পনেরো আগস্ট হত্যাকান্ড এবং এক বালকের স্মৃতিকথা

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০৯:০৬

ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন

পনেরো আগস্ট হত্যাকান্ড এবং এক বালকের স্মৃতিকথা 
ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন

(২য় পর্ব)
সেসময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আদ্যোপান্ত বিস্তারিত না জানলেও জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না করাসহ বিভিন্ন কারণে বালক জিয়াকে অপছন্দ করছিল। মনে তার জেনারেল জিয়ার কর্ম সম্পর্কে ক্ষোভ বা রাগ জন্মেছিল। আজকের বিএনপি সৃষ্টির পূর্বে প্রথমে জাগপা বা জাগদল নামে কী যেন একটি রাজনৈতিক দল বা সংগঠন তৈরি করা হয়েছিল। ময়মনসিংহে বালকের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের বর্তমান মূল ভবনের অদূরেই একটি টিনের লম্বা দুচালা হাফ বিল্ডিং ছিল। ওখানে পূর্বে প্রাইমারি সেকশনের ক্লাস হতো। ঐ ঘরটিতে ক্যারম বোর্ডসহ আরো কিছু খেলাধুলার সরঞ্জাম ছিল। হঠাৎ দেখা গেল ঐ ঘরের ওপরে জেনারেল জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত¡াবধানে সৃষ্ট নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের নামে বিরাট বড় সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছিল। স্কুলের বেশ কিছু সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে বালক ও ক্লাসের আরো কজন গিয়ে ঐ সাইনবোর্ড নামিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে ফেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার সক্রিয় প্রতিবাদ করে। পরদিন স্কুলে যাওয়ার পরপরই পুলিশ স্কুল ঘেরাও করেছিল পুরো স্কুল। হেডমাস্টার অনিল দেবনাথকে ডেকে পুলিশের ওসি কড়া করে সেসব ছাত্রদের নাম যারা সাইনবোর্ড ভেঙেছিল সংগ্রহ করে দিতে দেন-দরবার করেন। ভয়ে বালকের আত্মা শুকিয়ে এসেছিল। তার হেড স্যার কিছুতেই কারো নাম দিলেন না। না দিয়ে সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলেন যে, পরবর্তীতে কিছু করলে তাকে জানাতে, নতুবা এ নিয়ে পুলিশ কোনো ঝামেলা করলে বা কোনো সমস্যা হলে তাকে দায়ী করা যাবে না। 

১৯৮০ সালের মে মাস। বাংলা জ্যৈষ্ঠ। বালক গ্রামের নিজ বাড়িতে সকালে দাঁত ব্রাশ করছিল। তৎকালীন ঢাকার এক নামকরা স্কুলের নামকরা শিক্ষক বালকের চাচাও গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। সকালে উনি বালককে দেখে অত্যন্ত চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুনেছ, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবকে আর্মিরা মেরে ফেলেছে।’ তিনি আরো বললেন যে, ‘ইস! কী একটা বড় ক্ষতিই না হয়ে গেল! তাই না?’ বালক কিছুটা নিজেকে আড়াল করে দুঃখ প্রকাশ করলেও নিজেকে বিচলিত করেনি। 

বালক সেসময়ে রাজনীতি সক্রিয়ভাবে না করলেও মনে মনে ভেবেছিল মেজর জিয়াও তো অন্য কাউকে মৃত্যুর মুখে বা ফাঁদে রেখে ক্ষমতা নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর হাতে অন্য এক সেনানায়কের পতন তো আর নতুন কোনো ঘটনা নয়। কর্নেল তাহেরসহ হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের মার্শাল ল আইনে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন মেজর জেনারেল জিয়া। 

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ করে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেল হত্যার বিচার বন্ধ করে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের সদস্য ও শিশু রাসেলের হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেছেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত বানিয়েছেন। 

জীবন ও সময়ের প্রয়োজনেই সেই বালক তরুণ বা কিশোরে পরিণত হয়ে, আইন বিষয়ে পড়তেই সুদূর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল। তখন বালক তরুণ যুবকে পরিণত। সেই যে, রবিঠাকুরের ‘বালক আর বালক রহিল নার মতোই। বালক সেখানকার ক্যাম্পাসের নিরীহ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ করত। 

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া সংগঠন। ক্যাম্পাসের জোটবদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে, ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্র ঐক্য বা সমিতির মতো সংগঠনগুলোর চেয়েও তাদের সংযত হয়ে রাজনীতি করতে হতো। যেখানে ছাত্র শিবির ও ছাত্রদল পর্যন্ত বড় গলায় বেডাগিরি দেখিয়ে রাজনীতি করত। সেখানে তরুণ কিশোর বালকের ছাত্রলীগ করতে ক্যাম্পাস ও হলে আমাদের নির্ধারিত স্লোগান, চিকা মারা বা পোস্টার পর্যন্ত লাগাতে প্রভাবশালীদের দয়া, অনেকের কৃপা নিয়েই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে কোনোরকম ধরে রেখেছিল।

বালকের মনে আছে, ক্লাসে সাংবিধানিক আইন পড়াতেন তার এক প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. এরশাদুল বারী। তিনি সামরিক আইনে পিএইচডি করেছিলেন। পড়াতেন ডক্ট্রিন অব নেসেসিটি। মানে প্রয়োজনে সামরিক আইন বৈধ। ক্লাসে তার লেকচারে প্রতিদিন কোনো না কোনো প্রসঙ্গ টেনে যে কথাটি বলতেন সেটি ছিল এই যে, শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। যা করা তার মোটেও উচিত হয়নি। অথচ ইনডেমনিটি করে এতগুলো হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধ করে রাখাটা যে, কতটুকু অসাংবিধানিক, ন্যায়বিচার পরিপন্থি তা একবারও বলতেন না। কোনো ছাত্র এ বিষয়ে প্রশ্নও করত না। প্রতিদিন একটি বিষয় 

প্রতিটি ক্লাসে শুনতে শুনতে যখন অসহ্য লাগতে লাগল তখনই সমমনা বড় ভাইদের কাছেও জানা গেল যে, এটি তিনি তার শিক্ষকতার শুরু থেকেই করছিলেন। তখনই কিশোর তরুণ নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে সাহস করে দাঁড়িয়ে তার কথার যুক্তি দিয়েই প্রতিবাদ করেছিল। মনে তার ভয়ও ছিল।

প্রতিদিনের মতো যখনই শিক্ষক ড. এরশাদুল বারী একই প্রসঙ্গ নিয়ে গণতন্ত্র হরণের কথা তুললেন তখনই তরুণ প্রতিবাদ করে বলেছিল যে, সংবিধানের ৪৭-এর ক অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রের যে কোনো একটি মূলনীতি বাস্তবায়ন করতে সরকার যদি নাগরিকের কোনো মৌলিক অধিকারকেও হরণ করে তবে তা বৈধ। 

সংবিধানের চারটি মূলনীতি হলো জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাকশাল গঠন করেছিলেন যা, আদৌ সংবিধান পরিপন্থি নয়। ড. বারী তার এই তরুণ ছাত্রের যুক্তি প্রদর্শনে একটু হোঁচট খেয়ে থেমে থেমে বলছিলেন, হ্যাঁ অসাংবিধানিক নয়, তবে অগণতান্ত্রিক। ছাত্র বলেছিল, স্যার কোনো বৈপ্লবিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে শতভাগ গণতন্ত্র প্রদানের সুযোগ থাকে না। স্যার তরুণ ছাত্রকে তার বাসায় যাওয়ার কথা বলে, এ বিষয়ে আরো বেশি পড়াশোনা করতে। 

এ বিষয়ের ওপর কিছু বই দিবেন বলে ক্লাস শেষ করে অফিসে চলে গিয়েছিলেন। সাংবিধানিক ক্লাসের অনেক ক্লাসমেট ঐ ’৭৫-এর বালক তরুণ ছাত্রকে বলেছিল যে, স্যার হয়ত তোমার ওপর রাগান্বিত হয়েছেন। কিন্তু স্যারের ঐ কথামতো সেই প্রতিবাদী তরুণ ছাত্র অসংখ্যবার বাসায় গিয়েছিল, বইও এনে পড়াশোনাও করেছে। পরবর্তীতে আর কোনো ক্লাসেই কোনো লেকচারেও স্যার এই বিষয়টি আর একইভাবে উপস্থাপন করেননি।

পঁচাত্তরের সেই দশ বছরের বালক সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনপেশার মাঝামাঝি সময়ে ২০০০ সালে আবার জীবনের আবর্তে আমেরিকায় তার স্ত্রীসহ চলে গিয়েছিল। সেখানেও আইন অধ্যয়ন শেষ করে ফেডারেল সরকারের এডজুডিকেশনে নতুন ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মার্কিন জাতীয়তাবাদী নেতাদের ওপর গবেষণা করেন দীর্ঘ পনেরো বছর। 

সেসব গবেষণার বেশ কিছু প্রবন্ধ আকারে দেশীয় পত্রিকাসহ আমেরিকার বিভিন্ন সংবাদ জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছিল।  

বিশ্বের অনেক জাতীয়তাবাদী নেতাকে সামরিক বেসামরিক ক্যু-এর মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার ইতিহাস অনেক আছে। ইউরোপ, আফ্রিকা ও বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে এ ধরনের ক্ষমতার রদবদলের পেছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বেশিরভাগ দায়ী করা হয়। বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকারী বা সমাজতান্ত্রিক ভাবনা সমৃদ্ধ দলসমূহের নেতাদের এর শিকার হতে হয়েছে বেশি। 

চিলির আলেন্দে থেকে শুরু করে বাংলাদেশের শেখ মুজিব পর্যন্ত। তাদের কাউকে রাজনৈতিক কারণে নতুন সরকারের তত্ত¡াবধানে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল আবার কাউকে সরাসরি হত্যাও করা হয়েছিল। পরম ক্ষমতাধর খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই আব্রাহাম লিংকন ও জন এফ কেনেডিসহ মোট চার জাতীয়তাবাদী নেতাকে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। 

প্রতিবেশী বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে তাদের জাতির পিতা সারা বিশ্বের অহিংস আন্দোলনের পুরোধা মহাত্মা গান্ধী, অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী ও তার পুত্র রাজীব গান্ধীকেও আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। সমস্ত হত্যাকান্ডগুলোই ছিল শতভাগ রাজনৈতিক। 

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের হত্যাকান্ডটি পৃথিবীর অন্য সব রাজনৈতিক বা সামরিক হত্যাকান্ডের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এটিই একমাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ড যেখানে শুধু তার পরিবার নয়, আত্মীয়স্বজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীদেরও খোঁজে বের করে হত্যা করা হয়েছিল। এতবড় নির্মম ও নিষ্ঠুর, রাজনৈতিক সংজ্ঞার বাইরে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম বিশ্বের এই একমাত্র হত্যাকাÐটি নিয়ে বিশ্ব রাজনৈতিক  ইতিহাসে তেমন কোনো গবেষণাই হয়নি বলা যায়। 

রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে শুধু ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধান বা তার ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট নেতাদের হত্যা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তার স্ত্রী, শিশুপুত্র, অন্তঃসত্বা পুত্রবধূ, পুত্র, ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়েছিল। কী নিষ্ঠুর জাতিই না আমরা বাঙালি।

সরকার তার অতি সীমিত ক্ষমতা ও পরিসরে হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন করতে যতটুকু প্রয়োজন এর বাইরে কিছুই করতে সমর্থ হয়নি। বঙ্গবন্ধু তার পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনা, তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি তথা বাকশাল গঠনের জন্য বা সমাজতান্ত্রিক বলয়ে থাকার জন্য তাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদে হত্যা করা হয়েছিল বলা হলেও এটি গবেষণাপ্রসূত প্রমাণিত নয়। 

অনেকেই বলেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দু’ভাগে বিভক্ত- এক ভাগ শোষক আর এক ভাগ শোষিত আমি শোষিতের পক্ষে’। একই সভায় থাকা নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ বলেছিলেন যে, তখন থেকেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার দিকে নাখোশ হয়ে, তাকে সরানোর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তার প্রকৃত হত্যাকান্ডটি সেরকম কোনো পদক্ষেপের ফল হিসেবে এখনো প্রমাণিত হয়নি।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী অফিসার মেজর, সুবেদার যারা আবার নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও পরিচিত ছিল, সব সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীকে অন্ধকারে রেখে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করে ক্ষমতা তুলে দিলো সেসময়েরই সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিশ্বাস ঘাতক খন্দকার মুশতাক ও তাদের অনুসারীদের হাতে। সেই হত্যাকান্ডের হুকুমত পালনকারীদের বিচারের সম্মুখীন করা হলেও মূল পরিকল্পনাকারীদের এখনো কি খোঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তবে তা করা জরুরি বলে বালক মনে করে। দেশকে দেশের স্বাধীনতা বলবৎ রাখার স্বার্থেই সঠিক ইতিহাস খুঁজে পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যেতে হবে, যার অন্য কোনো বিকল্প নেই।

 লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সোশ্যাল সিকিউরিটি ল স্পেশালিস্ট,

কমিউনিটি সংগঠক, লেখক ও আবৃত্তিকার

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত