নতুন অর্থবছরে ৭.৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ‘উচ্চাভিলাষী’

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৩, ১৭:০৪

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

দেশের অর্থনীতি যখন নানামুখী চাপের মধ্যে, সেই সময় নতুন অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের কেউ বলেছেন, উচ্চাশা থাকা ভালো, কারণ আশাবাদী হলেই ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার কেউ বলেছেন, অতি আশাবাদের বদলে বাস্তবতা ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্য ধরাই উচিত ছিল সরকারের।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন তিনি।

মহামারীর ধাক্কা সামলে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

কিন্তু ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিই চাপের মধ্যে রয়েছে। বৈরী পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় এবারের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়েছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্যেও পৌঁছানো যাচ্ছে না।

মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের হিসাব ধরে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, তাতে দেখা যাচ্ছে, সাময়িক হিসাবে স্থির মূল্যে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হতে পারে।

সেদিকে ইংগিত করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কোভিড মহামারীর সময়টা বাদ দিলে গত ১২ বছরের মধ্যে এই প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির ভিত্তি কমে এসেছে। এরকম ভিত্তি নিচু হয়ে যাওয়ার পরের বছর ভালো প্রবৃদ্ধির সুযোগ থাকে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী চলমান অস্থিরতার মধ্যে প্রবৃদ্ধির এই টার্গেট অনেক উচ্চাভিলাষী।

তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বৃদ্ধি পায়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে পরের বছরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেই চর্চা কখনোই হয়নি।

এবারও একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। নতুন বাজেটে প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট ধরা হচ্ছে, সেটা কিছুটা অনুমান নির্ভর, কিছুটা আইএমএফ এর শর্তের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে।

আগামী অর্থবছরে যুদ্ধ পরিস্থিতি, জ্বালানি তেলের মূল্য পরিস্থিতি, এনার্জি মার্কেট কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দামও কিছুটা কমে আসতে পারে এমন একটা অনুমানের ভিত্তিতে হয়ত এই প্রবৃদ্ধির টার্গেট ধরা হয়েছে।

তবে প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্য ঠিক করার সময় ঝুঁকির বিষয়গুলো ঠিকঠাক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কিনা, সেই সংশয় প্রকাশ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, এটা আসলেই একটা আশঙ্কাজনক জায়গায় চলে এসেছে। সেটা পর্যাপ্তভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।

এখন রিজার্ভ বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন মাসের আমদানি বিল মেটানোর মত অবস্থায় আছে। এর ফলে আগামী বছর থেকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কষ্টকর হবে। এমন এক নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে।

এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে আমাদানি ব্যয় বেড়ে যাবে, বাজারের চাহিদামত সরবরাহ ডিফিকাল্ট হবে, কর্ম সংকট তৈরি হবে। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরেক দফা কমে গেলে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাবে।

গোলাম মোয়াজ্জেমের ধারণা, নতুন অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অনুমিতিগুলোর মধ্যে ইতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নেওয়া হলেও নেতিবাচক দিকগুলো হয়ত বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

এসব নেতিবাচক দিক বিবেচনায় নেওয়া হলে হয়ত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আরও কিছুটা কমিয়ে নেওয়া হত।

সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন অবশ্য সরকারের আশাবাদে দোষের কিছু দেখছেন না। তার ভাষায়, উন্নয়নের একটা অংশই হল আশাবাদী হওয়া।

আমার মনে হয়, ইউক্রেইন যুদ্ধ আর বেশি দিন ধরে চলতে পারবে না– এই রকম একটা আশাবাদ থেকে সরকার এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। এটা ঠিকই আছে। আমি মনে করি ইউক্রেইন যুদ্ধ আর প্রলম্বিত হতে পারে পারবে না নানা কারণে। এখানে উন্নত দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

মহামারীর আগে বাংলাদেশ যে ৮ শতাংশ ছাড়ানো প্রবৃদ্ধিও পেয়েছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনায়ক সেন বলে, গ্রোথ আমদের হচ্ছে, এর আগে আরো বেশিও হয়েছে। এখন বেশি আশা করতে সমস্যা কী। সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট নেওয়াতে আমি কোনো সমস্যা দেখছি না।

তবে ঘরে-বাইরে সব পরিস্থিতি মিলেয়ে বাংলাদেশ যে একটি ‘জটিল’ বছর পার করছে, বিআইডিএস এর মহাপরিচালকও সেটা মানেন।

তিনি বলেন, অনেক সমস্যা আমাদের পাড়ি দিতে হবে। এর মধ্যেও আমাদের ইতিবাচক মানসিকতা থাকতে হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের মধ্যে অনেকে হাতাশায় ভোগেন এবং ভালো হলেও সেটাকে ভালো বলে স্বীকার করতে চান না। এই মানসিকতা কাটিয়ে ওঠা উচিত।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর অবশ্য কোনো দ্বিধার মধ্যে নেই। তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ‘পূরণ হবে না’।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, আমদানি কমে যাচ্ছে। এই পরিবেশে প্রবৃদ্ধি খুব একটা যে হবে সেটা আশা করা ঠিক না। এ বছর বলা হচ্ছে ৬ দশমিক ০৩। সেটাও কমে হয়ত ৫ এর ঘরে চলে আসবে। আগামী বছর যে খুব একটা ব্যতিক্রম কিছু হবে তা মনে হয় না।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে প্রধান গুরুত্বে রেখে সরকারকে কাজ করা উচিত বলে আমি মনে করি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত