পুঁজিবাজারে ভয়াবহ দরপতন

প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪, ২০:২৮

সাহস প্রতিবেদক
ছবি: সংগৃহীত
তিন বছরের সর্বনিম্ন সূচক
• ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪৮৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা 
• সপ্তাহের ডিএসইর বাজার মূলধন ৪৯ হাজার কোটি টাকা
• ডিএসই সূচক নামল ৬ হাজারের নিচে
ভয়াবহ দরপতনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। লেনদেনে অংশ নেয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম গতকাল সোমবার কমছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে মূল্যসূচকও। যার ফলে হাজারো বিনিয়োগকারী হারিয়েছেন তাদের বিনিয়োগ।
মূল্যসূচকের বড় পতনের সঙ্গে গতকাল কমেছে লেনদেনের গতিও। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল লেনদেন হয়েছে ৪৮৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দাম কমেছে। ফলে সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। এর মাধ্যমে টানা সাত কার্যদিবস শেয়ারবাজারে দরপতন হলো। আর শেষ ২৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২০ কার্যদিবসেই দরপতন দেখতে হলো বিনিয়োগকারীদের।
ডিএসইএক্সের পাশাপাশি ডিএসইএস ও ডিএস -৩০ সূচক ও পয়েন্ট হারিয়েছে। প্রথম তিন ঘণ্টায় ডিএসইতে ৩২৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এ সময়ে ৩২৪ টি সিকিউরিটিজের দাম কমার বিপরীতে বেড়েছে মাত্র ৩১টির। বহুজাতিকসহ ভালো মৌলভিত্তির বড় মূলধনী কোম্পানির শেয়ার দরে নিম্নমুখী ছিল।
এর আগে গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হয়। এতে একই সপ্তাহেই ডিএসইর বাজার মূলধন ৪৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে কমে যায়। আর টানা চার সপ্তাহের পতনে বাজার মূলধন কমে ৭০ হাজার কোটি টাকার ওপরে।
এ পরিস্থিতি গতকাল শেয়ারবাজার লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়ার মাধ্যমে। ফলে লেনদেন শুরু হতেই ডিএসইর প্রধান সূচক ২ পয়েন্ট বেড়ে যায়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ার ধারা অব্যাহত থাকায় লেনদেনের এক পর্যায়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ২৩ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে মাত্র ৩৪টি প্রতিষ্ঠান। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৩০টি প্রতিষ্ঠানের। আর ৩২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৬৯ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৮৯৮ পয়েন্টে নেমেছে। এর মাধ্যমে ২০২১ সালের ২৫ মে’র পর সূচকটি সর্বনিম্ন অবস্থানে অবস্থান করছে। ২০২১ সালের ২৫ মে ডিএসইর প্রধান সূচক ৫ হাজার ৮৮৪ পয়েন্ট ছিল। এরপর সূচকটি আর এত নিচে নামেনি।
অন্য দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৮ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৪২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২৮৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
সবকটি মূল্যসূচক কমার পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪৮৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৫১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কমেছে ২৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। 
অব্যাহত দরপতনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে কারেকশন হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। গত ৪ থেকে ৫ বছরে লিজিং কোম্পানির শেয়ারে মানুষ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই। পাওয়ার সেক্টরেও সরকার আগের মতো সুবিধা দিচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের চুক্তির মেয়াদ শেষ। এই তিন সেক্টর বাদ দিলে আর কতটা কোম্পানি থাকে?
আবার (ব্যাংকে) সুদের হার বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। এখন মানুষ চিন্তা করবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে আমি কত টাকা লভ্যাংশ পাবো, আর ব্যাংকে রাখলে কত টাকা পাবো। মানুষ তো এভাবে চিন্তা করে। বহু বড় বড় ইনভেস্টর, মার্চেন্ট ব্যাংকার, অ্যাসেট ম্যানেজার তারা তাদের টাকা বন্ড ও এফডিআরে খাটাচ্ছেনÑ যোগ করেন এই শেয়ারবাজার বিশ্লেষক।
তিনি আরো বলেন, আইসিবির কোনো টাকা নেই। তারা নেট সেল করে খালি। এই যে এ খাতে তারল্য সংকট, এটাই মূল কারণ। দেখতে হবে এখন শেয়ারগুলোর পেছনে কত টাকা ছুটছে, এই টাকার সরবরাহ তো কমে গেছে। তাহলে শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতন হবে না তো কী হবে!
কথা হয় ডিএসইর পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিওর সঙ্গে। তিনি বলেন, আর্থিক খাতেই এখন সংকট, ব্যাংকগুলোতে টাকা-পয়সার সংকট, এফডিআরের রেট বেড়ে যাচ্ছে। এগুলোর একটা চাপতো আছেই। পাশাপাশি বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও বাড়তি চাপ তৈরি করছে। ‘জেড’ গ্রুপের ইস্যু নিয়ে বাজারে সিদ্ধান্তহীনতা আছে। একবার সিদ্ধান্ত হলো পরবর্তী এজিএমের (বার্ষিক সাধারণ সভা) পর থেকে কার্যকর হবে। পরে আবার দেখা গেলো ২২টিকে জেড গ্রুপে আনা হলো। সবকিছু মিলিয়ে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, এসব বিষয়ে বাজারে আস্থার সংকট রয়েছে। তবে বাজার সব সময় তো একরকম থাকে না। মাঝেমধ্যে এ রকম হয়, আবার এখান থেকে বেরিয়ে আসে। এগুলো থাকবেই বাজারে। আশা করি মানুষ যদি ভালো শেয়ার কিনে রাখতে পারে, মানুষের কাছে যদি ভালো শেয়ার থাকে, তাহলে তারা অপেক্ষা করবে, আলটিমেটলি আবার ওই রেট ক্রস করবে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পপ্রচার হচ্ছে এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। আমার কাছে এগুলো দৃশ্যমান মনে হয়েছে।
কী ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ফেসবুক খুললেই আপনি দেখবেন কত রকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কেউ কমিশনকে গালি দিচ্ছে, আবার কোনো কোনো আইটেমের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন কেউ কেউ। এগুলোর কোনোটাই কাম্য নয়। এসব বিষয় বাজারে আতঙ্ক ছড়ায়। আপনার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধে যদি ফেসবুকে আজেবাজে কথা বলেন, সেটা তো বাজারের জন্য ভালো হতে পারে না।
 
তিন ভাগের একভাগে নেমেছে লেনদেন
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১১ কার্যদিবসে ডিএসইতে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়। এর মধ্যে ১১ ফেব্রুয়ারি লেনদেন হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। তার আগের কার্যদিবস ৮ ফেব্রুয়ারি লেনদেন হয় এক হাজার ৮৫৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এখন সেই লেনদেন পাঁচশ কোটি টাকার ঘরে চলে এসেছে। সর্বশেষ ১৪ মার্চ ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৫১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকার। তার আগের কার্যদিবস ১৩ ফেব্রুয়ারি লেনদেন হয় ৪৮৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
 
শঙ্কায় ব্রোকারেজ হাউজের কর্মীরা
দীর্ঘদিন পর চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে লেনদেনের গতি বাড়তে থাকায় শেয়ারবাজার নিয়ে আশাবাদী ব্রোকারেজ হাউজের কর্মীরা। আসন্ন ঈদে ভালো বোনাস পাওয়ার প্রত্যাশা করছিলেন অনেকে। তবে রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে এবং রমজানের শুরুতে শেয়ারবাজারে দরপতনের সঙ্গে লেনদেনে খরা দেখা দেয়। এতে তাদের মধ্যে ফের অজানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আসন্ন ঈদে বোনাস পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন কেউ কেউ।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত