প্রতিমা সাজাতে ব্যস্ত কক্সবাজারে মৃৎশিল্পীরা

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৮:২০

ঈদুল আজহার উৎসবের রেষ এখনো কাটেনি। এরই মাঝে উঁকি দিচ্ছে সনাতনীদের সর্ব বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গাপূজা। ক’দিন বাদেই মহালয়ার মধ্যদিয়ে দেবী দুর্গার আগমন ঘটবে মর্তলোকে। শুরু হবে ৬ অক্টোবর মহাপঞ্চমী তিথিতে দেবীর বোধনের মধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত— সময় পার করছেন কক্সবাজারের মৃৎ শিল্পীরা। পড়েছে প্রতিমা তৈরির ধুম। এবারে কক্সবাজার জেলায় ছোট-বড় ২৮৬ মন্ডপের জন্য তৈরী হচ্ছে প্রতিমা। ফলে কারিগরদের দম ফেলার জুঁ নেই। সব কিছু শেষ পর্যায়ে এখন অপেক্ষা শুধু রঙের আঁচড় দেয়ার।

পরম যত্নে মুর্তিগুলোতে অবয়ব দিতে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করেও সঠিক পারিশ্রমিক না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করেন প্রতিমা কারিগররা। তাই ইতোমধ্যে অনেকেই বাপ-দাদার এ পেশা বদলে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে আর্থিকভাবে লাভবান না হলেও পৈত্রিক পেশা ধরে রাখতে এ কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিমা তৈরির শিল্পীরা।

আবার বিগত বছরের চেয়ে এবার প্রতিমা তৈরীর খরচ দেড় থেকে দিগুণ বেড়েছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এরপরও উৎসব মূখর ভাবে পূজা সম্পন্ন করতে প্রতিমা ও মন্ডপ তৈরীসহ আলোকসজ্জার কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন স্ব স্ব এলাকার পূজা উদযাপন কমিটি নেতৃবৃন্দ।  

কক্সবাজার জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা জানান, গত বছর জেলার বিভিন্ন স্থানে ২৭৬টি মন্ডপে দুর্গাপূজা হয়েছে। এবার ১০টি বেড়ে ২৮৬টি মন্ডপে পূজা হবে। দেবীর আগমন ও প্রস্থান হবে ঘোড়ায় চড়ে। 

তিনি বলেন, আগামী ৬ অক্টোবর মহাপঞ্চমী দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসব শুরু। ১১ অক্টোবর কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই উৎসব। ৭ অক্টোবর মহাষষ্ঠী পূজা থেকে মন্ডপে মন্ডপে বেজে উঠবে ঢাকঢোল আর কাঁসার শব্দ।

পূজা আরম্ভের দিন অতি সন্নিকটে। তাই প্রতিমা পূজা মন্ডপে তোলার উপযোগী করে তুলতে দিনরাত কাজ করছেন মৃতশিল্পীরা (কারিগর)।

কক্সবাজার শহরের লালদীঘির পূর্বপাড়ের হোটেল বিলকিস সংলগ্ন শত বছরের পুরোনো সরস্বতীবাড়ি মন্দির। এই মন্দিরের ভেতরে এখন শোভা পাচ্ছে ছোট-বড় শতাধিক নির্মিয়মান প্রতিমা। বাঁশ-কাঠ আর কাদা মাটি দিয়ে তৈরি প্রতিমাগুলো দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন সনাতন ধর্ম পূজারিরা। 

মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিমার নানা করো কার্য সম্পাদনে ব্যস্ত মৃৎশিল্পী (কারিগর) নেপাল ভট্টাচার্য। কাজের ফাঁকে তিনি রামু, টেকনাফ, উখিয়া, চকরিয়া, খুরুশকুলসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকজনের সাথে প্রতিমা বিক্রি নিয়ে কথা বলছেন। দরদাম করছেন অনেকে। ধর্মীয় কাজের বিষয় বলে অনেকে বেশী দরাদরির কথা না বাড়িয়ে কেউ দিয়ে যাচ্ছেন বুকিং মানি। 

নেপাল ভট্টাচার্য (৮১) বলেন, দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে এই মন্দিরে প্রতিমা তৈরি করছেন তিনি। দূর্গাপূজাকে উপলক্ষ করে গত দুই মাস পূর্ব থেকে এবারও প্রতিমা তৈরিতে হাত দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ২৮টি প্রতিমা সেট তৈরি শেষ পর্যায়ে। প্রতি সেটে দুর্গার সঙ্গে থাকে অসুর, সিংহ, মহিষ, গণেশ, সরস্বতী, কার্তিক ও লক্ষ্মী প্রতিমা। 

তিনি আরো বলেন, আগে একটা প্রতিমা সেট তৈরি করতে খরচ হতো ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। তা বিক্রি হতো ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। কিন্তু এখন বাঁশ, কাঠ, কাদা মাটিসহ প্রতিমা তৈরির উপকরণের দাম দিগুণ, তিনগুণ বেড়েছে। তাই প্রতি সেট প্রতিমা তৈরিতে খরচ পড়ছে ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এখন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বেশি লাভে বিক্রি করা যাচ্ছে না।

কক্সবাজার শহরের প্রতিমা তৈরির আরেক কারিগর বাবুল ভট্টাচার্য (৪৭) বলেন, রামুর বাঁকখালী নদী থেকে কাদা মাটি কিনে এনে প্রতিমা তৈরি করতে হয়। তারপর কাঠ, সুতা, খড়, রং, কাপড় ও মুকুট দিয়ে এক সেট প্রতিমা তৈরি করতে সময় লাগে পাঁচ দিন। কিন্তু প্রতিমা সেট বিক্রি করে তেমন লাভ হচ্ছে না। এরপরও ২৩ বছর ধরে এ পেশায় থেকে একপ্রকার প্রতিমার মায়ায় আটকে গেছি। তাই টানা পোড়নে থাকলেও পেশা ছাড়তে পারছি না।   

অপরদিকে, শহরের ঘোনারপাড়া কৃষ্ণানন্দধাম মন্দিরে প্রতিবছরের মতো এবারও তৈরি করা হচ্ছে বিশাল দুর্গাপ্রতিমা। চট্টগ্রাম থেকে আনা কারিগর অবিশ্রান্ত সময় ব্যয় করছেন এখানে। 

ঘোনারপাড়া দুর্গাপূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি স্বপন পাল বলেন, এই মন্দিরে প্রতিমা স্থাপন ও আলোকসজ্জার বিপরীতে খরচ হচ্ছে প্রায় সাত লাখ টাকা, যা গত বছর পাঁচ লাখ টাকায় হয়েছে।

কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও কেন্দ্রীয় কালী মন্দির পূজা উদযাপন কমিটির অর্থ সম্পাদক সুমন কান্তি দে জানান, বিগত বছরের চেয়ে এবার প্রতিমাসহ পূজার সকল আনুসাঙ্গিকের খরচ বেশী পড়ছে। গত বছর প্রতিমাসহ অন্যান্য খরচ মিলে সাড়ে চার লাখ টাকায় পূজা সম্পন্ন হলেও এবার ছয় লাখ টাকার উপর খরচ পড়ছে। অন্য সময়ের মতো এবারও চট্টগ্রাম থেকে শিল্পী এনে প্রতিমা ও মন্ডপ তৈরীর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। 

কালিবাড়ির পর ঈদগাঁওতে খুবই ঝাকজমকপূর্ণ ভাবে দূর্গাপূজার আয়োজন করে পালপাড়া প্রগতি সঙ্গের ব্যানারে পালপাড়া সার্বজনীন পূজা উদযাপন পরিষদ। এর উপদেষ্টা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা অনুপম পাল অনুপ বলেন, প্রতিটি মন্ডপ সরকারি একটি অনুদান পেয়ে থাকে। তা অনেক মন্দিরের পূজার প্রকৃত খরচের ১০ ভাগের একভাগও হয় না। এরপরও উৎসব মূখর ও দৃষ্টিনন্দন করতে খরচে কার্পণ্য থাকে না। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তবে, ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়কের বেহাল অবস্থা পালপাড়া থেকেই শুরু। তাই এবার পূজার্থী ও দর্শনার্থী সবাইকে নিশ্চিত ভোগান্তি পোহাতে হবে। এ নিয়ে পূজা কমিটিসহ পাড়ার সবাই উদ্বিগ্ন।

জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি রণজিৎ দাশ জানান, ১১ অক্টোবর লাখো ভক্তের উপস্থিতিতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে দেশের সর্ববৃহৎ প্রতিমা বিসর্জন উৎসব হবে। তাই প্রতিবারের মতো এবারও নিরাপত্তার ব্যাপারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হবে। ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে হবে দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা সভা হওয়ার কথা রয়েছে।

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলে রাব্বি বলেন, প্রতিমা বিসর্জনও কক্সবাজারের পর্যটনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকল ধর্মের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় একিভূত হয়ে সৈকতের বালিয়াড়িতে ওইদিন জড়ো হয়। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও অন্য সব বিভাগরে সমন্বয়ে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরীর চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।