"সিয়েরা লিওনের ২য় রাষ্ট্রভাষা বাংলা!!" তথ্যটা কতটা সত্য? নাকি অতিরঞ্জিত??

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩, ১৪:৪৭

মো. আকবর হোসেন
সিয়েরা লিওনে সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক মো. আকবর হোসেন

মনোবিজ্ঞানী হিসেবে পেশাগত কাজে গত বছর (২০২২) পুরোটা সময় আমি সিয়েরা লিওন ছিলাম৷ এ ১২ মাসের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার আলোকে এ অস্বস্তিকর বিষয়টা নিয়ে লিখবো৷ লিখাটা পড়ার পর আপনারাই সিদ্ধান্ত দিবেন, এটা অসত্য না অতিরঞ্জিত!! 

আমাদের মাতৃভাষা "বাংলা" পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট একটা দেশ সিয়েরা লিওনের ২য় রাষ্ট্রভাষা। এ তথ্যটা সর্ব প্রথম আমি জানতে পারি আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে গ্রামীণফোনের একটা বিজ্ঞাপন থেকে। এরপর কয়েকটা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াও এ খবর মুখরোচক এবং আবেগীয়ভাবে প্রচার করতে দেখা যায় বিশেষ করে ২১ ফেব্রুয়ারিতে।  বিসিএস এর পরীক্ষায় ও এ প্রশ্নটা কয়েকবার আসলো এমন "কোন দেশ বাংলা ভাষাকে তাদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে? ৪ টি সম্ভাব্য উত্তরের একটি হলো সিয়েরা লিওন"। নবম ও দশম শ্রেণির" বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়" বইয়ের জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ চ্যাপ্টারেও (১৩৩ পৃষ্ঠা) উল্লেখ করা আছে এমন" সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষা পেয়েছে সে দেশের ২য় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা"। পাশাপাশি বিভিন্ন নামি অনামি অনলাইন পোর্টালে এটা নিয়ে অনেক নিউজ আছে৷

বাংলা ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে৷ সালাম, রফিক জব্বার সহ আরো অনেকেই জীবন দিয়েছেন। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমরা পালন করি৷ বাংলা ভাষা আমাদের একটা আবেগীয় ধারক ও বাহক৷ সেই বাংলা ভাষা অন্য একটা দেশের ২য় রাষ্ট্রভাষা! এটা জানার পর আমাদের চোখ আবেগে টলমল করেই উঠবে৷ আমার ও তাই হয়েছিল।  

পেশায় আমি একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী।  নেদারল্যান্ডস এর একটা মেডিকেল অরগানাইজেশানে মনোবিজ্ঞানী হিসেবে ২০১৮ সাল থেকে কাজ করি৷ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য আমাকে একেক বছর একেক দেশে যেতে হয়। ইথিওপীয়ায় (২০১৮ ও ২০২১), সিরিয়া (২০১৯), নাইজেরিয়ায় (২০২০) কাজ করার পর গত ২০২১ এর নভেম্বরে আমার অফিস থেকে সিয়েরা লিওনে যাওয়ার জন্য আমাকে অপশন দেয়। বাংলা ভাষার ঐ ঘটনার জন্য আগে থেকেই সিয়েরা লিওন নামটা জানা ছিল৷ তবুও সাথে সাথে আমি ইউটিউবে গিয়ে সিয়েরা লিওন লিখে সার্চ দেই৷ "সিয়েরা লিওন: যে দেশের সরকারি ভাষা বাংলা" এ শিরোনামে কয়েকটা ভিডিও সামনে চলে আসে৷ গুগল করে দেখি সেখানেও অনেক নিউজ পেপারের লিংকে একই বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন৷ এসব দেখে সিয়েরা লিওনে ১২ মাসের জন্য যাওয়ার ব্যাপারে দ্রুত অফিসকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেই৷ এবং খুবই এক্সাইটেড হয়ে গেলাম যে ঐ দেশে গিয়ে বাংলায় কথা বলতে পারবো!! 

প্রচন্ড আবেগ নিয়ে ১লা জানুয়ারি ২০২২ এ সিয়েরা লিওন যাত্রা শুরু করি। ৩১ ঘন্টা দীর্ঘ বিমান (৯+১২+১০) ভ্রমন শেষে মধ্য রাতে আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেষে সিয়েরা লিওনের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লুঙ্গিতে অবতরণ করি। ইমিগ্রেশন অফিসার বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখেই এমন আন্তরিকতা দেখালেন যে মনে হলো আমি তার নিকটাত্মীয়।  লুঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে বাই রোডে সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রীটাউনে যেতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা আর আটলান্টিক মহাসাগরের একটা চ্যানেল দিয়ে স্পীড বোর্টে পার হতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। সীকোচ নামে একটা ফেরি কোম্পানির কাউন্টারে গেলে ম্যানেজার ওসমান জানতে চায় আমার দেশের নাম কি? বাংলাদেশ বলার সাথে সাথে সে কাউন্টার থেকে বের হয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো! আমি তো অবাক। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনী লুঙ্গিতে কি কি করলো তার লিস্ট সে আমাকে মুখস্থ বলা শুরু করলো। বুঝতে সমস্যা হলো না যে আগামী ১২ মাস সিয়েরা লিওনে আমার যত্মআত্বীর অভাব হবে না। 

আমাদের অরগানাইজেশানের গেস্ট হাউজে ৭ দিন কোয়ারান্টাইনে থেকে ৯ জানুয়ারি ২০২২ আমি প্রথম ফ্রীটাউনে বের হই। বাংলা সিয়েরা লিওনের ২য় রাষ্ট্রভাষা এটা তো মাথায় ছিলই৷ তাই আমি আমাদের অফিস চালকদের সাথে ২/৪ টা বাংলা কথা বলা শুরু করলাম৷ কিন্তু কেউ কিছু বুঝতেছিল না। সবাই ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলে কিন্তু বাংলার কিছুই জানে না৷ আমি বাংলাদেশী শুনেই সবাই বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনীর ইতিবাচক সুনাম শুরু করলো৷ এরপর তাদের যখন বাংলা ভাষার কথা জিজ্ঞেস করি, সবাই তখন ব্রু কুচকে না বাচক উত্তর দেয়। 

ফ্রীটাউনে ৩ দিন থেকে আমার মূল কর্মস্থল মাকেনি শহরে চলে যাই৷ এবং সেখানে গিয়ে তো আরও এলাহি কারখানা৷ আমি বাংলাদেশী শুনে সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠে, ভাবটা এমন আমি তাদের পূর্ব পরিচিত কোন আত্মীয় যার সাথে অনেক বছর পর দেখা হলো৷ শান্তিরক্ষী বাহিদের নিয়ে নানা রকম স্মৃতিচারণ করতে থাকে৷ প্রথম যেদিন আমি মাকেনি রিজিয়নাল হাসপাতালে যাই সেদিন সেখানকার সরকারি ডাক্তার ও নার্সরা আমাকে পেয়ে খুবই খুশি হয়৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মসজিদ করেছে, স্কুল করেছে, তাদের খাবার দিয়েছে, ঐ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছে, রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে.. ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এত্ত ভাললাগা কাজ করলো আমার মাঝে! বোঝাতে পারবো না৷ কথায় কথায় জানতে পারি ঐ শহর টা মানে  মাকেনি শহর বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনীর অধীনে ছিল। বোম্বালি ডিস্ট্রিক্ট, টংকলিলি ডিস্ট্রিক্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধিনে ছিল। তার জন্য এ সব এলাকার প্রতিটি মানুষ বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীদের প্রতি তাদের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ অনেক নারী তাদের ছেলে সন্তানের নাম রেখেছে "বাংলা"। এরকম একটা মহিলার সাথে দেখা হয়েছে। মাকেনি থেকে অফিসের গাড়ি করে আমি ফ্রীটাউন যাচ্ছিলাম৷ 

বিরতিতে মাসাইকা নামে একটা জায়গায় একটা আম গাছের নিচে অপেক্ষা করতেছিলাম৷ দেখলাম যে একটা মহিলা মুরগি ভাজি করতেছে। এটা দেখে তার অনুমতি নিয়ে ভিডিও করা শুরু করি। তখন মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমার দেশের নাম কি? উত্তর শুনে সে খুব আনন্দিত হয়ে উঠলো। এবং আমাকে জানালো যে ঐ জায়গায় (মাসাইকা) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল৷ তখন তার একটা ছেলে হয়েছে যার নাম সে "বাংলাদেশ" রেখেছে।  আমি পুরো কথোপকথন টা ভিডিও করে আমার ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করি। যেটা দেখে অনেকেই আবেগীত হয়েছে। "বাংলাদেশ" নামে ঐ ছেলেটার সাথে কয়েকবার দেখা করার চেষ্টা করেও অসফল হলাম৷ 

মাকেনি তে ফিরে আসি৷ আমি ধরে নিলাম যেহেতু সেনাবাহিনী এই এলাকায় কাজ করেছে,  তাহলে এসব এলাকার মানুষ অন্তত "বাংলা" ভাষার বিষয়টা জানবে। আমি আমার অধীনে কাজ করা ৬ জন কাউন্সিলরকে প্রথম জিজ্ঞেস করি বাংলা সিয়েরা লিওনের ২য় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে। তারা তো যেন আকাশ থেকে পড়লো। এ ধরনে কথা তারা শোনেও নাই৷ তারা আমাকে জানালো তাদের রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি।  ২য় সর্বাধিক ভাষা হলো ক্রিয়ো (Krio)। ধীরে ধীরে এটা জানার জন্য আমি আমার অন্য সব কলিগকে জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম। সবার উত্তর,  ২য় রাষ্ট্রভাষা কখনও যদি হয় সেটা হবে ক্রিয়ো। 

হাসপাতালের একজন সরকারি ডাক্তার, নাম কর্নেল বাল্লা। সে সিয়েরা লিওনের মিলিটারিতে ছিল ডাক্তার হিসেবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে সে সুদানে একসাথে একই ক্যাম্পে কাজ করেছে৷ তাকে আমি বাংলা ভাষার কথা জিজ্ঞেস করলাম। সে আমাকে বললো যে সে ২ একটা বাংলা শব্দ পারে। "কেমন আছো? আমি ভাল আছি, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি"। তার মুখে আমার মাতৃভাষা শুনে আমি মহা আনন্দিত হয়ে গেলাম। তাকে ও বাংলা ২য় রাষ্ট্রভাষার বিষয়টা জিজ্ঞেস করলাম। সে উত্তর দিল এরকম কিছু হলে সে অবশ্যই শুনতো। এ ধরনের কোন কথা সে শোনেনি। হাল না ছেড়ে আমি আরও জানার জন্য  আস্তে আস্তে অনেক পেশার মানুষ কে জিজ্ঞেস করা শুরু করি৷ উত্তর টা বেশিরভাগই এমন ভাব যে," আমাদের সিয়েরা লিওনে ভাষার কি এত অভাব পড়েছে যে বাংলা ভাষা কে ২য় রাষ্ট্রভাষা করতে হবে!!  

প্রসঙ্গত: সিয়েরা লিওনে অফিসিয়াল ভাষা ইংরেজি ছাড়াও আরও ২৩ টা ভাষা আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Krio, Temme, Mende, Kono, Kissi, Limba, Kuranko এবং Fula।  এরমধ্যে বেশ কয়েকটা ভাষা বিলুপ্তপ্রায়৷ কারণ হলো দিনদিন ক্রিয়ো ভাষার জনপ্রিয়তা৷ Krio ভাষা টা কে Broken English ও বলা যায়। Verb টা ইংরেজির মত হওয়ায় ইংরেজি জানা যে কেউ পুরো ক্রিয়ো না জানলেও বুঝতে পারবে কি নিয়ে কথা হচ্ছে৷ ইংরেজি এবং ক্রিয়ো কাছাকাছি হওয়ায় দিনদিন ক্রিয়োর ব্যবহার বাড়তেছে সিয়েরা লিওনে। 

আমার বাসা থেকে ৩ মিনিট হাটা দূরত্বে একটা মসজিদ। মাগরিব, এশা আর ফজর পড়তে আমি সেই মসজিদে যেতাম৷ সে সূত্রে ঐ মসজিদের ইমাম এবং এলাকার মুসল্লীদের সাথে ভাল প্রতিবেশীমূলক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল আমার। মসজিদের ইমাম যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খুব কাছাকাছি ছিল। তাকেও প্রসঙ্গত প্রশ্ন টা করেছিলাম৷ সেও একই উত্তর দিল, এ ধরনের কথা সে শুনে নাই।  মুসল্লিরাও একই উত্তর দিল যে তারা এটা শোনে নি। 

বোম্বালি ডিস্ট্রিক্টের অনেকগুলো স্কুলে আমি ভিজিট করেছি। তাদের ক্লাসে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের বলেছি কারণ তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতো না৷ মাকেনি শহরের আহমাদিয়া মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম থেকে দ্বাদশ শ্রেনি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সাথে আমি কথা বলেছি। তাদের কোন পাঠ্যবইতেও এরকম কোন তথ্য নেই৷ স্কুলের শিক্ষকদের ও বাংলা ভাষার বিষয়টা জিজ্ঞেস করেছি। উত্তর অইতিবাচক। তারা জানে না এরকম কোন তথ্য৷ 

সঠিক তথ্য জানার হাল আমি তখনও ছেড়ে দেই নি। মাকেনি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আর্নেস্ট বাই করোমা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ক্যাম্পাস মাকিনে শহরে অবস্থিত।  আমি দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি, ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কথা বলেছি৷ বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাজ নিয়ে সবাই খুবই ইতিবাচক তথ্য জানে। কিন্তু বাংলা ভাষার বিষয়টা তারা কেউ জানে না। কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর উত্তর ছিল, কখনও যদি সিয়েরা লিওনে ২য় রাষ্ট্রভাষা হয়, সেটা হবে Krio। 

বাংলাদেশের ২টা অরগানাইজেশান "ব্রাক" এবং "আশা" অনেক বছর ধরে সিয়েরা লিওনে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করতেছে। তারমধ্যে একজন ১২ বছর, একজন ৫ বছর ধরে সিয়েরা লিওনে জব করতেছেন৷ উনাদের সাথে দেখা হলে বিষয়টা জানতে চাই৷ মুকুল বিশ্বাস নামে এক ভাই জানালো, সিয়েরা লিওনে আসার পর উনিও এ বিষয় জানার চেষ্টা করেছেন৷ 
"বাংলা" সিয়েরা লিওনের ২য় রাষ্ট্রভাষা: বিষয়টা নিয়ে উনি মাকেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটের এক প্রফেসর কে প্রশ্ন করেছেন, ২ জন্য বর্তমান সংসদ সদস্যের কাছে বিষয়টা জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ এ বিষয়টা জানে না এবং তথ্যটা শুনে সবাই যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করতো। 

মোট কথায় গত ১ বছর (২০২২) সিয়েরা লিওনের প্রতিটি পেশার মানুষের কাছে বিষয়টা জানতে চেয়েছি৷ একটা মানুষ ও এ বিষয়ে কিছুই জানে না। অথচ আমাদের বাংলাদেশে এটা নিয়ে কত কি হয়ে যাচ্ছে!! 

আরেকটা বিষয় এখানে যোগ করা দরকার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটা স্কুল এবং মসজিদ করেছে।  তার কয়েকটার নাম বাংলা স্কুল, বাংলা মসজিদ কিন্তু সেখানে বাংলা ভাষার কোন প্রচলন নাই৷ অথচ একটা টিভি রিপোর্টে বলতে শুনলাম, বাংলা ভাষা শিখানোর জন্য আলাদা স্কুল ও আছে সিয়েরা লিওনে। 

এতক্ষণ যা আমি বললাম সবটাই আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যা ২০২২ এ সিয়েরা লিওনে থাকা অবস্থায় আমি জানার চেষ্টা করেছি। এটার উপর ভিত্তি করে, আপনারাই বলুন, "বাংলা সিয়েরা লিওনের ২য় রাষ্ট্রভাষা, এটা সত্য না কি ডাহা অসত্য!! 

প্রশ্ন করতে পারেন, যদি ঘটনা ঘটে কিছু না কিছু তো ঘটে, তাহলে এ তথ্যটা কোথা থেকে আসলো! মূল টা কি? আসুন মূল বিষয়টা আলোচনা করি যেটা আমি গুগল রিভিউ করে জানতে পেরেছি। 

ব্রিটিশ থেকে ১৯৬১ সালে স্বাধীন হওয়া দেশ সিয়েরা লিওনে ১৯৯১ সালে গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়৷ ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়৷ বাংলাদেশ সহ ১৩ টি দেশ থেকে জাতিসংঘ সিয়েরা লিওনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠায়। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে ৭৭৫ জন সেনাসদস্য লুঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলকার দায়িত্ব পায়৷ এরপর ধীরে ধীরে আরও বেশি সংখ্যাক সেনা সদস্য সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যায়৷ বিভিন্ন সময়ে সর্বমোট ১২ হাজার সেনাসদস্য সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে যা উপরে বর্ননা করা হয়েছে এবং সিয়েরা লিওনের সর্বস্তরের জনগণ সেসব অবদানের জন্য আজও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটা নিয়ে একটা ভিডিও আমার ইউটিউব চ্যানেলে আছে৷ 

যেমনটি উল্লেখ করা হলো উপরে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অনেক স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ এবং রাস্তাঘাট নির্মান করেছে সে সময়। সবচেয়ে বড় কাজ ৫৩ কিলোমিটারের একটা রাস্তা ২০০২ সালে শেষ করে। ততকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ তিজান কাবা ২০০২ সালে ঐ রাস্তাটা উদ্বোধন করেন৷ সে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাংলা কে "Honorary State Language of Sierra Leone" ঘোষনা দেন। কিন্তু সেটা নিয়ে পরবর্তীতে কোন রকম সরকারি অধ্যাদেশ জারি করা হয় নি বা দাপ্তরিক কোন ডকুমেন্টস নিশ্চিত করা হয় নাই৷ এবং এ ঘোষণার ও কোন প্রমাণপত্র আজ পর্যন্ত কোন মিডিয়া দেখাতে পারেনি ৷ ঐ মৌখিক ঘোষণার কিছুদিন পরই আহমেদ কাবা বাংলাদেশ সফরে আসেন৷ এবং ২০০২ সালে ভাষা দিবসের সুবন্ত জয়ন্তী উদযাপন করা হয়৷ সবকিছু মিলিয়ে তখন মিডিয়া এ মৌখিক এবং আবেগীয় ঘোষনা কে ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। 
 
এ খবরটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় পাকিস্তানী একটা নিউজপোর্টালে যদিও পরে তারা খবরটি সরিয়ে নেয়৷ কিন্তু বাংলাদেশী মিডিয়া সেটা লুপে নিয়ে কোন রকম প্রমান উপস্থাপন না করেই প্রচার করতেই থাকে এবং এখনও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট তিজান কাবার বরাত দিয়ে এই ডাহা অসত্য এবং অতিরঞ্জিত তথ্যটি প্রকাশ করে যাচ্ছেন।  

এটা অতি স্বাভাবিক যে মিডিয়ার কাজই হলো সত্য মিথ্যা যাচাই না করে বাড়তি কাটতির জন্য আবেগীয় বিষয়গুলো কে রংচঙ মাখিয়ে পাবলিশ করা। সেটা তারা করতেই পারে এবং আরও করবে। তাই বলে কোন রকম অকাট্য প্রমাণ ছাড়া এটা বিবিএসের মত পরীক্ষায় কেমনে আসে? পাঠ্যবইয়ে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়? প্রশ্নগুলোর উত্তর কখনই পাওয়া যাবে না৷ 

কাজের প্রয়োজনে আমি ছুটে বেরিয়েছি সিয়েরা লিওনের প্রত্যন্ত এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। একদিন এক জঙ্গলের মধ্যে আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলি৷ হঠাৎ একটা লোকের সাথে দেখা যে আমাদের পথ দেখিয়ে দেয়৷ সেও কথা প্রসঙ্গে যখন জানতে পারে আমি বাংলাদেশী, সাথে সাথেই সে লোকটি বলতে শুরু করে যে, যুদ্ধের সময় সে স্কুলে পড়তো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদেরকে বিস্কুট দিত, জামা কাপড় দিত৷ এই কথোপকথন টাও আমি ভিডিও করি এবং আমার ইউটিউবে আপলোড দিয়েছিলাম।  

সিয়েরা লিওনে থাকার পুরো সময়টায় সেখানকার জীবনযাপন, কৃষি, গ্রামীন জীবন, কৃষ্টি, কালচার নিয়ে অনেক ভিডিও আপলোড করেছি আমার ইউটিউব চ্যানেলে৷ তখন সবাই কমেন্ট করে বাংলা ভাষার বিষয়টা জানতে চাইতো৷ সেটার উপর ভিত্তি করে আমি ওখানকার সাধারণ মানুষ সহ অনেকে পেশাজীবির সাক্ষাৎকার নিয়েছি৷ সে ভিডিও তে তারা কথা বলেছেন সেনাবাহিনীর ভাল কাজ নিয়ে, স্মৃতিচারণ করেছেন যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে প্রাপ্ত সহযোগীতা নিয়ে। মন থেকে দোয়া করতেছেন তারা এখনও বাংলাদেশের জন্য, সেসব সেনাবাহিনীর জন্য৷ সে একই ভিডিও তে তারা কথা বলেছেন বাংলা ভাষার বিষয়টা নিয়ে৷

ভিডিওটার লিংক এখানে দিলাম (https://youtu.be/qz1QEoNzsGI)। অন্তত এটা দেখলেও নিশ্চিত হবেন, বাংলা সিয়েরা লিওনের  ২য় রাষ্ট্রভাষা, এটা একটা ডাহা অসত্য এবং অতিরঞ্জিত কথা। 

উপরোক্ত ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আশা করি সবাই সত্য টা মেনে নিবেন৷ এ অসত্য তথ্যটা পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দেয়া থেকে বিরত থাকবেন। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা,  আমাদের প্রাণের স্পন্দনের ভাষা। আমাদের আবেগ, আমাদের স্বাধীনতার প্রেরণা।  এইসবই আমাদের জন্য যথেষ্ট যুগ যুগ ধরে বাংলা ভাষা কে ভালবাসার জন্য। আমাদের প্রাণের ভাষা অন্য কোন দেশের ২য় রাষ্ট্রভাষা হয়ে থাকলেও সেটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হওয়ার কথা নয়৷ 

লেখাটা শেষ করার আগে একটা বিষয় আমার মতামত শেয়ার করবো৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সিয়েরা লিওনে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সে দেশের আপামর জনসাধারণের মনে যেভাবে জায়গা করে নিয়েছে, সেই সুযোগটা আমরা কাজে লাগাতে পারি নাই।  পুরো সিয়েরা লিওনের বেশিরভাগ ব্যবসা-বানিজ্য লেবানিজ এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দখলে অথচ বাংলাদেশীদের জন্য এটা বড় সুযোগ ছিল৷ সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশের কোন দূতাবাস নাই৷ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাজের স্বীকৃতির উপর ভিত্তি করে আমাদের সরকার পারতো দুদেশের সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিতে৷ বাট আমরা সেটা পারি নি৷ আমরা পড়ে আছি "বাংলা সিয়েরা লিওনের ২য় রাষ্ট্র ভাষা" এ মিথ্যা আবেগ নিয়ে৷ 

আমি ভাল লিখতে পারি না তবুও ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। সবাই ভাল থাকবেন। 

 

মো. আকবর হোসেন 
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, 
নুকুস, উজবেকিস্তান (বর্তমান কর্মস্থল) 
এমএসএফ- নেদারল্যান্ডস

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ