শহীদ ময়েজউদ্দিন (১৯৩০-১৯৮৪) এর ৩৯তম প্রয়ান দিবস

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৩১

মোঃ আমজাদ খান
শহীদ ময়েজউদ্দিন

১৯৩০ সালের ১৭-ই মার্চ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শহীদ ময়েজউদ্দিনের জন্ম। কালীগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে আই.এ, ১৯৫৩ সালে অনার্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান (ঢা.বি) ও ১৯৫৫ সালে এম. এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে সি.এস.পি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকুরিতে যোগদান করেন নাই। ১৯৬০ সালে (ঢা.বি) থেকে এল.এল.বি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দিয়েই ময়েজউদ্দিনের রাজনৈতিক জীবন শুরু ও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য। ১৯৬২ - ৬৩ সালে শহীদ ময়েজউদ্দিন ঢাকা পৌরসভার অধীনে কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদে প্রথমে মৌলিক গণতন্ত্রী (বেসিক ডেমোক্র্যাট) মেম্বার পরে তিনি এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ও উহার অঙ্গসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যাপক সহযোগিতা করেন। ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে। তখন শহীদ ময়েজউদ্দিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিল’ এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। 

শহীদ ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জায়গা দখল এবং আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের প্রধান অবস্থানে এসে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে আপোস করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সরে এসে সবকিছু ভন্ডুল করতে চেয়েছিল। খন্দকার মোশতাক দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সভার আয়োজন করেন কলকাতার থিয়েটার রোডের মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় ভবনের ছাদে। সেই সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ভোটাভোটির জন্য ডিভিশন চাওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সত্তরের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন চিৎকার করে বক্তৃতা দিলেন - “কোন ডিভিশন নয়, কিসের ডিভিশন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোন মূল্যে দলের অবস্থান যা আছে তা-ই থাকবে, কোন নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই উঠে না।” ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে খুনিচক্র খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় বসায়। এরপর মোশতাক সংসদ সদস্যদের সভা ডেকে ঘাতকদের সব অপকর্মের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সভায়ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন সবাইকে হতবাক করে চিৎকার করে বলেছিলেন - “খন্দকার মোশতাক আহম্মেদ অবৈধ প্রেসিডেন্ট, তার কোন নেতৃত্ব মানি না, সে খুনি, ষড়যন্ত্রকারী। আওয়ামীলীগ তার কোন নেতৃত্ব মানতে পারে না।” তিনি যখন এই বক্তব্য দেন তখন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা অস্ত্রহাতে পেছনের সারিতে দাঁড়ানো। বলার অপেক্ষা রাখে না সেই মূহুর্তে তাঁর মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল শতভাগ। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। বক্তব্য শেষ করে আত্মরক্ষার্থে তিনি বাসায় না ফিরে কয়েক দিনের জন্য গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
 
১৯৬৯ সালের ঘটনা। জেনারেল আইয়ুব খানের আহ্বানে পূর্ব বাংলার নেতৃস্থানীয় কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানে যান রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদান করার জন্য। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন প্রমুখ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ মূহুর্তে শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ জনাব ময়েজউদ্দিনকে বললেন, তুমি লাহোর থেকে আজই করাচী দিয়ে দেশে গিয়ে এই চিরকুটটি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নিকট পৌঁছিয়ে দিবে এবং বলবে তিনি যেন অতিসত্ত¡র জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর নিকট চিরকুটটি পৌঁছিয়ে দেন। তখনই তিনি দেশে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ঢাকা কমলাপুর এসেই বেবীটেক্সী যোগে তিনি বেগম মুজিবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। এই হলো শহীদ ময়েজউদ্দিন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বেকুসুর খালাসের পর লাহোর গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী হিসেবে যে দশ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন শহীদ ময়েজউদ্দিন ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।

ময়েজউদ্দিন ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একাধারে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি এফ.পি.এ. বি-র মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। IPPF সহ IOR-র সদস্য ছিলেন। Rexeo-র প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। যে মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যু নিয়ে জাতিসংঘ তথা সমগ্র বিশ্বে আজ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ’৮০র দশকেই এব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তখনই তিনি কালিগঞ্জে নিজ জায়গায় ৩টি মাতৃ সদন স্থাপন করে গেছেন। ঐ একই সময়ে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়া শহীদ ময়েজউদ্দিন বহুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। সমাজসেবক হিসেবে পৃথিবীর বহুদেশে সভা-সেমিনার এবং সম্মেলনে যোগদান করেছেন তিনি। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ ইন্দোনেশিয়া, সৌদী আরব, জর্দান, মালয়েশিয়া, বার্মা, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, রুমানিয়া, কেনিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইরাক, ইরান, কুয়েত, কাতার, চীন, জাপান ও ফিলিপাইন উল্লেখযোগ্য।

১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ¶মতা দখল করলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ধীরে ধীরে রাজপথে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। ধাপে ধাপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রবল গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও নির্দেশে রাজধানীর রাজপথ থেকে কালীগঞ্জের রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন শহীদ ময়েজউদ্দিন। কালীগঞ্জে সামরিক শাসকের দোসররা ততদিনে উপলব্দি করতে থাকে যে, ময়েজউদ্দিনের উপস্থিতিতে কালীগঞ্জের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কালীগঞ্জের ¶মতায় আসার জন্য সামরিক শাসকের সাথে ময়েজউদ্দিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দিশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য ময়েজউদ্দিন নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে চলে যান। মিছিলে নেতৃত্বদানের সময় দিনের আলোতে তাকে হত্যা করা হয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের এই হত্যকান্ড সারাদেশে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশে তাঁর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তীব্রনিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ময়েজউদ্দিনের আত্মদান ধীরে ধীরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে  অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শহীদ ময়েজউদ্দিনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলন অবশেষে সামরিক শাসকের পতনকে অনিবার্য করে তোলে। গণতন্ত্রের জয় হয়।

কালীগঞ্জের সাধারণ মানুষের নিকট তিনি গণমানুষের নেতা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। শহীদ ময়েজউদ্দিন একুশে পদকে ভূষিত হন। গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেয়া শহীদ ময়েজউদ্দিনের কথা স্মরণ রেখেই হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ময়েজউদ্দিন কন্যা মেহের আফরোজ চুমকীকে ১৯৯৬ সালে গাজীপুর-নরসিংদী জেলার সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি মনোনীত করেছিলেন। পরবর্তীতে নিষ্ঠা, সততা, কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা ও দূরদর্শিতার কারণে তিনি পর পর  তিন বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং দুই বার দক্ষতার সাথে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং মেহের আফরোজ চুমকী “শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক ২০২৩”-এ ভূষিত হন।

“কালীগঞ্জের রাজনীতিতে শহীদ ময়েজউদ্দিন এর মত নির্ভীক দেশপ্রেমিক আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।” (সাবেক এম.এল.এ ফয়জোর রহমান খান ১৯৫৪, কালীগঞ্জ, গাজীপুর)
তাই আজ ৩৯তম শাহাদৎ বার্ষিকীতে শহীদ ময়েজউদ্দিনসহ সকল শহীদদের প্রতি বিন্ম্র শ্রদ্ধা।

লেখক-
মোঃ আমজাদ খান
সহকারী অধ্যাপক
বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত