আধুনিক বাদ্যযন্ত্র আর অপসংস্কৃতির কাছে অসহায় বাউল শিল্পীরা

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১০:৩০

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় বাউল শিল্পীদের গানের আসর। ছবি: সাহস

গ্রামগঞ্জে কোন গানের আসর হলেই দেখা মিলতো বাউলদের। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে বাউল গানের আসর, কমেছে বাউল শিল্পীও। আধুনিক বাদ্যযন্ত্র আর প্রযুক্তির কাছে অসহায় বাউল শিল্পীরা। অর্থ কষ্টে ভালো নেই ময়মনসিংহের শত শত বাউল শিল্পীরা। পরিবার বাঁচাতে পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই।

একসময় পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেখা যেত বাউল শিল্পীদের গান। তাদের গানে উঠে আসত দেশ মাটি, ধর্মীয়, সচেতনতা, ভালোবাসার সুর। সৃষ্টি হয়েছে অনেক কালজয়ী গান। আধুনিক গান আর বাদ্যযন্ত্রের পরিবর্তন, সেই সাথে গানে আঞ্চলিকতার অনুপস্থিতি, অশ্লীন গান ও অঙ্গভঙ্গীর কাছে আজ অসহায় বাউল শিল্পীরা। সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়ায় অনেকে ছাড়ছেন বাউল গান। পারিশ্রমিক কম হওয়ায় অর্থাভাবে অনেকেই বাউল গান ছেড়ে বেছে নিচ্ছে অন্য পেশা। মূল্যায়ন ও ঐতিহ্যর ধারা ফিরিয়ে আনতে এখনও গান গেয়ে যাচ্ছেন মূলধারার ও তরুণ প্রজন্মের বাউল শিল্পীরা।

ময়মনসিংহ ফুলবাড়ীয়া উপজেলার সাপমারা বাজারের বাউল শিল্পী আব্দুর রহমান বলেন, দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে বাউল গান করে এসেছি। এখন আর গান গাইতে ইচ্ছা করে না। গান করা ছেড়ে দিয়েছি। আগে আমরা দরধ দিয়ে গান লিখতাম, সুর তুলতাম। সেই গান মানুষ আবেগ দিয়ে শুনত।  মুখে মুখে সেই গান থাকত। কিন্তু এখনকার গান গুলোতে সেই আবেগ নাই। নেই কোন শিক্ষা। শুধু লাফালাফি করে গান গেয়ে যায় এখনকার শিল্পীরা।

আরেক বাউল সালাম জানান, এখনকার বাউল আসরে আর গান হয় না। মঞ্চে উঠে নাচানাচি করে, আজেবাজে গান গেয়ে বাউল শিল্পীদের অপমান করা হচ্ছে। আর মূলধারার যে বাউল শিল্পী আছে তাদেরকে যে পারিশ্রমিক দেয়া হয় তা দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে যায়। যার কারনে অনেকে বাউল গান ছেড়ে অন্য কর্মে চলে যাচ্ছে।

ময়মনসিংহ বাউল সমিতির প্রচার সম্পাদক মিজান বাউল বলেন, এখনকার বাউল গানে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র এসে গেছে। গানের মধ্যে আঞ্চলিকতার সুর এখন নাই। আগে বাউল শিল্পীরা যে একতারা, দোতারা, ঢোল, মন্দিরা দিয়ে মঞ্চ মাতাত সেগুলো এখন দেখা যায় না। হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্য বাউল গান।

ময়মনসিংহের প্রবীণ বাউল শিল্পী সুনিল কর্মকার বলেন, বর্তমানে বাউল শিল্পীদের কোন মূল্যায়ন নাই। আর এখন যারা বাউল গান করে তাদের মধ্যে গুরু-শিষ্যর কোন ভক্তি নাই। যার কারনে দিন দিন এটা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাউল সমিতির সাধারন সম্পাদক রেজাউল করিম আসলাম বলেন, আগে যারা বাউল গান করতেন তারা প্রকৃত শিল্পী ছিলো। এখন অনেকে বিভিন্ন যাত্রা, অভিনেতা মুখে মেকাপ লাগিয়ে অশ্লীন গান ও অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে বাউল শিল্পী সেজেছে। আমরা এই ধরনের অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেখানে এমন অশ্লীন গান হচ্ছে সেখানে গিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছি এমন অনুষ্ঠান করা যাবে না। আর যারা শুদ্ধ বাউল সঙ্গীতের সাথে জড়িত তাদেরকে নিয়ে প্রতিমাসে বাউল বৈঠক করার পাশাপাশি বাউল শিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

অপসংস্কৃতি রোধে মুলধারার বাউল শিল্পীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে জেলা কালচারাল অফিসার আরজু পারভেজ বলেন, এখনকার টিভি চ্যানেলগুলোতে যে রিয়েলিটি শো গুলো হচ্ছে তাতে আগের শিল্পীদের কালজয়ী গান গুলো পরিবেশন হচ্ছে। শুধু এমন অনুষ্ঠানের জন্য নয়, সবসময় এসব গান গুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। নতুন নতুন গান সৃষ্টি করতে হবে। বাউল শিল্পীদের সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে বাউল শিল্পীদের অংশগ্রহণ আরো বেশি বাড়ানো যায় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহের ১৩ উপজেলায় প্রায় সাত শতাধিক বাউল শিল্পী রয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত