‘সো কলড মেগা প্রকল্প থেকে বের হতে হবে’

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৩, ১৯:১৪

ডেস্ক রিপোর্ট
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

আসছে নতুন অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেটে ‘সো কলড মেগা প্রকল্প’ থেকে বের হয়ে আসতে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার মতে, নতুন করে আর কোনো মেগা প্রকল্প নেওয়া উচিত নয়। বরং পুরোনো রাস্তাঘাট সংস্কারে আরও বেশি মনযোগ দেওয়া উচিত।

একইসঙ্গে তারমতে আসছে বাজেট হতে হবে ‘বাস্তবায়নযোগ্য ও জনকল্যাণমুখী’। কর বাড়াতে গিয়ে কেবল ভ্যাটের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না, বরং আওতা বাড়াতে হবে প্রত্যক্ষ করের। ভর্তুকি রাখতে হবে কৃষি ও জ্বালানিতেও।

সোমবার (২৯ মে) রাতে তার সঙ্গে আলাপকালে আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে এমন প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক মন্দাকে সামনে রেখে আগামী ১ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট সংসদে পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

নতুন অর্থবছরে ‘কেমন বাজেট চান’ জানতে চাইলে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেট হতে হবে বাস্তবায়নযোগ্য ও জনকল্যাণমুখী। বাজেট ব্যবসাবান্ধব, আই ডোন্ট বিলিভ। বাজেট হতে হবে সাধারণ মানুষের জন্য, বাজেট হতে হবে এ দেশের কৃষকের জন্য। এদেশের রিকশাওয়লার জন্য। বাজেট সবার জন্য হতে হবে।

তিনি বলেন, বাজেট এক বছরের জন্য। এক বছরে যে কাজগুলো করা যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সেই কাজগুলোকে ফোকাস করতে হবে। আবার দীর্ঘমেয়াদে এসডিজি বাস্তবায়নেও নজর দিতে হবে বাজেটে। গত বছর যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তারমধ্যে অনেক কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। নতুন বাজেটে সেগুলো যেন শেষ করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা নিয়ন্ত্রণে বাজেটে কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে। দেশের ব্যাংকের অবস্থা খারাপ, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে বাজেটে ভালো পদক্ষেপ থাকতে হবে। সবাই শুধু সার্ভিস সেক্টরের কথা বলছে, আইটির কথা বলছে, এরবাইরে অন্যান্য খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে।

কৃষি ও জ্বালানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কৃষিতে ভর্তুকি দিতেই হবে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক যাই বলুক না কেন- কৃষির ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে। তবে জ্বালানিতে সবার ক্ষেত্রে ভর্তুকি এক রকম না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন খাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হওয়া উচিত।

দেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর অবস্থা অপ্রতুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, যা খুবই অপর্যাপ্ত। সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশ, কিন্তু সেটি কোথায় ব্যয় হচ্ছে। শিক্ষার উপকরণ, ক্লাসের কোয়ালিটি বৃদ্ধি এসব ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়াতে হবে। জনস্বাস্থ্যে আরও মনোযোগ দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। সবাই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান বাড়াতে আরও বরাদ্দ থাকা উচিত।

তিনি আরও বলেন, রফতানির ক্ষেত্রে শুধু পোশাকে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। আরএমজিতে সব প্রণোদনা দিয়ে দেবেন, এটি ঠিক নয়। অন্যান্য রফতানিখাতেও প্রণোদনা দিতে হবে।

রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্র প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরোক্ষ করের (ইনডিরেক্ট ট্যাক্স) ওপর নির্ভর করা যাবে না। কোনো একটি পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ালে সেটি অন্য আরও বেশকিছু খাতে প্রভাব ফেলে। আটার ওপর ভ্যাট বাড়ালে রুটির দাম বেড়ে যাবে। ভ্যাট বাড়ালে দেশের গরিব মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই পরোক্ষ করে নির্ভর না করে প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দিতে হবে। আয়কর, কোম্পানি কর, করপোরেট কর ও ওয়েল ট্যাক্স- এগুলো থেকে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে হবে। এনবিআরের সব কিছুতে অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতা। তাদের সততা বাড়াতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে হবে।

করমুক্ত আয়কর সীমা বাড়ানোর বিষয়টি যুক্তিযুক্ত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, করমুক্ত আয়কর সীমা বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। করমুক্ত আয়কর সীমা বাড়ুক। ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়লে অনেকেই করজাল থেকে বের হয়ে যাবে এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। যারা ই-টিআইএনধারী আছে, তারা যে কর দেয় না, সেটি কেন ধরে না এনবিআর। ৭৫ লাখ টিআইএনধারীর মধ্যে মাত্র ২৫ লাখ কর দেয়, এটি হতে পারে না।

বাকিদের কাছ থেকে কেন কর আদায় করা হয় না? আবার যারা এখনও আয়কর দেয় না, তাদের কেন করের আওতায় আনা হয় না। যারা করজালের বাইরে আছে তারা এমনিতেই বাইরে। রাজস্ব আদায়ের আরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, সরকারের সে দিকেও মনযোগ দেওয়া উচিত।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার মনে করে নির্বাচনকালীন সরকারেও তারা থাকবে এবং আবারও তারা নির্বাচিত হবে। সে কারণেই তারা বাজেটের আকার বাড়িয়েছে। ৮০০টির বেশি প্রকল্প, লোকজনকে দেখানোর জন্যে। অনেক উন্নয়ন করেছি সেটি মানুষকে সরকার জানাতে চায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ করছে, এই টাকা ব্যয়ে জবাবদিহিতা নেই।

আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আর কত টাকা পাওয়া যায়! সরকার এখন অভ্যন্তরীণভাবে বেশি ঋণ করছে। বিদেশি ঋণে আগ্রহ কম দেখায়, কারণ ওই অর্থ ব্যয় করতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা করতে হয়।

মেগা প্রকল্প নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মেগা প্রকল্প যেগুলো অসমাপ্ত আছে, সেগুলো শেষ করতে হবে। বাকিগুলো হোল্ড করে দিতে হবে। নতুন করে যেগুলো শুরু হয়েছে, সেগুলো এখনই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। নতুন প্রকল্প না নিয়ে এলজিইডির যেসব রাস্তা আছে, ভাঙাচোরো সেগুলো সংস্কার করা উচিত। ভাঙাচোরা রাস্তা সংস্কার হলে পণ্য পরিবহনে গতি পাবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও বেশি ত্বরান্বিত হবে। তাই এখনই সো কলড মেগা প্রকল্প থেকে বের হয়ে আসা উচিত।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত