ভাগিরথীর রক্তে রঞ্জিত পিরোজপুর

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৬

সাহস ডেস্ক

মহান মুক্তিযুদ্ধে পিরোজপুরে অসংখ্য হৃদয়বিদারক এবং গর্বের ঘটনাবলী ঘটেছিল। অস্ত্রাগার দখল, ৪ সরকারি কর্মকর্তা ও ৮ মেধাবী ছাত্র হত্যা, গৃহবধূ ভাগিরথীকে রক্তে রঞ্জিত করা, কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে আড়াই শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশুর নারকীয় হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ঘটনা আজও পিরোজপুরের মুক্তিকামী মানুষ স্মরণ রেখেছে।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাষ্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ঐতিহাসিক দুঃসাহসিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল পিরোজপুরে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ১৮ ঘন্টার মধ্যে। 

পিরোজপুরের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা সেদিন তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য এডভোকেট এনায়েত হোসেন খানের নেতৃত্বে মহকুমা অস্ত্রাগার দখল করে ৮০টি থ্রী নট থ্রী রাইফেল এবং ৭ হাজার রাউন্ড গুলি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। শুরু হয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সদ্য লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন্ড পাওয়া পিরোজপুরে ছুটিতে আসা জিয়াউদ্দিন আহমেদের কমান্ডে মহকুমা শহরের ৮টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র পরিচালনা এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ।

৩ মে ২২ বালুচ এবং ৩২ পাঞ্জাবের সংমিশ্রনে গঠিত ২ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে কর্নেল আতিক এবং ক্যাপ্টেন এজাজ গানবোটে চড়ে পিরোজপুরে এসেই শুরু করে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। প্রথম দিনেই শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে এবং ২ শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ভষ্মীভূত করে তারা জানান দেয় যে তারা পিরোজপুরে কি করতে এসেছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অভিযোগে ৫ মে শহরের বলেশ্বর নদের খেয়াঘাটের বধ্যভূমিতে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে সে সময়ের মহকুমা প্রশাসক সিএসপি অফিসার মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিষ্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমান, মহকুমা পুলিশ প্রধান ফয়জুর রহমান আহমেদ (প্রয়াত প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের পিতা) এবং দুর্নীতি দমন বিভাগের দারোগা হিরেন্দ্র মহাজনকে।

এ ছাড়াও ৮ মে মঠবাড়িয়ায় হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন মহাবিদ্যালয়ের ৮ মেধাবী ছাত্রকে। এদের মধ্যে ছিলেন যশোর শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গনপতি হালদার, আযম খান কমার্স কলেজের মেধাবী ছাত্র আনোয়ারুল কাদির এবং মোঃ জিয়াউজ্জামান, আঃ মালেক কাজী, মোঃ গোলাম মোস্তফা, মোঃ আবুয়াল হোসেন, বিরেন মন্ডল এবং নুরুল ইসলাম।

১৩ অক্টোবর পিরোজপুরের পিচ ঢালা সড়ক রঞ্জিত করা হয় গৃহবধু ভাগিরথী রানীর রক্তে। ভাগিরথী মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর ছিলেন এই অভিযোগে ক্যাপ্টেন এজাজের নির্দেশে সুবেদার সেলিম ভাগিরথীর হাত-পা মোটর সাইকেলের সাথে বেঁধে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যায়। এই দৃশ্য দেখে অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরপর ভাগিরথীর নিথর দেহটি বলেশ্বর নদের বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি চালিয়ে নদের উত্তাল ঢেউয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

স্বরূপকাঠীর আটঘর কুড়িয়ানায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রথম দিন হানাদার পাক বাহিনী পর্যুদস্ত হলেও এর কয়েকদিন পর নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে সেখানে গিয়ে তারা আড়াই শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে।

পিরোজপুর মহকুমা ছাত্রলীগের সেই সময়ের সভাপতি মোঃ ওমর ফারুককে একটি যুদ্ধে পরাজিত করে বধ্যভূমিতে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। তাকে বলা হয় পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ফারুক তার সর্বশক্তি দিয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় একটি লোহার রডে পাকিস্তানী পতাকা বেঁধে সেই রডটি ফারুকের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটায় পাকিস্তানী নরপশুরা।

এসব আনন্দ-বেদনার স্মৃতি আজও অম্লান হয়ে আছে পিরোজপুরের মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে। এবারের বিজয়ের মাস অন্যান্য বছরের চেয়ে ভিন্নভাবে উদযাপনের জন্য প্রস্তুত পিরোজপুরের মানুষ। যারা মাতৃভূমির সাথে বেঈমানী করে বর্বর পাক হানাদারদের সহযোগিতা করেছে, মা বোনদের ধরে নিয়ে ওদের উপহার দিয়েছে তাদের মধ্যে শীর্ষ মানবতাবিরোধী পিরোজপুরের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ কয়েকজনের বিচার ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে এবং অন্যান্যদের বিচারও এগিয়ে চলছে। এতে মুক্তিকামী মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

সাহস২৪.কম/মশিউর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত