ভেনেরা মিশন : শুক্রগ্রহ জয়ের প্রচেষ্টা

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২২, ১৮:৫৮

প্রযুক্তি ডেস্ক
ছবি : ভেনেরা।

মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন এ আধিপত্য বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) আর আমেরিকার মধ্যে চলছিল কে কত আগে মহাকাশে নিজের আধিপত্য বিস্তার করবে। এরই অংশ হিসেবে ভেনেরা মিশন পরিচালনা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভেনেরা একটি রাশিয়ান শব্দ যার অর্থ ভেনাস। যাকে আমরা শুক্রগ্রহ বলে থাকি। আর ভেনেরা মিশন হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের শুক্রগ্রহ জয়ের সিরিজ মিশন।

ভেনেরা মিশন চলেছিল ১৯৬১ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। শুক্রগ্রহে মোট ৩০ টি মহাকাশযান পাঠানো হয়, যার মধ্যে ১৩ টি শুক্রগ্রহের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করতে পেরেছিল এবং ৮ টি শুক্রগ্রহের মাটিও স্পর্শ করেছিল। শুক্রগ্রহে পাঠানো মহাকাশযানগুলোর মধ্যে ১৬টি সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো।

ভেনেরা-১ ও ভেনেরা-২

১৯৬১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী ভেনেরা-১ উৎক্ষেপণ করা হয়। এটিই প্রথম শুক্রগ্রহে পাঠানো কোনো মহাকাশযান। কিন্তু শুক্রগ্রহের যাত্রাপথেই এটির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ১৯৬৫ সালের ১২ নভেম্বর ভেনেরা-২ কে উৎক্ষেপণ করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী মহাকাশযানটি শুক্রগ্রহে ২৪০০০ কিলোমিটার প্রদক্ষিণ করে। সফল ভাবে শুক্রগ্রহকে প্রদক্ষিণ করলেও কোনো তথ্য পৃথিবীতে পাঠাতে ব্যর্থ হয়। 

ভেনেরা-৩

ভেনেরা-২ উৎক্ষেপণের মাত্র ৪ দিন পর ১৬ই নভেম্বর ১৯৬৫ ভেনেরা-৩ কে উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি পাঠানোর লক্ষ্য ছিলো শুক্রগ্রহের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করানো কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে মহাকাশযানটির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং ১লা মার্চ ১৯৬৬ সালে শুক্রের পৃষ্ঠে ধ্বংস হয়। এটিই প্রথম কোনো মহাকাশযান যা অন্য গ্রহের পৃষ্ঠে ধ্বংস হয়।

ভেনেরা-৪

১৯৬৭ সালের ১২ জুন এটি উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি শুক্রগ্রহের উচ্চ তাপমাত্রা, চাপ এবং ত্বরণ সহ্য করার মত করে ডিজাইন করা হয়েছিল। এটি ১৯৬৭ সালের ১৮ অক্টোবর শুক্রের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। আর এটিই প্রথম কোনো মহাকাশযান, যা শুক্রের বায়ুমন্ডল থেকে তথ্য পাঠাতে সক্ষম হয়। এর থেকে পাওয়া তথ্যেই প্রথম বোঝা যায় শুক্রগ্রহের বায়ুমন্ডলের ৯০-৯৫ ভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড রয়েছে এবং এতে সামান্য পরিমাণ নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প বিদ্যমান।

ভেনেরা-৫ ও ভেনেরা-৬

ভেনেরা-৫ ও ভেনেরা-৬, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারীতে ৬ দিনের ব্যবধানে উৎক্ষেপণ করা হয়। ভেনেরা ৫  এবং ৬ ভেনেরা-৪ এর চেয়ে ছোট প্যারাশুট (১৫ বর্গ মিটার) দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছিল যাতে তারা দ্রুত অবতরণ করতে পারে এবং কার্যকর থাকা অবস্থায় বায়ুমণ্ডলে নীচে নামতে পারে। এছাড়া মহাকাশযান দুটিতে একটি করে ক্যাপসুল ছিল, যাতে শুক্রগ্রহের বায়ুমন্ডল পরীক্ষা করার নানা যন্ত্রপাতি ছিল। কিন্তু মহাকাশযান দুটি শুক্রের বায়ুমন্ডলের চাপে ধ্বংস হওয়ার আগে মাত্র ৫৩ মিনিট কাজ করতে পেরেছিল। এসময় প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে রিড-আউট পাঠিয়েছিল।

ভেনেরা-৭

১৯৭০ সালের ১৫ ডিসেম্বর ভেনেরা- ৭ কে উৎক্ষেপণ করা হয়। এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল শুক্রের বায়ুমণ্ডল থেকে তথ্য পাঠানো, ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করা এবং অবতরণের পর তথ্য পাঠানো। এটিই প্রথম কোনো মহাকাশযান যা অন্য গ্রহের মাটি সফলভাবে স্পর্শ করে এবং সেখান থেকে তথ্যও প্রেরণ করে। ভেনেরা-৭ শুক্রগ্রহের তাপমাত্রা পরিমাপ করে যা ছিলো ৪৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৮৮৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এটি মাত্র ২৮ মিনিট চালু ছিলো পরে শুক্রগ্রহের চাপ ও তাপে ধ্বংস হয়ে যায়।

ভেনেরা-৮

১৯৭২ সালের ২২ জুলাই ভেনেরা-৮ উৎক্ষেপিত হয়। মহাকাশযানটি সফলভাবে শুক্রের মাটি স্পর্শ করে এবং ৬৩ মিনিট কাজ করে। যানটি শুক্র গ্রহে পৌঁছাতে ১১৭ দিন সময় নেয়। এটি শুক্রের মাটিতে কতোখানি সূর্যের আলো পরে সেটি পরিমাপ করে এবং ভেনেরা-৭ এর দেওয়া তথ্যগুলো পুনরায় যাচাই করে।

ভেনেরা-৯

ভেনেরা-৯ উৎক্ষেপিত হয় ১৯৭৫ সালের ২০ অক্টোবর। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিশন। কারণ এটিই প্রথম কোনো মানব মিশন যে মিশনে অন্যকোনো গ্রহের পৃষ্ঠের ছবি তোলা সম্ভব হয়। এটিই প্রথম শুক্রগ্রহের পৃষ্ঠে নেমে একটি ১৮০ ডিগ্রী  সাদাকালো ছবি প্রেরণ করে। ছবিটিতে দেখা যায় শুক্রের পৃষ্ঠ মসৃণ তবে ৩০-৪০ সেমি পাথরে পরিপূর্ণ। যানটি ৫৩ মিনিট কাজ করার পর ধ্বংস হয়ে যায়।

ভেনেরা-১০

১৯৭৫ সালের ১৪ জুন ভেনেরা-১০ উৎক্ষেপিত হয়। শুক্রগ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ করে ২৩শে অক্টোবর ১৯৭৫ সালে এবং এর ২ দিন পর এটি শুক্রের পৃষ্ঠে অবতরণ করে। এটিও শুক্রের পৃষ্ঠ থেকে ১৮০ ডিগ্রী ছবি পাঠায় এবং শুক্রগ্রহের বায়ুমন্ডলে বায়ুর গতিবেগ নির্ণয় করে যা সেকেন্ডে ৩.৫ কিমি।

ভেনেরা-১১ ও ভেনেরা-১২

১৯৭৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ভেনেরা- ১১ এবং ১৪ সেপ্টেম্বর ভেনেরা-১২ উৎক্ষেপিত হয়। এই মহাকশযান দুটোই শুক্রের পৃষ্ঠ অবতরণ করে। মহাকাশযান দুটোতে প্রথমবারের মতো কালার ক্যামেরা পাঠানো হয়। তবে তা ছবি তুলতে পারেনি, কারণ পৃষ্ঠ স্পর্শ করার সময় ক্যামেরা নষ্ট হয়ে যায়। তবে ভেনেরা-১১ মেঘের স্তরে বজ্রপাত শনাক্ত করতে পেরেছিল এবং কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণও নির্ণয় করতে পেরেছিল।

ভেনেরা-১৩

১৯৮১ সালের ১০ অক্টোবর এটি উৎক্ষেপিত হয়। এটি একটি অত্যন্ত সফল মিশন ছিল। কারণ এটি এর সাথে নিয়ে গিয়েছিলো মাইক্রোফোন যা প্রথমবারের মত শুক্রগ্রহের বায়ুচলাচলের শব্দ রেকর্ড করেছিল। যা ছিলো প্রথম কোনো মহাকাশযানের বাইরের কোনো গ্রহের বায়ুর শব্দ ধারণ। যানটি ৩২ মিনিট স্থায়ী থাকার কথা থাকলেও এটি শুক্রের পৃষ্ঠে ১২৭ মিনিট স্থায়ী ছিল। এছাড়া এটি ৩৬০ ডিগ্রী কালার ফটোগ্রাফ পাঠাতেও সক্ষম হয়েছিল এবং এটি শুক্রের মাটি পরীক্ষা করেছিল।

ভেনেরা-১৪

১৯৮১ সালের ৪ নভেম্বর এটি উৎক্ষেপিত হয়। এটিও শুক্রগ্রহের বায়ুর শব্দ রেকর্ড করে এবং ৩৬০ ডিগ্রী রঙ্গিন ছবি প্রেরণ করে। এটির নেফেলোমিটারে তিনটি স্বতন্ত্র মেঘের স্তর সনাক্ত করা হয়েছিল। তাছাড়া এটি শুক্রের মাটির উপর পরীক্ষাও চালিয়েছিল। এটি ৫৭ মিনিট স্থায়ী ছিল।

ভেনেরা-১৫ ও ভেনেরা-১৬

২ জুন ১৯৮৩ সালে ভেনেরা- ১৫ ও ৭ জুন ১৯৮৩ সালে ভেনেরা- ১৬ উৎক্ষেপিত হয়। যান দুটিকে শুক্রগ্রহের ম্যাপ তৈরী করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এরপর নানা কারনে আর ভেনেরা মিশন চালানো হয়নি। ভেনেরা মিশনের মহাকাশযাগুলো এখনকার যান গুলোর মতো না হলেও এই মিশন গুলোই পরবর্তীতে মানুষকে পথ দেখিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার ফেডারেল স্পেস কর্পোরেশন রোসকসমস প্রথম নতুন ভেনেরা মিশন তৈরি করছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ভেনেরা-ডি। ২০২৯ সালে উৎক্ষেপণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, একটি অরবিটার এবং একটি ল্যান্ডার অন্তর্ভুক্ত করবে যা শুক্র গ্রহে ভবিষ্যত মিশনের জন্য একটি মডেল হিসাবে কাজ করবে।

সাহস২৪.কম/এএম/এসএস

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত