আমেরিকান হ্যাপিনেস

ধারাবাহিক প্রথম পর্ব

প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৩, ১২:২৮

ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন

‘আমেরিকান ড্রীম’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে আমেরিকার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যাবস্হায়। পৃথিবীর সকল প্রান্হ থেকে বিভিন্ন জাতি গোষ্টির আগমন ও স্বমন্বয়ে সৃষ্ট বৈচিত্রময় আমেরিকান জীবনের কোন এই রহস্য আমেরিকান ড্রীম বা আমেরিকান স্বপ্ন। কি সেই স্বপ্ন, যার স্বপ্নে বিভোর হয় রংগীন পৃথিবীর বিভিন্নকোন থেকে সমবেত হয় স্বপ্ন স্বারথীরা।

তারা কি সত্যি কোন জীবন্ত স্বপ্নের প্রত্যাশায় পাড়ি জমিয়ে আবাস গড়ে এই আটলান্টিকের পাড়ে।বিশ্বের সব ভালো ভালো নামকরা দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের সকল ভালো ছাত্ররা একবারের জন্য আমেরিকায় আসতে এখানকার একটা সার্টিফিকেটের জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। সকল টাকা ওয়ালা, ব্যবসায়ি থেকে শুরু করে শিক্ষক, আমলা ধনীর দুলালী, স্ত্রী ও পুত্ররা কিসের আশায়, স্বপ্নের ভেলায় পাল উঠিয়ে পাড়ি জমায় সাত সমুদ্র তের নদীর ঐ পাড়ে, গড়ে স্হায়ী নিবাস।

কি সেই প্রাপ্তি? আমার তিরিশ বছর আমেরিকান জীবনের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, সামাজিকতা ও পেশার অভিজ্ঞতায় রিসার্চ শেষে বের করতে চেয়েছি সেই স্বপ্নের চাবি ও প্রাপ্তির ব্যাপ্তি। সেই স্বপ্ন কি সত্যিই বাস্তব না অলীক।

১৭৭৬ সালে আমেরিকা সৃষ্টির পরিকল্পনা বা স্বাধীনতা ঘোষনার মুখবন্ধে ( Declaration of Independence) পাঁচ জাতীয় নেতা, ও জাতির জনক জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, বেন্জামিন ফ্রাংকলিন, জন এডামস  ও জন মেডিসনরা লাইফ, লিবার্টি ও পারসুয়েট অফ হ্যাপিনেসের (Life, Liberty and Pursuit of Happiness) যে অংগীকার করেছিলেন তার বাস্তবায়ন কি আমেরিকানদের জীবনে এসেছে নাকি এখনও তা অংগীকারই আছে। 

আর যদি নাই এসে থাকে তবে তা কোথায় আটকে আছে এবং কেন? এ প্রশ্নের উত্তরও এত সহজ নয়। এই শত বছরের উপাখ্যান এক লিখায় সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।

আঁড়াইশত বছর পূর্বে প্রতিটি আমেরিকান নাগরিকের জন্য লাইফ, লিবার্টি ও পারসুয়েট অফ হ্যাপিনেসের অংগীকারের সময় সেই সমাজ ব্যাবস্থায় কৃতদাস প্রথা প্রচলিত ছিল। 

কৃতদাসরা সমাজে সাধারন নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। শিক্ষা ও আর্থিকভাবে সমাজের অনঅগ্রসর জাতি গোষ্টি, উপজাতী যেমন রেড ইন্ডিয়ানরাও সেসময় সেইসব অংগীকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা তা স্পষ্ট ছিল না। 

তদুপরি বিবাহিত নারীরাও সমাজের অত্যাচারমূলক আচরনের শিকার ছিল যাঁদের হ্যাপিনেস ও লিবার্টিও অংগীকার মোতাবেক ছিল সূদুর পরাহত। 

আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে সিভিল ওয়ারের পর কৃতদাস প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে আমেরিকান সভ্যতার নতুন রুপান্তর ঘটার পরেও, আমেরিকান ডেমোক্র্যাসির গবেষক সমাজবিদ,ফ্রেন্চ দার্শনিক হেনরি টকিয়েভেলি অষ্টাদশ শতাব্দীর গবেষনায় বের করেন যে, অধিকাংশ আমেরিকানরা সুখি না হয়ে তারা অসুখী থাকেন, বিভিন্ন কারনে। এ সংক্রান্ত গবেষনায় তুলে এনেছেন অনেক তথ্য উপাত্ত।

কথা হলো আমেরিকান ফাউন্ডিং ফাদারেরা সেই আঁড়াইশত বা হাজার বছর পরের ভাবনাটিও তারা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই এগুলোর অংগীকার করেছিলেন। 

তারা জানতেন যে, এই লাইফ, লিবার্টি ও পারসুয়েট অফ হ্যাপিনেস তাৎক্ষনিক, দশ, বিশ, পন্চাশ বা শত বছর এমনকি হাজার বছরেও শতভাগ অর্জিত হবে কি না তা নিশ্চিত বা গ্যারান্টি না দিয়ে অংগীকারে সীমাবদ্ধ ছিলেন। কথা হলো সেই অংগীকারগুলো বাস্হবায়িত হচ্ছে কি না বা এর পূর্নাংগ বাস্হবায়ন কোথায় কিভাবে আটকে আছে? তাই আলোচনার মূল বিষয়।

হ্যাপিনেস বা সুখ ও সুখির সংজ্ঞা খুবই জটিল। যেহেতু মানুষের জীবনই আনপ্রিডিক্টেবল। ইউরোপীয়, এংলো ইউরোপীয় চেতনা ও শিক্ষায় এটির ব্যাপক আলোচনা বা কিসে মানুষ সম্পূর্ন সুখি হয় তা অনেকটা অলৌকিক বিশ্বাস, ভাগ্য বা ধর্মের বিষয়েও বটে। 

এ ধরনের হাইপোথ্যাটিকেল আলোচনায় না গিয়েও আমরা সাধারন পার্থিব বিষয় যেগুলো সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্তব্য তা ক্রমান্বযে আলোচনা করতে পারি।

আমেরিকান দার্শনিক , রাজনৈতিক ও সমাজ চিন্তকদের মতে বর্তমান আমেরিকান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় যে বা যিনি ভার্জিনিয়া, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, নিউ হ্যামশিয়ার, ম্যাসাচুয়েটস, ও ক্যালিফোর্নিয়াসহ অধিকাংশ অংগরাজ্যের সংবিধান মোতাবেক নাগরিকগন তাদের লাইফ, লিবার্টি ও পারসুয়েট অফ হ্যাপিনেস শুধু কাগজের অধিকারই ও অংগীকারই নয়, ইচ্ছা করলেই তারা তা বাস্হবায়নের জন্য আদালতের শরনাপন্নও হতে পারেন। আদালত তাদের সকল অধিকার, সুখ শান্তি নিশ্চিতের শতভাগ গ্যারান্টি ও নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য।

প্রফেসর ডেরিন মেকমেহেনের মতে যে কোন আমেরিকান নাগরিক তার হ্যাপিনেস বা সুখাধিকার, অন্য যে কোন ক্ষতি বা অধিকার আদায়ের জন্য আদালতের শরনাপন্ন হতে পারেন, এবং আদালত এ বিষয়ে তার পূর্নাংগ এক্তিয়ার প্রয়োগ ও বাস্হবায়নে বদ্ধ পরিকর, ধর্ম, বর্ন, ও গোত্র নির্বিশেষে। 

তাই পৃথিবীর যেকোন প্রান্থের যেকোন দেশ থেকে আশা যেকোন মানুষ নাগরিকত্ব লাভ করেই এসব অধিকার দাবী ও বাস্তবায়নের অধিকারী হয়ে, প্রত্যেকেই অতি সহজেই একেকজন অধিকার, সচেতন, স্বাধীন আমেরিকান হয়ে উঠেন। (চলবে..)

প্রবাসী লেখক ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন সুদূর আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি পেশায় বাংলাদেশী আমেরিকান আইনজীবি। চমৎকার তথ্য বিশ্লেষণী ও অনুসন্ধানী লেখায় তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ