বাংলার তাজ- তাজউদ্দীন আহমদ

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০১৬, ১২:১২

যে কোন জনগোষ্ঠীর জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর সেই সংগ্রাম যদি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিব্যপ্ত হয় এবং অন্য রাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে তা পরিচালনা করতে হয় তাহলে সুদক্ষ, দূরদর্শী, দৃঢ়চেতা এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত গুনাবলিসম্পন্ন নেতৃত্ব ছাড়া সাফল্য অর্জন অসম্ভব। এ ধরনের নেতৃত্বের উদ্ভব অকস্মাৎ হয়না। তাকে জনগনের মধ্য থেকে ধারাবাহিক কঠোর অনুশীলন, প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে বের হয়ে আসতে হয়। 

ইতিহাসের শিক্ষায় সমৃদ্ধ এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কুটনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে তাকে হতে হয় পারদর্শী। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী নেতার পাশে এক বা একাধিক স্থিতধী, তাত্বিক ও প্রয়োগবাদী নেতার সমাবেশ ঘটে। তিনি বা তারাই সংগ্রামের রূপরেখা প্রনয়ন ও প্রয়োগে প্রধান নেতাকে সহযোগিতা করে থাকেন। ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রধান নেতা জর্জ ওয়াশিংটনের সহায়ক তাত্বিক নেতা হিসেবে টমাস জেফার্সন, ইটালির জনক যোশেফ গ্যারিবল্ডির সংগ্রামে সহায়ক হিসেবে যোশেফ ম্যাৎসিনীর অবদান অবিস্মরনীয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পুরোধা এম. কে গান্ধীর সংগ্রামে জওহরলাল নেহেরু ও অন্যান্যরা হয়ে ওঠেন প্রধান সহযোগী। চায়না বিপ্লবের মহান নেতা মাও সেতুঙ এর প্রধান সহযোগী হিসেবে এন লাই অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেন। অনুরূপভাবে কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর প্রধান শক্তি হয়ে ওঠেন চে গুয়েভারা। 

পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরূদ্ধে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন দলের পক্ষে বেশ কয়েকজন নেতা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সকলকে অতিক্রম করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় হয়ে ওঠে প্রধান প্রতিষ্ঠান। শেখ মুজিব তাঁর জনসম্মোহনী নেতৃত্ব দ্বারা বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করেন। পূর্বোল্লেখিত ইতিহাসের মতো শেখ মুজিবের নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও প্রধান সহযোগী হিসেবে যাবতীয় নীতি-পরিকল্পনায় একজন হয়ে ওঠেন প্রধান ব্যাক্তি। তিনি বাংলার তাজ- তাজউদ্দিন আহমদ। 

চুড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিপক্ষ কর্তৃক বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে একটি পূর্ণমাত্রার সামরিক আক্রমণ চালিয়ে প্রধান নেতা শেখ মুজিবকে বন্দী করা হলে তাজউদ্দীন আহমদই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও অপরাপর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সহযোগিতায় দেশ স্বাধীন করার দূরুহ দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। কিন্তু একদিকে নেতার অনুপস্থিতিজনিত সমস্যা অন্যদিকে ভিন্ন একটি রাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দায়িত্বে পরিনত হয়। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয় স্বাধীনতা লাভের এই সংগ্রাম যে কোন দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে ছিল কঠিন। কেননা দ্বিতীয় ব্শ্বিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ ব্যতীত আর কোন দেশ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পরবর্তী সশস্ত্র যুদ্ধেও মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। 

এসব বিচারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যূদয় এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। এই অর্জনের মূল ব্যাক্তিই হলেন তাজইদ্দীন আহমদ। কিন্তু একই সাথে এ কথা অনস্বীকার্য যে শারীরিক ভাবে অনুপস্থিত থাকলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন যুদ্ধের মূল প্রেরণাশক্তি। তার অনুপস্থিতিতে দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং নেতাকে মুক্ত করে তার হাতে সেই রাষ্ট্র তুলে দেয়ার বহুমাত্রিক জটিল দায়িত্ব তাজউদ্দীন আহমদ পালন করেছেন। 

বড় বিস্ময়ের ব্যাপার, যার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অসীম ধৈর্য ও দৃঢ়তা ছাড়া দেশ স্বাধীন হতো কিনা সন্দেহ রয়েছে, সেই তাজউদ্দীন আজ ইতিহাসের পাতা থেকে নির্বাসিত প্রায়। তাকে কেবল কিছু সংখ্যক উন্নত রাজনীতি মনষ্ক মানুষগণ স্বরণ করেন। 

"যারা সত্য এবং ন্যায়ের জয়গান করেন তাদের কাছে তাজউদ্দীন আহমেদ এবং বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস অঙ্গঅঙ্গিভাবে জড়িত", বাবা সম্পর্কে এভাবেই বয়ান করেন কন্যা শারমীন আহমদ। 

বাবা মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মা মেহেরুন্নেসা খানম এর পুত্র তাজউদ্দীন আহমদ জন্মে ছিলেন গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দার্দোরিয়া গ্রামে, ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই। দশ ভাই-বোন পরিবেষ্টিত এবং রক্ষণশীল, মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা তাজউদ্দীন তার পুরো জীবনই সাদামাটাভাবে যাপন করেছেন। 

এমনই একজন স্বভাবসূলত বীর নেতা এবং বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী, মহান নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁর জন্মদিনে স্বশ্রদ্ধচিত্তে স্বরণ করি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ