ওয়ানডে সিরিজ

দ. আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম বিজয়

প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২২, ০৩:১৪

ছবি: সংগৃহীত

তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেঞ্চুরিয়নে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তাদের বিপক্ষে এটিই বাংলাদেশের প্রথম জয়। এই জয়ে ২০ বছরের অপেক্ষা ঘুচলো টাইগারদের, তাও ১৯ ম্যাচ পর। এর আগে এ বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ডকে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে হারিয়ে প্রায় ২০ বছরের খরা কাটিয়েছিল বাংলাদেশ। এবার খরা কাটল দক্ষিণ আফ্রিকাতেও।

শুক্রবার (১৮ মার্চ) সুপার স্পোর্টস পার্ক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৩৮ রানে হারিয়ে ১-০তে এগিয়ে গেল তামিম ইকবালের দল।

এদিন টসে জিতে আগে ব্যাটিং পায় বাংলাদেশ। ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ৩১৪ রান সংগ্রহ করে তামিম বাহিনীরা।

বাংলাদেশের দেওয়া ৩১৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৪৮.৫ ভারে সব উইকেট হারিয়ে ২৭৬ রান তুলতে সক্ষম হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

৩১৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা দক্ষিণ আফ্রিকাকে উদ্বোধনী জুটি গড়তে দেননি শরিফুল ইসলাম। ম্যাচের ৪র্থ ওভারে শরিফুলের পঞ্চম বলটা শর্ট অব আ লেংথ থেকে অ্যাঙ্গেল করে বেরিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ডিফেন্ড করতে গিয়ে খোঁচা মারেন ম্যালান। ব্যাটে হালকা খোঁচা লেগে বল জমে মুশফিকের হাতে। সাথে সাথে আবেদন। কিন্তু আম্পায়ার সারা না দিলেও বিষয়টি নিশ্চিত করেন টিভি আম্পায়ার। চতুর্থ ওভারে প্রথম উইকেট হারাল দক্ষিণ আফ্রিকা। ফেরার আগে ম্যালান করেন ১০ বলে ৪ রান।

তাসকিন আহমেদ। ছবি: এএফপি

এরপর তাসকিনের ৪ বলে ২ উইকেট
ম্যাচের ৯ম ওভারে তাসকিনের অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে ভেতরের দিকে ঢোকা প্রথম বলটা কাইল ভেরেইনার প্যাডে গিয়ে লাগে। এতে আবেদন করলে এলবিডব্লিউ দেন আম্পায়ার। সিদ্ধান্তটা রিভিউ নেননি ভেরেইনা, নিয়েও লাভ হতো না। শুরুটা ইতিবাচক হলেও বেশিদূর যেতে পারলেন না দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটকিপার-ব্যাটার। ফেরার আগে ২৫ বলে ২ চার ১ ছক্কায় ২১ রান করেন কাইল ভেরেইনা।

তার ২ বল পর এইডেন মার্করামকেও ফেরান তাসকিন। একই ওভারের ৪র্থ বলটি ড্রাইভ করতে গিয়ে পয়েন্টে মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে ধরা পরেন ইডেন মার্করাম। শূন্য রানে ফেরেন তিনি। ২ বলের ব্যবধানে ২টি উইকেট নেন তাসকিন আহমেদ। আগের ওভার মেডেন করেছিলেন তাসকিন। ৯ ওভার শেষে ৩ উইকেট হারিয়ে ৩৬ রান দক্ষিণ আফ্রিকার।

ফন ডার ডুসেন। ছবি: এএফপি

ফন ডার ডুসেনের ফিফটি, দক্ষিণ আফ্রিকার ১০০
৩৬ রানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। পরে অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাকে নিয়ে চাপ সামাল দিচ্ছিলেন রাসি ফন ডার ডুসেন। অর্ধশতকও করে ফেলেন তিনি। তাসকিন আহমেদকে মারা ছক্কায় ৫৭ বলে ৫০ হয়ে গেল তার। বাংলাদেশের বিপক্ষে এটি তার প্রথম ফিফটি।

এরপর অধিনায়ক বাভুমাকে বিদায় করেন শরিফুল
টেম্বা বাভুমা ও ফন ডার ডুসেন মিলে ৮৫ রানের জুটি গড়েন। এই জুটিতে আঘাত করেন শরিফুল। ২৭তম ওভারের তৃতীয় বলটির বাড়তি বাউন্সে মুশফিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন বাভুমা। ফেরার আগে ৫৫ বলে ২ চারে ৩১ রান করেন অধিনায়ক।

পরে রাসি ফন ডার ডুসেনের সঙ্গী হন ডেভিড মিলার
দুজনে ৭০ রানের একটি জুটি গড়েন। এরপরই তাসকিনের বলে ফেরেন ডুসেন। ৩৭তম ওভারে তাসকিনের শেষ ওভারের প্রথম বলটি উড়িয়ে মারতে গিয়ে ফুললেংথ থেকে স্লগ করেছেন ডুসেন। অনেকটা দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুণ ক্যাচ নিয়েছেন ইয়াসির আলী। ফেরার আগে ৯৮ বলে ৯ চার ১ ছক্কায় ৮৬ রান করেন ফেরেন ফন ডার ডুসেন।

এরপর মিলারকে সঙ্গ দিতে নামেন আন্দিল ফিকোয়া
ফিফটি করেন মিলার। দুর্দান্ত এক বোলারস ব্যাক ড্রাইভে চারে ফিফটি করেন ডেভিড মিলার। শুরু থেকেই বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে ছিলেন তিনি। মাত্র ৩৮ বলে ৫০ রান করেন মিলার। অন্যদিকে আন্দিল ফিকোয়াকে পেয়ে বসেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ, করেছেন টানা ৫টি ডট বল। তখন ৬০ বলে স্বাগতিকদের প্রয়োজন ১১৬ রান।

এবার মিরাজের উইকেট
৪২তম ওভারের প্রথম বলে মিরাজকে তুলে মারতে গিয়েছিলেন, তবে বল উঠেছিল খাড়া ওপরে। মিড-অফে লিটন দাসের হাতে ধরা পড়ে ফিরতে হয়েছে তাকে। ফেরার আগে মাত্র ২ রান করেন তিনি।

আবারও মিরাজের জোড়া উইকেট, তামিমের দারুণ ক্যাচ
৪৩ ওভারে মিরাজের তৃতীয় বলে ছক্কা হাঁকান মার্কো জনসেন। তার ছক্কা হাঁকানো বলটি ক্যাচ ধরতে গিয়ে ঝুক সামলাতে না পেরে বল উপরের দিকে ছুড়ে বাউন্ডারির বাইরে বেরিয়ে ঝুক সামলে ভিতরে ঢুকে আবারো বলটি হাতের তালুতে বন্দি করেন তামিম। ফেরার আগে ২ রান করেন জনসেন। তাকে ফিরিয়ে নিজের দ্বিতীয় উইকেট নিলেন মিরাজ।

নিজের বলে নিজেই ক্যাচ ধরলেন মিরাজ। ছবি: এএফপি

এই একই ওভারের শেষ বলে কাগিসো রাবাদাকে ফেরান মিরাজ। শেষ বলটি রাবাদার শটে খাড়া ওপরে উঠে যায়। ক্যাচটা নিতে ছুটে এসেছিলেন মুশফিক, কিন্তু ঠিকঠাকভাবেই ক্যাচটি ধরেন মিরাজ নিজেই।

বাংলাদেশের জন্য বিপদজনক হয়ে ওঠা ডেভিড মিলারকেও ফেরালেন মিরাজ। ৪৬তম ওভারে মিরাজের তৃতীয় বলে সামনে এসে খেলতে গিয়ে মিস করেন মিলার, উইকেট সময়মতো ভাঙতে ভুল করেননি মুশফিকুর রহিম। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে জয় পেতে বাংলাদেশের আর কোনো বাঁধা রইলনা। তখন ১ উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার ৭৩ রান, বল ছিল ২৭টি।

শেষের উইকেটে ৩৪ রানের একটি জুটি বাঁধেন কেশব মহারাজ ও লুঙ্গি এনগিডি। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর শিকার হন মহারাজ। ৪৯তম ওভারের পঞ্চম বলে এলবিডব্লিউ হন মহারাজ। মাহমুদউল্লাহদের আবেদনে সারা দেননি আম্পায়ার। পরে রিভিউতে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরেন কেশব মহারেজ। ফেরার আগে ১৬ বলে ৩ চার ১ ছক্কায় ২৩ রান করেন তিনি। এদিকে ১০ বলে ২ ছক্কায় ১৫ রান করে অপরাজি থাকেন লুঙ্গি এনগিডি। অবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২৭৬ রানে থামিয়ে ৩৮ রানে জিতে যায় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের হয়ে মেহেদী হাসান মিরাজ ৪টি, তাসকিন আহমেদ ১০ ওভারে ১ মেডেন নিয়ে ৩৬ রান দিয়ে ৩টি উইকেট নেন, শরিফুল ইসলাম ২টি এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ১টি উইকেট নেন।

এর আগে টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ৩১৪ রান করে তামিম ইকবালের দল।

ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশের আসে ৯৫ রানের বড় একটা স্কোর। প্রথম পাওয়ারপ্লেতে করেন ৩৩ রান। প্রথম ১০ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের এটি দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর। এর আগে ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ৪ উইকেট হারিয়ে সর্বনিম্ন ২৯ রান উঠেছিল। এরপর ৯৫ রানে ভাঙে উদ্বোধনী জুটি। ফিকোয়ার বলে আড়াআড়ি খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হন তামিম। রিভিউ নিয়েছিলেন তিনি, তবে তার রিভিউ টেকেনি। অবশেষে ৬৭ বলে ৩ চার ১ ছক্কায় ৪১ রান করেন ফেরেন অধিনায়ক।

তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। ছবি: এএফপি

তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে আজ একটি রেকর্ড উদ্বোধনী জুটি গড়েছেন তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। এর আগে ২০০৮ সালে বেনোনিতে সর্বোচ্চ ৪৬ রানের জুটি ছিল বাংলাদেশের। সেদিন তামিমমের সঙ্গে ছিলেন ইমরুল কায়েস। আজ লিটনকে সঙ্গে নিয়ে সে রেকর্ড ভাঙলেন তামিম। যদিও ২০১৫ সালে দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৫৪ রানের সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি ছিল। সেদিন তামিমের সঙ্গে ছিলেন সৌম্য সরকার।

এরপর নামেন সাকিব আল হাসান
পরিসংখ্যান বলছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বশেষ ২৫ ইনিংসে মাত্র একটি ফিফটি করেছেন সাকিব। সর্বশেষ গত বছরের জুলাইয়ে ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফিফটিটি করেছিলেন তিনি। এরপর তিন সংস্করণের ক্রিকেটেই বেশ কিছু ইনিংসে ভালো শুরু পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি। শতক তো নয়ই, অর্ধশতকও পাননি।

এদিকে অর্ধশতক করে আউট হলেন লিটন দাস
মহারাজের বেশ নিচু বল জায়গা বানিয়ে খেলতে গিয়ে নাগাল পাননি লিটন, হারালেন স্টাম্প। ঠিক আগের বলেই অর্ধশত পূর্ণ করে রেকর্ড গড়েন লিটন। এ নিয়ে টানা তিনবার ৫০ বা এর বেশি রান করলেন লিটন, আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের শেষ দুই ম্যাচে করেছিলেন ১৩৬ ও ৮৬ রান। আজ অবশ্য ইনিংসটা বড় করতে পারলেন না অর্ধশত পূর্ণ করার পর। আজ ফেরার আগে ৬৭ বলে ৫ চার ১ ছক্কায় ৫০ রান করেন লিটন দাস। তার উইকেট দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম উইকেট পেলেন কেশব মহারাজ।

এরপর নামেন মুশফিকুর রহিম
ক্রিজে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না তিনি। মহারাজকে স্লগ করতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে ডেভিড মিলারের হাতে তুলে দেন মুশফিক। ফেরার আগে মাত্র ৯ রান করেন এই ইউকেটরক্ষক-ব্যাটার।

নামলেন ইয়াসির আলী
তাকে নিয়ে ছুটেন সাকিব। করেন ফিফটি। দুইবার ডাইভ দিয়েছেন রান-আউটের হাত থেকে বাঁচতে। চোটের কারণে আছেন অস্বস্তিতেও। তবে ব্যাটিংয়ে সাকিব জ্বলে উঠলেন ঠিকই। ফিকোয়াকে লং-অফ দিয়ে মারা ছয়ে ফিফটি হয়ে গেল তার। ৫০ বলেই করলেন ৫০ রান। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সাকিবের এটি ৫০তম ফিফটি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তৃতীয়। আদতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিন ওয়ানডেতেই ফিফটি করলেন সাকিব, যদিও সেটি প্রায় ৫ বছরের ব্যবধানে।

সাকিবের মাইলফলকের পরের ওভারে ২০০ পূর্ণ হয় বাংলাদেশের। ইয়াসির আলীর সঙ্গে চতুর্থ উইকেট জুটি আগায় ১০০ রানের পথে। চতুর্থ উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি, আগেরটি ছিল ৬৯ রানের (মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিক)।

সাকিব আল হাসান ও ইয়াসির আলী। ছবি: এফএফপি

এরপই ইসাসিরের ফিফটি
নিজের চতুর্থ ম্যাচে এসে আস্থার প্রতিদান দিলেন ইয়াসির আলী। ৪৩ বলে পূর্ণ করে ফেললেন ফিফটি।

ইয়াসির ফিফটি করার পরই ফিরলেন সাকিব
এনগিডির ইয়র্কার বল স্কুপ করতে গিয়ে হলেন এলবিডব্লিউ। ইয়াসিরের সঙ্গে তার জুটিতে উঠেছে ৮২ বলে ১১৫ রান। ফেরার আগে ৬৪ বলে ৭ চার ৩ ছক্কায় ৭৭ রান করেন সাকিব আল হাসান।

তার পরের ওভারেই ফেরেন ইয়াসির
রাবাদার শর্ট বলে শট খেলে ফেলেছিলেন আগেভাগেই। বল লেগেছে একেবারে ব্যাটের নিচের প্রান্তে, ফিরতি ক্যাচ ধরে ইয়াসিরকে ফেরান রাবাদা। ফেরার আগে ৪৪ বলে ৪ চার ২ ছক্কায় ৫০ রান করেন ইয়াসির আলী। ৩ বলের ব্যবধানে থিতু হওয়া দুইজন ব্যাটসম্যানকে হারাল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের তখন ৪২.১ ওভারে ২৪৩/৫।

এরপর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ১৭ বলে ১ চার ১ ছক্কায় ২৫ রান, আফিফ হোসেন ১৩ বলে ১ চার ১ ছক্কায় ১৭ রান করে আউট হলেও মেহেদী হাসান মিরাজ ১৩ বলে ২ ছক্কায় ১৯ রান এবং তাসকিন আহমেদ ৫ বলে ১ চারে ৭ রান করে অপরাজিত থাকেন। অবশেষে নির্ধারিত ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ৩১৪ রান করে বাংলাদেশ।

দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে মারর্কো জনসেন ও কেশব মহারাজ ২টি করে এবং লুঙ্গি এনগিডি, কাগিসো রাবাদা ও ফেলুকাওয়ে ১টি করে উইকেট নিয়েছেন।

ম্যাচ সেরা হয়েছেন সাকিব আল হাসান।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত