লালন-এর গানকে বিকৃত করে যৌথ প্রযোজনার বাংলা চলচ্চিত্রে আইটেম গান!

প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:১১ | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:৫৬

আইটেম গান হিসেবে যৌনউদ্দীপক কণ্ঠে গেয়ে, নাচে-অভিনয়ে যৌন উন্মাদনা ফুটিয়ে লালন-এর একটি গানের বাণীকে বিকৃত অর্থে প্রকাশ করা হয়েছে একটি চলচ্চিত্রে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্রের নাম ‘ছেড়ে যাস না’। এই ছবিতে লালন-এর ‘প্রেম রসিকা’ গানটির নতুন করে সংগীতায়োজন করা হয়েছে। 

‘প্রেম রসিকা হব কেমনে’ লালন-এর ভাববাদী গান। এই গানে দৃশ্য ও বস্তুজগৎ থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের জন্য মনোজগতে আত্ম-জিজ্ঞাসার ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এই বাণীকে বিকৃত করে ‘স্বামী’ অর্থ্যাৎ লালনের গানের ‘প্রভু’কে বস্তুজগতের স্বামী বানিয়ে বিকৃত অর্থে প্রকাশ করা হয়েছে।


‘প্রেম রসিকা’ আইটেম গানটির একটি দৃশ্য

ইতঃপূর্বে লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানের দৃশ্যায়নে একটা খাঁচার মধ্যে একটা পাখিকে আটকে রাখতে দেখেছি! অনেকে একধাপ এগিয়ে এনিমেশন করে খাঁচার ভেতর পাখির আসা-যাওয়াও দেখিয়েছেন। অথচ এটি একটি ভাববাদী গান। এই গানে লালন মনের অভ্যন্তরের সত্তাকে তুলনা করেছেন এমন এক পাখির সাথে, যা সহজেই খাঁচা রূপী দেহের মাঝে আসা যাওয়া করে কিন্তু তবুও একে বন্দি করে রাখা যায় না। লালন, মানব আত্মাকে বিবেচনা করেছেন রহস্যময়, অজানা এবং অস্পৃশ্য এক সত্তা রূপে।  

বাহুল্যবর্জিত বাচনভঙ্গিই লালন-গানের প্রাণ। অবধারিত কিছু শব্দ রুদ্ধশ্বাস অপ্রকাশে রেখে, সংক্ষেপে নির্মিত হওয়াই এই ভঙ্গির বৈশিষ্ট্য। দৃশ্য ও বস্তুজগৎ লালন-কাব্য-সৌন্দর্য নয়, এ এক মনোজগতের আত্ম-জিজ্ঞাসার ভাষা।

‘প্রেম রসিকা হব কেমনে’ গানের গূঢ় অর্থ- কামের প্রভাবে মদনরসে মগ্ন না হয়ে কামের শক্তিকে প্রেমে রুপান্তরিত করতে না পারলে সত্যিকারের প্রেমরসিক হওয়া যায় না। আর প্রেমরসিক না হলে ঈশ্বর দর্শন হয় না। তাই, লালন বিধাতার কাছে জানতে চাচ্ছেন, কেন এই চোর দিয়ে চোর ধরাধরি- যার কারণে মানুষের মুক্তি মিলছে না। কিন্তু বিধাতা কিছু বলে না! 

লালনের বিনীত আর্জি, তুমি আমাদের স্বামী (প্রভু অর্থে), তুমি মারলে আমরা নালিশ জানাব কার কাছে। তাই হে প্রাণের পতি (প্রভু অর্থে) কেমনে তোমাতে একাত্ম হব তা জানিয়ে দাও। 

সর্বোপরি মানুষই ছিল লালনের কাছে ঈশ্বর। তাই লালনের কোন কুল নাই শাস্র নাই জাত নাই, আছে শুধু এক মানুষ ভজন। এই দর্শন না জেনে যারা লালনে প্রবেশ করে লালন রূপদর্শন তাঁদের কাছে মায়া।  

আলোচ্য চলচ্চিত্রে বাইজির রঙমহল খানার আদলে তৈরি সেটে অভিনেত্রী নিপুন ঠোঁট কামড়ে, কোমর দুলিয়ে যৌনউদ্দীপকভাবে লালনের ‘প্রেম রসিকা হব কেমনে’ গানটিতে অভিনয় করেছেন। গানের ‘স্বামী’ কথাটা এলেই তিনি জড়িয়ে ধরেছেন অভিনেতা ফেরদৌসকে।

গানের দৃশ্যে কিছুক্ষণ পরপর দেখা গেছে টিনের মগে ঢালা হচ্ছে বিদেশি মদ। নিপুনের পায়ে মদ ঢেলে পা ধোয়া মদ পান করা হচ্ছে। সেটে জ্বলছে একই সাথে হারিকেন এবং বৈদ্যুতিক বাতি। 


‘প্রেম রসিকা’ আইটেম গানটির ভিডিও

গানে নিপুনের সাথে যে ছেলেগুলো নেচেছে তাঁদের পরনে ছিল লুঙ্গির সাথে বুটজুতো, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, মাথায় গামছা, চোখে সানগ্লাস- এ ধরনের উদ্ভট পোশাক। নৃত্য পরিচালনা করেছেন মাসুম বাবুল।

উদ্ভট দৃশ্যায়নের পাশাপাশি গানটি গাওয়াও হয়েছে বিকৃতভাবে যৌন আবেদনময়ী কণ্ঠে। সংগীতায়োজন করেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য আর নতুন করে গেয়েছেন মৌমিতা চট্টোপাধ্যায়, কুমার শানু,  সুজয় ভৌমিক ও রজশ্রী।

বাংলাদেশের ‘ইচ্ছেমত’ ও কলকাতার ‘শুভলগ্ন ফিল্মস’ যৌথভাবে ছবিটি প্রযোজনা করছে। নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুলের সঙ্গে পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন কলকাতার তপন চক্রবর্তী।

লালন ফকির ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।  তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। রবীন্দ্রনাথকেও লালনের গান দারুণভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছিল।

লালন ফকিরের অন্তর্ধানের পর তাঁর জাহের-বাতেন বানীসমুহ,  ভক্তগন পবিত্র কালাম জ্ঞান করে গুরু-শিষ্য পরম্পরার নিষ্ঠার সাথে সংরক্ষণ করেছেন। সেই বাণীর মর্মার্থ বুঝে কিংবা না বুঝে বিকৃত করার অধিকার এই চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের কে দিয়েছে!

কলকাতায় ২৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেয়া হচ্ছে ‘ছেড়ে যাস না’ চলচ্চিত্রটি। তারপরেই হয়তো বাংলাদেশে মুক্তি পাবে।

আসছে ১৭ অক্টোবর ফকির লালন সাঁইজীর ১২৬তম তিরোধান বার্ষিকী। এই দিবসটি সামনে রেখে লালন-এর গানের বিকৃতিসহ কোনও চলচ্চিত্রের মুক্তি কাম্য নয়। লালনের গান নিয়ে সকল প্রকার বিকৃতি বন্ধ হোক। 

লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক