৭১’ এর এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:০৪

সাহস ডেস্ক

আজ ৭ ডিসেম্বর, চুয়াডাঙ্গাবাসীর কাছে এক স্মরণীয় দিন। বর্তমানে জেলা সদর চুয়াডাঙ্গা ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দখলদার ও হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয় এই দিন। এদিনে চুয়াডাঙ্গা হয় মুক্ত বা স্বাধীন।

চুয়াডাঙ্গা মুক্ত হবার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় মূলতঃ ডিসেম্বর মাসের প্রথম থেকেই। ডিসেম্বর মাসের প্রথম চুয়াডাঙ্গা মহকুমার সর্বত্র বিশেষতঃ ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ জোরদার হতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে ৬ ডিসেম্বর পরিস্থিতি হয়ে ওঠে চরম উত্তেজনাকর। এদিন সকাল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দখলদার বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয় চুয়াডাঙ্গাকে ঘিরে। একদিকে মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গা মুক্ত করতে চান, অপরদিকে দখলদার বাহিনী চায় তা প্রতিহত করতে। চুয়াডাঙ্গার পশ্চিমে ৬মাইল দুরে দামুড়হুদা থানা। এ থানার দুটি গ্রাম উজিরপুর ও পীরপুর। চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে এ দুটি গ্রামের দূরত্ব ৩/৪ মাইল। এ দুটি গ্রামসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা। এ দুটি গ্রাম থেকে দামুড়হুদা থানা সদরের দূরত্ব ৩/৪ মাইল। এ থানারই আর একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম কার্পাসডাঙ্গা।

চুয়াডাঙ্গার আর একটি থানা সদর হলো জীবননগর। চুয়াডাঙ্গা থেকে এর দূরত্ব ২২ মাইল। দামুড়হুদা ও জীবননগর থানা সদরে ছিল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। এছাড়া চুয়াডাঙ্গার (তৎকালীন মহকুমা) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও ছিল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। ঐদিন অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর দামুড়হুদা থানার উজিরপুর ও পীরপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে, হানাদার বাহিনী তাদের দামুড়হুদা ও জীবননগর থানার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে সেনা সরিয়ে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদরে আসছে। তখনই উজিরপুর ও পীরপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রচার করে যে, যেভাবেই হোক হানাদার বাহিনীকে দামুড়হুদা ও জীবননগরসহ এ দু’টি থানার বিভিন্ন এলাকার হানাদার বাহিনীকে আসা রুখতেই হবে।

মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দামুড়হুদা ও কার্পাসডাঙ্গা থেকে চুয়াডাঙ্গা আসার প্রধান সড়কের একটি কালভার্টের নিচে মাইন পুতে রাখেন। কিন্তু সামান্য ভুলের কারণে ভেস্তে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সমগ্র পরিকল্পনা। হানাদার বাহিনী এখান দিয়ে চুয়াডাঙ্গায় আসার আগেই অজ্ঞাত এক ব্যক্তি কোন কারণে ঐ কালভার্টের নিচ দিয়ে গরুর গাড়ী চালিয়ে আসতে গিয়ে মাইন বিষ্ফোরণে সেখানেই মারা যান। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা নতুন পরিকল্পনা করেন।

চুয়াডাঙ্গা-দামুড়হুদা সড়কের অনতিদূরে মাথাভাঙ্গা নদী। চুয়াডাঙ্গা থেকে দামুড়হুদার দিকে কিছুদূর গেলেই এ নদীর পাড়ে অর্থাৎ দক্ষিণে উজিরপুর ও তৎসহ অনেকগুলো গ্রাম আর ওপারে পীরপুরসহ অনেকগুলো গ্রাম। হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার পর উজিরপুর ও তার আশপাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা নদী পার হয়ে আরো নিরাপদ স্থান পীরপুর ও তার আশপাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হন এবং তাঁরা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর উপর সর্বাত্মক আঘাত হানার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। 

৬ডিসেম্বর বেলা ১০টা-১১টা দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী দামুড়হুদা থানা সদর ও এই থানার অধীন কার্পাসডাঙ্গা সীমান্তবর্তী ক্যাম্প থেকে তাদের সৈন্য সরিয়ে এনে চুয়াডাঙ্গা আসার পথে চুয়াডাঙ্গা-দামুড়হুদা প্রধান সড়কের উক্ত উজিরপুর গ্রাম সংলগ্ন মাথাভাঙ্গা নদীর ধারে অবস্থান নেয়। এক্ষণে পীরপুর ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর এ অবস্থানের খবর পেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদের উপর আক্রমণ চালায়। পাকহানাদার বাহিনীও মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের জবাব দেয়।

মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে থেমে থেমে হানাদার বাহিনীর উপর আঘাত হানতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা এই কৌশল নেয় হানাদার বাহিনীকে চুয়াডাঙ্গা সদর পৌঁছানো বিলম্ব করার লক্ষ্যে। এভাবে এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও হানাদার বাহিনীর সাথে অনুমান ৪/৫ ঘন্টা যুদ্ধ চলে ফলে হানাদার বাহিনীরও চুয়াডাঙ্গা আসা বিলম্ব হয়। এর মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে একজন সংবাদ বাহককে পাঠানো হয় চুয়াডাঙ্গায় সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য। আর পাশাপাশি চলে মুক্তিযোদ্ধাদের হানাদার বাহিনীর সাথে গুলি বিনিময়।

বেশ কিছুক্ষণ পর সংবাদ বাহক চুয়াডাঙ্গা থেকে খবর নিয়ে পীরপুর গ্রামে ফেরেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এবং তিনি জানান যে, পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা থেকে পিছু হটে যাচ্ছে এবং তারা যাচ্ছে আলমডাঙ্গার দিকে। আলমডাঙ্গা তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা মহকুমার একটি থানা। এ অবস্থায় পীরপুর গ্রামের ও তৎসহ আশপাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ অল্প সময়ের জন্য বন্ধ রেখে চুপচাপ থাকে। এদের মধ্য থেকে একটি দল পীরপুর থেকে চলে আসে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার আলোকদিয়া গ্রামে। এদিকে মাথাভাঙ্গা নদীর পাশে অবস্থান নেয়া দামুড়হুদা ও কার্পাসডাঙ্গা থেকে আসা পাকহানাদার বাহিনী সোজা চুয়াডাঙ্গায় চলে আসে এবং তাদের চুয়াডাঙ্গা থেকে আলমডাঙ্গার দিকে পিছু হটা বাহিনীর সাথে তারাও যোগ দিয়ে আলমডাঙ্গামুখি হয়। 

এদিকে দেশের আর একটি মহকুমা অর্থাৎ চুয়াডাঙ্গা মহকুমার খাড়া পশ্চিমে ১৮মাইল দূরে মেহেরপুর থেকেও হানাদার বাহিনী পিছু হটে চুয়াডাঙ্গার দিকে আসতে শুরু করে। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সড়কের দু’ধারে বিভিন্ন ধরনের বোমা ও বিস্ফোরক দ্রব্য পুতে রাখা হয় এ রাস্তার দু’ধারে হানাদার বাহিনীকে খতম করার লক্ষ্যে। এ অবস্থায় হানাদার বাহিনী অতি সতর্কতার সাথে ৬ ডিসেম্বর সন্ধা ৬টায় চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছায়। চুয়াডাঙ্গাতে তাদের কাউকে না পেয়ে মেহেরপুর থেকে পিছু হটা হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গার দিকে যাত্রা করে তবে পথিমধ্যে মুন্সিগঞ্জে তাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়।

চুয়াডাঙ্গা ছাড়ার আগে পাকহানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা টাউন মাঠে ২০০টি বন্দুক ফেলে যায়। এছাড়া তারা চুয়াডাঙ্গা শহর সংলগ্ন মাথাভাঙ্গা নদীর উপর ব্রীজের পূর্বদিকটা উড়িয়ে দেয় ডিনামাইট দিয়ে। চুয়াডাঙ্গা ছাড়ার আগে ৬ ডিসেম্বর সন্ধার পর হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয় যার অন্যতম চুয়াডাঙ্গা বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র।

চুয়াডাঙ্গা মহকুমা সদরসহ মহকুমার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত পাকহানাদার বাহিনী ৬ ডিসেম্বর রাত ৮/৯ টার মধ্যেই চুয়াডাঙ্গা ত্যাগ করে আলমডাঙ্গার পথ ধরে কুষ্টিয়া অভিমুখে যাত্রা করে যা চুয়াডাঙ্গাবাসীর জানা ছিল না। পাকহানাদার বাহিনীর চুয়াডাঙ্গা ছাড়ার এ খবর চুয়াডাঙ্গা মহকুমার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা খবর জানার পর তারা ৭ ডিসেম্বর ভোর থেকে চুয়াডাঙ্গা আসতে শুরু করে এবং এভাবেই চুয়াডাঙ্গা এদিন হয় পূর্ণ হানাদার বাহিনী দখলমুক্ত।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে চুয়াডাঙ্গাতে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি যুদ্ধ পরিচালনা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। চুয়াডাঙ্গার প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আসহাব-উল-হক ছিলেন এ উপদেষ্টা কমিটির প্রধান। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন-প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী ও পার্লামেন্ট সদস্য ব্যারিষ্টার বাদল রশীদ ও তৎকালীন চুয়াডাঙ্গাস্থিত ইপিআর ক্যাম্পের প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। সে সময় চুয়াডাঙ্গা ছিলো দক্ষিণ-পশ্চিম রণক্ষেত্র।

উল্লেখ যে, ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত