রস্তাবটি বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর সচিব প্রফেসর কফিলউদ্দিন আহমদ আনুষ্ঠানিক ভাবে অধিবেশনে উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবটি উপস্থাপিত হয় ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো অধিবেশনের শেষ দিনে। ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য রাষ্ট্রের কেউই এই প্রস্তাবে বিরোধিতা না করায় সর্বসম্মতিক্রমে সেই দিনিই প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। এভাবেই একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ভাষা আন্দোলন ও ভাষা দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রুপান্তরিত হয়। 
 
 
শেখ কামরুল হাসান
সহকারী অধ্যাপক
ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
 
 
রেফারেন্স:
• ড. মোহাম্মদ হাননান, হাজার বছরের বাংলাদেশ, ৩য় সংস্করণ, মে-২০০৫
• আমিনুল ইসলাম মাওলা, ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রস্তাবকের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা, জানুয়ারী ১০, ২০০২ ।
• A Brief History On International Mother Language Day ( IMLD)
• www. motherlanguagelovers.com
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ